রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন বেহালা বাজাচ্ছিলেন – এ কথা খুবই প্রচলিত। উইলিয়ম শেক্সপিয়র অবশ্য অন্য আরেকটা বাজনার কথা লিখেছেন। কিন্তু সে বিতর্ক থাক। কথা হল, বাজনদার হওয়া ছাড়াও নিরোর নানারকম গুণ ছিল। যেমন তিনি নিজের বাগানে অতিথিদের জন্যে এলাহি নৈশ পার্টির আয়োজন করতেন। সে পার্টির আলোর ব্যবস্থা করা হত অভিনব কায়দায়। কিছু অসহায় লোককে আলকাতরায় চুবিয়ে কাঠের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হত, তারপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হত। জ্যান্ত মানুষগুলো পুড়ত আর আলোয় আলো হয়ে উঠত নিরোর বাগান। সেসব কয়েক হাজার বছর আগেকার কথা। তখনকার মানুষ এখনকার তুলনায় অসভ্য ছিল – এই বলে নিরোর অতিথিদের মাফ করে দেওয়া যেতে পারে হয়ত। কিন্তু আমাদের মাফ করা হবে কোন অজুহাতে? আমাদের যুগেও তো আনন্দের আয়োজনগুলো, বিশেষ করে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ আখ্যা দেওয়া হয় যে মোচ্ছবগুলোকে, সেগুলো নিরোর পার্টির মতই বহু মানুষের জীবন, জীবিকা, স্বাধীনতার বিনিময়ে আয়োজিত হচ্ছে। কলকাতায় অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপ হলে বস্তি উচ্ছেদ হয়, আমেদাবাদে ডোনাল্ড ট্রাম্প এলে গরীব মানুষগুলোকে লুকিয়ে ফেলতে উঁচু পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়। কাতারে আজ থেকে যে বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে তার আয়োজন করতে যা যা করা হয়েছে সেসবও তো গোপন নেই। তবু তো আমরা মেতে উঠব, তাই না?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
কী হয়েছে জানেন না বলছেন? তা না জানতেও পারেন। কারণ এ যুগের নিরোরা সভ্য মানুষ। তাঁরা অমন বুক ফুলিয়ে অতিথিদের দেখিয়ে দেখিয়ে ওসব করেন না। অতিথিদের নজর যাতে কেবল ভাল ভাল জিনিসে পড়ে তার বন্দোবস্ত করার জন্য গাদাগুচ্ছের সংবাদমাধ্যমও আছে। তারা আর কতটুকু জানতে দেয় এসব? তবে বিদেশি সংবাদমাধ্যম এসে পড়লে হাটে হাঁড়ি ভেঙে যায় অনেক সময়। তাই একবার বলে দিই যতটুকু জানা গেছে।
কাতারের রাজপরিবার এবং ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বলেছেন ২০১০ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত নির্মাণকাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন মোটে তিনজন শ্রমিক। কিন্তু ফেয়ার স্কোয়ার নামের মানবাধিকার সংগঠন বলেছে ওই সংখ্যাটা নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তাদের সুপ্রিম কমিটির বক্তব্য, আরও ৩৬ জন বিভিন্ন নির্মাণস্থলে দিনের কাজ শেষ করার খানিকক্ষণ পরেই মারা গেছেন। কিন্তু কাতার সরকার এবং ফিফা তাঁদের হিসাবের মধ্যে রাখেনি, বলে দিয়েছে ওগুলো “প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু”। অবশ্য এ-ও হিমশৈলের চূড়া। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নামে যে বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার সংস্থা আছে, তাদের বিশ্বাস করলে বলতে হয় আসলে কয়েক হাজার শ্রমিক মারা গেছেন গত ১২ বছরে।
বিশ্বকাপ আরম্ভের দিন সকালে মেসি, নেইমার, রোনাল্ডো, এমবাপে, লেওয়ানডস্কিদের নিয়ে সুস্বাদু লেখা উপহার দেওয়ার বদলে তেতো সত্যের ঝাঁপি খুলে বসার জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। মৃত শ্রমিকদের কথা না তুলে পারলাম না। তার কারণ ইংল্যান্ডের দ্য গার্ডিয়ান কাগজের তদন্তমূলক প্রতিবেদনে বছর খানেক আগেই উঠে এসেছে এই তথ্য, যে স্রেফ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কারই ৬,৫০০ প্রবাসী শ্রমিক মারা গেছেন কাতারের আনন্দযজ্ঞে। সবে বছর দুয়েক হল, নিজের দেশের রাজপথ দিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের হাজার হাজার মাইল হেঁটে যেতে দেখেছি নিরম্বু উপবাসে। হাঁটতে হাঁটতে মরে যেতে দেখেছি, ক্লান্ত হয়ে রেললাইনের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ট্রেনের চাকায় পিষে যেতে দেখেছি। সে স্মৃতি টাটকা থাকতেও বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার উত্তেজনায় প্রবাসী শ্রমিকদের দুরবস্থা কী করে ভুলে যাই বলুন?
