পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতি সবসময়েই উত্তাল, বিশেষ করে ২০০৬ সাল থেকে। এমন কোনো মাস গিয়েছে কিনা মনে করতে পারছি না, যখন রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রেনে কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে তুলকালাম আলোচনা হয়নি। আপাতত প্রধান ও একমাত্র ইস্যু বর্তমান রাজ্য সরকারের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি এবং তার মধ্যে সবচেয়ে উপরে তৃণমূলের শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজ্যের কোষাগার থেকে বেতনপ্রাপ্ত সমস্ত কর্মীদের বিক্ষোভ এবং গতকালের ধর্মঘট।

মানুষের মস্তিষ্কের গ্রহণক্ষমতার একটা সীমা আছে সম্ভবত। এই সরকারের বহুমুখী দুর্নীতি সেই ক্ষমতার পরীক্ষা নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সম্ভবত এই সরকারের বহুস্তরীয় এবং বহুমাত্রিক দুর্নীতির নমুনা চোখের সামনে দেখতে দেখতে একটি ভয়াবহ পদক্ষেপের গুরুত্ব রাজ্যের মানুষ বুঝতে পারেননি। বুঝলে সারা রাজ্যের সাধারণ মানুষ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়তেন, আন্দোলনটা শুধু সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত না। পদক্ষেপটি হল ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম থাকার অজুহাতে রাজ্যের ৮,০০০ সরকারি প্রাথমিক এবং জুনিয়র হাইস্কুল বন্ধ করে দেওয়া।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

তৃণমূল দল অথবা মমতা ব্যানার্জির রাজনীতিকে দুভাবে ভাগ করা যায়। ১. চমক এবং হঠকারিতা, ২. দুর্নীতি। নেত্রী হিসাবে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর উত্থান ধ্বংসাত্মক, দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের মধ্যে দিয়ে। ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার পর প্রথমে ছিল শুধুই চমকের ছড়াছড়ি, যা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও বজায় ছিল বা এখনো আছে। সেই সব চমকপ্রদ ঘোষণার বড় চড়া মূল্য রাজ্যবাসীকে দিতে হচ্ছে, বিশেষত সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষকদের।

তার পরের ধাপটাই হল তৃণমূলের সর্বগ্রাসী এবং অকল্পনীয় দুর্নীতি, যার প্রভাব পড়েছে সমাজের প্রতিটি অংশে এবং জাতি হিসাবে বাঙালির চরিত্র ও নৈতিক আচরণের উপর। একটা জাতি, যার আর কিছু না হোক ভদ্র, রুচিশীল হিসাবে পরিচিতি ছিল এবং জাতীয় স্তরে যে রাজ্যের নেতারা এককথায় সৎ হিসাবে সম্মান পেতেন, তাদের কাছে আজ ওই বিশেষণগুলি ব্যঙ্গের মত শোনায়। মাত্র ১০-১২ বছরে একটি রাজ্যের এতখানি নৈতিক অধঃপতন না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব। এই নৈতিক দেউলিয়াপনা দিনের পর দিন শাসক দলকে প্রশ্ন করা থেকে বিরত রেখেছে মানুষকে। ঠিক সেই কারণেই ৮,০০০ স্কুল তুলে দেওয়ার মত ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিতেও এরা পিছপা হল না। বাম ছাত্র-যুব এবং শিক্ষক সংগঠনগুলি ছাড়া সমাজের অন্য জায়গা থেকে প্রতিবাদ শুরুই হয়নি বলতে গেলে।

এখানে প্রশ্ন আসবে, কেন সরকার এতগুলি স্কুল তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে? সরকারের তরফে উত্তর হিসেবে বলা হয়েছে এইসব স্কুলগুলিতে ছাত্রসংখ্যা অত্যন্ত কম (সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম প্রয়োজন হল স্কুল পিছু ৩০ জন ছাত্রছাত্রী), সেগুলি চালানো মুশকিল এবং এতে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর অপচয় হচ্ছে।

একজন স্কুলশিক্ষক হিসাবে এই যুক্তির সামনে দাঁড়িয়ে হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারি না। প্রস্তাব অনুযায়ী মোট বন্ধ হতে যাওয়া স্কুলের সংখ্যা ৮,২০৭। এর মধ্যে প্রাথমিক স্কুল ৬,৭১০, জুনিয়র হাইস্কুল ১,৪৯৬ এবং হাইস্কুল একটি। স্কুলগুলিতে মোট শিক্ষক ১৯,৮০২ এবং অশিক্ষক কর্মী ৭৩৩। অর্থাৎ মোট পদের সংখ্যা ২০,৫৩৫। নিচের তালিকা দেখলে জেলাওয়াড়ি স্কুল বন্ধ হওয়ার সংখ্যা এবং অন্যান্য হিসাব পরিষ্কার হবে।

