যাদবপুরের ফুটপাথে বই বিক্রি করতে করতেই গবেষণা করেন, লেখেন পূর্ণেন্দু ঘোষ
প্রতি বছর নিয়ম করে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস আসে। আবার চলেও যায়। যাদবপুরের ফুটপাথে বসে বই বিক্রি করেন এক প্রৌঢ়। ভগ্ন শরীর, উজ্জ্বল দুটি চোখ। ফুটপাথের বই-বিক্রেতার পাশাপাশি তিনি একজন লেখক, গবেষক, সাংস্কৃতিক কর্মীও। যিনি রাস্তায় বই বিক্রির ফাঁকে লিখে ফেলেছেন সুন্দরবনের ইতিহাস।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেটের সামনের ফুটপাথ। সারি সারি খাবার দোকান, মোবাইল মেরামতির দোকান, ফলের দোকান। তার মধ্যেই চোখে পড়বে একটি পুরনো বইয়ের দোকান। দোকান সামলাচ্ছেন ষাট ছুঁই ছুঁই এক ব্যক্তি। নাম পূর্ণেন্দু ঘোষ। ডাকনাম পুণ্য। আশেপাশের দোকানদারেরা পুণ্যদা বলে ডাকেন। আশ্চর্য মানুষ এই পুণ্যবাবু। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করার ফাঁকেই তিনি লিখে ফেলেছেন সুন্দরবনের একাংশের ইতিহাস! সেই বই আদৃত হয়েছে গবেষক মহলে। তা ছাড়াও আরো একাধিক বইয়ের লেখক যাদবপুরের ফুটপাথের এই অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, যাঁর প্রথাগত পড়াশোনা কলেজের গণ্ডি ডিঙোয়নি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
পুণ্যবাবুর জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই সুন্দরবনে। বাবা ছিলেন তালা চাবির মিস্ত্রি। প্রবল দারিদ্র ছিল নিত্যসঙ্গী, কিন্তু সেই সঙ্গে ছিল আড়বাঁশি বাজানোর নেশা। যাত্রাপালায় বাঁশি বাজাতেন নিয়মিত। সেই থেকে পুণ্যবাবুর মগজে সাহিত্য, সংস্কৃতি, আঁকাআঁকির ভূত ঢুকে যায়। এইট বি মোড়ের অতি ব্যস্ত ফুটপাথে ভিড়ের ধাক্কা খেতে খেতে পুণ্যবাবু বলছিলেন, “ছাত্র খুব খারাপ ছিলাম না। কিন্তু স্কুলের পরে পড়াশোনা আর তেমন হল না। স্থানীয় স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম। কিন্তু প্রবল অর্থকষ্ট! ডিগ্রিটা শেষ করতে পারলাম না।” চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে পুণ্যবাবু বলতে থাকেন, “গরীব বাড়ির ছেলে। পেট তো চালাতে হবে। আমাকে সংসারে অর্থ দিতে হত। তাই উপার্জন শুরু করলাম। বিচিত্র সব কাজ। কিন্তু ছোট থেকেই লিখতে ভালবাসতাম তো, তাই লেখাটা কখনও ছাড়িনি। সারাদিনের পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে লিখতে বসতাম। লিখতে লিখতে রাত ভোর হয়ে যেত। ঘুম হত না দিনের পর দিন। তবুও লিখে যেতাম। লেখাই ছিল আশ্রয়। লেখাই ছিল শান্তি। লেখা ভুলিয়ে দিত খিদে, ভুলিয়ে দিত অভাব।”
এমন করেই চলছিল। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। আচমকাই পুণ্যবাবুর মাথায় চাপল নিজের এলাকার অতীত খোঁড়ার ঝোঁক। তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করলেন সুন্দরবনের ইতিহাস। স্থির করে ফেললেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য: সুন্দরবনের একটি অংশের ইতিহাস লেখা। এরপর মাসের পর মাস কেটেছে, কেটেছে বছরের পর বছর – পাখির চোখের মত একটি মাত্র কাজকে জাপ্টে ধরে বেঁচেছেন পুণ্য। কোন মতে অন্নসংস্থান, বাকি সময় লেখা, লেখা আর লেখা।
পুণ্যবাবু জানান, ঐ বইটি তাঁর গত ২০ বছরের পরিশ্রমের ফসল। তাঁর কথায়, “আমি তো দিন আনি, দিন খাই। সংসার চালানোর জন্য রোজ উপার্জন করতে বেরোতে হয়। কিন্তু তার মাঝেই সুন্দরবনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেরিয়েছি। দিনের পর দিন হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছি গ্রন্থাগার আর মহাফেজখানায়। তাতে হয়তো সব দিন ভাত জোটেনি, কিন্তু তৃপ্তি পেয়েছি অসীম।”