তবে হ্যাঁ, যত শ্রমিকেরই মৃত্যু হয়ে থাক আর যত শ্রমিকই কাতারের অতি দুর্বল শ্রম আইনের সুযোগে চরম শোষিত হয়ে থাকুন (অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে সংখ্যাটা এক লক্ষের বেশি), দেখার মত একটা জিনিস যে দেখা যাবে আগামী একমাস, তাতে সন্দেহ নেই। অনেক শ্রমিক বলেছেন তাঁদের দিয়ে দিনে ১৪-১৮ ঘন্টা কাজ করানো হয়েছে। এত পরিশ্রম কি আর বৃথা যাবে? শুধু কাতারকে দোষ দিয়ে অবশ্য লাভ নেই। এমন নয় যে কেবল একখানা জমকালো বিশ্বকাপ আয়োজন করতে হবে বলেই তারা হঠাৎ শ্রমিকদের এভাবে নিংড়ে নেওয়া শুরু করেছে। দুনিয়াসুদ্ধ লোকের জানা ছিল কাতারে নিয়মকানুন সর্বনেশে। ফিফার সদস্যরা সব জেনেশুনেই তাদের বিশ্বকাপ আয়োজনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। কিসের বিনিময়ে তাঁদের এহেন বদান্যতা সে আবার আরেক কাহিনি।
আপনি বলতেই পারেন, এসব রাজনীতির কথা, ফুটবল কোথায়? কিন্তু মনে রাখবেন, এবারের বিশ্বকাপ থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়া হয়েছে ইউক্রেন আক্রমণ করার জন্যে। সুতরাং আর ফুটবল অরাজনৈতিক, বিশ্বকাপ অরাজনৈতিক – এসব বলার অধিকার ফিফা বা কাতারের নেই। ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন নতুন কাতারে নতুন শ্রম আইন বলবৎ করা এবং মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স সেন্টার তৈরি করানোর জন্য ফিফাকে চাপ দেবে বলে ঘোষণা করেছে। আটটা দলের অধিনায়ক মাঠে নামবেন সমপ্রেমী, তৃতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি বিবিধ লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের সমর্থনে রামধনু রংয়ের ‘ওয়ানলাভ’ আর্মব্যান্ড পরে। বেশকিছু দল কাতারের সমপ্রেমবিরোধী দমনমূলক আইনের প্রতিবাদে ফ্যান জোন করবে না ঠিক করেছে। এছাড়াও বেশ কয়েকজন ফুটবলার ও কোচ বলেছেন কাতারে বিশ্বকাপের আয়োজন করাই উচিত হয়নি। সুতরাং অন্তত এবারের বিশ্বকাপের আর অরাজনৈতিক হয়ে থাকার উপায় নেই। সেকথা বুঝেই বোধহয় ইনফান্তিনো হঠাৎ দারুণ কাতারি, আরব, আফ্রিকান, সমপ্রেমী, প্রতিবন্ধী, প্রবাসী শ্রমিক হয়ে উঠেছেন। এমনকি বলেছেন কাতারের নিন্দে করার আগে ইউরোপের নিজেদের তিন হাজার বছরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। আহা, এমন ভাল ভাল কথা যদি সারা বছর বিশ্বের বড় বড় পুঁজির অধিকারীরা ভাবতেন!
