সে ছিল এক ঝড়ের রাত্রি! যে-ঝড়ে মার্কিন সংগীত-দুনিয়ার অনেক দরজা-দুয়োর’ই ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন সংগীতের ইতিহাসে নিউ পোর্ট ফোক উৎসব একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমাদের আলোচনীয় ঘটনার সময়কাল ১৯৬৫-র উৎসবটিকে ঘিরে। পঁচিশে জুলাই বব ডিলান নিউ পোর্টের উৎসবমঞ্চে হাজির হলেন কালো জিন‌‌স্, কালো জ্যাকেট আর কালো চামড়ার বুট পরে। কিন্তু এ-বার তাঁর কাঁধে ঝুলছে না এ-যাবৎ পরিচিত অ্যাক্যুস্টিক গিটারটি। বদলে তাঁর সঙ্গী ফেন্ডার কোম্পানির তৈরি ঝাঁ-চকচকে নতুন ইলেকট্রিক গিটার। উৎসবের তৃতীয় তথা শেষ দিনে ডিলানের গান গাওয়ার কথা। ওই দিনে উপস্থিত তারকা-তালিকায় ছিলেন পিটার পল মেরি, পিটার ইয়েরো প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন পিতৃতুল্য পিট সিগার, যাঁর কাছে নিউ পোর্ট স্বপ্নপূরণের মঞ্চও বটে। এই ‘পরিবর্তিত’ ডিলান কিন্তু একা আসেননি, সঙ্গে ‘পল বাটারফিল্ড ব্লুজ ব্যান্ড’-এর একঝাঁক তরুণ বাজিয়ে— ডিলানকে সংগত করতে মঞ্চে উপস্থিত। প্রাথমিক সাউন্ড চেক-এ’ই দর্শক নড়েচড়ে বসলেন এবং ডিলান শুরু করলেন “আই এইন্’ট্ গন্না ওয়ার্ক অন ম্যাগি’স ফার্ম নো মোর”।

এ-ই প্রথম ডিলানের গানের সাথে তালযন্ত্র বাজছে! বেস ও লিড গিটার-সহ। দর্শকদের মধ্যে এক ধরণের উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে— একদল আনন্দে কাঁদছেন আর একদল দুয়ো দিচ্ছেন। চোখের সামনে তাদের আইকনের এই ‘পদস্খলন’ তারা মেনে নিতে পারছেন না! যদিও এটাই ছিল ডিলানের প্রথম পাবলিক পারফরমেন্স যেখানে তিনি ব্যান্ড ব্যবহার করলেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে ওই বছরের মার্চ মাসেই ডিলানের নতুন অ্যালবাম ‘ব্রিঙ্গিং ইট অল ব্যাক হোম’ বেরিয়েছে যেখানে অ্যালবামের এক পিঠের বেশ কিছু গান রেকর্ড করা হয়েছিল ব্যান্ড-সহযোগে। অবশ্য অপর পিঠে পুরনো ‘অ্যাক্যুস্টিক’ ডিলানকে পাওয়া গিয়েছিল স্বমেজাজেই।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

মোট তিনটি গান পরিবেশন করলেন ডিলান, যার মধ্যে অন্যতম ‘লাইক আ রোলিং স্টোন’। এই গানের মধ্যে বারবার দর্শক-শ্রোতাদের দিকে আঙুল তুলে : ‘হাউ ডাজ ইট ফিল?’…

একসঙ্গে এতজন বাজিয়ে-র হাই ভোল্টেজ ধ্বনিকে পরিবেশন করার জন্য সে-যুগে নিউ পোর্ট প্রস্তুত ছিল না, ফলে শ্রোতারা ডিলানের গানের আদ্ধেক কথাই শুনতে পেলেন না। সব মিলিয়ে তিনটি গানের পর-ই অনুষ্ঠান ভন্ডুল হয়ে গেল। যদিও দর্শকদের প্রবল জেদাজেদিতে ডিলান ফিরে এলেন তাঁর চিরাচরিত অ্যাক্যুস্টিক গিটার-সহ, এবং ‘ব্লোয়িং ইন দি উইন্ড’ গেয়ে আসর মাত করে দিয়ে গেলেন।

