দু সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যে নাটকটা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি পরিসর অধিকার করে বসেছিল, শেষপর্যন্ত ৩০ জুন সেটা শেষ হল। এ নাটক দেশ পরিক্রমা করছিল বললেও ভুল হয় না। মুম্বাইতে শুরু হয়ে গুজরাটের সুরাটে চলে গিয়েছিল, সেখান থেকে আসামের গৌহাটি, দিল্লির সুপ্রিম কোর্ট হয়ে মুম্বাইতে শেষ হয়েছে। মধ্যে কিছু সময়ের জন্য গোয়াতেও থেমেছিল। উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্র বিকাশ আগাদি সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এই নাটকের যবনিকা পতন হল।

সরকারটা যে এই কটা দিন চলল তা-ও এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং ভাষ্যকার এই জোট সরকার ১০০ দিন থেকে ১২ মাসের বেশি টিকবে না বলে রায় দিয়েছিলেন। তার কিছু কারণও ছিল।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

প্রথমত, এই জোট সম্ভবত ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে অভাবনীয় জোট। জম্মু ও কাশ্মীর শাসন করার জন্য বিজেপি আর পিডিপির হাত মেলানোর চেয়েও অভাবনীয়। কোনো সুস্থ স্বাভাবিক লোকের পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব ছিল না যে কংগ্রেস আর শিবসেনা একই জোটের সদস্য হতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে এই দুটো দলের মধ্যে আদর্শগত ব্যবধান দুস্তর। সুতরাং এদের জোট তৈরি করা অকল্পনীয় ব্যাপার।

বিজেপি এমন একটা দল যারা যে কোনো নির্বাচনই জিতবে বলে আশা করে। স্বভাবতই এরকম একটা প্রায় অসম্ভব নির্বাচনোত্তর জোটের কারণে বিস্তর দড়ি টানাটানির পর ক্ষমতা হারিয়ে তারা মোটেই খুশি হয়নি। মাত্র তিনদিন মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর দেবেন্দ্র ফড়নবীশকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তারপর থেকেই তিনি নিজের দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রশ্রয়ে মহারাষ্ট্র বিকাশ আগাদি সরকার ফেলে দেওয়ার ছক কষছিলেন। দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারও মহারাষ্ট্রের রাজ্য সরকারকে গদিচ্যুত করার জন্য সবরকম চেষ্টা করেছে। যতরকম অসদুপায় অবলম্বন করা সম্ভব, কোনোটাই বাকি রাখা হয়নি।

বিকাশ আগাদি সরকারের সদস্যরা ততদিন প্রতিরোধ করতে পেরেছেন যতদিন না টাকা, পদ ও ক্ষমতার প্রলোভন এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের মত কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোর আতঙ্ক সবকিছুর সীমা অতিক্রম করেনি।

তাহলে মহারাষ্ট্রের ঘটনাবলী কোন ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করছে?

যদি আমরা জাতীয় প্রেক্ষাপট বিচার করি, তাহলে বলতে হবে মহারাষ্ট্রের সাফল্য বিজেপিকে অন্যান্য অবিজেপি দল শাসিত রাজ্যগুলোতেও এই পথ নিতে উৎসাহিত করবে। মাত্র কয়েকদিন আগে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তেমন হুমকিও দিয়েছেন। এখন একবার এই রাজ্যগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক।

