রবীন্দ্রনাথের ‘খাতা’ গল্পের উমাকে মনে পড়ে? কিংবা ‘দর্পহরণ’ গল্পের নির্ঝরিণী? একজন খাতার পাতায় অবারিত করতে চেয়েছিল তার না বলা কথাগুলিকে। অন্যজন লিখনশৈলীর মুনশিয়ানায় ছাপিয়ে যায় তার নিজের স্বামীকেই।

দুক্ষেত্রেই কিন্তু পরিণতি যা হয়েছিল, তা মোটের উপর একইরকম। উমার একান্ত নিভৃতের সেই সম্পদ স্বামী, ননদদের নিষ্ঠুর বিদ্রুপের উপাদানে পরিণত হয়। আর নির্ঝরিণী স্বেচ্ছায় নিজেকে আড়ালে রেখে স্বামীকে গৌরবান্বিত করার মহৎ লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করে। দুক্ষেত্রেই মেয়েদের আত্মপ্রকাশের উন্মুক্ত পরিসরে আগল টানে পুরুষপ্রধান সমাজ থেকে উঠে আসা সংস্কার কিংবা অবদমন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

শুধুই কি আত্মপ্রকাশ? যে সমাজে চোখ রাঙানি কিংবা ফিসফাসের ভয়ে সীমিত রাখতে হয় মেয়েদের অনর্গল যাপনের চৌহদ্দি, সেখানে নিজেকে চেনার সুযোগটুকুও কি সহজে পাওয়া যায়? আত্মদীপের আলোয় কি আদৌ উদ্ভাসিত করা যায় নিজের গহনতম সত্তাকে, কবিতা হয়ে ওঠার যা এক অনিবার্য শর্ত?

লক্ষণীয়, উমা কিংবা নির্ঝরিণী – কেউই কিন্তু কবিতা লিখত না। নির্ঝরিণী লিখত গল্প। আর উমা চারপাশের তুচ্ছ ঘটনাবলি আর নিজের অনুভবকে স্থায়ী করে রাখতে চেয়েছিল সাদা পাতায় ফুটিয়ে তোলা অক্ষরে। তার সঙ্গে আজকের ডায়েরি লেখার তেমন কোনো ফারাক নেই। কিন্তু উনিশ শতকের সেই পুরুষশাসিত পৃথিবীতে মেয়েদের সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনা দূরের কথা, নিজের ভাবনাকে ভাষায় প্রকাশ করাও রীতিমত স্পর্ধার ব্যাপার! কেবল কলমটুকু হাতে তুলে নিতেই দেশে বিদেশে মেয়েদের লড়াই করতে হয়েছে অনেকখানি। বাংলা কবিতার পরিধিজুড়ে সেই লড়াইয়েরই এক কালানুক্রমিক ইতিহাস যেন ধরা পড়ল যশোধরা রায়চৌধুরী সংকলিত ও সম্পাদিত অনবদমনের কবিতা সংকলনে।

এ বইয়ের উপশিরোনাম – ‘বাংলা কবিতায় নারীর স্বর ও শরীরী কথন’। প্রশ্ন উঠতেই পারে, নারীর নিজস্ব স্বর তুলে আনার জন্য কেন বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হল তার ‘শরীরী কথন’-কে? ভূমিকাতেই এর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সম্পাদক। বলেছেন, “…অবধারিতভাবে লিঙ্গরাজনীতির মূল বিভাজক তো শরীর, তাই বৈষম্যের কথা বলতে গেলে শরীরের কথা তো বলতেই হবে। আর সেটা বলবে কে? যে এই বৈষম্যের ভিক্টিম বা শিকার রিসিভিং এন্ডে, সেই নারীই তো? অতএব, নারী লেখক বা কবিকে অন্তত একবারের জন্য, পুরুষের আধিপত্য ও অধিকারের ক্ষেত্র হয়ে ওঠা এই শরীরের উল্লেখ করতেই হয়।”

বস্তুত, নারী শরীরের চিহ্নায়কগুলিই সমাজের চোখে হয়ে উঠেছে এমন এক ভূমির সমার্থক যাকে অধিকার করা যায়, যার গায়ে এঁকে রাখা যায় যুগান্তরের শিকলচিহ্ন। বিষয়ী বা ভোক্তা নয়, বরাবরের মত যাকে রাখা যায় বিষয় তথা ভোগ্যের ভূমিকায়। সুতরাং নারী নিজেই যখন সেই চিহ্নায়কগুলির পুনর্নির্মাণ করতে চায়, নতুন করে আবিষ্কার করতে চায় তাদের, তখন তা প্রতিবাদের এক নতুনতর দিগন্ত রচনা করে বৈকি! এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা যাক এই বইয়েই ঠাঁই পাওয়া একটি কবিতার কয়েক পংক্তি

জমি। কর্ষণ যুক্ত জমি। সুফলা জমির
উপমায় এতবার ব্যবহৃত হয়েছি –
আর তোমরা হালচষা কৃষক

