আফতাব আমীন পুনাওয়ালা আর শ্রদ্ধা ওয়ালকর এই মুহূর্তে ভারতের সংবাদমাধ্যম তথা সামাজিক পরিসরে বহুচর্চিত নাম। রাতারাতি তাদের খবরের শিরোনামে উঠে আসার পিছনে যে শিহরণ জাগানো ঘৃণ্য অপরাধের ঘটনাটি রয়েছে, তা আজ কারোর অজানা নয়। তিন বছর লিভ-ইন সম্পর্কে থাকার পরে, শ্রদ্ধাকে নির্মম ভাবে খুন করে তার দেহ খণ্ড খণ্ড করে জঙ্গলে ফেলে এসে দুষ্কর্ম চাপা দেওয়ার অভিযোগ আফতাবের বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত আফতাব পুলিস হেফাজতে, তদন্ত চলছে এবং আশা করব সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকারী যেন যথাযথ শাস্তি পায়।
কিন্তু আফতাব-শ্রদ্ধার বিষয়টি কেবল একটি নৃশংস খুনের অপরাধের পরিসরেই সীমিত নয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেমন শুরু হয়েছে সংবাদমাধ্যমের বিচারসভা, তেমনি সমাজে শুরু হয়েছে অধুনা নিয়মিত ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রচার আর মহিলাদের ‘আদর্শ’ জীবনযাপন কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। বলাই বাহুল্য, এসব আলোচনার আঁতুড়ঘর আমাদেরই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা। নীতিশিক্ষা দিচ্ছে সেই সমাজ, যা অপরাধের চেয়েও অপরাধীর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বেশি উত্তেজিত। সেই সমাজ যে ‘অবাধ্য’ মেয়েদের চোখ রাঙিয়ে, মুচকি হেসে বলে – শিকল ছেঁড়ার পরিণতি এমনই হয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সোশাল মিডিয়া পোস্ট দেখলেই বোঝা যায়, কীভাবে এক বীভৎস অপরাধের ঘটনার বিচার-ব্যাখ্যা করে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজ। আফতাবের কথায় পরে আসছি, কিন্তু সমাজের বিচারে শ্রদ্ধার অপরাধই কি কিছু কম? শ্রদ্ধা স্বাধীনচেতা নারী, নিজের চেষ্টায় ও যোগ্যতায় উপার্জনশীল, নিজের ভাল লাগা-ভালবাসা নিয়ে অকুতোভয়। সে যেমন একা একা দুনিয়া দেখতে বেরিয়ে পড়ে, তেমনি সামাজিক শাসনের তোয়াক্কা না করে বিধর্মী পুরুষের প্রেমেও পড়ে। সেই প্রেমের জন্য পরিবারের কাছে সে জবাবদিহিও করে না। বরং লিভ-ইন সম্পর্কে থাকার সাহস দেখায় এবং দুজনের সংসার গড়ে তোলার জন্য এক শহর ছেড়ে অন্য শহরে এসে বাসাও বাঁধে। শ্রদ্ধা নিজের জীবনে এক নিঃশব্দ বিপ্লবের সূচনা করেছিল। সে প্রথাগত জীবনযাত্রাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, জেদ ছিল স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে সুখী হওয়ার।
আর আফতাব! যতটা সংবাদমাধ্যম থেকে দেখে বা পড়ে মনে হয়, সে একজন ‘আধুনিক’ তরুণ। ধর্মীয় গোঁড়ামি নেই কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ষোল আনা। নারী তার কাছে হয় অধিকার করে রাখার বস্তু, নয়ত নেহাতই ভোগ্য বস্তু। নানা প্রতিবেদনে উঠে আসছে, কীভাবে সে অকারণে বা তুচ্ছ কারণে গার্হস্থ্য হিংসার পথ বেছে নিত, কীভাবে শ্রদ্ধার উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছে। আবার রাগ কমে গেলে নানা উপায়ে সেই শ্রদ্ধাকেই কীভাবে এক বিষিয়ে ওঠা সম্পর্কে আটকে রেখেছে। হয়ত ভালবাসাও ছিল, কিন্তু খবর পড়ে মনে হয় তার থেকেও বড় ছিল অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং পুরুষত্বের অহঙ্কার। খবর থেকেই আমরা আরও জানতে পারছি, কীভাবে শ্রদ্ধার খণ্ড খণ্ড মৃতদেহ ঘরে রেখেও, সেই ঘরেই ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া নতুন বান্ধবীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় সে গল্পগুজব করেছে। এ থেকে নারী সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে আর বাকি থাকে না।