রাজস্থান আর ছত্তিশগড় এখনো কংগ্রেস শাসিত। মহারাষ্ট্রের পর রাজস্থানই বিজেপির সম্ভাব্য প্রথম লক্ষ্য। বিজেপি গত দু বছরের বেশিরভাগ সময়টা ধরেই অশোক গেহলত সরকারকে ফ্যাসাদে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে রাজস্থানে মহারাষ্ট্র কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি করতে হলে কংগ্রেস থেকে বিপুল সংখ্যক বিধায়ককে ভাঙিয়ে আনতে হবে। এই মুহূর্তে তার সম্ভাবনা খুবই কম বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া রাজস্থান, ছত্তিশগড় – দুটো রাজ্যেই ২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে বিধানসভা নির্বাচন। এইটুকু সময়ের জন্য সরকারে থাকা কোনো দলের পক্ষেই সুবিধাজনক নয়। সুতরাং যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তা হল বিজেপি রাজস্থানে ছ মাসের জন্য রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করবে, তারপর নির্বাচনে যাবে। যেভাবে গত ছ মাসে ওই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা হঠাৎ বেড়ে গেছে, তাতে মনে হয় সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের জমি তৈরি হচ্ছে।

আর কোন কোন রাজ্য বিজেপির নিশানায় আসতে পারে? দক্ষিণ ভারতের কেরালা আর তামিলনাড়ুকে বাদ দেওয়া যেতে পারে, কারণ ওখানে গেরুয়া বাহিনীর সাংগঠনিক অস্তিত্ব বলার মত নয়। অন্ধ্রপ্রদেশেও তাই। তাছাড়া ওই রাজ্যে ক্ষমতাসীন ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টি, এনডিএ-র সদস্য না হলেও যে কোনো দরকারে তারা বিজেপির পাশে দাঁড়ায়। বছর খানেক আগে পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী তেলেঙ্গানার ক্ষমতাসীন দল তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতিও তেমনই ছিল, কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। গত কয়েক মাসে কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের নেতৃত্বাধীন দলটার সাথে বিজেপির শত্রুতা ক্রমশ বেড়েছে। আর বিজেপিও ওই রাজ্যে নিজেদের ভিত খুঁড়তে পেরেছে। কিন্তু সরকারকে বিপদে ফেলার মত শক্তি সংগ্রহ করেছে কি? সম্ভবত না। ওড়িশার দিকে তাকালেও দেখব, বিজু জনতা দল বেশ কয়েকবার মোদী সরকারকে কঠিন পরিস্থিতিতে সাহায্য করেছে। তাছাড়া সম্ভবত নবীন পট্টনায়ক সক্রিয় রাজনীতিতে আর বেশিদিন থাকবেন না। অদূর ভবিষ্যতে তিনি সরে গেলে বিজেপির বিজু জনতা দলের জায়গা নেওয়া অনিবার্য।

পশ্চিমবঙ্গ ২০২১ সালে বিজেপির প্রবল চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল। তবু তারা ৭৭ টা আসন পায়। রাজ্যে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর জন্য আদর্শ ফলাফল। উল্টে বিজেপির উপস্থিতি ক্রমশ কমেছে। বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে যতগুলো উপনির্বাচন এবং পৌর নির্বাচন হয়েছে তাতে একথা স্পষ্ট। বিধানসভাতেও উল্লেখযোগ্যভাবে বিজেপি বিধায়কের সংখ্যা কমে গেছে। সুতরাং শুভেন্দু যতই ২০২৪ সালে তৃণমূল সরকার আর থাকবে না বলে হাততালি কুড়োন, তিনি নিজেও জানেন ওটা এখনো কষ্টকল্পনা।

অতএব সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে যে রাজ্যটা, তার নাম ঝাড়খণ্ড। গত নির্বাচনে সেখানে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, কংগ্রেস আর রাষ্ট্রীয় জনতা দলের জোট চমকপ্রদ জয় পেয়েছিল। কিন্তু বিজেপি তারপর থেকে একদিনও বসে থাকেনি। সেই নির্বাচনে যিনি কংগ্রেসের ভারপ্রাপ্ত নেতা ছিলেন তিনি ইতিমধ্যে গেরুয়া বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তিনি রাজ্য সরকারকে অস্থির করতে সবরকম চেষ্টা করবেন। তার উপর ভারতের অন্য যে কোনো রাজ্যের তুলনায় ঝাড়খণ্ডের রাজনীতিবিদদের ইডি আর সিবিআইকে ভয় পাওয়ার বেশি কারণ বর্তমান। সুতরাং রাঁচি আগামীদিনে খবরের শিরোনামে থাকতে পারে।

