রণজিৎ গুহ মারা গেলেন। অর্থাৎ তর্কযোগ্যভাবে আধুনিক ভারতের শ্রেষ্ঠতম এবং সবচেয়ে সৃজনশীল (রুল অফ প্রপার্টিজ নামক বইয়ের ফিরতি সংস্করণে যে তকমা ওঁকে দিয়েছিলেন অমর্ত্য সেন) ইতিহাস-মস্তিষ্কটি বিদায় নিলেন। অবশ্য নিছকই ইতিহাস কিনা তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। কেন না অভিধায়, শুকনো অভিধায়, রণজিতের আস্থা ছিল না কোনোদিনই।

একশো-প্রায় এই আশ্চর্য ঘটনাবহুল জীবনের শেষে ফিরে তাকালে মনে হয়, রণজিতের চিন্তাজগতকে প্রায় আট দশক তাড়া করে গিয়েছিল একটি কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। তা হল, ইতিহাস কী? অধুনার ইতিহাস, একটি বিদ্যায়তনিক ও নামবাচক বিশেষ্য মাত্র। কিন্তু দেশকালের অনুপুঙ্খ জমিতে দাঁড়িয়ে সেই বজ্রকঠিন তকমায় হেরফের ঘটে যায় কীভাবে ও কোন পদ্ধতিতে? কেমন করেই বা ইতিহাস নামক এই আপাত ধ্রুব অভিধার রূপান্তর ঘটে যায়– চৈতন্যে, সত্তায়, কল্পনায়? কীভাবে ইতিহাসে প্রযুক্ত হয় ব্যঞ্জনা, রস ও তাৎপর্য? প্রথম যৌবনে পাঁড় সিপিআই, ছাত্র ফেডারেশনের দুঁদে নেতা রণজিতের ভাবনাজগতকে আলোড়িত করেছিল এমন সব মোক্ষম প্রশ্নই।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এমন নয় যে এ প্রশ্ন ইতোপূর্বে এক্কেবারে অনালোচিত থেকে গিয়েছিল ভারতীয় ইতিহাস-মহলে। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আগে ও পরে যথাক্রমে যদুনাথ সরকার ও দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বীকেই এহেন জিজ্ঞাসার প্রতিনিধি ভাবা যেতে পারে। তাঁরা অবশ্য সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেই ইতিহাসকে জরিপ করেছিলেন এবং আবিষ্কার করেছিলেন নতুন ইতিহাস-প্যারাডাইম। কিন্তু রণজিতের পক্ষে কাজটা সহজ ছিল না। প্রথম জীবনে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে দীক্ষিত এক রাজনীতিকর্মী হিসেবে তো আরওই নয়। কোনও একটিমাত্র আদিকল্পে আজীবন থিতু থাকেননি, নতুন রাস্তা কাটতে কাটতে গেছেন। খবরের কাগজ তাঁকে বলবে “নিম্নবর্গের ইতিহাসের জনক”। এই সত্য অগ্রাহ্য করেই যে রণজিৎ জীবনভর লড়ে গিয়েছিলেন, আসলে নিজেরই বিরুদ্ধে। অচল ক্যাননে প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়ার ইতিহাসবিদসুলভ বাসনা তাঁকে কাবু করতে পারেনি।

পুব বাংলার বরিশালের সিদ্ধকাটি জেলার খাস তালুকদার পরিবারের ছেলে রণজিৎ। বাবা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের উকিল। তাঁর প্রথম ইতিহাস-জিজ্ঞাসা কেতাব থেকে আহৃত নয়, বরঞ্চ নিপাট আত্মজৈবনিক – যা দানা বেঁধেছিল অতি শৈশবেই, গ্রামের প্রজা-পরিবারের ছেলেদের সঙ্গে মিশতে মিশতে। গ্রামের সেই ছেলেগুলি, যারা কিনা এমনিতে তাঁর খেলার নিত্যসঙ্গী, বাড়ি ফিরলে কিশোর রণজিৎকে ডাকত ‘মনিব’ বলে। আর বাড়ির বড়দের আলোচনায় রণজিৎ বুঝতেন, এই ছেলেগুলি প্রজাদের পরিবারের সদস্য। মনিব কাকে বলে? প্রজাই বা বলে কাকে? দ্বিপদী এই দ্বন্দ্বের ইঙ্গিতেই রণজিতের দীর্ঘ মানস-অভিযাত্রার আরম্ভ। তাঁর কাছে মনিব আর প্রজার ভেদচিহ্ন নিছকই সমাজতাত্ত্বিক বর্গপ্রসূত নয়, বরঞ্চ ভাষাগত। আবার নেহাতই ভাষার উচ্চারে আটক না থেকে, প্রজা ও মনিবের দুস্তর ক্ষমতাবৈষম্য তিনি আবিষ্কার করেছিলেন দু তরফের শারীরিক বিভঙ্গে। কিশোর রণজিতের সামনে তারা সবসময়েই কুণ্ঠিত, বাবুর উপস্থিতিতে কেউই বিশেষ তামাক খায় না, দরকার পড়লে খুদে রণজিতের পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করে। দ্বন্দ্বের এমন অব্যর্থ ইশারা তাঁর রচনায় ঘুরে ফিরে এসেছে বারবার। মনিব-প্রজা, প্রভু-দাস, ঔপনিবেশিক-উপনিবেশায়িত, রাষ্ট্র-সমাজ, এবং সর্বোপরি আমি ও তুমি, অর্থাৎ কিনা আত্ম এবং অপর – ডায়লেকটিকের বিচিত্র সব প্রশ্নে তাঁর ইতিহাস-কৃতি বহতা থেকেছে জীবনভর। অবশ্য প্রশ্ন বললাম বটে, কিন্তু রণজিৎ তাঁর একটি রচনায় জানিয়েছিলেন: সব প্রশ্নই, বস্তুত, প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন নেহাতই বহিরঙ্গের অলঙ্কার। আপাত প্রশ্নের আড়ালে ধরা দেয় কখনো বিবিক্তি, কখনো বিস্ময়, কখনো বিরক্তি, কখনো বা অনুরোধ। সব প্রশ্নই রাজনৈতিক এবং কেবলই উত্তরপ্রার্থী নয়।