কিন্তু কেন এমন হয়? আফতাবের কেসটি নিশ্চয়ই মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হতে পারে। কিন্তু বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটের আঙ্গিকেই তাকে বুঝতে হবে। আফতাব তো প্রথম নয়, এই ধরনের নৃশংস ঘটনা দিল্লি থেকে দেরাদুন – আগেও বেশ কয়েকবার ঘটেছে। কাজেই বোঝা দরকার এই সমস্যার সামাজিক শিকড় কোথায়।
আফতাব ও শ্রদ্ধা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দুই নরনারী, যে সমাজ নারীকে শৈশবে পিতার অধীনে, যৌবনে স্বামীর অধীনে এবং শেষ বয়সে পুত্রের অধীনে থাকার ফতোয়া দিয়ে রেখেছে অনন্তকাল ধরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ত এই নিয়ন্ত্রণের বাহ্যিক চেহারার বদল হয়েছে, কিন্তু ভিতরের দৃষ্টিকোণ পালটায়নি। সেই কারণেই শ্রদ্ধার পরিবার একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের মতামত মেনে নিতে পারে না, তাকে পরিবার থেকে বহিষ্কার করে। সেই কারণেই আফতাবও হয়ত মনে করে একা হয়ে যাওয়া শ্রদ্ধার উপর ধারাবাহিক নির্যাতন চালানো যায়। এই সমাজে শ্রদ্ধা আফতাবের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে যেত কোথায়?
যাঁরা আজ প্রশ্ন তুলছেন, শ্রদ্ধার মতন স্বাধীনচেতা, স্বাবলম্বী মেয়ে কেন এমন এক বিষময় সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না, তাঁদের বোঝা উচিত, বাস্তবজগত শ্রদ্ধার মত মেয়েদের জন্য কতখানি কঠিন। শ্রদ্ধা হয়ত যে কোনো মূল্যে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে তার সব বিদ্রোহী সিদ্ধান্তই ছিল সঠিক। সংসার ভেঙে বেরিয়ে আসা মানে তো সেই মানুষগুলোকে ঠিক প্রমাণ করা, যারা বারবার নিষেধের বেড়াজালে মেয়েদের বেঁধে রাখে, যারা শ্রদ্ধাকেও নিষেধ করেছিল গতানুগতিক রীতিনীতির বাইরে পা না ফেলতে। “মেয়েদের এত সাহস ভালো না”। শ্রদ্ধা হয়ত তাদের কাছে হেরে যেতে চায়নি। তাছাড়া হয়ত সে নিজেও শেষপর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিকতার উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। সে কিছু প্রথা ভেঙেছিল, আর প্রথা ভাঙার পথে শ্রদ্ধাই তো প্রথম নয়। অনেকেই ব্যক্তিজীবনে প্রথা ভাঙেন, কিন্তু বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটকে চ্যালেঞ্জ করেন কজন? শ্রদ্ধাও করেনি। সেও মানিয়ে নিচ্ছিল, মার খেয়েও আফতাবের সঙ্গেই থাকছিল, তাকেই বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছিল।
শ্রদ্ধার মনের গণ্ডিও সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হাতেই কাটা। সেই গণ্ডির ভিতরেই ছিল তার ছোট ছোট বিদ্রোহ, গণ্ডিকে অস্বীকার করতে সেও পারেনি। সেটাই তো স্বাভাবিক। আজও গার্হস্থ্য হিংসার শিকার বহু মহিলা হিংসার ঘটনাগুলো নিজেরাই লুকিয়ে রাখেন। ডাক্তারখানায় চিকিৎসা করাতে গিয়েও সত্যের বদলে কল্পিত দুর্ঘটনার কথা বলেন। কারণ এঁরা সবাই এড়িয়ে যেতে চান সামাজিক আলোচনা, টীকাটিপ্পনী আর বিচার। কারণ এঁরা জানেন, শেষ বিচারে এই সমাজে মহিলাদেরই সব সমস্যার জন্য দায়ী করা হয়েছে, করা হবে। এই পুরুষতন্ত্রের চাপ থেকে শ্রদ্ধা যদি চটজলদি বেরিয়ে আসতে না পেরে থাকে, তাকে কি খুব দোষ দেওয়া যায়?
