যে কোনো বাঙালি ক্রীড়ামোদীকে যদি বলা হয় এমন একজন ক্রীড়াবিদের নাম করতে, যিনি একটির বেশি খেলায় চমকপ্রদ দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন, তাহলে শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রেই উঠে আসবে চুনী গোস্বামীর নাম। কিংবদন্তি এই ফুটবলার ছিলেন ক্রিকেটেও সমান পারদর্শী; রঞ্জি ট্রফিতে বাংলা দলের অধিনায়ক, তাঁর বিধ্বংসী বোলিংয়ে ১৯৬৬-৬৭ মরশুমে ইন্দোরের মাটিতে রীতিমত খাবি খেয়েছিল গ্যারি সোবার্স ও তাঁর দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল — এ গল্প তো আজ রূপকথার অঙ্গ। দ্বিতীয় স্থানে থাকবেন বাংলার ক্রীড়া ইতিহাসের আর এক নায়ক, টেস্ট ওপেনার পঙ্কজ রায়। চশমা পরিহিত এই নামী ক্রিকেটার কিন্তু একটা সময়ে ছিলেন একজন চমৎকার ফুটবলারও, স্পোর্টিং ইউনিয়নের জার্সি গায়ে দিয়ে কলকাতা লিগে প্রচুর গোল করেছেন। ১৯৪৮ সালে যেবার ভারত সফররত শক্তিশালী বার্মা দল কলকাতায় আই এফ এ একাদশের বিরুদ্ধে আটকে গেল ১-১ গোলে, সেবার স্থানীয় দলের একমাত্র গোলটা কিন্তু এসেছিল টেস্ট ক্রিকেটে টানা দশ বছরের বেশি ভারতের হয়ে ওপেন করা এই পঙ্কজ রায়ের পা থেকেই।
কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এঁরাই সব নন, সেই একই সময়ে আমাদের এই কলকাতার মাটিতেই ছিলেন আরও বেশ কয়েকজন, যাঁরা সাফল্যের নিরিখে চুনী-পঙ্কজ থেকে কিছুমাত্র পিছিয়ে ছিলেন না, একটির বেশি খেলায় অবিশ্বাস্য দক্ষতা দেখিয়ে গেছেন নিয়মিত। বুধবার, ৭ই জুলাই, কিছুটা নিঃশব্দেই চলে গেলেন তাঁদেরই একজন, কেশব দত্ত। গত একাত্তর বছর ধরে কলকাতার বাসিন্দা কেশবের বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বর্তমান প্রজন্মের বাঙালির কেশবকে নিয়ে কোনো বিশেষ আবেগ নেই, কিছুটা আবছা জানা আছে পঞ্চাশের দশকে এই পাঞ্জাবি যুবক ছিলেন এক মারকাটারি হকি খেলোয়াড়, ১৯৪৮ ও ১৯৫২ অলিম্পিকে সোনাজয়ী ভারতীয় হকি দলের মাঝমাঠের অন্যতম তারকা। ময়দানের সঙ্গে যাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ, তাঁদের অনেকের হয়তো বড়জোর মনে থাকতে পারে প্রায় একযুগের বেশি সময় ধরে কেশব ছিলেন মোহনবাগান হকি দলের সেরা অস্ত্র, তাঁকে ছাড়া সবুজ মেরুন হকি দলের কথা তখন ভাবাই যেত না। কিন্তু কজন মনে রেখেছেন যে কেশব পাশাপাশি ছিলেন একজন অসাধারণ ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়, হকির প্রতি অত্যধিক মনোযোগ না দিলে ভারতীয় ব্যাডমিন্টন দলের কেশবের নির্বাচন একটা সময় ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা?