তবে একথা বললে সত্যের অপলাপ হবে যে এই প্রথম এত বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এতখানি রাজনৈতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একনায়কতান্ত্রিক যে কোনো সরকার চিরকাল এরকম প্রতিযোগিতাকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের কাজে লাগায়। রুশ একনায়ক ভ্লাদিমির পুতিন ২০১৮ বিশ্বকাপকে ব্যবহার করেছিলেন, আর্জেন্টিনার একনায়ক হর্হে রাফালে ভিদেলা একইভাবে ব্যবহার করেছিলেন ১৯৭৮ বিশ্বকাপকে, বেনিতো মুসোলিনি ১৯৩৪ বিশ্বকাপকে। কর্তৃত্ববাদী শাসকরা ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে আর্য রক্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে অ্যাডলফ হিটলারকে যেভাবে ল্যাজে গোবরে হতে হয়েছিল জেসি ওয়েন্সের দাপটে, সে ইতিহাস মনে রাখেন না। রাখার দরকার নেই। কারণ মুসোলিনি আর ভিদেলার আমলে যথাক্রমে ইতালি আর আর্জেন্টিনায় ঠিক কী কী ঘটেছিল ইতিহাসে তা স্পষ্ট লেখা থাকলেও ওই দুই বিশ্বকাপে যে ফুটবলাররা খেলেছিলেন, তাঁরা সকলেই যে অংশগ্রহণের জন্য লজ্জিত বা তাঁদের জয় রক্তলাঞ্ছিত মনে করেন তা কিন্তু নয়। কারোর মতে তাঁরা খেলেছিলেন দেশের মানুষের জন্য, দেশের শাসকের জন্য তো নয়। কেউ আবার বলেন মাঠের বাইরে কী ঘটছে সে সম্পর্কে তাঁদের সম্যক ধারণা ছিল না। কিছু ফুটবলার সৎভাবে স্বীকার করেন সবকিছুই জানা ছিল, কিন্তু তাঁরা কী-ই বা করতে পারতেন? এই তিন দলের কেউই যে সম্পূর্ণ ভুল তা বলা চলে না। কারণ খেলোয়াড়দের ক্ষমতার সীমা আছে। বল পায়ে অতিমানবিক দেখতে লাগে বলেই তাঁরা কেউ সত্যি সত্যি অতিমানব নন।
আরো পড়ুন সুরজিৎ সেনগুপ্তের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার বাংলার রাজনীতির বলি
সত্যি কথা বলতে মুসোলিনি আর ভিদেলা আয়োজিত বিশ্বকাপে যা যা ঘটেছিল, তার তুলনায় কাতারে যা হতে চলেছে সেটা বড়জোর নোংরামি। কাতারে অন্তত কোনো স্টেডিয়াম থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে ডিটেনশন ক্যাম্প নেই, আর্জেন্টিনায় কিন্তু ছিল। উপরন্তু মুসোলিনি যেভাবে ফাইনালের রেফারিকে পর্যন্ত চোখ রাঙিয়ে ইতালির বিশ্বকাপ জয় নিশ্চিত করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে, কাতারের রাজার পক্ষে তা করা প্রায় অসম্ভব। কাতার যদি গ্রুপ এ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছয় তাহলেই যথেষ্ট। কারণ তাদের গ্রুপে আছে নেদারল্যান্ডস আর আফ্রিকান সিংহ সেনেগাল। সাদিও মানে শেষ মুহূর্তে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলেও তারা যথেষ্ট শক্তিশালী দল।
গ্যারেথ সাউথগেটের ইংল্যান্ডের পক্ষে গ্রুপ বি মোটেই কঠিন হওয়ার কথা নয়। হ্যারি কেন ও তাঁর দলবল ইতিমধ্যেই ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা দলগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে, কারণ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে (২০১৮) পৌঁছবার পরের ইউরোতেই (২০২০) ফাইনাল খেলার বিরল কৃতিত্ব এই দল অর্জন করেছে। তবে ১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ড দলের বিশ্বজয়ের কৃতিত্ব এখনো অধরা। এফ এ-র সঙ্গে সাউথগেটের চুক্তির মেয়াদ ২০২৪ পর্যন্ত। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন, যে জানা আছে এবার ট্রফি জিততে না পারলে ওই চুক্তি কাজে আসবে না। গত কয়েক বছরে ক্রমাগত উন্নতি করে চলা এই দলটা কেনই বা গ্যারেথ বেলের ওয়েলস, নড়বড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইরানকে নিয়ে চিন্তিত হতে যাবে?
