তথাকথিত বিদ্যায়তনিক পরিসরের বাইরে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে মেয়েদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লেখালিখি করে চলেছেন, যশোধরা রায়চৌধুরী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বলা চলে নারী বিষয়ক প্রশ্নাবলি গণপরিসরে সহজ কথায় ভাসিয়ে রাখার গুরুভার কাজটি যাঁরা নিরলসভাবে করে চলেছেন, তাঁদেরই একজন যশোধরা।  এমনিতেই বহু দক্ষতার অধিকারী যশোধরার দেখার জগৎটি বিস্তৃত। সেই সঙ্গে স্বভাবজ সহমর্মিতা আর সুদীর্ঘ পাঠাভ্যাসে গড়ে ওঠা তৃতীয় নয়ন দিয়ে না-দেখার অন্ধকারের উপর সেতু বেঁধে নিতে পারেন অনায়াসে। তাই যে কোনো বাস্তব সমস্যাকে যখন তিনি নিজের বিস্তৃত প্রজ্ঞার আলোয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেন, আর তাঁর সাহিত্যিকের কলম মারফত পাঠকের দরবারে হাজির করেন, তখন তাঁর যুক্তি কেউ মেনে নিতে পারেন, কেউ হয়ত লেখিকার সঙ্গে কোমর বেঁধে কাল্পনিক তর্কে নেমে পড়তে পারেন, কেউ বা সেই যুক্তি প্রবাহের ত্রুটি খুঁজে বার করে প্রতিযুক্তির জাল বুনে অন্য প্রবন্ধ খাড়া করতে পারেন। কিন্তু যাঁরা ভাবতে চান, তাঁরা অন্তত যশোধরার লেখা উপেক্ষা করতে পারবেন না।

যতদূর মনে পড়ে, তাঁর নারী বিষয়ক লেখালেখির শুরু আগের শতকের শেষতম ভাগেই। তাঁর বিভিন্ন নারীবাদী লেখার সংকলন আগেও বেরিয়েছে। তাই এই বইতে স্থান পেয়েছে মূলত তাঁর সাম্প্রতিক লেখালিখিই। ২০০৬ ও ২০০৭ সালে লেখা মাত্র দুটি প্রবন্ধ বাদ দিলে, এই বইয়ের বাকি সবকটি প্রবন্ধই ২০১৩ পরবর্তী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও সংবাদপত্রে পূর্ব-প্রকাশিত।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

