তাত্ত্বিক পরিভাষা সহযোগে গুরুগুম্ভীর আলোচনা সরিয়ে রেখে কথা শুরু করা যাক বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায় সম্প্রতি উঠে আসা কয়েকটি আপাতবিচ্ছিন্ন, অথচ একই বিন্দুকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণরত ঘটনা দিয়ে। ঘটনাগুলিকে ভাবা যেতে পারে শিক্ষাব্যবস্থা ছেয়ে যাওয়া এক নব্য মহামারীর উপসর্গ হিসাবে, যে মহামারীর জীবাণুর নাম “ভুয়ো শিক্ষক”। এ জীবাণু জাতে সর্বভুক, তারা গোগ্রাসে খেয়ে ফেলেছে আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তম্ভকে, খুবলে খেয়েছে আমাদের আগামীকে। খেয়েছে ছাত্র-শিক্ষকের অমূল্য সম্পর্ককে যার ভিত্তি ছিল বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, স্নেহ। এই ভুয়ো শিক্ষক নামক জীবাণুর সংখ্যাবৃদ্ধির আশ্চর্য ক্ষমতা। তারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে ভুয়ো মানুষ। গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে আসা যাক ঘটনাগুলিতে।
ঘটনা ১: ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের মধ্যে মতবিরোধ নতুন নয়। সম্প্রতি এক তরুণী ও এক প্রবীণার মধ্যে ঘটে যাওয়া অকল্পনীয় কলহ চোখে পড়ল। মাতৃসমা সেই প্রবীণা কোনো প্রসঙ্গে এক তরুণীকে বলেন, “গুরুজনের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না? আমি একজন টিচার। তোমার মত কত মেয়ে আমার ছাত্রী ছিল।” মেয়েটি আসল ঝগড়া ভুলে বিকট হেসে বলে ওঠে, “ও বাবা, আপনি স্কুলটিচার নাকি? তাহলে তো ভুয়ো শিক্ষক। তালিকায় নাম বেরোল? নাকি ভয়ে ভয়ে আছেন কোনদিন বেরোবে? ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন আবার এত বড় গলা! রাস্তায় বেরোতে পারবেন না এরপর আপনারা”। ভদ্রমহিলা কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে যান। তারপর ডুকরে বলে ওঠেন, “ওরে আমি তোর জন্মের আগে চাকরি পেয়েছি। তোর জন্মের আগে।” মেয়েটি শাসিয়ে বলে, “চুপ করুন। আপনারা সব সেম। সবকটা চোর। ঘুষ দিয়ে লাইন করে চাকরি পাওয়া।” গোটা কামরা চুপ। এই নিবন্ধকার এবং আরেকটি মেয়ে তীব্র প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়। প্রবীণা অসুস্থ বোধ করেন। বিড়বিড় করে বলেন, “রাস্তা দিয়ে রোজ যখন স্টেশনের পথে যাই আসি, টুপটাপ প্রণাম করতে থাকে পুরনো ছাত্রীরা। কেউ ডাক্তার, কেউ প্রফেসর, কেউ ইঞ্জিনিয়ার! কতকগুলো অসৎ লোকের জন্য এও শোনা প্রাপ্য ছিল?”
