সদ্যপ্রয়াত সুভাষ ভৌমিক নিজের ফুটবল জীবন নিয়ে বলতে গেলে একটা কথা প্রায়ই উল্লেখ করতেন। ১৯৭৩ সালটা তাঁর দীর্ঘ ফুটবল কেরিয়ারের শ্রেষ্ঠ সময়, কলকাতা লিগ থেকে শুরু করে পুরো মরসুম জুড়ে তিনি তখন মাঠ কাঁপাচ্ছেন, তাঁর পায়ে বল পড়লেই সেই বল শেষ অবধি কুড়িয়ে আনতে হবে বিপক্ষের জাল থেকে — এমন একটা ধারণা ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মনে দৃঢ থেকে দৃঢতর হচ্ছে। অথচ বহু বছর বাদে পিছন ফিরে দেখতে গিয়ে সুভাষের বারবার মনে হয়েছে, এই ১৯৭৩ সালেই তিনি বুঝি সবচেয়ে বড় বঞ্চনার শিকার।
আসলে কারণটা বলা যাক। ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে সুভাষ তখন কার্যত অপ্রতিরোধ্য, তিনি মাঠে পা রাখা মাত্র বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে যায়। নিজের উপর সুভাষের তখন প্রবল আস্থা। তাঁর ক্রমশ ধারণা হচ্ছিল শুধু ইস্টবেঙ্গলের হয়ে নয়, দেশের জার্সি পরেও সেই একই ছন্দে ফুটবল খেলতে তিনি সম্পূর্ণ পারঙ্গম, প্রতিপক্ষ যতই প্রবল হোক না কেন, সুভাষ ভৌমিককে আটকাতে হিমসিম খেতে হবে তাদের।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আক্ষেপ করে সুভাষ বলেছিলেন, “কিন্তু আমার যাবতীয় মানসিক প্রস্তুতি স্রেফ জলে গেল। ঘোষণা করা হল ভারত সে বছর মারদেকা টুর্নামেন্ট খেলতে যাবে না। তখন সারা বছরে ভারত ওই একটাই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত। ফলত জীবনের সেরা ফর্মে থেকেও আমার দেশের হয়ে খেলা হল না।”
সুভাষের কাছে যা ছিল আফসোস, তাঁরই সতীর্থ অনেক ফুটবলারের কাছে তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল চরম অভিশাপ। সুভাষ ভৌমিক তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায় কিছুটা ভাগ্যবান। তাঁর আন্তর্জাতিক ফুটবল জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৭০ সালে, প্রথম বছরেই তাঁর জেতা হয়ে গিয়েছিল এশিয়ান গেমস পদক, মারদেকায় তৃতীয় স্থান। বাকিদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। তাঁরা যখন জাতীয় দলের যোগ্য হয়ে উঠলেন, ততদিনে ময়দানি ঘুঘু এবং রাজনীতিবিদদের যোগসাজশে কলকাতার ফুটবল পরিণত হয়েছে একটি নিখাদ ক্লাবসর্বস্ব জড়বস্তুতে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭, এই চরম অনাচারের দিনগুলিতে যাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম নাম নিঃসন্দেহে সুরজিৎ সেনগুপ্ত।
সুভাষ চলে যাবার পর একমাসও কাটেনি, প্রয়াত হলেন সত্তর দশকের আর এক দুর্ধর্ষ বাঙালি উইঙ্গার সুরজিৎ। কলকাতা ময়দানের সর্বকালের সেরা শিল্পী ফুটবলারদের অন্যতম, তাঁর পায়ের জাদুতে একসময় মুগ্ধ হয়েছেন দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ ফুটবলপ্রেমী, খেলা ছাড়ার বহু আগেই তিনি পরিণত হয়েছেন এক চলমান কিংবদন্তিতে। কিন্তু তবু বড় দুর্ভাগ্য সুরজিতের — ফুটবল মহলের আনাচে কানাচে তাঁকে নিয়ে আজও শোনা যায় এক পরিচিত গুঞ্জন; সুরজিৎ সেনগুপ্তর যাবতীয় “মস্তানি” ছিল ঘরোয়া ফুটবলেই সীমাবদ্ধ, আন্তর্জাতিক আসরে তাঁকে অধিকাংশ সময় বেশ মলিন দেখিয়েছে।