পুণ্যবাবুর প্রথম বইয়ের নাম ‘রাখালবন্দনা’। বারোটি গল্পের একটি সংকলন। এরপর লেখেন কিশোরদের জন্য গল্পচ্ছলে কলকাতার ইতিহাস। নাম, ‘গল্পকথায় কলকাতা’। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বইটি ‘ইতিহাসের আলোকে সুন্দরবন ও পোর্ট ক্যানিং’। কেবলমাত্র ক্যানিং নয়, গবেষণাধর্মী এই বইতে পুণ্যবাবু সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অংশের জনবসতি গড়ে ওঠার ইতিহাস লিখেছেন। ২০১৭ সালে প্রকাশিত বইটি গবেষক মহলেও সমাদৃত।
পুণ্যবাবুর জন্ম ক্যানিং থানার অর্ন্তগত এক নম্বর পূর্বদিঘির পাড় গ্রামে। গ্রামের পাশেই মাতলা নদী। নদীর ধারে আদিবাসীদের বাস। পুণ্যবাবুদের পরিবারের আদি বাড়ি ছিল বালিতে। তাঁর কথায়, “পোর্ট ক্যানিং যখন তৈরি হল, তখনই আমাদের পরিবার এই এলাকায় চলে আসে। মোটামুটি সচ্ছল অবস্থাই ছিল, কিন্তু ১৯৪৩ সালের বন্যায় আমাদের ভদ্রাসন মাতলার গ্রাসে চলে যায়। তারপর থেকেই আর্থিক অনটন নিত্যসঙ্গী। আমার সারাজীবনেও সেই অনটন আর কাটেনি। বলতে পারেন দারিদ্র্য আমার জন্মদাগ,” হেসে ফেলেন পুণ্যবাবু।
বইয়ের ব্যবসা শুরু করার আগে কী করতেন? পুণ্য বলেন, “কী যে করিনি তাই ভাবি। রেল স্টেশনে, ট্রেনে হকারি করেছি। সাইনবোর্ড লিখেছি। মাটির প্রতিমা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেছি। ছোট পত্রিকায় কাজ করেছি। হোটেলে থালা-বাসন মেজেছি। গত দেড় দশক রাস্তায় বই বিক্রি করি।” আর লেখালিখি? “অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচে? অক্সিজেন নেওয়ার মতো করেই লিখে গিয়েছি। কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকেই লিখেছি একটানা, বিরতিহীন। প্রথমে দেওয়াল পত্রিকায় লিখতাম, তারপর বিভিন্ন ছোট পত্রিকায়। একবার ‘দেশ’ পত্রিকায় একটি গল্প প্রকাশিত হয়। সেই সূত্রেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, আবুল বাশারের মতো সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তবে ওঁরা অনেক দূরের গ্রহ। অনেকের মতো আমারও প্রেরণা।”
একেই রোজগার নেই৷ তার উপর একটানা লকডাউনে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে সব।
নির্বাচনের আগে বিক্রিও কম। কথাবার্তার ফাঁকেই ক্রেতা সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পুণ্য। হেসে বললেন, “আমার স্ত্রী রেখার ছিল দুরারোগ্য কিডনির অসুখ। টাকার জন্য ভাল করে চিকিৎসা করাতে পারছিলাম না। গত বছর আগস্ট মাসে আচমকা অসুখ বাড়ল। তখন তো ভরা লকডাউন। একে টাকা নেই, তার উপর লকডাউন। চিকিৎসাই হল না ঠিক করে। ও চলে গেল। এখন আরও একা হয়ে গিয়েছি। সেই একাকীত্বের হাত ধরছে খাতা-কলম।” বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় ভিড় বাড়ছে। পথচলতি দু-একজন উঁকি দিচ্ছেন পুরনো বইগুলোর দিকে। কলকাতার ব্যস্ত ফুটপাথে ফের বই বেচতে শুরু করলেন লেখক, গবেষক, সাহিত্যকর্মী পূর্ণেন্দু ঘোষ।
ফুটপাথে বই বিক্রি করে লেখালিখি চালাতে সমস্যা হয় না? প্রশ্নটাকে হেসে উড়িয়ে দিলেন পুণ্যবাবু। “কীসের সমস্যা! আমি তো নাম, যশ কিছুই চাই না। লিখে শান্তি পেতে চাই শুধু। সেটা ঠিক পেয়ে যাই। এই যে সারাদিনের পরিশ্রম, অপমান, ক্লান্তি – সব ভুলিয়ে দেয় লেখা।” স্ত্রীর চলে যাওয়া অনেকখানি ভেঙে দিয়েছে মানুষটিকে। বলছিলেন, “ও ছিল আমার প্রথম শ্রোতা। সব লেখাই প্রথম ওকে পড়ে শোনাতাম। ওর ভাল লাগলেই আমি শান্তি পেতাম৷ এখনো লিখি। রোজ লিখি। কিন্তু কাকে শোনাব বলুন তো?”
ছবি ঋণ : সুন্দরবনের ছবি Wikimedia থেকে। পূর্ণেন্দু ঘোষের ছবি নিজস্ব।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।