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা ও দেশভাগ রিক্ত করেছে বহু মানুষকে, ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত করেছে বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকে। সেই ছিন্নমূল অগণিত মানুষদেরই একজন কেশব দত্ত। প্রিয় শহর লাহোর যখন পরভূমে পরিণত হল, তখন ভাগ্য অন্বেষণে কেশব প্রথমে পৌঁছলেন মুম্বাই, তারপর ১৯৫০ সালে এলেন কলকাতায়। বয়স মাত্র ২৫, কিন্তু তখনই তিনি দিকপাল হকি খেলোয়াড়, পকেটে রয়েছে লন্ডন অলিম্পিকের সোনা। কলকাতায় পৌঁছে কিছুদিনের মধ্যেই নাম লিখিয়ে খেলতে নামলেন বাংলা রাজ্য ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপে। সবাই জানত কেশব ভালো হকি খেলেন, কিন্তু র্যাকেট হতে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে এককথায় তাক লাগিয়ে দিলেন সবাইকে।
মনোজ গুহ তখন বাংলার সেরা তারকা, টানা দু বছর রাজ্য চ্যাম্পিয়ন, ভারতীয় ব্যাডমিন্টন দলের নিয়মিত সদস্য। পুরুষদের সিঙ্গলস ফাইনালে মনোজকে তিন গেমে হারিয়ে খেতাব জিতে নিলেন কেশব। এরপর ডাবলসে বিশু ব্যানার্জীকে সঙ্গী করে জিতলেন ফাইনালে। এখানেই শেষ নয়, বেটি হিউম্যানকে জুড়ি করে জিতে নিলেন মিক্সড ডাবলস খেতাবও। ত্রিমুকুট জয়ী কেশব এক ধাক্কায় ঢুকে পড়লেন যথেষ্ট শক্তিশালী বাংলা দলে।
ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের দুর্ভাগ্য, খেলাটা নিয়ে সেভাবে বেশি এগোলেন না কেশব। আসলে হকি তখন তাঁকে গ্রাস করেছে, তিনি ভারতীয় দলের মূল্যবান সদস্য, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাফ ব্যাক। তাঁর কাছে সময় কোথায় ব্যাডমিন্টন নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করবার? কিন্তু তবুও বেশ কয়েক বছর টানা কেশব ছিলেন সর্বভারতীয় র্যাঙ্কিংয়ে বেশ ওপরের দিকে, বাংলার হয়েও কোর্টে নামতেন নিয়মিত। আমরা অবশ্য সেভাবে মনে রাখিনি এই অতি সুদর্শন খেলোয়াড়কে, বাংলাই ছিল যাঁর ঘরবাড়ি।
তবে ব্যাডমিন্টন কেন, দুর্ধর্ষ হকি খেলোয়াড় হিসাবেই বা ঠিক কতটা সম্মান জানানো হয়েছে কেশবকে? তাঁর সঠিক প্রাপ্য কি তিনি পেয়েছেন? ১৯৫২ অলিম্পিকে কেশব ছিলেন দলের সহ অধিনায়ক। স্বভাবতই ধরে নেওয়া গিয়েছিল ১৯৫৬ মেলবোর্নে তিনিই হবেন অধিনায়ক। সেইমতই সবকিছু এগোচ্ছিল। শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসল কেশব যেখানে চাকরি করতেন, সেই ব্রিটিশ চা কোম্পানি। তাদের বক্তব্য ছিল, অতদিন ছুটি দেওয়া সম্ভব নয়, অলিম্পিক খেলতে হলে চাকরি ছাড়তে হবে। কেশব সম্পূর্ণ অপেশাদার খেলোয়াড়, চাকরি ছাড়লে খাবেন কী? হাতছাড়া হল অলিম্পিকের অধিনায়ক পদ, টানা তিনটি অলিম্পিক খেলবার বিরল সম্মান। সেদিন কিন্তু এগিয়ে আসেনি কেউ, এমনকি তাঁর প্রিয় মোহনবাগান ক্লাব অবধি নয়। এই অন্যায় নিঃশব্দে মেনে নিয়েছিল দেশের ক্রীড়ামন্ত্রক, জাতীয় হকি ফেডারেশনও।