স্কুল

এবার স্কুল বন্ধ হবার বিপর্যয়ের দিকগুলি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

প্রথমেই বলি, স্কুল বন্ধ হওয়ার ফলে কর্মরত শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের কী হবে সেই আলোচনায়। তাঁদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তাঁদের নিকটবর্তী অন্যান্য স্কুলের শূন্য পদগুলিতে নিয়োগ করা হবে। এর অর্থ বুঝতে পারছেন? এমনিতেই স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে রাজ্য উত্তাল। উত্তীর্ণ হয়েও চাকরিতে ডাক না পাওয়া প্রার্থীরা ৬০০ দিনের বেশি রাস্তায় বসে রয়েছেন, সেখানে এই ৮,০০০ স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ২০,৫৩৫টি পদ স্রেফ হাওয়া হয়ে যাবে। তাতে ক্ষতি কাদের?

এটুকুই সব নয়, আরও আছে। এই পদগুলিতে বর্তমানে, আমি যেটুকু এলোমেলো হিসেব পেয়েছি, তাতে প্রায় ১১,০০০ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী কাজ করছেন। বাকিগুলি শূন্য। এঁদের নাকি অন্য স্কুলে নিয়োগ করা হবে। কীভাবে? না ওই স্কুলগুলির শূন্যপদ পূরণ করে। তার মানে আরও প্রায় ১১,০০০ শূন্য পদ কিন্তু পূরণ হয়ে গেল। অর্থাৎ এই ৮,০০০ স্কুল বন্ধের ঘোষণায় প্রায় ৩০,০০০ শূন্য পদ স্রেফ উবে গেল। সাধারণ মানুষ, চাকরিপ্রার্থী এবং শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েদের অভিভাবকরা এ ব্যাপারে সচেতন তো ? তাঁরা কিন্তু প্রতিবাদে গর্জে ওঠেননি এখনো, হয়ত দ্বিমুখী বিপর্যয়টা বুঝতে পারেননি।

এবার আসি স্কুল বন্ধ করার সরকারি যুক্তিতে। বলা হয়েছে, যেসব স্কুলে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা তিরিশের কম সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে এমন স্কুলও আছে যেখানে চল্লিশের বেশি ছাত্রছাত্রী আছে। সে যা-ই হোক, ছাত্রছাত্রীর অপ্রতুলতা কখনোই স্কুল বন্ধ করার যুক্তি হতে পারে না, বিশেষ করে প্রাথমিক স্কুল বন্ধ করার ক্ষেত্রে। এই চূড়ান্ত প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় রাজ্যের সর্বত্র জনঘনত্ব এক নয়। ফলে একই নিয়ম সর্বত্র লাগু করা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। ঠিক যেমন কলকাতা বা দক্ষিণবঙ্গের গ্রীষ্মের দিকে নজর রেখে সারা রাজ্যে গরমের ছুটি ঘোষণা করা নির্বুদ্ধিতা। মে মাসের প্রথমদিকে উত্তরবঙ্গে এমন কিছু গরম পড়ে না যে স্কুল বন্ধ রাখতে হবে। আগের সরকারের আমলে এই ছুটিগুলির সময় নির্ধারণ করার অধিকার স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল।

শহরাঞ্চলের সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলিতে দীর্ঘদিন ধরেই ছাত্রছাত্রীর অভাব চরমে, তার কারণ ইংরেজি মাধ্যম নির্ভরতা। এমন স্কুলের কথাও জানা আছে যেখানে ছাত্রছাত্রীর চেয়ে শিক্ষক বেশি। সেক্ষেত্রে স্কুল বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকে না, কিন্তু মফস্বল বা গ্রামাঞ্চলে এই সিদ্ধান্ত একেবারেই অনুপযুক্ত। উদাহরণ হিসাবে আমরা তিনটি অঞ্চলের কথা আলোচনা করছি।

১. পূর্ব মেদিনীপুরের ঘাটাল বিধানসভার অন্তর্গত সুলতানপুর-লক্ষ্মণপুর গ্রাম পঞ্চায়েত: ষোলোটি গ্রাম নিয়ে এই পঞ্চায়েত তৈরি। এই অঞ্চল যথেষ্ট ঘনবসতিপূর্ণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল, আর্থসামাজিক অবস্থা মন্দ নয়। এই অঞ্চলের প্রাথমিক স্কুলগুলিতে যথেষ্ট ছাত্রছাত্রী আছে।