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ঘটনা ২: রাজ্যের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকার কাছে স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েই স্টাফরুমে এসে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে তিনটি ছাত্রী। সভয়ে জানায় তারা জানেই না কীভাবে এমএ পাশ করার মত পড়াশোনা করতে হয়। কারণ তারা তা ধাপে ধাপে শিখে আসেনি ইংরেজি অনার্স পড়ার সময়ে। মজার ব্যাপার হল, পাশ করা নিয়ে কিন্তু তাদের কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চিত জানে পাশ তারা করবেই। যতই কম জ্ঞান থাকুক, যতই খারাপ লেখা হোক। খুব ভাল নম্বর পেয়েই পাস করবে। তবে “পড়াশোনা” এবারেও গ্র্যাজুয়েশনের মতই হবে কিনা, এই নিয়ে চিন্তা। কিছু না শিখেই কি প্রচুর নম্বর পেয়ে পাশ করবে? স্তম্ভিত অধ্যাপিকাকে তারা জানায়, যে কলেজে তারা বিএ পড়েছে, সেখানে ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের সে অর্থে ক্লাসই হয়নি লকডাউনের পর থেকে তারা পাস করে বেরনো অবধি। পরীক্ষার আগে অনলাইনে এক দুদিন “সাজেশন” দিয়ে মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের মত “অতি আগ্রহী” কিছু ছাত্রছাত্রী “দয়া করে ক্লাস হোক”, “অমুক অমুক বিষয় বুঝতে পারলাম না”, “প্রশ্ন আছে”, “কিছু শিখতে চাই” – এসব অনুরোধ করলে, জবাব এসেছে “আরে পাশ করা নিয়ে তো কথা। মিনিমাম ৭০% পেয়ে পাস করবে।” হয়েছেও তাই। তারা কুঁকড়ে গিয়েও অকপটে জানায়, “আমরা ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস পড়িনি”, “সনেটে কটা লাইন হয় জানি না”, “শেক্সপিয়র কী কী লিখেছেন ঠিকঠাক নাম জানি না”, “রোম্যান্টিক পোয়েট্রির বৈশিষ্ট্য বলতে পারব না”, “প্যারাডাইস লস্টের গল্পটা জানি না।” ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী মাত্রেই অবহিত থাকবেন, ইংরেজি অনার্স পড়লে, এসব জিনিস না জানা ভয়ংকর অস্বাভাবিক। তারা সলজ্জভাবে বলে, “আমরা কিচ্ছু জানি না। অথচ আপনার চেয়েও হয়ত গ্র্যাজুয়েশনে বেশি নম্বর পেয়েছি। এই কিচ্ছু না জেনে নাম্বার পাওয়ার লজ্জা আমরা বইতে পারছি না। এমএ ক্লাসে শিখতে চাই। আপনারা ক্লাসে পড়াবেন তো? শেখাবেন তো? যোগ্যতা ছাড়া ৭০% দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন না তো?” অধ্যাপিকা এই কথোপকথনের অভিঘাতে মাথায় হাত দিয়ে বিহ্বল হয়ে থাকেন। তারপর তাদের বুঝিয়ে, আশ্বাস দিয়ে, চোখের জল মুছিয়ে বাড়ি পাঠান। কিন্তু অবশ হয়ে থাকেন অসহায়তায় আর কিছুটা শিক্ষক হিসাবে পেশাগত লজ্জায়, অপরাধবোধে।
প্রথম ঘটনায় দেখা গেল এক প্রবীণ শিক্ষিকা, যাঁর সাথে বর্তমানে আবির্ভূত ভুয়ো শিক্ষক প্রজাতির কোন জিনগত মিল নেই, তিনি স্রেফ একই পেশার মানুষ হওয়ায় বদনামের ভাগী হয়েছেন। দ্বিতীয় ঘটনাতেও, আমরা জানি না, মেয়ে দুটি যে কলেজের ছাত্রী সেখানকার শিক্ষক (বা শিক্ষকরা) অন্যায়ভাবে চাকরি পেয়েছেন কিনা। কিন্তু তাঁরাও যে ভিন্ন অর্থে ভুয়ো শিক্ষক তা মানতেই হবে। যে কাজের জন্য আক্ষরিক অর্থেই ঘরে বসে মাইনে পেয়েছেন প্রায় দুবছর, সে কাজ করার কোনো চেষ্টাই করেননি। বরং পড়াশোনায় আগ্রহী ছাত্রীদের অবহেলা, অবজ্ঞা করে গেছেন। ঘুষ দিয়ে কি নেতা ধরে চাকরি না পেলেও এই ধরনের শিক্ষককে প্রকৃত শিক্ষক বলা যায় না।
ঘটনা ৩: সমাজমাধ্যমে বহুল প্রচারিত একটি ভিডিও। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কিছু মেয়ে কাঁদছে। সাংবাদিক তাদের প্রশ্ন করেছেন, “পরীক্ষায় গার্ড কেমন দেওয়া হয়েছে আজ?” মেয়েরা বিলাপ করছে, “গার্ড একদম ভাল দেওয়া হয়নি। খুব বাজে গার্ড দেওয়া হয়েছে”। দ্বিতীয় বাক্যে যাওয়ার আগে যদি প্রথম বাক্যটি আলোচনা করি, তাহলে কী অর্থ হয়? পরীক্ষার ‘ইনভিজিলেটর’, যাঁকে চলতি ভাষায় বলা হয় গার্ড, তার বাংলা অর্থ কি? প্রহরী বা রক্ষক। পরীক্ষার হলের নিয়মগুলির প্রহরী বা রক্ষক তিনি। যে নিয়মগুলির মধ্যে প্রধান হল, পরীক্ষার্থী কোনো অসদুপায় অবলম্বন করতে পারবে না। ক্রন্দনরত মেয়েটি যখন আকুলভাবে বলে, গার্ড একদম ভাল ছিল না, সুস্থ বুদ্ধির দর্শকের ধারণা হওয়ার কথা, গার্ডরা কাজে গাফিলতি করেছেন, সৎভাবে পরীক্ষা পরিচালনা করেননি। কিন্তু একটু পরেই বোঝা যায় ঘটনা তা নয়। কারণ মেয়েগুলি বলে, তারা কঠিন প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারছিল না কারণ ওঁরা “গার্ড লুজ” করছিলেন না। পিছন ঘুরে দেখতেও পারছিল না, কারণ ওঁরা এসে বকে দিচ্ছিলেন। আরেকটি মেয়ে বলছে, “আমি পাশেরজনেরটা দেখছি বলে আমায় এসে বলছে, কেন তুমি ওরটা দেখছ? দূরে সরে বসো। আচ্ছা, কোশ্চেন এত কঠিন এসেছে, আমরা দেখে লিখব না কেন?”