সাহেব চা কোম্পানি কেশবকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল তাদের কাছে হকি খেলবার জন্য কোনো বিশেষ ছাড় নেই, নির্দিষ্ট সময়ের এক মিনিট আগেও অফিস থেকে ছুটি তিনি পাবেন না। তাই পঞ্চাশের দশকে লিগ চলাকালীন অনেক ম্যাচেই মোহনবাগান শুরুতে দশজনে খেলতে নামত। একটু পরেই সদস্য গ্যালারি উল্লাসে ফেটে পড়ত, তাদের অতি পরিচিত হারলে-ডেভিডসন মোটরবাইক চালিয়ে নায়কোচিত ভঙ্গিতে তাঁবুতে ঢুকছেন কেশব দত্ত। আর চিন্তা নেই, কয়েক মিনিটের মধ্যে ড্রেস করে মাঠে নামবেন আমাদের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। দেরী করে এলে কী হবে, কেশবের ক্ষেত্রে সর্বদাই সাতখুন মাফ।
একটা সময় ছিল, যখন কেশব দত্তের মহিলা ফ্যানের সংখ্যা হয়ে উঠেছিল স্থানীয় ক্রীড়াজগতের রীতিমত আলোচনার বস্তু। কেশব শেষ অবধি বিবাহ করেন এক ইউরোপীয় মহিলাকে, কিন্তু আদতে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ দেশজ ভাবধারার অনুগামী। পরবর্তীকালে তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকন্যা যখন দেশ ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন বেঁকে বসলেন কেশব স্বয়ং। গেলেন না, একা রয়ে গেলেন কলকাতায়। দীর্ঘায়ু কেশব শেষ কয়েক বছর বড় মানসিক অসুবিধার মধ্যে ছিলেন, সঙ্গীহীন, একাকী। চাকরি ছাড়বার পর বাসস্থান নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন, শেষ অবধি শহরের এক প্রখ্যাত আইনজীবী তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে অনুরোধ করে শহরের দক্ষিণ প্রান্তে একটি ফ্ল্যাট তাঁকে পাইয়ে দেন, শেষ জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে গেছেন কেশব। শেষদিকে স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল, শুভানুধ্যায়ীদের কল্যাণে তাঁর দেখাশোনার জন্য একজন সর্বক্ষণের কর্মী ছিলেন। শেষ সময়ে তাঁর নিকট পরিবারের কেউ পাশে ছিলেন না।
আমাদের স্মৃতি ফিকে হয়ে যেতে পারে, আমরা যা কিছু পুরাতন তাকে জীর্ণ বস্ত্রের মত পরিত্যাগ করতে পারি। কিন্তু নিভৃতে, নিজের মনের কাছে একথা কি অস্বীকার করতে পারি, যে কেশব ছিলেন এক চলমান কিংবদন্তী? অলিম্পিকের আসরে যে সমস্ত ম্যাচ তিনি খেলেছেন, তা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়, কিন্তু পরিবর্তে আমরা তাঁকে দিয়েছি অতি সামান্য! যাবার বেলায়, এই ৯৫ বছরের অসহায় বৃদ্ধকে আমরা, বহুল প্রচারিত ক্রীড়াপ্রেমী বাঙালি, কি প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখাতে পেরেছি? তাঁর শীর্ণ হাতটা চেপে ধরে কি একবারও বলতে পেরেছি, যাচ্ছেন যান, কিন্তু মনে রাখবেন, আমাদের মধ্যে আপনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন, আপনাকে ছাড়া কখনই সম্পূর্ণ হবে না এই শহরের ক্রীড়া ইতিহাস? আমরা কিন্তু ফিরে ফিরে আসব সেই আপনার কাছেই।
সেই আশ্বাস দিয়ে শেষ যাত্রায় তাঁকে পাঠাতে পারলাম না আমরা।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।