প্রশ্নের এমন বিচিত্র নোঙর ফেলতে ফেলতে ১৯৩৮ সালে রণজিৎ ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে, ইতিহাস অনার্সের ছাত্র হিসেবে। তারপরের আখ্যান অনেকেরই জানা। কমিউনিস্ট ভাবধারার সঙ্গে মিতালি, ছাত্র ফেডারেশনের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে স্বনিযুক্তি এবং তারই সুবাদে, ঠিক এক দশকের মাথায়, প্যারিসে বিশ্ব গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনে যোগদান এবং মিশর, সোভিয়েত, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডে ছোটাছুটি। স্মর্তব্য, এই পর্বে রণজিৎই সেই গুটিকয়েক বাঙালির অন্যতম, যাঁরা ১৯৪৯ সালের সদ্য বিপ্লবোত্তর চিন স্বচক্ষে দেখেছিলেন। ঘটনাচক্রে মাওবাদ তাঁর চিন্তার অবলম্বন হয়ে ধরা দেবে আরও দু দশক পরে।

ছাত্র ফেডারেশনের সর্বক্ষণের সদস্য হিসাবে রণজিতের এই অভিযাত্রা মোটামুটি প্রচারিত। কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠনের হয়ে রণজিৎ এ সময়েই চিন্তা মকশো করতে শুরু করেন, ভারতীয় উপমহাদেশের কিশোর মজুরদের দুরবস্থা নিয়ে দ্য স্টুডেন্ট-এ লেখালিখিও করেছিলেন। অথচ ইতিহাস তথা পরিসংখ্যানভিত্তিক অর্থনৈতিক ইতিহাসে আশ্রয় নিতে নিতেও সাহিত্যকে রণজিৎ ছেড়ে যাননি কদাচ। আট বছর বয়সের ভিতর বঙ্কিমের একাধিক উপন্যাসের পাঠক ছিলেন যিনি, শৈশবেই ঠাকুরদার কাছে মেঘনাদবধ কাব্যে হাতেখড়ি যাঁর, যিনি বয়ঃসন্ধির আগেই আবিষ্কার করেছিলেন ফিওদর দস্তয়েভস্কি, লিও তলস্তয় এবং ডিএইচ লরেন্স, নবীন সেনের রৈবতক যিনি অবলীলায় পড়ে ফেলেছিলেন বছর দশেকের মধ্যে – প্রেসিডেন্সিতে ঢুকে, ইতিহাস অনার্সের ছাত্র রণজিতের সেই সাহিত্য-অন্বেষা টাল খায়নি এতটুকুও। মাথায় রাখতে হবে, রণজিৎ নিজেই তাঁর জীবন-উপান্তের একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, ১৯৪০-এর দশকে ইতিহাস তখনও বৃহদর্থে হিউম্যানিটিজের অংশ, এবং তখনও “ফিজিক্সের সত্য ঢেকে দেয়নি হিউম্যানিটিজের সত্যকে”। বারো বছর বয়সে এবং ক্লাস এইটে যে ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর স্থায়ী পরিচয় হয়, তা দস্তুর মত বিরক্তি উৎপাদন করেছিল কিশোর রণজিতের মনে। মানবিক সত্যের কর্ষণই তাঁর কাছে ইতিহাস পড়ার প্রেরণা। ফলে খুব একটা আশ্চর্য নয় যে বয়সকালে ঐতিহাসিকতার বিচিত্র স্বরূপ তিনি আবিষ্কার করবেন সাহিত্যে। ছাত্র বয়সে সক্রিয় রাজনীতি যেমন করেছেন, তেমনই, তাঁরই অধিনায়কত্বে চারের দশকের একেবারে গোড়ায়, প্রেসিডেন্সির রবীন্দ্রভজা সাহিত্য-আবহে পদ্মানদীর মাঝি বিষয়ক আলোচনাচক্রও বসেছে। যে যে বিষয়ে শেষাবধি লেখা হয়ে উঠল না, সেই তালিকায় বছর পাঁচেক আগের একটি সাক্ষাৎকারে রণজিৎ ঠাঁই দিয়েছিলেন মহাভারত, শঙ্করাচার্য এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। শুনেছি, চল্লিশের দশকের শেষ বরাবর প্রেসিডেন্সির লাইব্রেরিতে টাটকা অবতরণ করল টিএস এলিয়টের সদ্যপ্রকাশিত প্রবন্ধগুচ্ছ। ইংরিজি বিভাগের অধ্যাপকদের সঙ্গে কার্যত দর কষাকষি করে সে-বই প্রেসিডেন্সি তো বটেই, সমগ্র কলকাতা শহরেই প্রথম যে কয়েকজন পড়েছিলেন তাঁদের একজন রণজিৎ।

রণজিতের চিন্তাজীবনকে তাই বিদ্যাবিভাজনের পাটোয়ারি ছাঁকনিতে পৃথগন্ন করা যাবে না। ক্ষমতা ও বাজারপ্রসূত ডিসিপ্লিন-খুপরিতে চিন্তাকে আটক করার আপোসধর্মিতা তাঁর ছিল না। মধ্য কলকাতার টোলে দস্তুর মত সংস্কৃত শিখেছেন যৌবনে, প্রথম স্ত্রী মার্তার সঙ্গে হেলেনা ববিনস্কার সোসো (স্তালিনের শিশুপাঠ্য জীবনী) বাংলায় অনুবাদ করেছেন পঞ্চাশের দশকে, নীরেন্দ্রনাথ রায়ের শেক্সপিয়র অনুবাদ নিয়ে তীব্র বিতর্ক তুলেছেন পরিচয় পত্রিকার পাতায়। অবিশ্বাস্য নয় যে, ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সে, সাবঅলটার্ন স্টাডিজের খণ্ডে ‘প্রোজ অফ কাউন্টার ইনসার্জেন্সি’ লিখছেন, আর পাদটীকায় এমিল বেনভেনিস্তের প্রবলেম্মা দ্যু লাঁগুইস্তিক জেনেরাল গ্রন্থের মূল ফরাসি এবং ইংরিজি অনুবাদের গরমিল ধরে ধরে উল্লেখ করছেন। আশির দশকের গোড়ায়, জড়ভরত-প্রায় অঙ্গনে দাঁড়িয়ে এক ভারতীয় ইতিহাসবিদের পক্ষে কাজটা নিতান্ত সহজ ছিল না। ঠিক যেমন ইতিহাসবিদের পক্ষে সহজ ছিল না, বৃদ্ধ বয়সে লাগাতার লিখে চলা একের পর এক বাংলা বইয়ে, পিঠোপিঠি পাতায়, একই সঙ্গে বাংলা, জার্মান, সংস্কৃত ও ইংরেজি উদ্ধৃতি সূত্রের সমান্তরাল উল্লেখ।