“কেন আমরা দেখে লিখব না?” এই হল ছাত্রীর দাবি! তাদের দেখে লিখতে অনুমতি দেননি, নিজের স্বাভাবিক কর্তব্য মেনে গার্ড দিয়েছেন – এই হল তত্ত্বাবধায়কের গুরুতর অপরাধ। এই ভিডিও নিয়ে সোশাল মিডিয়ার হাসির রোল উঠেছে। ছোট ছোট মেয়েদের এই বয়স থেকেই অপরাধপ্রবণতা বা নীতিবোধের অভাব দেখলে কষ্ট হয় বটে, কিন্তু যে বয়োজ্যেষ্ঠরা তামাশায় মজেছেন, তাঁরা তলিয়ে ভাবছেন না আসল অপরাধী কে। এমন নির্লজ্জ নীতিবোধহীন শিশু, কিশোরদের তৈরি করল কারা? যে ১৪-১৫ বছর বয়সী মেয়ের কথা ছিল রোম্যান্টিক চোখে এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার, যেখানে সব মানুষ দুবেলা দু মুঠো খেতে পাবে, সসম্মানে সৎভাবে রোজগার করবে, সে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছে দুর্নীতির পূতিগন্ধময় শিক্ষাব্যবস্থা তথা সমাজব্যবস্থায়। জ্ঞান হওয়া ইস্তক সে দেখছে চুরি, ঘুষ, কাটমানি, অসততা আর সর্বস্তরে নোংরা রাজনীতি। একরত্তি মেয়ে প্রতিদিন জানছে, যে শিক্ষক তাকে পড়ান তাঁর নিয়োগ সন্দেহজনক। সে শুনেছে যে অনেক শিক্ষক চাকরির পরীক্ষায় সাদা খাতা, ফাঁকা ওএমআর শিট জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। অনেকে আদৌ পরীক্ষা না দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। একদিকে সে দেখছে সৎভাবে পরীক্ষা দিয়ে পাস করা দাদা-দিদিরা রাস্তায় বসে অনশন করছে তবু চাকরি পাচ্ছেন না, অন্যদিকে রাজ্যজুড়ে হাজার হাজার অসৎ লোক লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে শিক্ষক হয়ে বসেছে। সে জানে চাকরি বিক্রি হয়, ডিগ্রি বিক্রি হয়, নম্বর বিক্রি হয়। অতএব মেধার সঙ্গে, পরিশ্রমের সঙ্গে, সততার সঙ্গে সাফল্যের এখন আর কোনো সম্পর্ক নেই।
এই সমাজে একজন কিশোরীর নীতিবোধ তৈরি হবার কি কোনো সুযোগ আছে? তাহলে সে আমাদের হাসির পাত্রী কেন? হয়ত সেদিন পরীক্ষায় যাঁরা গার্ড দিচ্ছিলেন, তাঁরা অত্যন্ত সৎ মাস্টারমশাই-দিদিমণি, নিজেদের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছেন এবং কর্তব্য পালনে অবিচল ছিলেন। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটি সেই প্রথম ঘটনায় উল্লিখিত ট্রেনে দেখা তরুণীটির মতই অবচেতনে বুঝে গেছে “এরা সব চোর”। অতএব সে ভাবছে নিজে চোর হয়ে কী করে অন্যকে চুরি করতে বাধা দেওয়া যায়? তাকে একটি সৎ শিক্ষাব্যবস্থা দিতে না পারার দায় কি আমাদের নয়? নাকি আমরা শুধুই হ্যা হ্যা করে হেসে চলব আর পরবর্তী কেচ্ছায় মন দেব?
