শ্রাবন্তী ঘোষাল

কোনো এক বসন্তের সকাল। শীতের জরা কাটিয়ে গাছে নতুন পাতা, ক্ষেতে হলুদ সর্ষে ফুল, দূরে কোথাও পাখির ডাকে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ রঙে ঝলমলে হোলি পালনে কলরব করতে করতে চলেছে। ললিত রাগে পৃথিবীর রূপের হাটের বাহার দেখে তারা ভুলেছে জীবন যন্ত্রণা। এমন বসন্তে আপনজনের মৃত্যুশোকে বিহ্বল এক সুফী সাধক স্বেচ্ছায় নিজেকে অন্তরীন করে রেখেছেন সাধনা আর অনুশাসনের কঠোর নিগড়ে। তাঁর প্রধান শিষ্য কবি-যন্ত্রী-সুরসাধক মুর্শিদের বিহনে ম্রিয়মাণ। মাঠের বাঁশি শুনে তিনি ঠিক করলেন আর শোক নয়, এমন দিনে মুর্শিদের কাছে তিনি যাবেনই, ভাঙবেন তাঁর শোকের সাধন। হলুদ ঘাগরা, হলুদ ওড়নায় নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে, হলুদ ফুলে সেজে ঢোল বাজিয়ে ব্রজভাষায় গান গাইতে গাইতে তিনি হাজির হন আউলিয়ার দুয়ারে। “আজ বসন্ত মনা লে সুহাগন”-এর সুরে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে আসেন নিজামুদ্দীন আউলিয়া। প্রিয়তম ভাগ্নে খাজা তাকিউদ্দীন নুহের মৃত্যুতে চিল্লা-ই-শরীফ শেষে বেরিয়ে আসেন বসন্তের আহ্বানে, শিষ্যের ডাকে।

এত সুন্দর পার্থিব জীবনের যিনি স্রষ্টা, তাঁর প্রতি আত্মনিবেদন জানানোর ভাষা ভালবাসা ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে। যা ভালবাসা, তা-ই শ্রদ্ধার হাত ধরে কখন যেন প্রার্থনায় পরিণত হয়। হলুদ রঙে কাপড় ছুপিয়ে সেই কাপড় মাথায় বেঁধে আজও শোভাযাত্রা সহকারে কাওয়ালি গাইতে গাইতে সন্ত নিজামুদ্দীনের দরগায় সমবেত হন হাজার হাজার ভক্ত-প্রেমিক-সাধক। মহা সমারোহে দিল্লির নিজামুদ্দীন আউলিয়ার দরগায় হলুদ ফুল, হলুদ পাগড়ি আর হোলি উৎসবের কাওয়ালির উর্সে বন্দিত হন মুর্শিদ। অনুরণিত হয় ভারতভূমির অন্তর্নিহিত সাম্প্রদায়িক ঐক্যের সুর।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

হজরত নিজামুদ্দীন আউলিয়ার দরগার বর্তমান খাদেম ফরিদ আহমেদ নিজামী, যিনি নিজামুদ্দীনের পরম্পরার ২১তম উত্তরাধিকারী। তিনি বলেছেন, দরগায় হোলি আসলে সম্প্রীতির উৎসব। ভালবাসা ছড়িয়ে দেওয়ার, প্রকৃতির রঙে জীবন রাঙিয়ে নেওয়ার এমন অপূর্ব আনন্দের দিনে নিজের ভালবাসার মানুষকে নিয়ে উদযাপনই হোলি।

আজ রঙ্গ হ্যায়, হ্যায় মা রঙ্গ হ্যায় রি,
মেরে মেহবুব কে ঘর রঙ্গ হ্যায় রি
সজন মিলাওয়ে রে, সজন মিলাওরে
মোরে আঙ্গন কো
আজ রঙ্গ হ্যায়…
মোহে পীর পায়ো নিজামুদ্দীন আউলিয়া,
নিজামুদ্দীন আউলিয়া মোহে পীর পায়ো,
দেশ বিদেশ ম্যায় ঢুন্ড ফিরি হুঁ,
তোরা রঙ্গ ম্যায় ভায়ো রি
জগ উজিয়ারো,জগত উজিয়ারো
ম্যায় তো আ্যায়সি রঙ্গ ঔর নাহি দেখি রে
ম্যায় তো জব দেখুঁ তেরা সঙ্গ হ্যায়,
আজ রঙ্গ হ্যায় হে মা রঙ্গ হ্যায় রি।

রঙের প্রতি, মুর্শিদের প্রতি আত্মনিবেদনের, ভালবাসার এই সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের ধারার অন্যতম নিদর্শন। বাহার রাগে নিবদ্ধ আমীর খসরুর রচনা “আজ রচো হ্যায় বসন্ত নিজাম ঘর,/দুনিয়া সব মিল গয়ে বসন্ত” এমন এক বসন্ত রচনা করে যেখানে চিশতী ধারার সুফীবাদ এক বিপুল ভাবের আদানপ্রদানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে আসছে সেই চতুর্দশ শতক থেকে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষ জমায়েত হয়ে শুধুমাত্র এই দিন দরগার ভিতরের মাজারে কাওয়ালি গাওয়ার অনুমতি পায়।

আ এরি সখী মোরে খাজা ঘর আয়ে
ভাগ লাগে ইস আঙ্গন কো
আপনি পিয়া কো ম্যায় বোল বোল জাউঁ,
চরণ লাগাও নির্ধন কো।

এই সাধনধারায় উত্তর প্রজন্ম বাহিত হয়েছে। সপ্তদশ শতকের পাঞ্জাবি সুফী কবি বুল্লে শাহ বেঁধেছেন বিসমিল্লাহ বলে হোলি খেলার কালাম। গঙ্গা, যমুনা বিধৌত জনপদে বসে তিনি লিখছেন

হোরি খেলুঙ্গি কহে বিসমিল্লাহ,
নাম নবী কি রতন চড়ি, বুন্দ পড়ি আল্লাহ, আল্লাহ,
রঙ্গ রঙ্গিলি ওয়হি খিলাওয়ে, জিস শিখি হো ফনা ফি আল্লাহ,
“আলাস্তু বি রাব্বিকুম” প্রীতম বোলে
সব সঁখিয়া নে ঘুঙ্ঘট খোলে,
“কালু বালা” য়ুঁ হি কার বোলে,
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
হোরি খেলুঙ্গি কহে বিসমিল্লাহ

বিশ শতকের সন্ত কবি হজরত জাহিন শাহ তাজহি ফারুকী লেখেন

হোরি হো রাহি হ্যায়
আহমেদ জীয়ো কি দ্বার,
হজরত আলী কা রঙ্গ বানো হ্যায়
হাসান হোসেন খিলার।
অ্যায়সো হোরি কি ধুম মচি হ্যায়,
চাহু অউর পারি হ্যায় পুকার…

কাওয়ালি-গজলের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী, পাকিস্তানি গায়িকা আবিদা পারভীনের কণ্ঠে এই গীত পরিচিতি পেয়েছে। শুধুমাত্র নিজামুদ্দীন আউলিয়ার দরগা নয়, বাবা ওয়ারিশ আলীর দেওয়া শরীফ সহ আরও নানা দরগাতেই হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ এভাবেই দোলপূর্ণিমায় বা বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে হোলির উর্স মহা সমারোহে পালন করেন।

আরো পড়ুন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ: গতায়াতের ভুবন

স্থান, কাল, পাত্র বারবার পালটে গেলেও ভালবাসা তার দোসর খুঁজে নেয়। আনুমানিক ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপে দোলপূর্ণিমা তিথিতেই জন্মগ্রহণ করেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, যাঁর জীবন ও যাপন বাঙালীর মনন, সাহিত্য, সঙ্গীতে এক নতুন জাগরণের সূচনা করে। ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের আধিপত্যকে নস্যাৎ করে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণিকে কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা করে দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন একই সাথে সাধক, প্রেমিক, পাগল – সর্বোপরি ভাবের মানুষ।

এভাবে রঙে রং, মনে মন, সুরে সুর মিশে যায় বারবার। সুফী এসে ভক্তির হাত ধরে। মানবীয় প্রেমের মুগ্ধতা, আত্মনিবেদন দিব্যপ্রেমের মার্গ খুঁজে নেয়। শুধু আক্ষেপ থেকে যায়, এমন ভাব-ভালবাসার ভারতভূমি এখন ধূসর অতীত।

নিবন্ধকার পেশায় স্কুলশিক্ষিকা। বাংলার উৎসব, খাদ্যসংস্কৃতিতে আগ্রহী। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.