একই কথা প্রযোজ্য গ্রুপ সি-র আর্জেন্টিনার জন্য। এমনকি দিয়েগো মারাদোনার খেলোয়াড় জীবনেও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ অভিযান শুরু হত অস্থিরভাবে। এই প্রথম ওই বিরল প্রতিভার মানুষটি না থাকবেন ড্রেসিংরুমে, না থাকবেন শিশুসুলভ উদ্দীপনা নিয়ে সমর্থক হিসাবে গ্যালারিতে। অনেকদিন পরে এবার আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ খেলতে নামছে ফেভারিটদের মধ্যেও ফেভারিট হিসাবে, যদিও লায়োনেল মেসি সেকথা মানতে চাইছেন না এখনো। কদিন আগেই তিনি দাবি করেছেন আর্জেন্টিনা মোটেই ফেভারিট নয়। কথাটা নিঃসন্দেহে দলের উপর চাপ তৈরি হতে না দেওয়ার জন্য বলা। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত একটা দল যদি ফেভারিট না হয় তাহলে শব্দটার মানে কী? এবারের বিশ্বকাপ মেসির জন্যে শেষ সুযোগ। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে যতরকম খেতাব জেতা সম্ভব প্রায় সবই জিতে ফেলেছেন একাধিকবার, বিশ্বের সর্বকালের সেরাদের মধ্যেও তাঁর নাম লিখে ফেলেছেন অগণিত মানুষ। তবুও মারাদোনা নামক একটা দেওয়ালের সামনে এসে বারবার থমকে দাঁড়াতে হয়েছে মেসিকে। আর্জেন্টিনার সমর্থকরা এবং সারা পৃথিবীর সমালোচকরা বারবার বলে এসেছেন, বার্সেলোনার মেসি আর আর্জেন্টিনার মেসি এক নয়। তিনি নীল-সাদা জার্সিতে তো কিছুই জেতেননি। মারাদোনা প্রয়াত হলেন ২০২০ সালে, আর পরের বছরই মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকা জিতে ফেললেন। এবার তাঁর সামনে মারাদোনার ১৯৮৬ সালের কীর্তি ছুঁয়ে ফেলার সুযোগ। মারাদোনা অবশ্য প্রায় একা হাতে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন ভরা যৌবনে, মেসি এখনই ৩৫। ইতিমধ্যেই বার্সেলোনা ছেড়ে তাঁকে প্যারিস সাঁ জা-য় সরে যেতে হয়েছে, ২০২৬ সালে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা-মেক্সিকোর বিশ্বকাপে মেসি মাঠে নামার অবস্থায় থাকেন, তাহলেও বিশ্বকাপ জেতার অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাছাড়া এত শক্তিশালী দলই বা প্রতি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা পাবে কোথায়? সাধারণত আর্জেন্টিনা গোল করেও নিশ্চিন্ত হতে পারে না। কিন্তু এবার লায়োনেল স্ক্যালোনির দলে অন্তত একজন ক্রিস্টিয়ান রোমেরো আছেন রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকায়।