ঘটনা ৪: এক অধ্যাপিকা বন্ধুর কাছ থেকে কদিন আগেই শুনলাম আরেকটি নিদারুণ গল্প। তার ছাত্রীদের সেমেস্টার পরীক্ষার সিট পড়েছে একটি কলেজে। ছাত্রীরা নাকি প্রিয় ম্যাডামকে পরীক্ষা দিয়ে এসে জানিয়েছে, গার্ডরা সাবলীলভাবেই বলেছেন, “তোমরা বই দেখে লেখো, নোট দেখে লেখো, মোবাইল দেখে লেখো, যা ইচ্ছা করো। কোনো অসুবিধা নেই। এমনিও এত এত নম্বর পাবে, অমনিও পাবে। কে আর খাতা পড়বে! যা খুশি করো।” অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী খুশি হয়েছে। কিন্তু কেউ কেউ চমকে গেছে, আহত হয়েছে। তাদের এতদিন শিখে আসা নীতিবোধ গুলিয়ে গেছে শিক্ষকের মুখেই অসৎ হবার পরামর্শ শুনে। সেই ইনভিজিলেটর অধ্যাপক হয়ত পিএইচডি, নামী দামী জায়গায় পাব্লিকেশন আছে তাঁর, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে হয়ত তুখোড় অ্যাকসেন্টে বক্তৃতা দেন। কিন্তু এঁকেও তো ভুয়ো শিক্ষক না বলে উপায় নেই।
এই চারটি সম্পর্কহীন ঘটনা থেকে কিন্তু একটি কথা পরিষ্কার বোঝা যায় – এ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার কী চরম দুর্দশা। আমরা নিজেদের নিশ্চিন্ত অবস্থান থেকে আহা উহু করছি হয়ত, কিন্তু জানতেই পারছি না বা জানার চেষ্টা করছি না, শিক্ষাব্যবস্থার দুই স্তম্ভ – শিক্ষক এবং ছাত্রসমাজ কীভাবে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রের মহামারী গিলে খেয়েছে এদের পারস্পরিক বিশ্বাসকে। শিক্ষক জানেন ছাত্রছাত্রী টুকে লিখেছে, অতএব তার খাতা পড়ে সময় নষ্ট করার মানে হয় না, গড়ে মূল্যায়ন করে দেবেন। ছাত্রছাত্রী জানে, শিক্ষক খাতা পড়ে তার উত্তরের মান যাচাই করবেন না, অতএব সে পড়াশোনা ভালভাবে করে না, সুযোগ পেলেই টোকে। অবিশ্বাসের দুষ্টচক্র নির্বিকারে ঘুরে চলেছে। একদিকে মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চ থেকে নির্দ্বিধায় বলেন, “কোনো পরীক্ষা যদি খারাপ হয়, আমাদের নজরে এলে আমরা দেখে নেব”। “দেখে নেব” মানে কী, তা শাসককে প্রশ্ন করার সাহস আমাদের কারোর না থাকায় খাতা দেখার সময়ে শিক্ষক ভাবেন, বেশি বেশি নম্বর দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলি। অন্য দিকে পরীক্ষার্থীর অভিভাবক সেই আশ্বাসের বলে বলীয়ান হয়ে চিৎকার করে টিভি চ্যানেলে বলেন, “আমাদের চিন্তা নেই। পরীক্ষা যেমনই দিক না কেন, ঠিক পাশ করবে। দিদি ঠিক পাশ করিয়ে দেবে আমাদের মেয়েদের।” দিদিটি কে তা বলাই বাহুল্য।
আমরা রোজ কাগজে পড়ছি বর্ধিত স্কুলছুটের সংখ্যা, পড়ছি কত শতাংশ কিশোর স্কুল ছেড়ে চলে গেছে অন্য রাজ্যে প্রবাসী শ্রমিক হয়ে। শুনছি আট হাজারের বেশি প্রাইমারি স্কুল বন্ধ হতে চলেছে, পড়ছি মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কত লক্ষ কমল, দেখছি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বেরনো অসংখ্য মেয়ের কপালে সিঁদুর, জানছি মিড ডে মিলের দুরবস্থা, কপাল চাপড়াচ্ছি জেলায় জেলায় কত সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তা পড়ে, ইউনেস্কো প্রকাশিত রিপোর্টে দেখছি রাজ্যে এক লক্ষের বেশি শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ বাকি, গ্রামবাংলার প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক স্কুলগুলি পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে।