মাঠের বিচারে কথাটা হয়ত ঠিক, কিন্তু বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে এই ধারণা নিশ্চিতভাবে বেঠিক। দেশের জার্সি পরে সুরজিতের পারফরমেন্স বিচার করতে বসার আগে অবশ্যই জেনে নিতে হবে, নিজের ফুটবল জীবনের সেরা সময়ে কীভাবে প্রতি পদে বাধা পেয়েছেন সুরজিৎ সহ একঝাঁক বাংলার ফুটবলার।
ঘটনার শুরু ১৯৭৩ মরসুমে। সেই ১৯৫৯ সাল থেকে মারদেকায় খেলে আসছে ভারত। প্রতি বছরই মালয়েশিয়ায় এই টুর্নামেন্ট হত অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে, যখন জোরকদমে চলত কলকাতা লিগ। কলকাতা থেকে নির্বাচিত ফুটবলাররা চলে যেতেন দেশের হয়ে খেলতে, ফিরতেন সপ্তাহ দু-তিন বাদে, ততদিন ঢিমেতালে চলত কলকাতার লিগ, তারকা ফুটবলাররা ফিরে এলে আবার জমে উঠত ময়দান। দীর্ঘকাল ধরে এই প্রথা চলে এলেও ১৯৭৩ সালে হঠাৎ বেঁকে বসলেন একদল কর্মকর্তা, যাঁদের উস্কে দিতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়।
দুই বড় ক্লাবের বক্তব্য হল, বাৎসরিক চুক্তিতে টাকা দিয়ে খেলোয়াড় কিনেছি আমরা, দেশের জন্য তাদের ছাড়লে ক্লাবের ক্ষতি হয়ে যাবে, সদস্য-সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হবেন। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছল যে দিল্লি উড়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী (তখন খেলাধুলো ওই মন্ত্রকেরই দায়িত্ব ছিল) নুরুল হাসানকে বোঝালেন, কেন কলকাতার ফুটবলারদের জাতীয় দলের জন্য ছাড়া যাবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের ইঙ্গিতে চুপ করে গেলেন সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের কর্তারাও, কলকাতার ফুটবলার ছাড়াই ভারতীয় দল গঠিত হল। সুরজিৎ, সুভাষ, সুধীর কর্মকার, গৌতম সরকার, হাবিব প্রমুখ তখন অসাধারণ ফর্মে, কিন্তু ক্লাবের হয়ে খেলেই শেষ হয়ে গেল তাঁদের মরসুম।
আসলে ষড়যন্ত্র ছিল আরও অনেক বেশি গভীর। সত্তর দশকের উত্তাল রাজনৈতিক আবর্তে পশ্চিমবাংলা তখন ছিন্নভিন্ন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে তখন নকশাল নিধন যজ্ঞে মেতে উঠেছে রাজ্যের পুলিশ; প্রায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং সিদ্ধার্থশংকর। ১৯৭৩ সালে যাবতীয় গোলযোগ অনেকটাই প্রশমিত, কংগ্রেস সরকারের দাবি অনুযায়ী রাজ্যব্যাপী শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে। রাজ্য সরকারের কৌশল ছিল খুবই সহজ — যুবসমাজকে যেনতেনপ্রকারেণ সরিয়ে রাখতে হবে রাজনীতির মঞ্চ থেকে, আর তার জন্য প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠল ফুটবল। রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী, যিনি আবার একটি বৃহৎ সংবাদপত্র গোষ্ঠীর মালিকও, প্রকাশ্যে বললেন, ফুটবল মরসুমে কলকাতার আইন শৃঙ্খলার প্রভূত উন্নতি হয় প্রতি বছর। তাঁর নিজস্ব সংবাদপত্রে প্রতিদিন লেখা হতে লাগল যত্রতত্র আজেবাজে টুর্নামেন্টে জাতীয় দল পাঠানো শুধু সময় নষ্টের নামান্তর মাত্র। অতএব, বিদায় জাতীয় দল, মোক্ষলাভ হবে ক্লাব ফুটবলেই।
এই ব্যবস্থা চলেছিল টানা পাঁচ বছর, ১৯৭৭ সাল অবধি। সুরজিৎ তখন ক্রমশ হয়ে উঠছেন ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম আইকন, দেশ জুড়ে যেখানেই তিনি খেলছেন, সেখানেই তাঁকে দেখতে ভিড় করছেন দর্শকরা। অথচ জাতীয় দলের হয়ে তাঁকে মোটেই নিয়মিত দেখা যাচ্ছে না।