…বাঁকানো মেরুদণ্ডটি
সেই বিতর্কিত হাল
যা চিরকালীন পুরুষ অধ্যুষিত ছিল
অল্প
অভ্যাসে আমিও তাকে আয়ত্তে আনি।”

(“হলাসন”, ‘তৃষার শব্দকোষ’; তৃপ্তি সান্ত্রা)

ঠিক যেমন করে এখানে কবি চিরকালীন পুরুষ অধ্যুষিত দেহকে নিজ নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছেন, স্মরণাতীত কাল ধরে পুরুষ অধ্যুষিত বাংলা ভাষা এবং বাংলা কবিতার জমিকে নারী কবিরা আনতে চাইলেন নিজেদের অধিকারে। নিশ্চিত করতে চাইলেন নিজেদের অব্যাহত চলাচল। তার অনিবার্য এক অংশ হয়ে রইল নারীর দেহবোধ। সেই যাত্রাপথের এক অনুপুঙ্খ দলিল পাঠক পাবেন এই বইতে।

নারীবাদী তাত্ত্বিক এলেইন শোয়াল্টার মেয়েদের লেখালিখিকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছিলেন। প্রথম পর্যায়ের নাম ‘ফেমিনিন’। ইউরোপে ভিক্টোরিয় বাতাবরণের মধ্যেই যে সব মেয়েরা কলম ধরেছিলেন, লেখার রীতি ও ভাষা গড়ে তুলেছিলেন খানিক যেন পুরুষের অনুকরণ করেই, তাঁদের লেখালিখি এই স্তরের অন্তর্গত। দ্বিতীয় পর্যায়টি হল ‘ফেমিনিস্ট’। এই পর্যায়ে মেয়েরা ধীরে ধীরে চিনে নিচ্ছিলেন পুরুষতান্ত্রিক অবদমনের চেহারা। সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে ওঠা এবং সমানাধিকার আদায়ের লড়াইয়ের পাশাপাশি লেখার মধ্যে দিয়েও ফুটে উঠছিল প্রতিবাদী ও প্রতিস্পর্ধী স্বর। তৃতীয় পর্যায়ে এসে পুরুষের সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টার বদলে দেখা গেল নারীর আত্ম আবিষ্কারের অভীপ্সা। শরীর এবং মনোরাজ্যে যে সব অভিজ্ঞতা একান্তভাবে নারীর নিজস্ব, তাকেই লিপিবদ্ধ করতে চাইলেন নতুন যুগের নারীবাদী লেখকেরা। নারীবাদের ক্ষেত্রে তৈরি হল ‘এসেনশিয়ালিজমের’ ভাবনা।

এই সংকলনের অধিকাংশ কবিতাই হয় ‘ফেমিনিস্ট’ নতুবা ‘ফেমিনিন’ পর্যায়ের। অনেক ক্ষেত্রে এ দুইয়ের সীমারেখাটিও যেন আবছা হয়ে এসেছে। তাই পুরুষের প্রতি, পুরুষপ্রধান সমাজের প্রতি যে কবি ছুঁড়ে দেন ঘৃণা, ক্ষোভ কিংবা অবজ্ঞাময় সংলাপ তাঁর কবিতা যেমন এই সংকলনে ঠাঁই পায়, তেমনি পুরুষের প্রতি প্রেমের প্রকাশেও নারী যখন খুঁজে নেয় নিজস্ব ভাষাভঙ্গী, কিংবা যখন সে বিষয়ী থেকে বিষয় হয়ে উঠতে চায় প্রেম অথবা যৌনতার ক্ষেত্রেও, সেইসব কবিতার অমোঘ উপস্থিতি রয়ে যায় এ সংকলনের পাতায় পাতায়।

এই বইয়ের পাঠকের অন্যতম প্রাপ্তি যশোধরা রায়চৌধুরীর ভূমিকা। শুরুতে যদিও তিনি ডিসক্লেইমার দেন “সম্পূর্ণ নিরাসক্ত কোনো পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধরচনা এই লেখকের লক্ষ্য নয়। একশো শতাংশ বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা করে পৃথিবীতে কোনো লেখা হয়নি, হবার ধারণাটাও একটা পুরুষতান্ত্রিক মিথ বলে মনে হয়।…”, তারপরেও উনিশ শতকের অন্তঃপুরচারিণী থেকে হাল আমলের নারী কবিদের কবিতায় নিজস্ব স্বর জ্ঞাপনের পরম্পরাকে তিনি তুলে ধরেছেন ঐকান্তিক সততায়। সেখানে গবেষকের নিবিড় অনুধ্যান যেমন আছে, তেমনি সাধারণ অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাছেও আদৃত হবে এই ভূমিকা। তাঁর লেখা শুরু হয়েছে কুসুমকুমারী, অন্নদাসুন্দরী দেবীদের কবিজীবনের বিবৃতিতে। তাঁদের কারোর ক্ষেত্রে সংসারের কাজের সর্বগ্রাসিতা রুদ্ধ করেছে কলমের অবারিত গতি, কাউকে আবার উমার মতই খাতার ‘দুই মলাটের ভেতরে নিজের অস্তিত্বকে পুরে, গোপনীয়তায় মুড়ে…অবাঞ্ছিত চক্ষু বা হাসিঠাট্টা থেকে লুকিয়ে’ রাখতে হয়েছে নিজেদের সৃষ্টিশীলতাকে। সেই বিন্দু থেকে ক্রমে অনেক দূরে যাত্রা করে বাংলা কবিতা। পূর্বনারীদের ঋণ যথাযথভাবে স্বীকার করেই সম্পাদক পৌঁছে যেতে চান নব্বই বা শূন্য দশকের নারী কবিদের পথরেখা পর্যন্ত। অপরাজিতা দেবী, রাজলক্ষ্মী দেবী, কবিতা সিংহ, বিজয়া মুখোপাধ্যায় থেকে অনুরাধা মহাপাত্র, সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, মল্লিকা সেনগুপ্ত। কিংবা সুতপা সেনগুপ্ত, মন্দাক্রান্তা সেন থেকে দীপান্বিতা সরকার, সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায় – মেয়েদের লেখালিখির নানা বাঁক নানা বৈচিত্র্যের ইতিহাস ধরা থাকে তাঁর ভূমিকায়। আর এই কাজে তিনি কোনো একপেশে বয়ান তৈরি করেন না। বরং বারংবার একইসঙ্গে তুলে আনেন থিসিস ও অ্যান্টিথিসিস। নারীর যৌন উচ্চারণ এই সংকলনের অনেকখানি স্থান জুড়ে থাকার পরেও যশোধরা লেখেন “যৌনতা নিয়ে লেখা মানেই নারী নিজেকে পণ্যায়িত করেন কিনা এ প্রশ্নও তোলা যায়।” উল্লেখ করেন নারীবাদী তাত্ত্বিক রবিন মর্গ্যানের যুক্তিও “কোনো নারী যখন যৌনতা লেখেন, তিনি তা লেখেন পুরুষের এজেন্ট হিসেবে, শত্রুর দলে ভিড়ে গিয়ে”। “দোষারোপ, প্রতিবাদ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্যায় অত্যাচার লাঞ্ছনার জন্য ব্যক্তিপুরুষকে দায়ী করা, চিৎকৃত বিরুদ্ধচারণ” – এগুলি যে নারীকে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আনার পরিবর্তে তাকে পুনরায় ‘বিষয়’ (Object) করে তোলে, ‘বিষয়ী’ (Subject) হতে বাধা দেয়, সে কথা উল্লেখ করতে ভোলেন না সম্পাদক। আর ঠিক এই কারণেই এই কবিতা সংকলনে পুরুষের বিরুদ্ধে চিৎকৃত অভিযোগ তত বেশি সামনে আসে না। বরং প্রাধান্য পায় পুরুষ আধিপত্যকে উপেক্ষা করে নিজস্ব বাচন রেখে যাওয়ার প্রয়াস। প্রতিবাদ এলেও, তার রূপ অনেকসময়েই থাকে প্রচ্ছন্ন। যেমন

যা চাও, তা পাবে তুমি, কটিতে দু’হাত রেখে
দু-ঊরু তফাৎ করে দাঁড়ায়েছে তীব্র ভানুমতী
ইচ্ছে হলে, দেহ থেকে ফোটাবে সে যথেচ্ছ বিদেহ
যষ্টির হেলনে তার করতলে মুদ্রা হবে, মাছ, পদ্ম, বরাহ, হরিণ
…তবু তার শ্রেষ্ঠ খেলা, শেষ খেলা, যতক্ষণ থেকে যাবে দেহ
তোমাকে সমস্ত দিয়ে সঙ্গোপনে রেখে দেওয়া
                     একতিল ফিরোজা সন্দেহ।”

(“দেহ”, ‘কবিতা পরমেশ্বরী’; কবিতা সিংহ)

এ পংক্তিগুলি যত না প্রতিবাদের, তার চেয়ে বেশি প্রতিস্পর্ধিতার। একই প্রতিস্পর্ধিতা দেখতে পাই এই কবিতার থেকে বেশ কয়েক দশক পরে লেখা কবিতাগুচ্ছেও

দুর্বল ভেবেছ খুব? ভেবেছিলে শক্তিহীন, ভীরু,
নিশ্চুপ থেকেছি তাই? বেশ। ভাবো। আমি ততক্ষণে
নত, আরও নত, আরও ছোটো, আরও ছোট্ট হতে হতে
আংটির ভেতর দিয়ে, শাস্তির ভেতর দিয়ে গলে,
এই যে পেরিয়ে যাচ্ছি যাবতীয় বিদ্রুপ, আঘাত
এ সেই অন্তিম জাদু, যার কথা বলিনি তোমায়।”
….      ….      ….         ….       ….       ….      ….

প্রকাশ্যে জানাব কেন, কার উপাসনা করি আমি?

…যত ইচ্ছে জেরা করো! তোমরা তো কোন ছার, খোদ
তিনিও স্বয়ং যদি পাশে এসে জিজ্ঞাসা করেন
দাঁতে দাঁত চেপে থাকব, নামধাম কিচ্ছু জানাব না।

(“ইনকুইজিশন থেকে”, ‘জেনেসিসের সাত দিন’; রাকা দাশগুপ্ত)

পুরুষদৃষ্টি বা মেল গেজের বাইরেও যে নারীর আছে এক স্বতন্ত্র পরিসর, সেই পবিত্র গোপনীয়তারই উদযাপন এই কবিতায়। বস্তুত ‘প্রতিবাদ’ শব্দের মধ্যে শাসক ও শাসিতের যে বাইনারি আছে, তাকেই যেন অস্বীকার করতে চেয়েছে এই সংকলনের কবিতাগুচ্ছ। তার জন্যে প্রচলিত মিথেরও পুনর্নির্মাণ করলেন কবিরা। ‘শমীবৃক্ষে একা’ কবিতায় কবিতা সিংহ লিখেছেন “কিম্পুরুষের সঙ্গে ঘটে” যাওয়া অফলা সঙ্গমের কথা। আবার কোনো কোনো নারী পুরুষের অপেক্ষা না করেই খুঁজে পেতে চান নিজের সত্যতম পরমতম অস্তিত্বকে। সে সন্ধান জারি থাকে একাধিক কবির কলমে।

মা, এবার আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে বলো –
                ‘এই পৃথিবীর যোগ্য হও’।

তারপর চলে যাবো আমি নির্বাসনে
অপেক্ষা করব নতশির
যতদিন না এই মহীয়ান জন্মের যোগ্য হয়ে উঠতে পারি।

(‘যোগ্যতার জন্য’; বিজয়া মুখোপাধ্যায়)

শুধু এই কবিতায় নয়, মেয়েদের কলম ধরার সেই প্রথম যুগে একাধিক কবির কাছেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল মা-মেয়ের উত্তরাধিকারসূত্র, যা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পিতা-পুত্রের সনাতন পরম্পরাকে চ্যালেঞ্জ জানায়:

মা দিলেন ছুঁচ, মা দিলেন সুতো
সেলাই করতে সে প্রতিশ্রুত
বুনে যায় ফুল সেই থেকে ছুঁচে
রুমালে বাগান জীবনশিল্প

(“দেবতা ও দেশলাইওয়ালি”, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে বঙ্গ ইতিহাস’, গীতা চট্টোপাধ্যায়)

এই সংকলনে এমন কিছু কবিতাও রাখা হয়েছে যাদের তথাকথিত প্রেমের কবিতার অভিধা অনায়াসে দেওয়া যেতে পারে। তা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে রয়ে গেছে নারী-অভিজ্ঞতার স্মারক, যা কখনো প্রকট, কখনো অন্তঃসলিলা

তোমার আত্মার কাছে দেহ চাই, আলিঙ্গন চাই
আজ আমার সঙ্গে চলে লক্ষ হাত, লক্ষ লক্ষ জিভ,
কোটি কোটি রক্তকণা, পৃথিবীর সমস্ত হৃদয় –

আজ দেখি ভালোবাসা কীভাবে ফেরাও

(“আজ বলি’, ‘ব্রেল’; অনিতা অগ্নিহোত্রী)

অথবা,

শুধু তোমারই জন্য এই রাত্রির কবিতা লেখা শুরু হল।
শুধু তোমারই জন্য আজ অমাবস্যার মতো নিকষ অশ্বটিও
মন্ত্রমুগ্ধ, নদীবুক থেকে উঠে এসে –
অবিবাহ প্রণয়ের গোপনতা ঢেকে দিল তুমুল হ্রেষায়, ধুলোঝড়ে।

(‘দেবীপক্ষে লেখা কবিতা’; চৈতালী চট্টোপাধ্যায়)

এ জাতীয় ক্লাসিক প্রেমের উচ্চারণ থেকে আবার কতখানি পৃথক সুতপা সেনগুপ্তের সপ্রতিভ পংক্তিবিন্যাস!

উঠে পড়ে স্নান করব, স্নান করতে করতে ভাবব, আজ
আর-একবার দেখা হতে পারে নাকি স্টেশনে আবার
কফিকাপ চলকে যাবে, নেমে এসে গড়াবে কাপড়ে
তবু বদলাব না আমি যে জামা ছুঁয়েছে শ্যাম রায়”

(“জামা বদলাব না আমি, যে জ্যাকেট নিয়ে পরেছিলে”, ‘ছোকরা ছোকরা শ্যাম রায়-বাই’, সুতপা সেনগুপ্ত)

আবার প্রীতি আচার্যের কলমে “যতদিন তোমাকে পাব না, চুল বাঁধব না” দিয়ে যে কবিতার শুরু হয় তা শেষ হয় এইভাবে, “তোমাকে না পাওয়া পর্যন্ত কোনোদিনই/ ১৫ই আগস্ট মানব না” (“রাধা”, ‘ইউরেনাসের মেয়ে’)।

নারীবাদের তৃতীয় তথা আধুনিকতম তরঙ্গে অনেক নারীবাদী তাত্ত্বিকই ঝুঁকে পড়েছেন সমপ্রেম বা সমকাম সংক্রান্ত ধারণার দিকে। তাঁদের উদ্দেশ্য সর্বক্ষেত্রেই পুরুষনির্ভরতার শিকলটি ছিন্ন করা। মেয়েদের সমপ্রেমের ছবি এঁকে সমকালীন কবিতা ভুবনে আলোড়ন তুলেছিলেন রমা ঘোষ –

নীতা না-থাকলে সাথে পুরীর সমুদ্র নেই,
                 বেথলা ফরেস্টে নেই একটাও গাছ,
পাখিরা উধাও হয়, লোকালয় শূন্য হয়,
             কাঁসাই জলঙ্গী নদী জমাট পাথর,…

(“নীতা ফিরে আসে”, ‘কালো মেয়ের ডানা’)

আসলে প্রেম হোক বা যৌনতা, লক্ষ্য সেই ‘অ্যান্ড্রোসেন্ট্রিক’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে আসা ‘গাইনোসেন্ট্রিক’ বয়ানে। ‘গাইনোসেন্ট্রিক’ বয়ানেরই এক শিল্পিত রূপ পাওয়া যায় দেবারতি মিত্রের কবিতায়

প্রিয়তম পুরুষটি এক পা একটুখানি উঁচু করে
বিছানায় ভেসে আছে দেবদূত
সুকুমার ডৌলভরা মাংসল ব্রনজের ঊরু
অবিশ্বাস্য নিখুঁত সহজ গ্রিক ভাস্করতা
হঠাৎ সচল হয়ে ডাকে তরুণীকে…

(“পৃথিবীর সৌন্দর্য একাকী তারা দুজন”, ‘আমার পুতুল’)

দীর্ঘকাল ধরেই বাঙালি মেয়েদের যাপন ঘিরে অজস্র বিধিনিষেধের বেড়া। অগণিত ট্যাবু – কর্মক্ষেত্রে। সম্পর্কে। সাহিত্যরচনায়। ভাষাপ্রয়োগে। সর্বত্র। বিবাহ বহির্ভূত প্রেম বা অসমবয়সী প্রেমের (নারী চরিত্রটি যেখানে বয়সে বড়) গল্প লিখতে গিয়ে একজন ‘নারী-লেখক’ কীভাবে ‘judged’ হন নিজের পরিবার পরিজনের কাছে, সে কাহিনি আমাদের শুনিয়েছেন নবনীতা দেবসেন। বলা বাহুল্য, এই সমাজে মেয়েদের যৌনতার উচ্চারণ পাপ। যৌন স্বাধীনতা এক দূরতর দ্বীপ। শরীরী বাসনার বিবৃতি দূরে থাক, ঋতুস্রাবের মতো স্বাভাবিক শারীরিক সংঘটনকেও “শরীর খারাপ” তকমা দিয়ে গোপন রাখতে হয় প্রতিনিয়ত। আর এই সমাজে থেকেই নিজেদের শরীর ও শরীরী আকাঙ্ক্ষাকে কবিতায় উপস্থাপন করার চ্যালেঞ্জ নিতে শুরু করলেন কবিতা সিংহ ও তাঁর সমকালের ‘নারী কবি’রা। দুঃসাহসী পদরেখা ক্রমে গাঢ় হতে থাকল তাঁদের উত্তরসূরীদের বিচরণে। যৌন চাহিদার কথা কবিতার শৈলীতে কীভাবে স্থান পাবে, তা নিয়ে চলল একাধিক নিরীক্ষা। নারীর লেখনী ক্রমে এমন কথা লেখারও সাহস দেখাল, “শরীরে আসেনি যে, সে কখনও প্রেমিক হয় না…” (শ্বেতা চক্রবর্তী)। সম্পাদক অবশ্য সেই কবিতাগুলিকেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন এই সংকলনে, যেখানে যৌনতাতেও পুরুষের তথাকথিত সক্রিয়তাকে পেরিয়ে নিয়ন্ত্রণসূত্র নারীরই হাতে। নারী যেখানে নিছক ভোগ্য নয়। ভোক্তা।

এ মুহূর্তে মেয়েটি নিজেকে ভুবনেশ্বরী বলে বোধ করে।
কেন-না, নিজেকে সে, এইমাত্র, একটি পুরুষকেন্দ্রে স্থাপন করেছে।
নাসাপথে ধূম ও আগুন, ললাটে স্বেদবিন্দু।
নখের উলটোপিঠে আঁশছোপ, কিন্তু তাতে কী,
অদূরে যূথিকামালা রূপকথা ঘনাল,
ঘোড়া ছুটছে…
এইবার সব তার নিয়ন্ত্রণমতো।”

(“ভুবনেশ্বরী”, ‘বিষাক্ত রেস্তোরাঁ’, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়)

এইসব পংক্তিমালায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীকেই দেখা যায় বিষয়ীর ভূমিকায়। সক্রিয়তার প্রেক্ষাপটে:

জেগে থাকব সারারাত, তোমাকেও ঘুমোতে দেব না
শয়নমন্দিরে হবে, লিঙ্গরাজ, গুপ্ত আরাধনা।
সুবর্তুল বেল দুটি নগ্ন রেখে দেব দুই পাশে
দুগ্ধ প্রস্রবণ দেব যাতে নৌকা বহুদূর ভাসে

যৌনতার উচ্চারণে যত সাবলীল হয়েছেন নারীরা, বাংলা কবিতা পেয়েছে এক নতুন শরীরী ভাষ্য, যা পুরুষ কবিদের থেকে একেবারেই পৃথক। আগের দৃষ্টান্তগুলির মত প্রকট না হয়ে, কোনো কোনো কবিতায় যৌনতার অনুষঙ্গ আনাগোনা করেছে রূপক সংকেতের রহস্যময় সাকিনে। যেমন

চোরের চোখ এত সুন্দর! পাকা গমখেতে ঢেউ তোলা শিষ যেন! চোরের পশম বোনা তামাটে বুকে বঙ্গোপসাগরের ঘ্রাণ। তাঁর ফেটে পড়া জামের কোয়ায় যে উষ্ণ দশন ক্ষত তুমি কী তার ক্ষতিপূরণ দেবে?…এই বালিশে তার সাপের গা পিছলানো চুলরাশি, ওই শুভ্র চাদরে তার তাম্বুলের রক্তছাপ, এই কদলী জঙ্ঘায় তার অজাগর পেষণচিহ্ন।”

(“চৌরপঞ্চাশিকা”, ‘ফুল ও সুগন্ধ’; সেবন্তী ঘোষ)

প্রায় একই রীতিতে শরীরী বাসনা ফুটিয়ে তোলেন দীপান্বিতা সরকার:

কাঁচা বাঁশের শরীর ঘিরে কেমন লোভ নামে। যেসব ঠোঁট থেকে ঠোঁটে ফিরে আসে অমল বালিকা, আমিও কুড়িয়ে আনি ছেলেদের জিভ থেকে তোর বিলি করা ছোবলের বিষ। চেখে চেখে দেখি। …তোর মনোরম শিকারের ভিড়ে আশরীর একটি ফণা। আমি মুখে মুখ ভরে দেখি। প্রদীপ জ্বালাই আর ভাসাই নীচু খাতে। চূড়ার মুখে হাঁ বসে থাকি। আমাকে পোড়াবে মেয়ে? ওলো শঙ্খচূড়া, আমিও বেদিনী হয়ে যদি তোকে নাচাই, নাচাই, নাচাই?

(“শঙ্খচূড়া”, ‘ঝিম রাতের মনোলগ’)

আসলে আবহমানকাল ধরে নিজেকে সমর্পণের পর নারী এবার পুরুষকেও দেখতে চায় সমর্পিতের ভূমিকায়। তাই সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন

প্রতিটি মিলনই যৌনমার
যদি না তোমার দেহখানি
উপচার হয়ে ঝুঁকে পড়ে কাছে

(“মার”, ‘অনেক অবগাহন’)

এ ধরনের কবিতায় যৌনতার সংক্রাম যেমন অনিবার্য, ‘যৌনমার’ তথা ধর্ষণের মতো সামাজিক সত্যকেও তো উপেক্ষা করতে পারেন না নারী কবিরা। তাই সংযত প্রতিস্পর্ধী উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভ আর পুঞ্জীভূত ক্রোধও প্রকট হয়ে ওঠে কোথাও কোথাও

গণধর্ষণের পর খোলামাঠে পড়ে রইল লাশ
কণ্ঠে ছেঁড়া ব্লাউজের ফাঁস
দু-তিন দিন পরে কারা লাশ পুঁতে গেল তাড়াতাড়ি
সে-ঘরে নতুন মেয়ে, অঙ্গে সেই ছেড়ে যাওয়া শাড়ি

(“ভাসান”, ‘ছদ্মপুরাণ’; মন্দাক্রান্তা সেন)

কিন্তু এই পরাজয়ই তো অন্তিম গন্তব্যবিন্দু নয়। তাই কাবেরী রায়চৌধুরী লেখেন

প্রতিটি ধর্ষণের পরে
আমি কুমারী হয়ে উঠি।
প্রতিটি লাঞ্ছনা, প্রতিটি অপমান
অবমাননার পর
আমার মৃত আত্মার শরীর থেকে
ঘুম ভেঙে চোখ মেলে
এক নতুন প্রাণ!”

(“কুমারী”, ‘অলৌকিক সাম্রাজ্য’; কাবেরী রায়চৌধুরী)

যে পুরুষ হয় ধর্ষক, নতুবা ‘কিম্পুরুষ’ তার সামনে দাঁড়িয়ে বিকল্প খোঁজার ঘোষণাও হয়ে ওঠে নারীবাদের এক ভিন্নতর অবস্থান –

যার কোনো উত্থানপতন নেই, আমি সেই
ছাতাপড়া অঙ্গটিকে গড় না করতেই পারি
যদ্যপি সে আমার স্বামীর।
শেষ জলবিন্দুটিকে, নিঃশেষ, না পাই, তো
যাচ্ঞা করতে পারি অন্য মেঘ
যদি অহল্যাও হই, ইন্দ্রের কাছে যাব, বারবার
পাষাণ হব না।

(‘একটি শারীরিক কবিতা’, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়)

কেট মিলেট, শুলামিথ ফায়ারস্টোনের মতো অতিনারীবাদীরা নারীর যৌন স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। যৌন স্বাধীনতা যদিও প্রতিবাদের একমাত্র ভাষা নয়। নারী কবিদের উচ্চারণে প্রতিবাদ কখনো দেখা দেয় শীতল অবজ্ঞা আর তীব্র উপেক্ষার বয়ানে

কমলালেবুর মতো স্তন দুটি ঠান্ডা
যেন সদ্য ফ্রিজ থেকে বের করা,
রেশমবেড়ালের মতো যোনি, কাঠ, এখনই মাছি বসবে, রোদ ঠিকরোনো নিতম্ব বেয়ে
কয়েকটা পিঁপড়ে
নিজেদের মধ্যে ব্যস্তভাবে কথা বলতে উঠে যাচ্ছে;

…তোমার উন্মুখ শরীরের নীচে
এ শহরকে আর আগের মতো পাবে না।”

(“ঠান্ডা মাংস: মান্টোকে নিবেদিত”, ‘যে কোথাও ফেরে না’; তৃষ্ণা বসাক)

কখনো আসে ছদ্ম-ক্ষমা বা ছদ্ম-করুণার বেশে

শুয়েছি যাদের সঙ্গে – তাদের বিরুদ্ধে আমি অস্ত্র ধরতে পারব না দামিনী
    সুন্দর সরণি ওরা, ওই পথে ঢিল আমি কিছুতেই ছুড়তে পারব না;

(“অতি-বিবাহিত”, ‘রাত্রি তখন কথকতা’; শ্বেতা চক্রবর্তী)

রিংমাস্টার যেভাবে বাঘের মুখে মাথা ঢোকায়
     সেভাবে তুমি আমার মধ্যে ঢুকে আসছ,
     আমার তোমার জন্য করুণা হচ্ছে
     তুমি যে নিষ্ক্রমণ জানো না!

(“কাঁচা খেলুড়ে”, ‘অজাতক সমগ্র’; তৃষ্ণা বসাক)

আবার কখনও আসে অভিসম্পাতের রূপে

আমাকে যারা তোমার সঙ্গে মিলিত হতে দিল না
নিজেদের প্রত্যেকটা মিলন রাত্রে তারা
            চমকে চমকে উঠবে।

…আর অকৃতকার্য বাসনাকে দু-ঊরুর
মাঝখানে চেপে রেখে নিজেরা তখন
দু-পাশ ফিরে ঘুমোবে –

মধ্যে পড়ে থাকবে আমি – আদিগন্ত ব্যবধান।

(“মিলন”, ‘অনেক অবগাহন’; সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়)

কখনও আবার পুরুষের দ্বারা সংজ্ঞায়িত, নিয়ন্ত্রিত এই শরীরবোধকেই অস্বীকার করে আত্ম আবিষ্কারের এক নতুন বিন্দুকে ছুঁতে চান এই কবিরা

আমাকে এখনই নিয়ে যাবি? দরজা খুলে দিচ্ছি, ভাই
একা একা ভাল্লাগে না; শাড়িসহ পালাব কী করে
খুলে আসব? খুলে আসছি। পায়ের আলতাও খুলে আসি
আংটায় টাঙিয়ে আসি বাঁকা ভুরু, নাভি ও ব্লাউজ
আর কাদা, তাল তাল কাদা ― তবে স্তনও খুলে আসি

না, শরীর নিয়ে আমি তোর সঙ্গে পালাব না;…

(“দূর”, ‘রেডিও বিতান’, যশোধরা রায়চৌধুরী)

এর পরেও নারীর নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টা নানাভাবে চলতে থাকে কবিতার সদরে অন্দরে

দেবীকে দ্যাখোনি তুমি।
ঝলকে ঝলকে কাঁচা অন্ধকার মুখ থেকে বুক থেকে উগড়ে দিয়েছ।
উল্টানো পায়ের ছাপ মুছে, আবার মানুষ-জন্ম হল তবে;
লোহা ও তামার মুদ্রা সঙ্গে নেই, ছুঁইনি আগুন –
দেয়ালে উপুড়-করা ভাঙা চাঁদমালা আমার এ পথ আলো করে।”

(‘দেবীপক্ষে লেখা কবিতা’, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়)

পুরুষের বিরুদ্ধ অবস্থানে দাঁড়াতে হলেও যে নিজের সত্য পরিচয়টুকু উন্মোচন করতেই হয়। নারীর আত্মানুসন্ধানের এক স্নিগ্ধ অনুচ্চকিত ছবি চোখে পড়ে বর্ণালী কোলের কবিতায়

মাটির দেয়াল খসে খসে পড়ছে…টালির চাল…বাড়িটার পাঁচিল নেই, দরজা নেই… বারান্দায় লণ্ঠন ধরা বউ চুপ…মাটি আঁকড়ে

লণ্ঠন ধরা বউ, তোমার কি কোনো নাম আছে?