গত দু’টি নিউ পোর্ট উৎসবে ডিলান ছিলেন অন্যতম আকর্ষণ, যাঁকে স্বয়ং পিট সিগার দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময়ের সিভিল রাইটস্ আন্দোলন-উদ্ভূত টালমাটাল আমেরিকায় ডিলান হয়ে উঠেছিলেন আইকন-স্বরূপ। একের পর এক গানে ডিলানের জনপ্রিয়তা হয়ে উঠেছিল তুঙ্গস্পর্শী। ব্লোয়িং ইন দি উইন্ড তো ছিলই। এ ছাড়া ‘ট্যাম্বুরিন ম্যান’, ‘মাস্টারস্ অব ওয়র’, ‘ডোন্ট থিংক টোয়াইস’ এবং ‘টাইম দে আর এ চেঞ্জিন’ প্রভৃতি গানের মাধ্যমে ডিলান এক নতুন কাব্যভাষার উদ্ভব ঘটালেন যা আমেরিকান ফোক গানে এ-যাবৎ অধরা ছিল। কিন্তু এই নতুন ভাষার পরিবেশনটি সাদামাটা একটি গিটার ও হারমোনিকা-সহযোগে ঘটানো হচ্ছিল, যেখানে তালবাদ্যের কোনও ভূমিকা ছিল না। আর এই অবস্থাতেই তিনি— বব ডিলান, জনপ্রিয়তার শিখরে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। একই গোত্রের শব্দ-ধ্বনি পরিবেশন তাঁর বিরক্তির উদ্রেক ঘটাল, যা থেকে শিল্পী হিসাবে মুক্তি পেতে চাইলেন তিনি। ডিলানের এই শব্দ-ধ্বনি সম্ভাবনার সন্ধান জারি থাকবে আগামী কয়েক দশকেও— যেখানে পিট সিগার স্থিত থাকবেন ফোক আন্দোলন থেকে উঠে-আসা চিরাচরিত সাউন্ডস্কেপ-এ, যা আবার এই আন্দোলনের মূল বক্তব্যও বটে!

ফোক আন্দোলন যে রক-পপের সাউন্ডস্কেপকে বর্জন করেছিল তার পিছনে একটা সচেতন রাজনৈতিক কারণ ছিল। পিট সিগার বা উডি গাথরি-রা মনে করতেন, প্রযুক্তিনির্ভর এই সাউন্ডস্কেপের কাছে আত্মসমর্পণ করা মানে বৃহৎ পুঁজি, যা রেকর্ডিং কোম্পানিগুলোর হাত ধরে সংগীত-দুনিয়ায় বা মিউসিক ইন্ডাস্ট্রিতে মাথা তুলছিল, তার কাছেই মাথা নোয়ানো। ডিলান কিন্তু কখনোই এই রাজনীতির ধার ধারেননি। তাই তিনি ১৯৬৫ বা তার পরবর্তী সময়ে একের পর এক অ্যালবামে বিভিন্ন মিউসিয়ানদের সঙ্গে জোট বাধতে লাগলেন। এঁদের প্রত্যেকের কাজের ধরণ শুধু আলাদাই নয়, বরং এঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজস্ব সাউন্ডস্কেপ তৈরিতে সক্ষম ছিলেন। ডিলান এই পর্যায়ে জর্জ হ্যারিসন, এরিক ক্ল্যাপটন, ক্লাউস বোরম্যান, মার্ক নফলার বা কার্লোস সান্তানা ছাড়াও হালফিলের জি ই স্মিথের সঙ্গেও কাজ করেন। ফলত একের পর এক লাইভ পারফরমেন্সে বা স্টুডিওতে রেকর্ড-করা অ্যালবামগুলিতে ডিলান নিজেকে পাল্টাতে থাকেন।

পিট সিগারের সংগীত-জীবনে এ-রকম বড় শিফট না-ঘটলেও জীবনের উপান্তে এসে বব ডিলানের ‘ফরএভার ইয়াং’ গানটি রেকর্ড করেন তিনি। যেখানে, স্টুডিও ভার্সান-টিতে (ভিডিও-সহ) আমরা দেখি বিভিন্ন যন্ত্র-অনুষঙ্গে (লিড গিটার, বেস গিটার, কি বোর্ড, ড্রাম-সহ) বৃদ্ধ পিট একঝাঁক কচিকাঁচার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন ‘ফরএভার ইয়াং’-এ। যদিও এরই মধ্যে হাডসন নদী দিয়ে বয়ে গেছে বিস্তর জলরাশি।

বব ডিলান নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভ্যাল ১৯৬৫, ছবি ঋণ : Wikimedia

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.