উমর খালিদ, শার্জিল ইমাম, তালিব হুসেন শাহ, রিয়াজ আত্তারি – এদের মধ্যে মিল কোথায়? চারজনেই যে ইসলাম ধর্মাবলম্বী তা তো নামগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তারপর? এরা কি সবাই দেশদ্রোহী সন্ত্রাসবাদী, নাকি দেশপ্রেমিক? আলোচনা করা যাক।
প্রথম দুজন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি বম্বের মত প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা এবং অধ্যাপনা করেছেন, রাজনীতি করেছেন। দুজনেই প্রকাশ্য সভায় জনতাকে প্রতিবাদ করতে বলার অপরাধে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ রয়েছেন। উমর নিজেকে কমিউনিস্ট মনে করেন, শার্জিল অন্য পথের পথিক। কিন্তু দুজনেই নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শার্জিলকে ওই আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবেই দেওয়া দুটো বক্তৃতার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অভিযোগ – তিনি হিংসায় প্ররোচনা দিচ্ছিলেন। উমরের বিরুদ্ধে দিল্লি দাঙ্গায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। দুজনের কারোর বিরুদ্ধেই কোনো অভিযোগ আজ অব্দি প্রমাণিত হয়নি, কিন্তু ইউএপিএ আইনের দস্তুর অনুসারে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর এরা কারারুদ্ধ থাকা অবস্থাতেই প্রমাণ জোগাড় করে যাওয়ার অধিকার আছে। তাই শার্জিল ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে আর উমর ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাস থেকে গরাদের পিছনে আছেন। জামিন খারিজ হয়েছে কিছু মামলায়, কোথাও জামিন হয়েছে, কোনোটার আবার শুনানিই হয়নি এখনো।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
তৃতীয় ব্যক্তি তালিব ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন লস্কর-এ-তৈবার অন্যতম কমান্ডার। তিনি জম্মুর রাজৌরির বাসিন্দা। গত রবিবার রেয়াসি জেলার টুকসানে গ্রামবাসীদের উদ্যোগে বিস্তর অস্ত্রশস্ত্র সমেত ফয়জল আহমেদ দার বলে আরেকজনের সঙ্গে তিনি ধরা পড়েন বলে খবরে প্রকাশ। চতুর্থ ব্যক্তি রিয়াজ মানুষ খুনে অভিযুক্ত। রাজস্থানের উদয়পুরে কানহাইয়া লাল নামে একজনকে সে আর ঘাউস মহম্মদ নৃশংসভাবে খুন করে, সে দৃশ্যের ভিডিও তুলে সগর্বে শেয়ারও করে। এমন করার কারণ কী? কানহাইয়া হজরত মহম্মদ সম্পর্কে বিজেপির সাসপেন্ড হওয়া মুখপাত্র নূপুর শর্মার নোংরা মন্তব্যের সমর্থনে সোশাল মিডিয়ায় কিছু পোস্ট করেছিলেন। রিয়াজ ও ঘাউসের মতে তা মহাপাপ। এ কাজে তাদের দুই স্যাঙাতের সন্ধানও পাওয়া গেছে বলে তদন্তকারী সংস্থার দাবি।
রাজৌরির তালিব আর উদয়পুরের রিয়াজের মধ্যে একটা চমকপ্রদ মিল আছে। দুজনেই বিজেপির সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ উঠেছে। তালিব নাকি বিজেপির জম্মু এলাকার মাইনরিটি মোর্চার সোশাল মিডিয়ার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক। জম্মু ও কাশ্মীরের বিজেপি প্রেসিডেন্ট রবীন্দর রায়না তাঁকে পুষ্পস্তবক দিচ্ছেন, এমন ছবিও পাওয়া গেছে। দেশের প্রবল প্রতাপান্বিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পিছনে অন্য বিজেপি নেতাদের সঙ্গে তালিব দাঁড়িয়ে আছেন, এমন একখানা ছবি আছে বলেও জম্মু ও কাশ্মীরের কংগ্রেস দাবি করেছে। অন্যদিকে রিয়াজ যে উদয়পুরের বিজেপির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তারও একাধিক লক্ষণ দেখা গেছে। বিজেপির বক্তব্য রিয়াজ তাদের দলে ঢুকতে চাইতেন মাত্র, কিন্তু কানহাইয়া হত্যার বহু আগে থেকেই যে বিজেপির সংখ্যালঘু সেলের নেতাদের সাথে রিয়াজের ঘনিষ্ঠতা ছিল, তার একাধিক প্রমাণ সোশাল মিডিয়া থেকেই উঠে এসেছে।