১৯৫৬ সালে সোভিয়েতের হাঙ্গেরি আক্রমণের প্রতিবাদে যখন কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়লেন, ততদিনে রণজিৎ ঢুকে পড়েছেন নতুন চিন্তার গহ্বরে: যার সূত্র লুকিয়ে আছে সর্বজনীন আর স্থানিক, অর্থাৎ সামান্য আর বিশেষের টানাপোড়েনের ভিতর। কেস স্টাডি হিসাবে তিনি বেছে নিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে, পারিবারিক সূত্রেই যে উত্তরাধিকার তাঁর উপর বর্তেছিল। প্রশ্নটা এরকম – কোম্পানি আমলে ফিজিওক্রেসি তত্ত্বত চেয়েছিল উদ্যমী, বিনিয়োগেচ্ছু, কৃষিসম্পত্তিনির্ভর বুর্জোয়া শ্রেণির পত্তন ঘটাতে। কিন্তু কালক্রমে তা ভোল বদলে আবির্ভূত হল জঙ্গম, খাজনাভিত্তিক, উঞ্ছভোগী ও আধা-সামন্ত এক শ্রেণি অবতারে। প্রশ্ন হল, তত্ত্ব এবং বাস্তবতার এমন ফারাক কেনই বা? অর্থাৎ নিপাট অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রশ্নকে রণজিৎ তর্জমা করলেন ইউরোপীয় বৌদ্ধিক ইতিহাসের সমস্যায়। এখানেই গোলমাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ তাঁকে ফেরত পাঠালেন, সরবোন তাঁর পিএইচডি নিল না। বয়সকালের এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, সেসময় বন্ধুবান্ধবরা সখেদে বলত, অর্থনৈতিক ইতিহাসের নামে রণজিৎ আবার একটি হিস্ট্রি অফ আইডিয়াজ লিখেছে! বস্তুত, ইতিহাসের সার্কিটে নিরন্তর অভিবাসী হতে হতেই রণজিতের এগিয়ে চলা।

অভিবাসন অবশ্য আক্ষরিক অর্থেও। কলকাতা ছেড়ে রণজিৎ তত দিনে দেশান্তরী, ইংল্যান্ডমুখী। দ্রুত সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডারের চাকরি। অথচ কিছুকালের ভিতরেই ব্যক্তিজীবনে ঝড়ঝাপটা ও নিঃসঙ্গতা। নির্বাসন, বস্তুত, এ সময় থেকেই রণজিতের জীবন ও ইতিহাসচিন্তার এক অব্যর্থ মোটিফ। ভাষাদর্শন নিয়ে এই কালপর্বে ভেবেছেন তিনি বিস্তর, লেখেননি কার্যত তার কিছুই, নিজেকে অনেকখানি প্রত্যাহার করেছেন গতে বাঁধা ও সেমিনারমুখী অ্যাকাডেমিক মহল থেকে। র‍্যাডিকাল ছাত্রদের নিয়ে কিছু স্টাডি সার্কেল চালাতেন আর একটি ডায়রি লিখতেন, যার দু-তিন অনুচ্ছেদ পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের উল্লেখে পাওয়া যাবে। এই সময় তিনি ভাবিত তাঁর শৈশব নিয়ে, যখন “যুক্তিসর্বস্বতার শেকল তাঁর হাত-পা বেঁধে দিতে পারেনি”, ডায়রিতে মধ্যে মধ্যে ঝলসে উঠত পুববাংলার রোমন্থন। সে অর্থে আত্মজীবনী লিখতে চাননি কখনোই, তেমন প্রস্তাব নাগাড়ে কাটিয়ে গেছেন এবং মনোবিশ্লেষণের একমনা পাঠক বয়সকালে কিঞ্চিৎ শ্লেষ সহকারেই জানিয়েছেন “যত আত্মজীবনী পড়বে, জানবে সব মিথ্যে কথায় ভরা।” জানা নেই, ষাটের দশকে লেখা সেই ডায়রিটি এই মুহূর্তে ঠিক কোথায়। আজ থেকে ১৫ বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তাঁর ব্যক্তিগত কাগজপত্র সবই দিয়ে যাবেন অস্ট্রিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসে, তাঁর মৃত্যুর পর উৎসাহী গবেষক যাতে ভবিষ্যতে উপকৃত হতে পারেন সেগুলি থেকে। রণজিতের এতাবৎ অপ্রকাশিত ডায়রিগুলি না পড়লে, আশি-ঊর্ধ্ব বয়সে সত্তা, অস্তিত্ব ও ফেনোমেনোলজি বিষয়ক তাঁর চিন্তাগুলিকে সম্পূর্ণ আত্মস্থ করা যাবে কি, সে প্রশ্নটা থেকেই যায়।