আরো পড়ুন যে সমাজে না বলা বারণ, সেখানে বহরমপুর অনিবার্য
আফতাব যে ধর্মেরই হোক, সে পুরুষ। এটি আমাদের সমাজে এক বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থান। সে যে ঘৃণ্য অপরাধে অভিযুক্ত, আগেই বলেছি সেটিও দেশের অপরাধের ইতিহাসে প্রথম নয়। প্রায় একইরকম অপরাধের নিদর্শন দেশের নানা অংশে ছড়িয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রে বিচারবিভাগীয় দীর্ঘসূত্রতায় মামলা চলছে বছরের পর বছর। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যখনই মেয়েরা প্রতিবাদী হয়েছে তখনই সমাজ তার উপরে খড়গহস্ত হয়েছে। এ দেশেই তো অনার কিলিংয়ের বহু উদাহরণ আছে। আছে বধূহত্যার শত সহস্র মামলা। আইন করেও মহিলাদের সমানাধিকার, সমমর্যাদা, সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়নি। শুধুমাত্র আইনের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন আসে না। তার জন্য দরকার সামাজিক সংস্কার, সামাজিক আন্দোলন। বর্তমানে সেসব সুদূরপরাহত। বরং যেখানে মূল সমস্যা লিঙ্গভিত্তিক হিংসা, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এবং যে প্রসঙ্গে আলোচনা হওয়া উচিত নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত তা নিয়ে; সেখানে মূলধারার মিডিয়া থেকে সোশাল মিডিয়া পর্যন্ত সমালোচনা হচ্ছে হয় শ্রদ্ধার ‘অবাধ্যতার’, নয় সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে আসার অক্ষমতার। উপরন্তু অভিযুক্তের ধর্মীয় পরিচয়ের অজুহাতে প্রচারিত হচ্ছে মুসলমানবিদ্বেষ। আমাদের অসুস্থ সমাজ একজন অপরাধী এবং তার শিকারকে প্রায় একইভাবে, সামাজিক প্রথাকে স্বল্প পরিসরেও লঙ্ঘন করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে চলেছে – এর চেয়ে বড় বিড়ম্বনা আর কী? অবশ্য আদ্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছ থেকে এর বেশি আর কী-ই বা আশা করা যায়?
শ্রদ্ধা কাণ্ডে অভিযুক্ত আফতাবের অপরাধ প্রমাণিত হলে দেশের আইন তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে – এই প্রতীক্ষা। যে সমাজ আফতাবদের তৈরি করে (ধর্ম নির্বিশেষে), যে সমাজ শ্রদ্ধাদের অসহায়তার চরম সীমায় ঠেলে দেয় – সেই সমাজ, সেই পুরুষতান্ত্রিকতা, সেই সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের বিধান কে ঠিক করবে? কারণ সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত না করলে, আগামীদিনে আরও অনেক শ্রদ্ধা নিজের মত করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হবে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।