প্রবন্ধগুলোকে তিনটি পর্বে ভেঙেছেন লেখক। সেই পর্ব বিভাজন ধরেই আলোচনা করা যাক।

অসহবাস

এই পর্বে গ্রন্থিত হয়েছে কুড়িটি প্রবন্ধ। তার বেশিরভাগই বিভিন্ন জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক ঘটনার প্রতিক্রিয়া। ঘটনার প্রতিক্রিয়া বললে এক ধরনের সাময়িক উত্তেজনার কথা মনে হয় বটে, কিন্তু তার মধ্যেও বোনা থাকে ভাবনার বীজ। প্রথম প্রবন্ধ থেকেই আমূল নাড়া পড়ে। অ্যাসিড আক্রান্ত মেয়েদের অভিজ্ঞতা (‘নিজের মুখের সন্ধানে’) বলতে গিয়ে তিনি জানান, ভাত ঠিকমত সেদ্ধ হয়নি বলে স্বামীর এক মেয়ের গলায় অ্যাসিড ঢেলে দেওয়ার কথা। এক কন্যা অ্যাসিড গায়ে লাগার পরে পথিকদের কাছে সাহায্য চেয়েও পাননি। সঙ্গের শিশুদুটিকে পথে বসিয়ে তিনি গায়ের জ্বালা কমাতে পুকুরে ঝাঁপ দেন। শেষে টোটোয় করে বাড়ি ফেরেন। টোটোওলাও কিন্তু ভাড়া নিতে ছাড়েননি। এই আমাদের স্বদেশ! তবু এই মেয়েরাও স্রেফ অত্যাচারের শিকার হওয়ার পরিচিতি নিয়ে বাঁচতে চান না। নিজেদের বলেন “সারভাইভার”। আর তখনই এই প্রবন্ধ হয়ে ওঠে অনবদমিত চেতনার গল্প। নারীর প্রতিবাদী স্বর, সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বিধানকে সরিয়ে নারীর নিজস্ব স্বরের সন্ধান করেছেন যশোধরা। তাই তাঁর কলমে ফুটে ওঠে ইরানের হিজাববিরোধী আন্দোলনের (‘ইনকিলাব পথের মেয়েরা’) পাশাপাশি ফ্রান্সের বুরকিনি ব্যানের কাহিনীও (‘নিজের শরীর নিজের অধিকার’)। যদিও আমরা জানি যে নারী কোনো সমসত্ত্ব শ্রেণি নয়। বরং বলা যায় জাতি, ধর্ম, জাত, শ্রেণি, যৌন পরিচয় ইত্যাদি অজস্র সুতোর বুনোটে নারীর আত্মপরিচয়টি বোনা হয় এবং কোনো ব্যক্তির ব্যক্ত ইচ্ছাকেও আদতে গণিতের ভাষায় বহু চলরাশির উপর নির্ভরশীল এক ক্রিয়া হিসাবে দেখা যায়। সে কারণেই বিভিন্ন বিপরীতমুখী ইচ্ছার মধ্যে সমন্বয়সাধনের কাজটি প্রায় অসম্ভব। তবু এই যে সংখ্যালঘুর ব্যতিক্রমী স্বর চেনার চেষ্টা, নারীবাদের এ এক অত্যন্ত জরুরি পর্ব।

আরো পড়ুন হিজাববিরোধী ইরান: বিপ্লব চাপিয়ে দেওয়া যায় না

অবশ্য শুধু এই স্বর উন্মোচনেই কলম থেমে থাকেনি, সংখ্যাগুরুর স্বরের লিঙ্গসাম্যের আলোয় বিশ্লেষণ করেও ত্রুটি নির্দেশের দুরূহ কাজটিও লেখক করেছেন ‘অসহবাস’, ‘শাঁখা সিঁদুর’ প্রভৃতি প্রবন্ধে। বহু প্রচলিত সামাজিক, পিতৃতান্ত্রিক প্রথাগুলিকে প্রশ্ন করে গেছেন বারবার। ‘সবিতা ভাবি ও আমাদের মধ্যবিত্ত যৌনতা’ আরেক ঢাকঢাক গুড়গুড় ভাঙা বিশ্লেষণী লেখা। বিশেষত যৌনতার লেন্স দিয়ে মেয়েদের ক্ষমতায়নকে উল্টে পাল্টে সেঁকে দেখার পর্বটি পাঠকের মনে এক নতুন চিন্তার পথ খুলে দেওয়ার সম্ভাবনা রাখে।

এই সংকলন মূলত শহুরে শিক্ষিত সমাজের প্রেক্ষাপটে লেখা প্রবন্ধ নিয়েই। তাই সামাজিক বহুস্বর যাকে বলে তা হয়ত তেমন ফুটে ওঠেনি এই বইতে। তবু কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন, বিজ্ঞাপনী মায়া এবং আরও বিভিন্ন সুতো ধরে সেই মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সমাজের অন্তর্লীন পিতৃতান্ত্রিক স্বরটিকে অব্যর্থ চিনে নেন লেখক। প্রতিটি প্রবন্ধ ধরে ধরে আলোচনা করা এই পরিসরে সম্ভব নয়। তাই বরং শেষ করি এই বইয়ের জায়গায় জায়গায় ছড়ানো বিভিন্ন ধাক্কা দেওয়া অংশগুলোর মধ্যে একটি অংশ তুলে ধরে।

“উল্টোদিকে আজ, ধর্ষণ শব্দটা বার বার মিডিয়াপ্রচারিত হয়ে এমন অসাড় ও স্পর্শহীন অবস্থায় পৌঁছেছে সো কলড পাবলিক, এরপর একটি মেয়ে কোন পুরুষের অবাঞ্ছিত স্পর্শ নিয়ে আপত্তি জানালে বোধহয় বলে বসবে, তাতে কি হয়েছে, ধর্ষণ করে মেরে তো আর ফেলেনি?