১৯৬০-এর দশকের শেষেই তাঁর আলাপ দ্বিতীয় স্ত্রী মেখঠিল্ডের সঙ্গে, আর ১৯৭০ সাল নাগাদ তাঁরা একযোগে কিছু কাল দিল্লিতে কাটান। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সময়টা অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়িয়েছিলেনও বটে। বলা যেতেই পারে, এই সংক্ষিপ্ত দিল্লিবাস রণজিতের চিন্তাজীবনের মোড় কার্যত ঘুরিয়ে দিয়েছিল, একই সঙ্গে তাঁকে টেনে এনেছিল স্বারোপিত রাজনৈতিক বানপ্রস্থ থেকেও। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাওবাদী ছাত্রদের সঙ্গে এ সময় তাঁর আলাপ হয়। প্রণব বর্ধনের লেখা পড়লে জানা যায়, নকশালপন্থী কর্মকাণ্ডের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ও স্নেহ বিষয়ে। রণজিৎ সে সময়টা ভারতে এসেছিলেন মূলত মহাত্মা গান্ধী ও কৃষক বিদ্রোহ বিষয়ক গবেষণা করতে। দিল্লিতে থাকার ফাঁকেই একদিন উপকরণ জোগাড়ের কাজে গেছেন গুজরাত। ভোরবেলা বদোদরা থেকে খেরা যাচ্ছেন, কালি পরজ (ব্ল্যাক কটন সয়েল)-এর আলপথ ছুঁয়ে ছুঁয়ে ট্রেন চলেছে – আচম্বিতে দেখতে পেলেন বেশ কিছু কৃষক ধানখেত বরাবর গান্ধী টুপিপরে হেঁটে চলেছেন, হাতে লাঠি। মুহূর্তের ওই এপিফ্যানিতেই রণজিৎ বুঝেছিলেন, উপমহাদেশের মহাত্মা-ফেনোমেননকে, এবং বৃহত্তর ভাবে উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামকে ধরতে গেলে, কেবলই কংগ্রেস-প্রসূত খাড়াখাড়ি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণ করলে চলবে না। সাবঅলটার্ন স্টাডিজ তখনো কালের গর্ভে। কিন্তু জনচৈতন্যকে বুঝতে চাওয়ার ওই চকিত ইচ্ছাতেই কালক্রমে তা ভ্রূণস্থ হয়।

রণজিতের সহধর্মিণী মেখঠিল্ডের বয়ানে জানা যায়, এ সময় দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর খোঁচড়রা রণজিৎদের গতিবিধির উপর উঁকিঝুঁকি মারত। স্বাভাবিক। স্বাধীনতা সংগ্রামের চলিত ও অভ্যস্ত লিবারাল-বুর্জোয়া ধারণাটিকেই যে তিনি বিদ্ধ করে গেছেন পরের দু দশক। ফ্রন্টিয়ারনাউ পত্রিকায় এ সময় বেশ কয়েকটি লেখাও লিখেছেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রসঙ্গে, তার অব্যবহিত বঙ্গানুবাদও হয়েছে। সাতচল্লিশে জন্মানো মধ্যরাতের সন্তানরা তখন প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেস জমানার প্রতি বিরূপ। তাঁদেরই কাউকে কাউকে জুটিয়ে এনে আশির দশকের গোড়ায় সাবঅলটার্ন স্টাডিজের মহরত এবং দিল্লির অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের সঙ্গে সমঝোতা। বাকি ইতিহাস। ঘটনাচক্রে এই গোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্য তখনো পিএইচডিই করেননি। হালফিলের ডিগ্রিখেকো বিদ্যায়তনিক পটভূমিতে যা এক রকম অচিন্তনীয়ই বলা চলে।

এ ইতিবৃত্ত মোটামুটি প্রচারিত। কিন্তু এখানে একটি কথা স্পষ্টভাবে বলা দরকার। যে কেন্দ্রীয় প্রশ্নের মোকাবিলা রণজিৎ জীবনভর করে গেছেন, সেই ‘ইতিহাস কী?’-র ক্যানভাসটুকু ভারতের পটভূমিকায় অনেকখানি বিস্তৃততর হয়ে উঠতে পেরেছিল সাবঅলটার্ন স্টাডিজেরই সৌজন্যে। ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার কক্ষে রণজিতের সেই যুগন্ধর ভাষণ, যা কিনা কালক্রমে এই জ্ঞানকাণ্ডের ইমারত নির্মাণ করে – শ্রোতৃমণ্ডলীর অনেকের তরফেই বিশেষ ভালভাবে গৃহীত হয়নি। কলকাতার অন্তত দুজন নামজাদা ও শ্রদ্ধার্হ ইতিহাসবিদ চিরকুটে তাঁদের ‘ভেটো’ পাঠিয়েছিলেন বক্তৃতা চলাকালীনই। রণজিৎ অবশ্য অকুস্থলেই কাটা-কাটা জবাব দিয়েছিলেন সে সব প্রশ্নের। প্রশ্ন হল, সাবঅলটার্ন স্টাডিজ প্রসঙ্গে তারপরের এক দশক ভারতে (এবং বহির্বিশ্বেও) যে বিপুল বিতর্কের মন্থন হয়েছে, তার কারণ কী? কেমব্রিজ, স্বাদেশিক-লিবারাল, মায় মার্কসবাদীরা তাঁদের আক্রমণ করে গেছেন কেন – এর একটা বাহ্যিক কারণ ঠাওরানোই যায়। কিন্তু গভীরতর কারণ হল, তাঁদের অভ্যস্ত অ্যাংলোফাইল ও এম্পিরিকাল-পজিটিভিস্ট (তথ্যাশ্রয়ী ও দৃষ্টবাদী) ইতিহাস মেথডোলজির নিক্তিতে সাবঅলটার্ন স্টাডিজকে ধরাই যাবে না। রণজিৎ তাঁর চিন্তাবিশ্বকে নিছক ইংল্যান্ডের কয়েদখানায় আবদ্ধ রাখেননি, প্রকৃত কসমোপলিটানের ধর্ম অনুযায়ী তাকে বিশদ করেছেন সারা দুনিয়া ছেঁচে অনেকান্ত ইতিহাস-উপকরণ সংগ্রহের মাধ্যমে। প্রায় ছুটোছুটি করেছেন – ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ থেকে রলাঁ বার্ত, লেভি স্ত্রস থেকে রোমান ইয়াকবসন, টমাস কুন থেকে গ্রামশি, মাও সে তুং থেকে মিশেল ফুকো। সবমিলিয়ে এমন এক দিগন্তসঞ্চারী বিশ্লেষণী পটভূমি, যা ভারতীয় ইতিহাস লেখায় কার্যত অতুলনীয়। আবার কেবল কন্টিনেন্টাল ইউরোপ ছেনেই ইতিহাসচিন্তার আকর পেয়েছেন, এমন ভাবাও ভুল। নিতান্তই ঔপনিবেশিক সময়ে, অর্থাৎ ১৭৭০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে, কৃষক-জনজাতি বিদ্রোহের গায়ে ফুটে ওঠা দমন আর বশ্যতার কুলুজি ঠাওরাতে গিয়ে ‘এলিমেন্টারি অ্যাসপেক্টস’-এর যাত্রা আরম্ভই হয় সুদূর মঝঝিমনিকায় উদ্ধৃত করে। কখনো সেখানে হানা দেয় দণ্ড, ভক্তি, বা ধর্ম-র মত কতগুলি উপমহাদেশীয় বিশ্লেষণী বর্গ। গুজবের চরিত্র বোঝাতে পাণিনি থেকে নিয়ে আসেন অতিদেশ (ঠিক যেমন পরবর্তী কালে মেটোনিম বোঝাতে ভর্তৃহরি থেকে ধার করবেন উপচার)। নির্দিষ্ট স্থানিক আর কালিক প্রেক্ষিতে, বিদ্রোহের কতকগুলি সাধারণ লক্ষণ চিহ্নিত করতে গিয়ে রণজিৎ একদিকে শরণ নিচ্ছেন স্ট্রাকচারালিজমের, অন্য দিকে স্মরণ করছেন তাঁরই অগ্রজ ডিডি কোসাম্বীকে। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সংঘর্ষ ডিঙিয়ে আবিষ্কার করেছেন তৃতীয় এক প্রদেশ, যা একান্ত ভাবেই রণজিৎ স্বাক্ষরিত। মেধার এই দাপুটে মাধুকরীবৃত্তিই তাঁকে বরাবর অনন্য রেখেছে।

প্রতিষ্ঠান তাঁকে নিছকই সাবঅলটার্ন স্টাডিজের কুলগুরু হিসেবে দেখতে চাইবে, স্বাভাবিক। দেখেছেও। অথচ এক বিদ্যাজীবনে বারংবার জন্মান্তরের অভ্যাস তিনি অগ্রাহ্য করেননি। সাবঅলটার্ন স্টাডিজের তুঙ্গ খ্যাতির সময়কালে ছটি খণ্ড সম্পাদনা করেই তিনি ওই প্রকল্প থেকে কার্যত স্বেচ্ছাবসর নিলেন। খেয়াল না করে পারি না, নয়ের দশক থেকে যখন সাবঅলটার্ন স্টাডিজ ঈষৎ হেলে পড়ছে পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজের দিকে, নতুন অবতারের গোষ্ঠীকে আক্রমণ করছেন এজাজ আহমেদ বা পুরনো সদস্য সুমিত সরকার, তখন তাঁদের চাঁদমারি থেকে ছাড় পায় কেবল একটিই লেখা: তা রণজিতেরই বহুকীর্তিত ‘চন্দ্রাজ ডেথ’। এই প্রবন্ধগুলি তুলনায় পঠিত। কিন্তু রণজিৎ গুহর কী অবস্থান তখন?

নয়ের দশক থেকে রণজিতের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল যে কোনোরকম আদিকল্পের জট ছাড়িয়ে মুক্ত ইতিহাস লেখা, যেখানে সত্তা, চৈতন্য ও ভাষার প্রশ্নটি যথাযথ স্বীকৃতি পায়। এই কাজে তিনি একদিকে অবলম্বন করছেন প্রাচীন সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ ও রসতাত্ত্বিকদের, অন্যদিকে আশ্রয় নিলেন উনিশ-বিশ শতকের জার্মান চিন্তানায়কদের লেখাপত্রে। এমন নয় যে এঁদের অকুণ্ঠ উল্লেখ তাঁর লেখায় কিছুমাত্র কম ছিল। গৌতম ভদ্র একবার বলেছিলেন, ১৯৮৭ সাল নাগাদ এক রোববার, ছুটির দিনে প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্ররা রণজিতের সঙ্গে তুমুল তর্কে রত হয়েছিল, তাঁর লেখায় ‘হেগেলীয় বিচ্যুতি’ দেখা যাচ্ছে, এই মর্মে। স্বভাবতই এমন অভিযোগ রণজিৎ মানেননি। হেগেলের প্রতি সমস্ত ঋণ স্বীকার করেও রাষ্ট্রপোষিত ইতিহাসের সরহদ্দটি রণজিৎ বরাবরই ঠাওরাতে চেয়েছেন। পাশাপাশি মার্কসের প্রতি ঋণও কদাচ ত্যাগ করেননি তিনি। ডমিন্যান্স উইদাউট হেজিমনি-র আদত তত্ত্বপ্রকল্পটিই দাস ক্যাপিটাল থেকে উদ্ভাবিত, তার সঙ্গে যথোচিত ব্যাপকতায় রণজিৎ ধার নিয়েছেন বাখতিন বা চমস্কির কাছ থেকে। এই সময়কারই শ্রেষ্ঠ একটি বাংলা রচনায় – জীবনানন্দ-বিষয়ক – আমরা দেখি মার্কসের গ্রুন্দরিজেকে তিনি বহুল ব্যবহার করছেন আসলে অভ্যস্ত মার্কসবাদী জীবননান্দ পাঠেরই বিপ্রতীপে! ঠিক যেমন মহাকাব্যের ঐতিহাসিকতাকে বুঝতেও তিনি মার্কসের প্রতি ঋণ স্বীকারে দরাজ।