গ্রুপ ডি-র প্রথম স্থানের লড়াইটা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স আর বিপজ্জনক ডেনমার্কের মধ্যেই থাকার কথা, যদি না অস্ট্রেলিয়া কোনো চমক দেয়। এই নিয়ে পরপর পাঁচটা বিশ্বকাপ খেলবে তারা, কিন্তু এবারের বিশ্বকাপটা আরেকটু হলেই ফসকে যাচ্ছিল। শেষমেশ আন্তঃমহাদেশিয় প্লে অফে পেরুকে হারিয়ে কাতারে পৌঁছতে হয়েছে। ইউরো ২০২০-তে ডেনমার্ক সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল। সেইসময় মাঠেই অসুস্থ হয়ে পড়া ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন নিজের ফর্ম ফিরে পেয়েছেন, সম্প্রতি ফ্রান্সকে ডেনমার্ক দুবার হারিয়েছেও বটে। তবু দিদিয়ের দেশঁর ছেলেরা বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দল। পল পোগবা আর এনগোলো কান্তে অবশ্য মাঝমাঠে থাকছেন না, কিন্তু গত বিশ্বকাপের বিস্ময়বালক কিলিয়ান এমবাপে এখন ২৩ বছরের ভয়ঙ্কর গোলশিকারী। সঙ্গে থাকার কথা ছিল করিম বেনজেমার। কিন্তু তিনি আবার উরুর চোটে ছিটকে গেলেন গতকাল। ফ্রান্সের গোলে অবশ্য নির্ভরযোগ্য উগো লরিস থাকছেন।
গ্রুপ ই থেকে যে দুই দলের দ্বিতীয় রাউন্ডে না ওঠাই অঘটন হবে, সেই স্পেন আর জার্মানির বেশ মিল আছে। দুটো দলই প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, কিন্তু বেশ কিছুদিন কোনো ট্রফি জিততে পারেনি। জার্মান ফুটবল ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ সময় গত চারটে বছর। রাশিয়া বিশ্বকাপে গ্রুপ থেকেই তাদের বিদায় সকলকে চমকে দিয়েছিল। তারপর ইউরো ২০২০-তেও তারা দ্বিতীয় রাউন্ডের গন্ডি টপকাতে পারেনি। কিন্তু হান্সি ফ্লিকের দলে আবার একগুচ্ছ পৃথিবীর প্রথম সারির ফুটবলার এসে গেছেন। গোল করার জন্য সার্জিও ন্যাব্রি, লেরয় সেন, কাই হ্যাভের্তজ, টিমো ওয়ার্নারের পরেও আছেন ৩৩ বছরের থমাস মুলার। পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। ম্যানুয়েল নয়ারকেও ভুলে গেলে চলবে না, তিনি তো শুধুই গোলরক্ষক নন।
লুই এনরিকের স্পেনেও প্রতিভাবান আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের ছড়াছড়ি। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তারকা এই মুহূর্তে পেদ্রি, যাঁর বয়স মাত্র ১৯, বিশ্বকাপ চলাকালীন কুড়িতে পা দেবেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই বার্সেলোনার জার্সি গায়ে প্রায় ১০০ ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে। বার্সেলোনার আরেক তরুণ আনসু ফাতিকে নিয়েও অনেকের বিরাট আশা। ফিট থাকলে তিনি একাই বিশ্বকাপ মাতিয়ে দিতে পারেন বলে কারো কারো ধারণা। ইউরো ২০২০-তে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়া স্পেন বিশ্বকাপের যোগ্যতার্জন পর্ব পেরিয়ে এসেছে বেশ অনায়াসেই। তবে পেদ্রি, ফাতিদের করা গোল এনরিকের রক্ষণ ধরে রাখতে পারবে কিনা সেটাই বড় কথা। বটবৃক্ষের মত সার্জিও বুস্কেৎস অবশ্য থাকবেন ওই তরুণদের পিছনে।