মাঝে মাঝে চীৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, আসলে সবটাই একটা বাস্তবতার অংশ, তফাত শুধু মাপের। আসলে সবটাই এক। ওই দৃষ্টি, ওই স্পর্শ, ওই টিটকিরি, আর, জং ধরা লোহায় এ ফোঁড়, ও ফোঁড় হওয়া। একটু একটু করে বেড়ে ওঠা যন্ত্রণার ডিগ্রি শুধু। নইলে চার বছরের একটি মেয়েকে বাড়ির কাজের লোক বা নিজের মামা, কাকারা যদি একলা ঘরে খারাপভাবে ছোঁয়, অথবা কল্পকাহিনিতে যদি লেখক একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়, তার সঙ্গে সত্যিকারের রেপিস্টের খুব বেশি মানসিক দূরত্ব বোধ হয় নেই। ব্রিটেনে সম্প্রতি রেপ পর্নোগ্রাফি দেখাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছেন ডেভিড ক্যামেরন। এখনো দেশ বিদেশে এ নিয়ে চলে বিতর্ক। পুরুষদের একটা অংশ তো বলেই চলেন যে আদি অনন্তকাল ধরে পুরুষের রিরংসা ছিল আছে থাকবে। তাই নিয়ে এত হৈ চৈ এর কী আছে।”

পাতার পর পাতা তো আর উদ্ধৃতি দেওয়া যায় না, থামতে হয় – এই যা দুঃখ।

অনবদমনের দিকে

প্রথম পর্ব যদি প্রতিবাদের গল্প বলে, পরের পর্ব বলে সফল প্রতিরোধের গল্প। এই পর্বে রয়েছে ছটি প্রবন্ধ। এখানে মূলত সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় – কল্পবিজ্ঞান থেকে কবিতায় – মেয়েদের দাপুটে চারণের ইতিহাস লিখে রাখেন বিভিন্ন প্রবন্ধ জুড়ে। নিজেও বিশিষ্ট কবি বলেই হয়ত, মেয়েদের লেখা কবিতায় আদি যুগের পুরুষ-নির্ভরতার অন্তরালের প্রশ্ন থেকে আধুনিক মেয়েদের নিজস্ব কবিতার ভাষা তৈরির চেষ্টা হয়ে আজকের মেয়েদের নিজস্ব ভুবন নির্মাণের সুর তাঁর কান এড়ায়নি। বাংলা সাহিত্যের তন্নিষ্ঠ পাঠকের অবশ্যই পড়ে দেখা উচিত এই মেয়েদের কবিতার ইতিহাস। অসম্ভব দ্যুতিময় সব কবিতার পংক্তি তুলে এনে অনবদ্য বিশ্লেষণ করেছেন যশোধরা। আমারই মত কবিতার ততটা তদ্গত পাঠক নন যাঁরা, তাঁদেরও কিন্তু টেনে রাখবে এই তুখোড় বিশ্লেষণ। তারই মধ্যে অন্য ধাঁচের দুটি প্রবন্ধও জায়গা করে নিয়েছে। সেই দুটি প্রবন্ধ নিয়েই এবার একটু কথা বলা যাক।