বস্তুত রাজনীতির প্রশ্নকে সচেতন ভাষাপ্রশ্ন হিসাবে দেখতে চাওয়ার তাগিদ আরও বাড়তে থাকে তাঁর এই কালপর্বের লেখাগুলিতে। ভাষা এবং ইতিহাস যেন সমবায়ে আবদ্ধ দুটি দ্রব্য, ভাষার মালমশলা ছেনেই ইতিহাসের স্থাপত্য নির্মিত হয়। সাহিত্যের কাছে হাত পাততে শুরু করেন রণজিৎ, কেন না তাঁর কাছে ইতিহাস ও সাহিত্যের সাধারণ লক্ষণ এই, যে উভয়েই কালাশ্রয়ী। তত দিনে ক্যানবেরার পাট চুকিয়ে রণজিৎ বাসা বেঁধেছেন ভিয়েনার শহরতলি পুর্কের্সডর্ফে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সুভাষচন্দ্র বসুর সংক্ষিপ্ত উদাহরণ বাদ দিলে, আর কোনো পরিচিত বাঙালি মুখ আদৌ পুর্কের্সডর্ফে স্বেচ্ছায় অবস্থান করেছেন কি? জানা নেই। কিছু পুরনো বাংলা গান আর বাংলা সাহিত্যের বিপুল উপচারে নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন। তৈরি করতে থাকলেন সাহিত্য বিষয়ক দীর্ঘ টিপ্পনীধর্মী ক্যাটালগ আর নোট (যার কিছু মৃত্যুর পর প্রকাশিত হবে, এ প্রত্যাশা রাখাই যায়)। বাড়ির প্রায় সমস্ত ইংরিজি সমাজবিজ্ঞানের বই হটিয়ে দিলেন, লিখতে আরম্ভ করলেন বাংলায়। আবাল্য শেখা ভাষার স্পর্শে বুঝতে চাইলেন ঐতিহাসিকতাকে – রাষ্ট্র পরিচালিত ইতিহাসসর্বস্বতা থেকে বহুদূরে যার বসতি।

ইতিহাস আর সাহিত্যের সাধারণ সংযোগ কী? রণজিতের কাছে উভয়েরই অবস্থান স্বদেশ এবং স্বসময়ে প্রোথিত, যা ডালপালা মেলে সত্তা আর সংসারের নিয়ত টানাপোড়েনে। এবং গুহ মনে করাবেন, ইতিহাস ও সাহিত্য, দুয়েরই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আরোপিত ঐতরিকতার (এলিয়েনেশন শব্দের রণজিৎকৃত তর্জমা। তবে নিছকই ইংরিজি তত্ত্বমূলের আঁকাড়া অনুবাদ ধরে নিলে এর নিহিত ব্যঞ্জনাটির প্রতি কিঞ্চিৎ অবিচার করা হবে) বিচ্ছিন্নতাপ্রবণ শৃঙ্খল ভেঙে, বৃহৎ সংসারের সঙ্গে সংলাপে লিপ্ত হওয়া। অভিনবগুপ্তর লব্জ টানলে বলা যায়, এই ‘হৃদয়সংবাদী’ কথোপকথনের মূল ভিত্তি কী? উত্তর: অভিজ্ঞতা। সেখানেই পার্থিব ইতিহাসের জন্মদাগ। আর এহেন অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সাধারণ মাধ্যম? রণজিতের চূড়ান্ত জবাব: ভাষা। ভাষাই সত্তার সেই নির্বিকল্প প্রকাশমাধ্যম।

২০১০ সালে রণজিৎ একটি সাক্ষাৎকারে চেতাবনি দিয়েছিলেন, ঐতিহাসিকতাকে যথাযথ বুঝতে হলে নিছকই ইতিহাস পড়লে চলবে না। চোখ ফেরাতে হবে সাহিত্যের দিকেও এবং সতত বিদ্রোহী এই মানুষটি মনে করেছিলেন: আধুনিক ভারতের ইতিহাস তাই হিস্ট্রির কেতাব খুঁড়লে মিলবে না, যতটা পাওয়া যাবে আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যের খাঁজে খাঁজে। কেবলই কি আধুনিক? আজ থেকে ১২ বছর আগে রামায়ণের প্রথম শ্লোক নিয়ে এক বহুস্তরী আলোচনায় দেখিয়েছিলেন, ‘আমি’ এবং ‘অপর’-এর উভয়ত পরিচয়ে কীভাবে কবিসত্তার স্ফূরণ ঘটে। মাথায় রাখা ভাল, এই আনকোরা উপলব্ধিতে সাহিত্য কেবল ইতিহাস লেখার সামগ্রীবিশেষ নয়। সে, নিজের স্পর্ধাতেই, ইতিহাস হয়ে ওঠার দাবিদার। অবশ্য কেবল এই নয়। বছর কুড়ি আগে এক বক্তৃতায় তিনি সরাসরি আক্রমণ করেছিলেন অ্যাকাডেমিক ইতিহাসের বাড়বাড়ন্তকে, তাকে অভিযুক্ত করেছিলেন জীবনবিচ্ছিন্নতার দায়ে। ইতিহাস ও কবিতাকে মানুষী অস্তিত্বের আলোয় দেখতে বরাবরই আগ্রহী থেকেছেন রণজিৎ – দেশকাল আর অভিজ্ঞতার অমোঘ জংশন স্টেশনটিকে গণ্য করে এসেছেন ঐতিহাসিকতার অনিবার্য চিহ্ন হিসাবে।

রাজনীতি প্রসঙ্গে রণজিতের জিজ্ঞাসা আরও ঘনীভূত হয়ে উঠতে থাকে একুশ শতকে এসে। একদা সাবঅলটার্ন স্টাডিজে তিনি অভিনব মুনশিয়ানায় সংজ্ঞায়িত করেছিলেন ‘পলিটিক্স অফ দ্য পিপল’ বা জন-রাজনীতিকে – রাষ্ট্রপোষিত খুপরিখাঁচার বাইরেও যা সতত জীয়ন্ত। শিশুতোষ মার্কসবাদী ছককে বানচাল করে জানিয়েছিলেন, পুঁজিবাদের অনুপস্থিতিতেও রাজনীতির অনেকান্ত প্রকাশভঙ্গিমা থাকে – তাকে, নেহাতই ‘প্রাক-রাজনৈতিক’ বলে দাগানো মস্ত ভুল। একুশ শতকে এসে অবশ্য, তামাম রাজনীতি বিষয়টিকেই, ঠিক ইতিহাসের মতই, সমস্যাদীর্ণ করে তুললেন রণজিৎ। উপমহাদেশীয় পরিস্থিতিতে রাজনীতি যে তার জীবিকা নির্বাহ করে থাকে কেবলই সেপাই সান্ত্রী কবলিত বাহুবলের দ্বারা, সেকথা নিশ্চিত প্রত্যয়ে তিনি জানিয়েছিলেন আগের কাজগুলিতে। এ দফায়, এহেন বাহুবল-অধ্যুষিত রাজনৈতিক পরিসরের বাইরে বিকল্প এক নৈতিক পরিসরের খোঁজেও ব্যাপৃত হলেন রণজিৎ। এই নৈতিকতার ভিত্তি কী? আমরা ভাবতেই পারি: তা হল সহিত-ত্ব – সাহিত্যের যে সংজ্ঞা একদা সরবরাহ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। রামমোহনকে দৃষ্টান্ত ধরে, বর্ষীয়ান ইতিহাসবিদের কলমে চলতে থাকল দয়া, করুণা আর সমানুভূতির সন্ধান। কেবলই বজ্রকঠিন যুক্তি আর রাষ্ট্রসর্বস্বতা নয় – ভারতীয় আধুনিকতার পরতে কী তরিকায় থেকে গেছে নৈতিকতার রেশ, তা যাচাই করলেন রণজিৎ। এই আধুনিকতা নিছক ভেদ-অভেদের বাটখারায় যাচাইযোগ্য নয়। একদা যেমন উদাহরণ সমেত দেখিয়েছিলেন, কী ভাবে বাংলা ব্যাকরণের পিতৃত্ব স্বীকার করেও বহিরাগত শব্দপুঞ্জ রং পাল্টায়, যেমন, টেবল হয়ে যায় ‘টেবিল’, গ্লাস ‘গেলাস’ আর স্কুল ‘ইশকুল’– ঠিক তেমনই, আধুনিকতা আর জাতীয়তাবাদও আলাদা ঐতিহাসিক অবয়বে আবির্ভূত হয় বিশেষ বিশেষ অবস্থায়। রাষ্ট্রমথিত রাজনীতি-ভাষ্যের তর্জনী উপেক্ষা করে থেকে যায় একটি সার্বভৌম অঞ্চল, যেখানে ক্রিয়াশীল থাকে অভিজ্ঞতাপূর্ব এক চৈতন্যস্তর – যাকে রণজিৎ বলবেন ‘প্রাগভিজ্ঞা’– যেন বা, উৎপলকুমার বসুকে যেমনটা জানিয়েছিলেন: আদিম কোনো ‘দৈবী প্রেরণা’-র মত।

সবিস্ময় খেয়াল করি, গত ৩০-৪০ বছরের ইতিহাস ক্লাসঘরে উত্থাপিত প্রতিটি জরুরি সমস্যাতেই রণজিতের মৌলিক অবদান। সেটা সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে রূপান্তরের প্রশ্ন হতে পারে; কিংবা গণতন্ত্র, আধুনিকতা, জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি, ঔপনিবেশিকতা কিন্তু এ কথাও বলার যে তাঁর কৃতি কেবল সেখানেই ফুরোচ্ছে না। লেখার গোড়াতেই বলেছিলাম না, নিতান্ত অভিধায় তিনি আস্থাশীল থাকেননি কখনও? ইতিহাস, তাঁর কাছে, কেবল বিদ্যায়তনিক অভিধামাত্র নয়। বরং, নবতিপর রণজিতের লেখালিখি থেকে এই আন্দাজই কেবল করা যায় যে ইতিহাস তাঁর কাছে নৈতিকতার জানলা, মানুষী সত্তার স্ফূরণের অনিবার্য আধার। প্রায় জীবনভর উজিয়ে এসে, উপান্তে, এই তীব্র আশাবাদই তাঁর ইতিহাসবোধকে জাগ্রত রেখেছিল।

অথচ হিংসা থাকে রাষ্ট্রের গোড়াতেই উপ্ত রয়েছে হিংসার এই বীজ। মহাভারত বা গীতার উপর লেখাগুলিতে আমরা তেমন চিন্তাশীল রণজিৎকেও আবিষ্কার করি, যেখানে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কোনো শেষ হয় না। কেবল, ইতিহাসের দু-একটি পৃষ্ঠায় তার পর্যায়ক্রমিক নবায়ন ঘটতে থাকে। কিন্তু রাত্রিই কি ভবিতব্য? রণজিতের ভাবনাসঞ্জাত শব্দপেটিকার দুটি উজ্জ্বলতম রত্ন: ‘দিগন্ত’ আর ‘উত্তরণ’ (ট্রান্সেন্ডেন্স)। দশক খানেক আগেকার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন মানুষী সত্তার অনিবার্য শারীরিক সীমাবদ্ধতা বিষয়ে। যেমন একটা পাখি উড়তে পারে, মানুষ পারে না। একটা মাছ বিশ বাঁও জলে ডুবে থাকতে পারে, মানুষ পারে না। তা হলে? সেই আবদ্ধতাতেই মানুষের উত্তরণ – মানুষ চায় এরোপ্লেন বানাতে, সাবমেরিন হয়ে জলে ডুবুরি হতে। সে তার নিপাট ও একটেরে ‘থাকা’ থেকে কেবলই ধাবমান হয় অনির্দেশ্য এক কল্পদেশের দিকে। অস্ থেকে ভূ। নব্বইয়ের চৌকাঠে পা রাখা রণজিৎ এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে বলছেন, ‘উত্তরণ’ বা ‘উৎক্রান্তি’। যা হতে পারে, সেই সম্ভাব্য কল্পনাই রঙ্গিলা করে তোলে বাস্তবকে। হিংসার অবিরল আনাগোনা সত্ত্বেও, যা কিছু নৈতিক এবং যা কিছু শুভ, তার প্রতি বিশ্বাস সম্ভবত রণজিৎ জীবনভর হারাননি। তাঁর কাছে ইতিহাস যেন মহাভারতীয় – যে কাব্য অতীতেও লেখা হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। ইতিহাস সেই প্রক্রিয়া, যা চলেছে “এক অসমাপ্তি থেকে আর এক অপস্রিয়মাণ অসমাপ্তির উদ্দেশে”। এমন প্রখর নিশ্চিতি না-থাকলে কি ‘এলিমেন্টারি অ্যাসপেক্টস’ শেষ হতে পারত এই তীব্র ঘোষণায়, যে যত দিন ভূস্বামীবৃত্তি বহাল থাকবে – ততদিন যতগুলি গণবিদ্রোহ ঘটবে এই উপমহাদেশে – তার অঙ্গীকার হবে তিতুমীর, সিধু-কানু বা বীরসার অসম্পূর্ণ বিদ্রোহকে সমাপ্ত করা?