পরিকল্পিতভাবে আমাদের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হচ্ছে। একদিকে শিক্ষকের অভাবে স্কুল অচল, অন্যদিকে স্কুলছুট, ছাত্রছাত্রীর অভাবজনিত কারণে সরকারপোষিত স্কুল বন্ধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ফুলে ফেঁপে উঠছে বেসরকারি স্কুলে আর টিউশনে বা এডুকেশন অ্যাপে শিক্ষা কেনাবেচার বাজার। ফলে ছাত্র- শিক্ষক সম্পর্ক আজ পরিণত হয়েছে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কে। অর্থ এই লেনদেনের ভিত্তি হওয়ায় যাদের অর্থের অভাব, সেই পড়ুয়ারা বঞ্চিত হবে শিক্ষা নামক মৌলিক অধিকার থেকে। যে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ছিল বলে অসংখ্য অভাবী পরিবারের প্রথম প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে যোগ্যতার বিচারে চাকরিবাকরি পেয়েছিল, তার বিলুপ্তিতে অসংখ্য ছেলেমেয়ে আগামী দিনে তলিয়ে যাবে অন্ধকারে।
আরো পড়ুন নিয়োগ দুর্নীতি: চাকরি নয়, প্রার্থীদের জন্য বরাদ্দ শুধু হতাশা
শিক্ষকতা শুধু রোজগারের পথ ছিল না। বলতে দ্বিধা নেই, এই ভুয়ো শিক্ষকরা আজও সংখ্যালঘু। সৎ, ছাত্রদরদী শিক্ষকরা তাদের কয়েকগুণ বেশি। ব্যক্তিগত জীবনে অসংখ্য অনুকরণীয় শিক্ষককে দেখার সুযোগ হয়েছে, যাঁরা শুধু ক্লাসরুমে ভাল পড়ান তাই নয়, নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসেন। বিপদে পাশে থাকেন, সুপরামর্শ দেন, অভাবী শিক্ষার্থীকে বই কিনে দেন, বিনা বেতনে পড়ান, পরীক্ষার ফিজ দিয়ে দেন নিজের পকেট থেকে। স্কুল, কলেজের পরিসরের বাইরেও তাঁরা অনেক দায়িত্ব পালন করেন। নাবালিকার বিয়ে রুখতে ছুটে যান, গার্হস্থ্য হিংসার শিকার ছাত্রীকে থানায় নিয়ে যান, সাপে কাটা ছেলেকে কোলে করে হাসপাতালে ছোটেন, দুর্ঘটনায় আহত ছাত্রকে রক্ত দেন, বাবা মারা যাওয়া ছাত্রীর পরিবারের জন্য টাকা তোলেন, ঝড়ে-বন্যায় বিপন্ন ছাত্রছাত্রীর পরিবারের জন্য সর্বস্ব পণ করে পাশে দাঁড়ান।
অতএব মনে রাখতে হবে, শিক্ষক-ছাত্রের যৌথ ভবিষ্যৎকে বাঁচানোর কর্তব্য আমাদের বর্তমানে দাঁড়িয়েই পালন করতে হবে। নতুবা ক্লাস শেষ করে পিছন ফিরলেই আমার-আপনার আদরের ছেলেমেয়েরা ফিসফিসিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করবে, আমরা কীভাবে চাকরি পেয়েছি? নেতা না নোট? রাজনৈতিক অন্যায়ে যে বদনামের ভাগী হয়েছে শিক্ষককুল, তা ঘোচানোর দায়িত্ব সমবেতভাবে শিক্ষকদেরই নিতে হবে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
“বলতে দ্বিধা নেই, এই ভুয়ো শিক্ষকরা আজও সংখ্যালঘু।”
একজন ভুয়ো শিক্ষক থাকলেও বিষয়টা চূড়ান্ত অনৈতিক, এবং ব্যর্থ, সেখানে সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু এই কথাগুলো অর্থহীন । বরং বলতে দ্বিধাবোধ করলে কিছুটা আশ্বস্ত হওয়া যেত।