এদিকে কিছুদিন হল নীতিশ কুমার তাঁর জোটসঙ্গীদের সম্বন্ধে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে চলেছেন। মনে হচ্ছিল বিহারে এনডিএ ভেঙে যাওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু মহারাষ্ট্রে যা হল তাতে নীতিশের আপাতত সাহসের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

আরো পড়ুন বিজেপি মুখপাত্র বিতাড়ন: হিন্দুত্বের টাইম আউট, খেলা শেষ নয়

মহারাষ্ট্রে এরপর কী ঘটবে তা অনেকটাই নির্ভর করবে শিবসেনার নীচের তলার কর্মীরা কোনদিকে ঢলে পড়েন তার উপর। কিন্তু রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তাদের গুরুত্ব হ্রাস প্রায় নিশ্চিত। উদ্ধব গত আড়াই বছর সরকারে থেকে বহু চিরকালীন সমালোচকের মন জয় করেছেন, অনেক নতুন ভক্তও তৈরি হয়েছে তাঁর। কিন্তু এই লাভগুলোর উপর ভিত্তি করে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা কি তাঁর আছে? ঠাকরে পদবিটা মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে এখনো কতটা ওজনদার? উদ্ধবের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী আদিত্য তার কতটা কাজে লাগাতে পারবেন? অবশ্য এ-ও সত্যি যে শিবসেনা শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস এবং গান্ধী পরিবারের পোক্ত সঙ্গী হিসাবে থেকে গেল, যা প্রায় অলৌকিক। ফলে নিশ্চিতভাবেই এরপর বিজেপির আক্রমণের মূল লক্ষ্য হবে মহারাষ্ট্র কংগ্রেস। ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর পার্টি এবং তার প্রতিনিধিদের প্রলোভন ও আতঙ্ক জয় করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি আছে কি?

বিজেপির ব্যাপারে মহারাষ্ট্র কী প্রমাণ করল? স্পষ্টত, পার্টির ভিতরে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে। জাতীয় সংবাদমাধ্যম যা-ই দেখানোর চেষ্টা করুক, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফড়নবীশকে যেভাবে শেষপর্যন্ত উপমুখ্যমন্ত্রী হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হল তাতে পরিষ্কার যে গেরুয়া বাহিনীর মধ্যেও দ্বন্দ্ব, সংঘাত কিছু কম নেই। বিশ্বাস করা শক্ত, যে ফড়নবীশ এতদিন ধরে এত পরিশ্রম করছিলেন স্রেফ উপমুখ্যমন্ত্রী হবেন বলে। তিনি এবং তাঁর সমর্থকরা নির্ঘাত ফুঁসছেন। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত একনাথ শিন্ডে এবং তাঁর ক্যাবিনেট বিদ্রোহের আগুনে জল ঢালতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন।

ভারত দেশটা আর ভারতীয় রাজনীতির জন্য মহারাষ্ট্রের বার্তা কী? প্রথমেই যে প্রশ্নটা করা দরকার, তা হল আমাদের কি নির্বাচন জিনিসটার আদৌ দরকার আছে? কারণ যতক্ষণ বিজেপি সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে, যতদিন না বিচারব্যবস্থা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে, ততদিন কোনো নির্বাচিত সরকারই তো নিরাপদ নয়। ভারত সবে ‘রিসর্ট’ রাজনীতিতে অভ্যস্ত হচ্ছিল, এর মধ্যেই এসে পড়ল ‘ভারত দর্শন’ রাজনীতি। অর্থাৎ এমন রাজনীতি, যার নাটক অভিনীত হবে একাধিক জায়গায়, যে রাজ্যের সমস্যা, তার থেকে অনেক দূরের রাজ্যগুলোতে।

~ মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.