১৯৭৪ সাল তেহরানে এশিয়ান গেমসের বছর, সেই বছর ফুটবলার ছাড়তেই হল দুই ক্লাবকে। সুযোগ পেয়ে মারদেকায় চমৎকার খেলে যথেষ্ট প্রশংসা কুড়োলেন সুরজিৎ, যদিও কোনো অজ্ঞাত কারণে এশিয়ান গেমসে একটি ম্যাচেও তাঁর প্রথম একাদশে জায়গা হল না। বিশ্রী ফল করে দেশে ফিরল মগন সিং, পিকে বন্দোপাধ্যায়ের ভারত।
১৯৭৫ সালে ঘোষিত হল জরুরি অবস্থা, চরম রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে মারদেকায় গেল না ভারত। ১৯৭৬ সালে মারদেকা, আফগান আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট, সিওলে প্রেসিডেন্টস কাপ — তিনটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিল ভারত, একটিতেও ছাড়া হল না কলকাতার ফুটবলারদের। খলনায়কের যৌথ ভূমিকায় যথাযথ অভিনয় করলেন রাজ্য সরকার এবং ক্লাব কর্তারা। আর একটি পেরেক পোঁতা হল ভারতীয় ফুটবলের কফিনে।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল ১৯৭৭ সালেও। বহু দড়ি টানাটানির পর শুধু একটি টুর্নামেন্টে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল একজন করে ফুটবলার ছাড়তে রাজি হল; তৎকালীন দুই কনিষ্ঠতম ফুটবলার, মানস ভট্টাচার্য ও প্রশান্ত বন্দোপাধ্যায়ের ভাগ্যে জাতীয় দলের শিকে ছিঁড়ল। আবার চাকা ঘুরল সেই ১৯৭৮ সালে এসে। এশিয়ান গেমসের জন্য ফুটবলার ছাড়তেই হল, নির্বাচিত হলেন সুরজিৎ। কিন্তু ততদিনে তাঁর বিধ্বংসী ফর্ম সামান্য হলেও কিছুটা অস্তমিত, যদিও ডুরান্ড কাপ অথবা সন্তোষ ট্রফির মত ঘরোয়া টুর্নামেন্টের ফাইনালে তাঁর চোখধাঁধানো গোল দেখে তখনো আলোড়িত হচ্ছেন হাজার হাজার স্থানীয় দর্শক। এরপর কালের নিয়ম মেনেই জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ে গেলেন সুরজিৎ।
তাই আজ যাঁরা বিজ্ঞের মত মুচকি হেসে বলেন “আরে, এরা আদতে সব ছিল ময়দানি ফুটবলার। বড় জায়গায় গেলে অচিরেই এদের স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়ত”, তাঁরা এই প্রাক্তন ফুটবলারদের প্রতি খুব সুবিচার করেন বলে মনে হয় না। আজ সুরজিৎ চলে যাবার পর এই ফুটবলবোদ্ধারা যদি পিছন ফিরে হিসাব করতে বসেন, তাহলে নির্ঘাত দেখতে পাবেন কীভাবে দিনের পর দিন রীতিমত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জাতীয় দল থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল সত্তর দশকে বাংলার সেরা ফুটবলারদের। নিজেদের শ্রেষ্ঠ সময়ে দেশের হয়ে হাতে গোনা ম্যাচ খেলতে সুযোগ পেয়েছেন তরুণ বসু, গৌতম সরকার, সুরজিতের মত দক্ষ ফুটবলাররা। তাঁদের প্রতিভাই বুঝি তাঁদের শত্রু হয়ে দাঁড়াল। মানুষকে যে প্রবল আনন্দ দিতে তাঁরা মাঠে নেমেছিলেন, তা শেষ অবধি ব্যবহৃত হল ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে। আজ যাঁরা সুরজিতের ফুটবল মেধার সঠিক মূল্যায়ন হল না বলে গলা ফাটাচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশ কিন্তু এতদিন চুপ করে ছিলেন। সঠিক কারণটা প্রকাশ্যে নিয়ে আসবার কোনো উৎসাহ তাঁদের কোনোদিনই ছিল না, আজও নেই। আসলে অভিমন্যু বধের হোতা সপ্তরথীদের শিরস্ত্রাণের আড়ালে যে লুকিয়ে আছে এঁদেরই মুখ।
মতামত ব্যক্তিগত
আরও পড়ুন
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।