২. জঙ্গলমহলের অন্তর্গত বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধ বিধানসভার অন্তর্গত রাজকাটা গ্রাম পঞ্চায়েত: এই পঞ্চায়েতের অন্তর্ভুক্ত গ্রামের সংখ্যা ৪৮, কারণ এখানে জনঘনত্ব অত্যন্ত কম। যাতায়াতের ব্যবস্থা মসৃণ নয়, যানবাহন অত্যন্ত কম, মানুষের জীবিকা নির্বাহ সুকঠিন। ফলে এইসব অঞ্চলের স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম হওয়াই স্বাভাবিক।

এই তালিকা প্রকাশ হওয়ার আগেই জঙ্গলমহলে ১৭টি আদিবাসী হোস্টেল বন্ধ হয়েছিল, সাতটি জুনিয়র হাইস্কুলও। তার মধ্যে পাঁচটি স্কুলে তখনই একজন মাত্র শিক্ষক ছিলেন। কেন বন্ধ হয়েছিল? কারণ সরকার ওই জঙ্গলে হোস্টেল চালানো জরুরি মনে করেনি। স্কুলগুলিতে শিক্ষক ছিল না, হোস্টেলগুলিতে উপযুক্ত পরিকাঠামো ছিল না। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। কখনো কোনো স্থায়ী হোস্টেল সুপার নিয়োগ করা হয়নি। ফলে একসময় আবাসিক ছেলেমেয়েরা বাধ্য হয়ে হোস্টেল ছাড়তে আরম্ভ করে এবং স্বাভাবিকভাবেই পড়াশোনাও বন্ধ করে দেয়। তা নিয়ে সরকার কখনো একটি মন্তব্যও করেনি। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দশ বছর ধরে শুনছেন জঙ্গলমহল হাসছে। তারপর এবার প্রাথমিক স্কুল অবধি বন্ধ করে দেবার ঘোষণা হয়ে গেল। এবার ভেবে দেখুন, জঙ্গলমহল সত্যিই হাসছে কিনা।

৩. উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক জেলা আলিপুরদুয়ার: জেলার অনেকটা জায়গা জুড়ে জঙ্গল। বক্সা পাহাড় ও সংলগ্ন জনবসতি অঞ্চল অত্যন্ত দুর্গম। এখানেও প্রাথমিক স্কুলগুলিতে ছাত্র ছাত্রীদের সংখ্যা খুবই কম। এখানে কিন্তু প্রচুর স্কুল আগেই তুলে দেওয়া হয়েছে একই যুক্তি দেখিয়ে।

এবার ভাবুন, এইসব অঞ্চলের যা পরিবেশ পরিস্থিতি তাতে স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম বা খুব কম হওয়াই স্বাভাবিক নয় কি? কিন্তু সেই স্কুলগুলি তুলে দিলে এই ছাত্রছাত্রীরাও কিন্তু স্কুলছুট হয়ে যাবে। কারণ শিশুদের পক্ষে এই দুর্গম অঞ্চলে দূরের স্কুলে যাওয়া অসম্ভব আর তাদের অভিভাবকদের পক্ষেও নিজেদের কঠিন জীবিকার লড়াই থেকে অনেকখানি সময় বার করে স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা সম্ভব নয়। ফলে স্কুল তুলে দিলেই এই অঞ্চলগুলির শিশুদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে।

তাহলে এটুকু নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, যে সরকার নির্ধারিত কমপক্ষে ৩০ জন নথিভুক্ত ছাত্রছাত্রীর সূত্র সর্বত্র প্রযোজ্য হতে পারে না। আসলে এই সরকারের প্রধান এ ধরনের অতিসরলীকৃত সিদ্ধান্তই নিয়ে থাকেন। তার কারণ সমস্যার মূলে গিয়ে তা বোঝার অক্ষমতা। দ্বিতীয় কারণ স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা। মমতা ব্যানার্জির দলে যেহেতু উনিই একমাত্র এবং শেষ কথা, তিনি প্রশাসনও সেভাবেই চালাতে চান। বৈচিত্র্য ওঁর বোধগম্য নয় বা পছন্দের বিষয় নয়। ফলে একরৈখিক শাসন চালাতে গিয়ে রাজ্যের অবস্থা সবদিক থেকেই শোচনীয়।

জুনিয়র হাইস্কুলগুলির আবার অন্য সমস্যা। সেখানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম হওয়ার মূলত দুটি কারণ চোখে পড়ে।