গত বিশ্বকাপের রানার্স আপ ক্রোয়েশিয়ার জন্য গ্রুপ এফ সহজ হওয়ার কথা। কারণ এই গ্রুপে তাদের চ্যালেঞ্জ করার মত দল একমাত্র বেলজিয়াম, যাদের কেবলই শক্তিক্ষয় হয়েছে গত চার বছরে। অন্যদিকে জ্লাটকো ডেলিচের অধীন ক্রোয়েশিয়ার ক্রমোন্নতি হয়েছে। ২০১৮ বিশ্বকাপের বেলজিয়াম দলকে বলা হয়েছিল সোনালি প্রজন্ম। সেই প্রজন্ম প্রায় শেষ। ভিনসেন্ট কম্পানি অবসর নিয়েছেন, রোমেলু লুকাকু আগের মত বিপজ্জনক নেই আর ইডেন হ্যাজার্ডের চোটে জর্জরিত সময় কেটেছে রিয়াল মাদ্রিদে। এখনো প্রথম দলে নিয়মিত নন। একমাত্র কেভিন ডি ব্রুইন আর গোলরক্ষক থিবাউ কুতোয়া আগের বিশ্বকাপের ফর্মেই আছেন বলা যায়।
গ্রুপ জি-র ক্যামেরুন উচ্চাকাঙ্ক্ষী দল। রিগোবার্ট সংয়ের ছেলেরা যখন মার্চ মাসে আলজেরিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপের ছাড়পত্র আদায় করলেন, তখন ক্যামেরুনের কিংবদন্তি প্রাক্তন ফুটবলার স্যামুয়েল এটোয়ো দলকে বলেছিলেন “আমরা কাতারে যাব বিশ্বকাপ জিততে।” স্বপ্ন সবসময় বড় করে দেখাই ভাল। কিন্তু এটোয়োর স্বপ্ন সফল করতে ক্যামেরুনকে প্রথম রাউন্ডেই সার্বিয়া আর সুইটজারল্যান্ডের মত শক্ত বাধা ডিঙোতে হবে। দ্রাগান স্তোইকোভিচের অধীনে সার্বিয়া শুধু জিততে চায় না, অনেক গোল করতে চায়। তাদের হারানো মোটেই সহজ নয়। কিন্তু দল হিসাবে আরও জমাট মুরাত ইয়াকিনের সুইটজারল্যান্ড, যাদের প্রাণভোমরা গ্রানিৎ ঝাকা। এই দল ইউরোর দ্বিতীয় রাউন্ডে ফ্রান্সকে ১-৩ পিছিয়ে পড়েও শুটআউটে হারিয়েছিল, কোয়ার্টার ফাইনালেও স্পেনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল পেনাল্টি শুটআউট অব্দি।
এমন একটা গ্রুপ হয়ত তিতের ব্রাজিলের পক্ষেও নেহাত সহজ হবে না, যদিও পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা এই গ্রুপ থেকে প্রথম হয়ে উঠবে বলেই সকলে আশা করবে। মেসির মত নেইমারও এবার যে দলে খেলবেন তাঁর খেলোয়াড় জীবনে সেটাই সম্ভবত ব্রাজিলের সবচেয়ে শক্তিশালী দল। রাফিনিয়া, রিচার্লিসন, লুকাস পাকেতা – নেইমার ছাড়াও তিতের হাতে গোল করার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য এতজন হাজির। তার উপর মাঝমাঠে আছেন ক্যাসেমিরো আর রক্ষণভাগে বর্ষীয়ান থিয়াগো সিলভা। কার তাতে কী, তিতে যদি ষষ্ঠ খেতাবের স্বপ্ন দেখেন?
ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোরও এটাই শেষ বিশ্বকাপ। পিয়ার্স মর্গানের সঙ্গে যে সাক্ষাৎকারের জন্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাঁকে ক্লাব থেকে তাড়াতে চলেছে বলে খবর, সেখানেই তিনি জানিয়েছেন আর ২-৩ বছর খেলে চল্লিশে অবসর নিতে চান। সেক্ষেত্রে বিশ্বকাপের মুখে অমন একখানা সাক্ষাৎকার কেন দিতে গেলেন তা বিস্ময়কর। এমনিতেই পর্তুগাল পড়েছে শক্ত গ্রুপে। গ্রুপ এইচে তাদের প্রতিপক্ষ ঘানা, উরুগুয়ে আর দক্ষিণ কোরিয়া। ঘানা অবশ্য শেষ ১২ ম্যাচের মাত্র দুটো জিতেছে, কিন্তু হেড কোচ ওটো অ্যাডো যথার্থই বলেছেন, ঘানা হল বড় প্রতিযোগিতার দল। তারা ২০১০ সালে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের স্বাদ পেয়ে গেছে। ফলে তাদের হালকাভাবে নেওয়া যায় না। আবার উরুগুয়ে শুধু যে দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন (যদিও বহুকাল আগে – ১৯৩০, ১৯৫০) তা নয়, এবারে তাদের দল যথেষ্ট শক্তিশালী। লুই সুয়ারেজ আর এডিনসন কাভানি তো আছেন বটেই, আছেন দিয়েগো গোদিন। এঁদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে থাকবে রিয়াল মাদ্রিদের ফেদেরিকো ভ্যালভের্দের তারুণ্যের দীপ্তি। কোচ দিয়েগো আলোনসোর বিশ্বাস এই দল তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জিততে পারে। সে বিশ্বাসের শক্ত পরীক্ষা গ্রুপেই হয়ে যাবে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত এই গ্রুপে আছে দক্ষিণ কোরিয়া – এশিয়ার সবচেয়ে ধারাবাহিক দল। এমনকি ব্রাজিল, জার্মানি, আর্জেন্টিনা আর স্পেনকে বাদ দিলে একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়াই টানা দশটা বিশ্বকাপ খেলতে চলেছে। তাদেরও বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। টটেনহ্যামের সন হিউং-মিন সুস্থ থাকলে এবং ফিট থাকলে কোরিয়াও বেগ দিতে পারে।
এমতাবস্থায় রোনাল্ডো ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ফর্ম হারিয়ে বসলেন, একটা ম্যাচের মধ্যেই মাঠ ছেড়ে চলে গেলেন, বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে বললেন ইউনাইটেড ম্যানেজার এরিক টেন হ্যাগকে মোটেই শ্রদ্ধা করেন না। ওই ক্লাব এবং ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ফুটবলার ওয়েন রুনিকে অকারণেই ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসলেন। পর্তুগালের আর যে ফুটবলার যেমনই খেলুন না কেন, বলাই বাহুল্য রোনাল্ডো স্বমহিমায় না থাকলে ২০১৬ ইউরো জয় আর ২০১৯ উয়েফা নেশনস লিগ জয় সম্ভব হত না।
পাঠক, আপনি যদি পর্তুগালের ভক্ত হন, তাহলে রোনাল্ডোর জন্য প্রার্থনা করুন। যদি অন্য কোনো দলের সমর্থক হন তাহলে তাদের জন্য প্রার্থনা করুন। কিন্তু বিনীত অনুরোধ, সঙ্গে কাতারের মৃত এবং অত্যাচারিত মানুষের জন্যও প্রার্থনা করুন। প্রার্থনায় কিছু হয় না, কিন্তু এছাড়া আর কী-ই বা করতে পারবেন? আমরা সকলেই তো নিরোর অতিথি হয়ে গেছি, কেউ বাদ নেই। কারণ আজ বিশ্বজুড়ে অনেক নিরো।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
[…] নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত […]