“কত দিলে সন্তুষ্ট হবেন, বলতে পারেন? আর কী কী পেলে খুশি হবেন, নন্দলালেরা? … এর থেকে বেশি দেওয়া সম্ভব নয়। পছন্দ না হলে আমার মুণ্ডু কেটে নিয়ে যান” (সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ মার্চ ২০২৩)। বকেয়া ডিএ (মহার্ঘ ভাতা) মেটানোর ন্যায্য দাবিকে এই ভাষাতে বিদ্রুপ করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বিদ্রুপের সঙ্গে রইল প্ররোচনামূলক বক্তব্য। গত ৬ মার্চ বিধানসভায় দাঁড়িয়ে এভাবেই কুকথার নজির সৃষ্টি করলেন তিনি। কুকথা ও বিদ্বেষের প্রতিযোগিতা বঙ্গ রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এখন পরিচিত। দুদিন আগেই বিধানসভার একটি আসনের উপনির্বাচনের ফলাফলের পর সেই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের নজির দেখা গেছে। কুকথাই এখন অনেক রাজনৈতিক নেতাদের টিআরপি বাড়ায়। অন্তত তাঁরা তাই মনে করছেন। যে বিধানসভায় তৃণমূলের আমলে একাধিকবার মন্ত্রীমশাই ও বিধায়কদের ডেইলি অ্যালাউয়েন্স (দৈনিক ভাতা) বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই বিধানসভাতেই কর্মচারীদের বকেয়া ডিএ নিয়ে এমন মন্তব্য!

এখন প্রশ্ন তোলা মানা। যুক্তিপূর্ণ কথা বলা অন্যায়। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করো আর পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দাও। কর্মচারী ও পেনশনভোগীরা বকেয়া ডিএ চাইলেই রাজ্যের আর্থিক সঙ্কটের কথা বলা হয়। চাকরির বেলাতেও তাই। জনগণকে অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হবে, কিন্তু ‘জনপ্রতিনিধিদের’ বেতন আর ডিএ বাড়বে। সরকারি বিজ্ঞাপন, উৎসবে কোটি কোটি টাকা খরচ হবে। এর আগেও মহার্ঘ ভাতার দাবিকে ঘেউ ঘেউ করা বলে কর্মচারী, শিক্ষকদের চূড়ান্ত অপমান করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বারবার সরকার ও শাসক দলের তরফ থেকে এই দাবিকে বিদ্রুপ করা হয়েছে। জনসাধারণকে বোঝানো হয়েছে, আর্থিক সংকটের মধ্যে এই দাবি তোলা স্বার্থপরতা। ডিএ দিলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সমেত নানা খাতে অর্থ দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তাই বাড়তি ডিএর দাবি তোলা অযৌক্তিক। দিন কয়েক আগে রাজ্যের একজন মন্ত্রী না পোষালে সরকারি কর্মচারীদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। শ্রমিকদের উদ্দেশে মালিক পক্ষ এমন মন্তব্যই করে। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে কর্মচারীদের উদ্দেশে একজন মন্ত্রীর এই উক্তি ভয়ঙ্কর। বিশেষত যেখানে তাঁদের নিজেদের বেতন বহুগুণ বেড়েছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

বামফ্রন্ট আমলে বিধায়কদের ভাতা ছিল দৈনিক ৭৫০ টাকা। মুখ্যমন্ত্রীর মাসিক বেতন ছিল ৮,৫০০ টাকা, মন্ত্রীদের ৭,৫০০ টাকা। ২০১১ সালে রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। তারপর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনবার মন্ত্রী ও বিধায়কদের বেতন, ভাতা বেড়েছে। ২০১৯ সালে দৈনিক ভাতা বাড়িয়ে করা হয় ২,০০০ টাকা। মন্ত্রীদের ৩,০০০ টাকা। অর্থাৎ দৈনিক ভাতা বাবদ মাসে বিধায়কদের প্রাপ্তি ৬০,০০০ টাকা, মন্ত্রীমশাইদের ৯০,০০০ টাকা। তখন থেকে পূর্ণমন্ত্রীরা ২২,০০০ টাকা বেতনসহ সব মিলিয়ে পান ১,১২,০০০ টাকার বেশি। রাষ্ট্রমন্ত্রীরা সামান্য কম, আর বিধায়করা পান প্রায় ৮২,০০০ টাকা। এরপরেও ভাতা বাড়ানোর প্রসঙ্গ এসেছে। আবার বলা হয়, অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় তাঁদের বেতন নাকি কম। অথচ, কর্মচারীদের ডিএ নিয়ে অন্য রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করলেই আক্রমণ করা হবে।

বকেয়া ডিএ মেটানোর দাবিতে কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীসহ রাজ্য সরকারের বেতনভুক কর্মচারীরা বহুদিন ধরেই আন্দোলন চালাচ্ছেন। প্রথম থেকেই সরকার ও শাসক দল এই আন্দোলনের ওপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। কখনো বেতন কেটে নেওয়া সমেত নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার হুমকি, আবার কখনো কুকথা বলে জনসাধারণকে খেপিয়ে দেওয়ার অপকৌশল। গত ৬ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় আরও বলেছেন, ডিএ মেটাতে গিয়ে নাকি পেনশন বন্ধ করতে হবে। পেনশনভোগীদের সঙ্গে কর্মরতদের বিরোধ বাধাতে চেয়েছেন তিনি। অথচ, পেনশনভোগীরাও বকেয়া ডিএর দাবি জানাচ্ছেন। আন্দোলনের ঐক্যে ফাটল ধরাতেই এমন কুকথা। তিনি আরও বলেছেন, সরকারি কর্মীদের অনেক ছুটি দেওয়া হয়। অর্থাৎ ছুটির কথা বলে অধিকার কেড়ে নেওয়ার অপযুক্তি। সাধারণ মানুষও ভাববেন, এত ছুটি পাওয়ার পরেও আর্থিক দাবি করা অযৌক্তিক।

কিন্তু ঘটনা হল, সরকারি কর্মচারীদের বা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের নিয়োগ করা হয় মানুষকে পরিষেবা দিতে। নিযুক্তদের ছুটি দিতে নয়। তাঁরা যাতে ঠিকমত পরিষেবা দেন তা দেখার পাশাপাশি তাঁদের প্রাপ্য দেওয়া সরকারেরই দায়িত্ব। মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় সরকারি আমলা ও কর্মচারীদের কাজ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। অথচ তাঁরা যথাযথ দায়িত্ব পালন না করলে সরকার তথা খোদ মুখ্যমন্ত্রী দায় এড়াতে পারেন না। আবার ডিএ না দিয়ে বেশি ছুটি দেওয়াও মুখ্যমন্ত্রীরই ব্যর্থতা।

ডিএ প্রত্যেক কর্মরত কর্মচারী ও পেনশনভোগীর অধিকার। কোনো ভিক্ষা নয় যে, বেশি ছুটি দিয়ে সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে। যেমন চাকরি পাওয়া প্রত্যেক বেকারের অধিকার। চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিদ্যালয়ে নিযুক্ত হওয়া প্রত্যেক হবু শিক্ষকের অধিকার। ন্যূনতম আর্থিক উপার্জন প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। তাই ডিএ, চাকরিপ্রাপ্তি, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারসহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে সুবিধাপ্রাপ্তির মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। এক পক্ষের অধিকারের আন্দোলন, অপর পক্ষের আন্দোলনকে শক্তিশালী করে। বরং মন্ত্রীমশাইদের বহুগুণ বেশি ভাতা পাওয়ার অধিকার আছে কিনা সেটা বড় প্রশ্ন। সেই প্রশ্নটাকেই তৃণমূল আড়াল করে দিতে চাইছে।

সুকৌশলে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে অধিকারের লড়াইকে সরকার দুর্বল করতে চায়। লক্ষ্য কম অর্থে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ এবং পরিষেবা ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ। দীর্ঘদিন বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ ঠিক মত হচ্ছে না। সাড়ে তিন লক্ষের বেশি শিক্ষক পদ শূন্য। সরকারি শূন্যপদ আড়াই লক্ষের বেশি। সব মিলিয়ে সাড়ে ছয় লক্ষের বেশি শূন্যপদ রয়েছে। শিক্ষকের বদলে অতি সামান্য অর্থের বিনিময়ে সিভিক শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে। ছাত্রীছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়ার অজুহাতে সরকারি বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এভাবেই উৎসাহিত হচ্ছে শিক্ষার বেসরকারিকরণ। এখন আবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে সিভিক পুলিশদেরই স্থায়ী চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ, অনুগত সিভিক পুলিশদের স্থায়ী করার প্রলোভন। দলবাজি, কাটমানির অবাধ রাজত্ব। এদিকে ডিএ না দিয়ে, আগামীদিনে পেনশন বন্ধের হুমকি দিয়ে অধিকার কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে একই চিত্র। ডিএ না দেওয়া, পেনশন অনিশ্চিত করার প্রতিযোগিতা চলছে। তৃণমূল সরকারও সেই প্রতিযোগিতায় সামিল।

আরো পড়ুন পঞ্চায়েত: দুর্নীতি আর তরজায় ব্রাত্য ভোটারের অংশগ্রহণ

বকেয়া ডিএ মেটানো নিয়ে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের আন্দোলন ৪০ দিন অতিক্রম করেছে। পঁচিশ দিনের বেশি চলছে অনশন। অনেকেই অসুস্থ হয়েছেন। সরকার তবুও অনড়। পাশাপাশি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবু শিক্ষকরা। কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের ডিএ আন্দোলনের সঙ্গে হবু শিক্ষকদের নিয়োগের আন্দোলনের বিরোধ নেই। বিরোধ নেই প্রতিটি শূন্য পদে স্থায়ী নিয়োগের আন্দোলনের। আবার স্থায়ী নিয়োগের আন্দোলনের সঙ্গে অস্থায়ী কর্মীদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের মধ্যেও কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সরকারি কর্মচারী-শিক্ষকদের আন্দোলনের সঙ্গে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে বিরোধ নেই। শাসকই এই বিরোধ লাগাতে চায়। আগামী ১০ মার্চ ডিএ আন্দোলনকারীরা ধর্মঘট ডেকেছেন। আন্দোলনের চাপে সরকার মাত্র তিন শতাংশ ডিএ দেওয়ার কথা বলেছে। বকেয়া রয়েছে বহুগুণ। ১০ মার্চের ধর্মঘট রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে চলমান সব আন্দোলনের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলুক। অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পারে সরকারের দম্ভ চূর্ণ করতে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.