সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা নিয়ে জাকিয়া জাফরির আর্জি খারিজ করার পরের দিনই আটক করা হল সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদকে। পৃথক অভিযোগে প্রতিবাদী সাংবাদিক মহম্মদ জুবেরকে গ্রেপ্তার করে দিল্লি পুলিস। সমাজকর্মী, ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব, সাংবাদিক থেকে শুরু করে যে কোনো প্রতিবাদীকে আটক করা, মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করাই আজকের ভারতের স্বাভাবিক ঘটনা। সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়েও নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যায় নিহত এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া বিশেষ তদন্তকারী দলের রিপোর্টের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানিয়েছিলেন। বিশেষ তদন্তকারী দল গুজরাটের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী তথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ক্লিনচিট দেয়। সুপ্রিম কোর্ট মোদীজিকে ক্লিনচিট দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। আবেদনকারী এবং সাক্ষীদেরও কড়া সমালোচনা করেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছে। অর্থাৎ অভিযোগ খারিজই শুধু নয়, এখন অভিযোগকারী ও তাঁর সমব্যথীদের অপরাধী বলে গণ্য করা হবে। পরের দিনই গুজরাট পুলিস অতি তৎপর হয়ে তিস্তা, অবসরপ্রাপ্ত পুলিসের অবসরপ্রাপ্ত ডিরেক্টর জেনারেল শ্রীকুমারকে গ্রেপ্তার করে। প্রাক্তন পুলিস অফিসার সঞ্জীব ভাটের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তিনি অবশ্য এমনিতেই দীর্ঘদিন জেলবন্দী। গুজরাট গণহত্যার প্রতিবাদীদের প্রতি এতটাই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে রাষ্ট্র।
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একসময় একাধিক ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার অভিযোগ ছিল। আদালতে বহু আগেই সেসব অভিযোগ খারিজ হয়ে গেছে। বিচারব্যবস্থা রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, অথচ বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক দানবীয় আইন প্রয়োগ করে বছরের পর বছর প্রতিবাদীদের আটক রাখা হচ্ছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় কার্যত মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এরপর যদি অভিযোগকারীদের ষড়যন্ত্রকারীর তকমা দিয়ে শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হয়, তাহলে তার পরিণাম অতি ভয়ঙ্কর। সরকার, শাসক দল, তদন্তকারী সংস্থা, আদালত, মিডিয়া – সবাই এক সুরে কথা বলছে। যে কথা দেশের গণতান্ত্রিক চরিত্রের বিরোধী, স্বৈরাচারী। মূলস্রোতের কোনো সংবাদ মাধ্যম অন্যরকম ভূমিকা পালন করলেই রাষ্ট্রের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে যাচ্ছে। সত্য প্রকাশ করার ‘অপরাধে’ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনও প্রয়োগ করা হচ্ছে। আজকের ভারতে বুলডোজার দিয়ে রাতারাতি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা যায়, প্রতিবাদীদের দেশদ্রোহী বলা যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি বেচে দিয়ে দেশপ্রেমের ধুয়ো তোলা যায়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এ এমন দেশ যেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থার মুখোশটাও খসে পড়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও কোনো দল ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে। বিরোধী পক্ষের জনপ্রতিনিধি কিনে নিয়ে একটি দলের রাজত্ব সর্বব্যাপী করাই আজ বীরত্বের পরিচায়ক। জনমতের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে দলবদলের, নির্বাচিত সরকার ভাঙ্গার অগণতান্ত্রিক খেলা। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কর্পোরেট দুনিয়ার কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ভোট ব্যবস্থায় কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ বহুগুণ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ভারত আজ কর্পোরেটতান্ত্রিক ভারতের দিকে এগিয়ে চলেছে। সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানের সঙ্গে কর্পোরেটতন্ত্রের মেলবন্ধনে শোনা যাচ্ছে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি। নির্বাচনে ধারাবাহিক সাফল্য, বিরোধী দল জিতলেও নিজেরাই ক্ষমতা দখল করার সাফল্যে আজ বিজেপি বেপরোয়া। লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, তত হিন্দুত্ববাদের পক্ষে সুর চড়া হচ্ছে। পরিপুষ্ট হচ্ছে সংখ্যালঘু মৌলবাদও। কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে রুটি রুজির লড়াইকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন।
মূল স্রোতের মিডিয়া ভুলিয়ে দিচ্ছে ভয়াবহ বেকার সমস্যার কথা, অতিমারীতে কাজ হারানো বা শিক্ষাজগৎ থেকে ছিটকে যাওয়া মানুষের কথা, ধনী-নির্ধনের লজ্জাজনক ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের বাস্তব চিত্র।
আরো পড়ুন দেশদ্রোহ-বিরোধী আইন সংক্রান্ত ধারা বাতিল হলেও লাভ নেই
ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি আজ বিনোদনের বস্তুতে অবনত হয়েছে। দলবদল, ভুল বক্তব্য, উস্কানিমূলক, বিতর্কিত, হিংস্র ভাষণের প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যেতে বসেছে শ্রেণি রাজনীতি। শ্রেণি রাজনীতি করার দায়িত্ব যাদের রয়েছে, তারাও সংসদীয় রাজনীতিতে বর্তমানে কোণঠাসা হয়ে অনেকখানি দিশেহারা। সংসদের বাইরের ও ভিতরের লড়াইকে এক সূত্রে গাঁথার বদলে, চটজলদি সাফল্য পেতেই মরিয়া। মতাদর্শহীন বিরোধী জোট গড়ে যে বিজেপি বা ফ্যাসিবাদকে রোখা যায় না তা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনা নতুন করে তা প্রমাণ করল। তবুও লড়াই জারি থাকে। ভীমা কোরেগাঁও মামলা দিয়ে, তিস্তা, সঞ্জীবদের জেলে পুরেও সেই লড়াই থামানো যায় না। মৌলবাদী রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে অগ্নিপথ নিয়ে যুব বিক্ষোভ বা কৃষক আন্দোলন স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে আক্রমণ শানিয়েও প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলনকে দমন করা যায় না। দেশের নানা প্রান্তে গড়ে ওঠা সামাজিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনে উন্নীত হয়, রাষ্ট্রযন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে।
দেশের নানা প্রান্তে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে রুটি রুজির লড়াইয়ের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা সময়ের দাবি। দেশ এক রূপান্তর পর্বে দাঁড়িয়ে আছে। বিকাশের নামে দেশ, সমাজ যেন ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। সঙ্কটে খাবি খাওয়া পুঁজিবাদ আজ মৌলবাদকে রক্ষাকবচ করে বাঁচতে মরিয়া। প্রতিবাদী রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মীদের উপর তাই আগামীদিনে আরও আক্রমণ নেমে আসবে। একমাত্র প্রতিবাদী আন্দোলনের ঐক্যই পারে ফ্যাসিবাদীদের রুখে দিতে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।