(“বউ”, ‘আকাশ আজ রামকিংকর’; বর্ণালী কোলে)

সমগ্র সংকলনের কবিতাগুচ্ছে এই ঝটিকা সফর থেকে স্পষ্ট হয় কবিতা নির্বাচনে সম্পাদকের দক্ষতা। কবিতার বিষয় নির্বাচনে ও কবি নির্বাচনে যে ব্যাপ্তি তিনি দেখিয়েছেন তা প্রশংসনীয়। তবে ভূমিকায় রাজলক্ষ্মী দেবীর ‘ঘোরানো সিঁড়ি’ ও আরও কয়েকটি কবিতার উল্লেখ বা উদ্ধৃতি থাকলেও মূল সংকলনে তাদের অনুপস্থিতির ফলে কিঞ্চিৎ অতৃপ্তির আক্ষেপ থেকে যায়। ‘নারীসত্ত্বা’-র মতো কয়েকটি ভুল বানান বা মুদ্রণ প্রমাদ চোখে পড়ে, যেগুলি পরবর্তী মুদ্রণে সংশোধিত হবে বলেই আশা করা যায়। এছাড়া, সময় অনুসারে কবিদের সাজানো, কবিতার নামের সঙ্গে গ্রন্থনাম ও প্রকাশসালের উল্লেখ সুচিন্তিত সম্পাদনারই সাক্ষ্য দেয়। বইয়ের শেষ অংশে সংক্ষিপ্ত কবি পরিচিতি অংশটিও অত্যন্ত জরুরি।

থিসিসের পাশাপাশি অ্যান্টিথিসিসকে তুলে ধরার স্বভাববশতই যশোধরা রায়চৌধুরী ভূমিকায় চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের মতেরও উল্লেখ রেখে যান। “মেয়েদের লেখা” এই শ্রেণিকরণেরই বিরোধী তিনি। তাঁর মনে হয়েছে “এতে করে আপনি/আমি, আমরা, আমরাই স্বেচ্ছায় একটা ঘেরাটোপ বানিয়ে নিচ্ছি, চিড়িয়াখানার জিরাফ বা জেব্রার খাঁচার মতো, যার বেড়ার ধারে উৎসাহী বাচ্চার (পাঠকের) ভিড় জমবে। ‘মেয়েদের লেখালিখি’ কথাটার পাশাপাশি তাহলে তো একটা ‘ছেলেদের লেখালিখি’ বলেও ক্যাটাগরি বানাতে হত। নয় কি?”

আরো পড়ুন মিস শেফালি নামক দর্পণে সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি ও নারী

এ বক্তব্য মেনে নিলে গোটা সংকলনের প্রয়োজনীয়তাই হয়তো প্রশ্নের মুখে পড়তে বাধ্য। নবনীতা দেবসেনও বলেছেন “ নারীর অভিজ্ঞতা, নারীর দৃষ্টি, নারীর অনুভব, পুরুষের চেয়ে অনেক আলাদা,… কিন্তু আরেকবার বলি, লিঙ্গ বিভাজিত দৃষ্টিই শিল্পীর শেষ কথা নয়, লিঙ্গ নিরপেক্ষ দৃষ্টির সন্ধান করাও শিল্পীর পক্ষে জরুরি।”

তাহলে কি তত জরুরি ছিল না এই সংকলন? নারীস্বরকে আলাদা করে দেখা কি নারীর অবস্থানকেই অবনমিত করার নামান্তর? তা হয়ত নয়। চর্যাপদের কুক্কুরীপাদ নারী ছিলেন কিনা, তার পাথুরে প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। চন্দ্রাবতীর কথা আমরা সাহিত্যের ইতিহাসে পড়ি বটে, কিন্তু চন্দ্রাবতীর মতই আরও কত নারীর লেখনী হারিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতা থেকে, নিশ্চিত করে আজ আর তা বলা যায় না। নারীরা কবিতা লিখতে কলম ধরেছেন যখন থেকে তখন থেকেই তৈরি হয়েছে এক ভিন্ন পরম্পরা, যা পুরুষলিখিত কবিতার সঙ্গে এক হয়েও স্বতন্ত্র। অতীতের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেই অগ্রাহ্য করা যায় না সেই ধারাবাহিকতাকে। পূর্বপুরুষ নয়, উৎসর্গপত্রে ‘পূর্বনারী’দের ঋণ স্বীকার করে যে বই, তার গুরুত্বকেও তাই উপেক্ষা করার কোনো উপায় থাকে না।

অনবদমনের কবিতা
সম্পাদনা: যশোধরা রায়চৌধুরী
প্রচ্ছদ: সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক: ধানসিড়ি
দাম: ৩৫০ টাকা

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.