যশোধরার সম্পাদনায় গুরুচন্ডালি প্রকাশন থেকে ২০১৮ সালে প্রকাশ পায় লক্ষ্মীর পাঁচালি। লক্ষ্মীর পাঁচালির আদর্শ নারী নির্মাণ প্রকল্পের এক সার্থক নব্য বিনির্মাণ। বিভিন্ন কবির লেখা জুড়ে জুড়ে তৈরি এই নতুন পাঁচালি আজকের মেয়েদের জন্য উপযুক্ত সামাজিক কোড তৈরি করতে চেয়েছে। এইরকম সফল বিনির্মাণ বাংলা সাহিত্যে মনে হয় খুব বেশি হয়ে ওঠেনি। আদর্শ নারী নির্মাণের খাঁচাটিকে সম্পূর্ণ রেখেও কীভাবে তার মধ্যে নব্য আধুনিকতাবাদ পুরে দেওয়া যায়, কীভাবে অবশ্যমান্য নিত্যপাঠ্য পাঁচালির লোকশিক্ষার মডেলটিকে নতুনভাবে ব্যবহার করে যুগোপযোগী ঝকঝকে বহুবিদ্যাপারঙ্গম নারী তৈরি করা যায় তার আদর্শ এই চটি বইটি। এই বইয়ের নির্মাণ ভাবনা নিয়ে একটি প্রবন্ধ এখানে রয়েছে, নাম ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি ডিকোড করার বিপদ ও সম্পদ’।

অন্য প্রবন্ধের বিষয়টিও বহু আলোচিত – স্বাধীনোত্তর কিশোর সাহিত্যে মেয়েদের রহস্যজনক অনুপস্থিতি। সমসাময়িক আমরা অনেকেই যশোধরার মত করে অনুভব করেছি আমাদের ঘষে ঘষে পাতা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা। এই সব পাথর টপকে টপকেই তো আমরা খণ্ডিতা থেকে গোটা মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে এসেছি। ঊন-মানুষ থেকে গোটা ও সম্পূর্ণ মানুষ। এই আলোচনাটি তাই একেবারে মরমে গেঁথে গেছে।

পূর্বনারীর ঋণ

নামেই মালুম এই পর্ব ঋণ স্বীকারের। এই শেষতম পর্বে রয়েছে ছটি প্রবন্ধ। দ্য ফেমিনিন মিস্টিক বইয়ের লেখক পশ্চিমি নারীবাদী বেটি ফ্রিডান, বাংলার সরস্বতী-সাধিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য, ধীমতি বরিশাল-কন্যা বিপ্লবী শান্তিসুধা ঘোষ, দ্য ফিমেল ইউনাখ বইয়ের লেখক জার্মেন গ্রিয়ারকে নিয়ে রয়েছে একেকটি প্রবন্ধ।

তবে পূর্বনারীদের কথা বলতে বলতেও বর্তমানকে ছুঁয়ে গেছেন যশোধরা। তাই লিখেছেন, হালফিলের নির্ভীক কন্যা সুজেট জর্ডানের কথা। এই পোড়া সম্মতি-বধির দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের পুরুষালী ক্ষমতার বিপক্ষে তাঁর সাহসী প্রতিবাদের কথা তো ভোলার নয়। শেষ হয়েছে ইয়েজেদি কন্যা নাদিয়া মুরাদের কথায়। নাদিয়া ২০১৮ সালে নোবেল পুরস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়েও প্রশ্ন তুলেছেন, নারীর শরীরকে কেন যুদ্ধের বলি (ফুয়েল ফর ওয়ার্স) বানানো হবে? গোটা পৃথিবীর রাষ্ট্রনেতারা এর কোনো প্রতিকার করেন না কেন?

যদিও নাদিয়া প্রত্যক্ষ যুদ্ধের কথা বলেছেন আর আমরাও দেখছি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুর্দশা; মেয়েরা জানে, এই লিঙ্গ-অসাম্যের দুনিয়ায় আরও কতরকম অপ্রত্যক্ষ যুদ্ধের বলি হতে হয়। তবু আমরা উটপাখির মত বালিতে মুখ খুঁজে থাকতেই ভালবাসি। আমাদের চেতনাহীনতার দুয়ারে ঘা মেরে মেরে জাগানোর জন্য তাই এরকম আরও অনেক বই দরকার।

অসহবাস থেকে অনবদমন: মেয়েদের কথা
লেখক: যশোধরা রায়চৌধুরী
প্রচ্ছদ: শুভেন্দু সরকার
প্রকাশক: কারিগর
দাম: ৫৫০ টাকা

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.