এমন হতেই পারে যে সত্যিই দেশপ্রেমিক বিজেপি নেতারা কিছু বুঝতে পারেননি, সন্ত্রাসবাদীরা তাঁদের মধ্যে সুকৌশলে সেঁধিয়ে গেছে। গত দু-তিন দশকের হিন্দি সিনেমার মনোযোগী দর্শকদের বলে দিতে হবে না, স্লিপার সেল কী জিনিস। শত্রু সংগঠনে ঢুকে পড়ে ভিতর থেকে সেই সংগঠনের ক্ষতি করার কৌশল তো আরও পুরনো। অক্ষয় কুমারের ভক্তদের দায়িত্ব দিলে তো তাঁরা স্লিপার সেল চিহ্নিত করে তাদের শেষ করে দেওয়ার উপায়ও বাতলে দেবেন সম্ভবত। কিন্তু মুশকিল হল, বিজেপির মত এক নিবেদিতপ্রাণ জাতীয়তাবাদী দলের নেতারা বুঝতেই পারেননি এতবড় কাণ্ড হয়ে গেছে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের মত একজন জেমস বন্ডের উপস্থিতি সত্ত্বেও দেশের শাসক দলে সন্ত্রাসবাদীরা দিব্যি ঢুকে পড়ছে – এ বড়ই চিন্তার বিষয়। আমরা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসবাণীতে ভরসা করেছিলাম। আমরা জানতাম তিনি পোশাক দেখলেই সন্ত্রাসবাদী চিনতে পারেন। তিনি পারেন আর তাঁর দলের অন্যরা পারেন না – এমন তো আমাদের জানা ছিল না! লেখার শুরুতেই একই পংক্তিতে দুজন রাজনৈতিক বন্দীর সঙ্গে একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসবাদী আর একজন সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদীর নাম করেছি, তার কারণ ওরকম নামের লোক মানেই যে নিরপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অপরাধী, তা-ই আমাদের এতদিন শেখানো হয়েছে। কারা দেশদ্রোহী আর কারা দেশপ্রেমিক, তার স্পষ্ট তালিকা আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু তালিব আর রিয়াজ ধরা পড়ায় সব যে গুলিয়ে গেল।
আরো পড়ুন আমরা মুক্ত থাকলে পরিচয় নির্বিশেষে আর্ত মানুষের কাছে ছুটে যেতাম
তাহলে কি ধরে নিতে হবে ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত উমর, শার্জিল, সিদ্দিক কাপ্পানের মত মুসলমান বা সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা, ভারভারা রাওয়ের মত হিন্দু এবং রোনা উইলসন, ফাদার স্ট্যান স্বামীর মত খ্রিস্টানরাই শুধু নয়; ঘোষিত দেশপ্রেমিক সঙ্ঘ পরিবারের মধ্যেও দেশদ্রোহীদের উপস্থিতি আছে? না হয় স্লিপার সেলই হল। দুটো স্লিপার সেলের কথা জানা গেছে, এমন কত স্লিপার সেল যে আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে তার সন্ধান দেবে কে? যে দেশদ্রোহীরা ধরা পড়েছে, তাদের ব্যবস্থা তো হয়েই গেছে। গত বছর আজকের দিনেই তো পারকিনসন্স ডিজিজের রোগী স্ট্যান স্বামী শেষ কটা দিন জল খাওয়ার জন্য স্ট্র পর্যন্ত না পেয়ে কারাগারেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আর গতকাল শার্জিল আদালতকে জানিয়েছেন জেলের মধ্যে ৮-৯ জন বন্দী তাঁকে মারধোর করেছেন, তাঁর নিরাপত্তা সম্পর্কে আর নিশ্চিন্ত থাকা যাচ্ছে না।
কিন্তু দেশপ্রেমিক সর্ষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসবাদী ভূতদের কী হবে?
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।