এমন পাঠ আবিষ্কৃত হতেই বোঝা যায়, রণজিৎকে নিতান্তই ইতিহাসের জেলখানায় আটকে রাখা মস্ত বড় ভুল। ইতিহাসকে ঐতিহাসিকতার দিকে চালিত করেছেন আবিশ্ব যে গুটিকয় দার্শনিক, তিনি নিঃসন্দেহে তাঁদের একটি আসন অধিকার করে থাকবেন। তবু আজকের যুগমুহূর্তে দাঁড়িয়ে দু-একটি প্রশ্নও করতে ইচ্ছে হয় বই কি। যেমন ভাবতে ইচ্ছে হয়, রণজিতের ব্যাখ্যানে প্রকৃতি এসেছে (আদি কবি, বিভূতিভূষণ বা রবীন্দ্রগান বিষয়ক রচনাগুলি স্মরণীয়) – কিন্তু বিষয়ী হিসাবে নয়, নেহাতই বিষয় হিসাবে। আজ জলতলের উষ্ণতা ক্রমেই বেড়ে যাওয়ার, তাপমান উৎকট আকার নেওয়ার, আর অগুনতি না-মানুষ প্রজাতি বিলীন হয়ে যাওয়ার এই ভয়াবহ ক্রান্তিমুহূর্তে, প্রকৃতিসত্তাকে ঠিক কীভাবে দেখতেন রণজিৎ? প্রকৃতি-উচ্চার্য ভাষার ভিতর ঐতিহাসিকতার স্পন্দন কি পাওয়া সম্ভব? বা সংক্ষেপে বললে, রণজিৎ গুহর ইতিহাস-জিজ্ঞাসা কি নেহাতই মনুষ্যকেন্দ্রিক হয়ে থাকেনি? দুই, এ-ও মনে হয় যে রাজনীতিকে রাষ্ট্রিকতার দোসর হিসাবে ঘোষণার মাধ্যমে কি আজকের বাস্তবতাই উপেক্ষণীয় হচ্ছে না? অবশ্য কেউ এ-ও বলতে পারেন যে রণজিৎ বর্ণিত মানবসত্তা অলীক এক কল্পদেশের উদ্দেশেই উত্তরণে ইচ্ছুক – না-ই বা তাকে মেলানো গেল বাস্তবতার আঁকাড়া মাপজোকে।

তাহলে মৃত্যুর পর রণজিৎকে কীভাবে মনে রাখা যায়? আমি নিশ্চিত, বৃদ্ধ ঐতিহাসিককে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন, বিস্মরণের মাধ্যমে। পরিপাটি স্মরণের যে অভ্যস্ত বাঙালিসুলভ সংস্কার, তাকে জীবনভর – লেখায় এবং যুক্তিতে – রণজিৎ গুহ আক্রমণ শানিয়ে গেছেন। বিস্মরণকে তিনি সত্তার জরুরি অংশ মনে করতেন। তাঁর চিন্তাজীবনেও আচ্ছন্ন হয়ে আছে বিস্মরণের এই বিরল গুণ। নিঃসীম ক্যাননাইজেশনের মাধ্যমে, আর যা-ই হোক, এই মহৎ ভাবুককে মনে রাখা যাবে না। তার জন্য প্রয়োজন যতির, সাইলেন্সের। রণজিতের গদ্যশৈলী আকীর্ণ করে যে নীরবতা স্বরাট থাকত।

আরো পড়ুন ঐতিহাসিক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ: এক আপোসহীন ইতিহাস লেখক

ওঁর যখন নব্বই হল, ক্যানবেরাস্থিত এক অস্ট্রেলীয় নৃতাত্ত্বিক, ক্রিস গ্রেগরি, একটি লেখায় রণজিতের আলোচনার কিছু প্রিয় বিষয়ের হদিশ দিয়েছিলেন। সেগুলি হল, হাইডেগার, রাহু, পথের পাঁচালী, বিদ্রোহ এবং মৃত্যু। মৃত্যু কী? তাঁর বয়স যখন ৮৫ বছর, এই প্রবীণ ইতিহাসবিদ এক বক্তৃতায় বলছেন: “Death… where alone man meets his Destiny, the ultimate Other beyond which there is no knowing the Self.” এই মৃত্যু কি আক্ষরিক, জৈবিক মৃত্যুই? না হোক, কী-ই বা আসে যায়।

এ লেখা শেষ করি তাঁরই পুরোনো একটা উক্তি স্মরণ করে। উক্তিটির বয়সও, নয় নয় করে, ৪০ হতে চলল। সমর সেনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে রণজিৎ একটি শ্রদ্ধাঞ্জলিধর্মী নিবন্ধ লিখেছিলেন, যার নাম ‘শান্তি নেই’। এ লেখায় সাংঘাতিক কটি বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন তিনি, যার মধ্যে ছিল

“সমরদার জীবন ও ব্যক্তিত্ব এখনও সাম্প্রতিকতায় সজীব। একদিন তিনি মারা যাবেন; আমরা তাঁর কথা যা জানি তা তখন কেবল স্মৃতির, সুতরাং সমর সেন প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রচনার বিষয় বলে গণ্য হবে।”

স্মৃতিপ্রসূত কর্তার ভূত না হয় মুলতুবি থাক। রণজিৎ গুহকে ধারণ করতে এই কথাগুলিই কি যথেষ্ট নয়?

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।