১. স্কুলগুলিতে শিক্ষকের অভাব। রাজ্যের অধিকাংশ জুনিয়র হাইস্কুলেই এক বা দুজন শিক্ষক আছেন। তাঁদের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত বিষয় পড়াতে হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই কাজটা ভালভাবে হয় না। একইসঙ্গে সেই শিক্ষকদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে পদ শূন্য থাকার কারণে শিক্ষাকর্মীর দায়িত্বও পালন করতে হয়। শেষ অবধি এতে ক্ষতি হয় পড়ুয়াদের এবং লেখাপড়ার। ফলে পড়ুয়ারা এই স্কুলগুলিতে ভর্তি না হয়ে চলে যাচ্ছে একটু দূরবর্তী মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলিতে। সেখানে শূন্যপদ থাকলেও শিক্ষক সংখ্যা কিছু বেশি এবং বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকরা আছেন। ফলে বাংলার শিক্ষকের কাছে অঙ্ক বা বিজ্ঞানের শিক্ষকের কাছে ইংরেজি পড়তে হয় না।

২. এ ধরনের নতুন স্কুলগুলির অবস্থান। এই সরকারের আমলে কিছু জুনিয়র হাই এবং জুনিয়র গার্লস স্কুল তৈরি হয়েছে। তাড়াহুড়ো করার ফলে যেখানেই কিছুটা জায়গা পাওয়া গেছে সেখানেই স্কুল তৈরি করা হয়েছে। কাছাকাছি বড় স্কুল রয়েছে কিনা দেখাই হয়নি। এদিকে শিক্ষক নিয়োগ করা যায়নি সঠিকভাবে এবং অন্যদিকে কাছেই পুরনো স্কুল থাকায় নতুন স্কুলগুলিতে ছাত্র পাওয়া যায়নি। নিন্দুকরা বলছে, তাড়াহুড়ো করে এসব স্কুল তৈরির আরেকটি কারণ নাকি স্কুলবাড়ি তৈরি করার অজুহাতে শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের কাটমানি উপার্জন করা। যদিও এই অভিযোগ যাচাই করতে আমরা অপারগ। আজ এইসব স্কুল তুলে দেওয়ার অজুহাত হিসেবে দেখানো হচ্ছে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার অভাব।

দায়ী কে? একমেবাদ্বিতীয়ম সরকার। কারণ নিয়োগ একেবারেই সরকারের দায়িত্ব আর সেই জায়গায় এই সরকার ডাহা ফেল। আজ রাজ্যের মানুষ বিস্মিত হয়ে দেখছেন স্কুলে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে শাসক দলের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি। শিক্ষা দপ্তরের একাধিক শীর্ষ কর্তা এবং প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী জেল আলো করে বসে রয়েছেন। আদালতের নির্দেশে তদন্ত চলছে এবং প্রায় প্রতিদিন দুর্নীতির নতুন নতুন দিক এবং মুখ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। একইসঙ্গে শুরু হয়েছে বেআইনিভাবে পাওয়া চাকরি থেকে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া। এখন পর্যন্ত ৬,৫০০ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি গেছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে এই সংখ্যা অনেক বাড়বে।

এতদূর আলোচনায় আমরা মোটামুটি এটুকু বুঝলাম যে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত কঠিন সংকটে। আর এজন্য একমাত্র সরকারকে দায়ী করা ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা আমাদের সামনে নেই। এমনিতেও কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারই সরকারি স্কুল তুলে দিতে চাইছে – এমন ধারণা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বাড়াবাড়ি করছি? উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি তাহলে।

আমরা সবাই জানি সরকারি স্কুলব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মিড ডে মিল প্রকল্প। এ রাজ্যে তার অবস্থা কী? প্রথম কথা, ছাত্রছাত্রীদের মাথাপিছু দৈনিক বরাদ্দ মর্মান্তিকভাবে কম। সে ব্যাপারে বারবার আবেদন করেও কোনো ফল হয়নি। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাও লজ্জাজনক, কারণ বাজেটে যুদ্ধাস্ত্র কেনার বরাদ্দ বিগত আট বছর ধরে নিয়মিত বেড়ে চললেও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমেই চলেছে। অর্ধমৃত ব্যবস্থার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মত এসে পড়েছিল কোভিড-১৯। ২০২০ সালের মার্চ মাসে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। দেশ জুড়ে হইচই হওয়াতে মিড ডে মিলের বদলে সপ্তাহে একদিন স্কুলগুলি থেকে খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা চালু হল। আমরা কাজ করতে গিয়ে কী দেখলাম?

দেখলাম বরাদ্দ কমে গেল অনেকটাই। প্রোটিন সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল। মানে ডিমের কোনো অস্তিত্ব থাকল না তালিকাভুক্ত প্যাকেট করা খাবারে। প্রোটিনের উৎস হিসাবে ছোলা এবং সয়াবিনের সরবরাহ ছিল চূড়ান্ত অনিয়মিত এবং খুব অল্প। নিচের ছবিটি দেখুন।

স্কুল

ভেবে দেখুন, দীর্ঘ ১৮ মাস স্কুল বন্ধ থাকাকালীন রান্নার জন্য জ্বালানির খরচ কিন্তু সরকারকে দিতে হয়নি। সে টাকার পরিমাণ নেহাত কম নয় এবং সেই টাকা ছাত্রছাত্রীদের মাথাপিছু বরাদ্দের অন্তর্গত। ফলে রান্না যেহেতু করা যায়নি সেই পরিমাণ টাকার খাবার (ডিম, ফল ইত্যাদি) কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্য ছিল। তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তাদের পুষ্টির।

এই রাজ্যের সরকার আরও এক কাঠি সরেস; স্কুলের বাচ্চাদের নিয়েও ভোটের খেলা খেলেন। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক চার মাস আগে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎ এক সরকারি নির্দেশে মিড ডে মিলের বরাদ্দ বেশকিছুটা বাড়ানো হল। জনগণ খুশি এবং শাসক দল একে গ্রামাঞ্চলে ভোটের প্রচারে ব্যবহার করল। মুখ্যমন্ত্রীর মমতার উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা হল।

স্কুল

মমতাময়ী মুখ্যমন্ত্রী যে কোন রাজ্যের মানুষের কাছেই কাম্য। কিন্তু সমস্যা হল ভোটের পর। ফল প্রকাশ হবার ঠিক ২৩ দিনের মাথায় আরেকটি সরকারি নির্দেশে ওই অতিরিক্ত বরাদ্দটুকু বন্ধ হয়ে গেল। এত স্বল্পমেয়াদি মমতাকে ঠিক কী বলা যায় আমার জানা নেই।

স্কুল

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এখন। ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টি বৃদ্ধি করার জন্য সাপ্তাহিক ভিত্তিতে মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ২০ টাকা এবং সেই টাকা ব্যবহার হবে সপ্তাহে একদিন মুরগির মাংস এবং মরসুমি ফল খাওয়াতে। প্রস্তাব অনুযায়ী বরাদ্দ বেশ কম হলেও উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানানোর মত উদ্যোগ। কিন্তু আপনি জানেন কি, এই উদ্যোগের সময়কালও স্থির হয়েছে ওই চার মাস? মানে ঠিক যে সময়ে এই রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন সম্পন্ন হবে।

আরো পড়ুন শুধু নিজেদের জন্য নয়, শিশুদের জন্যও লড়ছেন ‘আম্মা’

এই নির্বাচনমুখী উদারতাকে আপনারা কীভাবে দেখবেন তা আপনাদের উপরেই ছেড়ে দিলাম।

সুধী পাঠক, এবার স্কুল বন্ধ হবার সুদূরপ্রসারী ফলের দিকে আরেকবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ওই ৮,০০০ স্কুল বন্ধ হবার অর্থ, ওই স্কুলগুলিতে মিড ডে মিলও বন্ধ হতে চলেছে। বেকার হয়ে যাবেন রান্নাবান্নার কাজে যুক্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা। প্রাকৃতিক বা ভৌগোলিক কারণে দুর্গম অঞ্চলের বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রী স্কুলছুট হবে এবং দুপুরের খাবার থেকেও বঞ্চিত হবে।

কলকাতা, শিলিগুড়ি বা পশ্চিমবঙ্গের কোনো শহর বা মফস্বল কি শহরসংলগ্ন গ্রামে বসে এই লেখা পড়ার সময়ে আপনি হয়ত ওই প্রান্তিক অঞ্চলগুলির শিক্ষাক্ষেত্রে আসন্ন দুঃসহ পরিস্থিতির কথা সঠিকভাবে অনুভব করতে পারছেন না। সে দোষ আপনার নয়। কিন্তু তথ্যের উপর ভরসা করে সোচ্চার হবেন এই স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার কালা নিয়মের বিরুদ্ধে – এই আশাটুকু নিয়েই এই লেখার অবতারণা।

তথ্য লেখকের, মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।