রবি ঠাকুরের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের অত্যন্ত উষ্ণতার সম্পর্ক ছিল। তাঁর রাজর্ষি উপন্যাসে দেবীমূর্তিতে রক্ত দেখে এক বালিকা বাবাকে প্রশ্ন করেছিল “এত রক্ত কেন?” স্বপ্নলব্ধ ওই উপন্যাস পরবর্তীকালে বিখ্যাত বিসর্জন নাটক হয়েছে। উপন্যাস এবং নাটকে ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমাণিক্যকে রক্তস্নাত নদীর ঘাটে বালিকা হাসি প্রশ্ন করেছিল “ও রক্তের দাগ কিসের?” গোবিন্দমাণিক্য উত্তর দিতে পারেননি। জ্বরে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত হাসি ঘোরের মধ্যে বারবার বলেছে “ও রক্তের দাগ কিসের?” গোবিন্দমাণিক্য উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু ত্রিপুরা রাজ্যে বলি নিষিদ্ধ করেছিলেন। ১৮৮৭ সালে রাজর্ষি প্রকাশিত হয়, আর আজ ২০২৩। এখনো হাসির মতই আমাদের প্রশ্ন করতে হচ্ছে “এত রক্ত কেন?” বা “ ও রক্তের দাগ কিসের”?
গত শতকের আট ও নয়ের দশকের প্রথমদিকে জঙ্গি বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাস অতিক্রম করে ত্রিপুরা হয়ে উঠেছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ দেশের অন্যতম শান্ত রাজ্য। ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে অবধি, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ত্রিপুরা ছিল রাজনৈতিক হানাহানি মুক্ত। ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরেই আরম্ভ হয় নারকীয় সন্ত্রাস, বিরোধীনিধন যোগ্য। সেবছর নির্বাচনের ফলাফল বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হয় বামপন্থী তথা সিপিএম নেতা, কর্মীদের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ। কয়েক হাজার বাড়িতে অগ্নি সংযোগ, বাড়ি ভেঙে ফেলা, দোকান ভাংচুর, রাবার বাগান, চাষের জমি নষ্ট করা, মানসিক নির্যাতন, দৈহিক আক্রমণ। অসংখ্য খুন হয়, অগুনতি মানুষ ঘরছাড়া হন। কোনো বর্বরতাই বাদ রাখেনি বিজেপি। বিলোনিয়া বাজারে লেনিন মূর্তি বুলডোজার দিয়ে উপড়ে ফেলা, সিপিএম রাজ্য দপ্তর দশরথ দেব ভবন আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ – একের পর এক ঘটনা স্তম্ভিত করেছে শান্তিপ্রিয় মানুষকে। আক্রমণ এতটাই নির্লজ্জ বর্বর ছিল যে গ্রাম পঞ্চায়েত, এডিসি পৌরসভা থেকে সিপিএম দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। নির্বাচন ছাড়াই পঞ্চায়েত, এডিসি পৌরসভার দখল নেয় বিজেপি। অনেকটা পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের মত। গত পাঁচ বছরে ত্রিপুরায় কোনো নির্বাচনেই বিরোধীদের লড়তে দেওয়া হয়নি। গত পৌর নির্বাচনে ভোট চলাকালীন বামফ্রন্ট প্রার্থী তুলে নেয়। নরেন্দ্র মোদীর কাঙ্খিত ফ্যাসিস্ট দেশের সূতিকাগার হয়ে ওঠে ত্রিপুরা।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
২০১৮ থেকে ২০২৩ – এই পাঁচ বছর ত্রিপুরায় সিপিএম পার্টি অফিস আক্রমণ, সমাবেশ, মিছিলে বাধা দেওয়া বিজেপির প্রতিদিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাজ্য পরিচালনায় অসন্তোষ, ডামাডোল, ব্যর্থতা, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ, বিপ্লব দেবের পদত্যাগ, গৃহবিবাদ, জোটসঙ্গী আইপিএফটির সাথে দূরত্ব, ওই দলে ভাঙন, তিপ্রা মোথার জন্ম – এসব নিয়ে বিজেপি এতটাই অগোছালো ছিল যে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গেলে সন্ত্রাস ছড়ানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না।
গত পাঁচ বছরে ত্রিপুরার অধিকাংশ জায়গায় বামফ্রন্ট সন্ত্রাস প্রতিহত করে সংগঠন মজবুত করার সুযোগ পায়নি। দলীয় কর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতেই অধিকাংশ সময় চলে গেছে। বহু জায়গায় এবারের বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণার দু-তিন মাস, কোথাও একমাস আগে পার্টি অফিস খুলেছিল। ততদিনে ত্রিপুরায় বিজেপিবিরোধী জনরোষ প্রবল আকার ধারণ করে। প্রস্তুতিহীন অবস্থায় বামফ্রন্ট কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে। প্রদ্যোৎ দেববর্মণের নেতৃ্ত্বে মোথা বিজেপির সঙ্গে জোটে না গিয়ে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড দাবিকে সামনে রেখে এককভাবে নির্বাচনে লড়ে। উপজাতি এলাকার ২০ ছাড়াও মোট ৪২ আসনে প্রার্থী দেয়। বামফ্রন্ট ৪৬, সমর্থিত নির্দল ১ এবং কংগ্রেস ১৩ আসনে প্রার্থী দেয়। নির্বাচনে বিজেপির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি-আইপিএফটি জোট পেয়েছে ৪০% ভোট এবং ৩৩টি আসন। অর্থাৎ গতবারের চেয়ে ১৩টি কম, সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে মাত্র তিনটি বেশি। বাম-কংগ্রেস জোট পেয়েছে ৩৭% ভোট। সিপিএম ১১ এবং কংগ্রেস তিনটি আসন। তিপ্রা মোথা ১৩টি আসনে জিতেছে এবং ২২% ভোট পেয়েছে। বিরোধী ভোট ভাগাভাগি না হলে বিজেপির আসনসংখ্যা দশের কাছাকাছি থাকত। জোটের কারণে মোথা সাতটি আসনে সরাসরি পরাজিত হয়েছে। আবার সমতলে, এডিসি এলাকার বাইরে মোথা ২২টি আসনের মধ্যে অন্তত দশটিতে ভোট কেটে জোটকে পরাজিত করেছে। ফলে এই জয় সম্ভবত ত্রিপুরা বিজেপিকেও অবাক করেছে।
২ মার্চ গণনাকেন্দ্রের মধ্যেই বিলোনিয়া কেন্দ্রের বিজয়ী বাম প্রার্থীকে দৈহিক আক্রমণের মধ্য দিয়ে এবারের নির্বাচনোত্তর সন্ত্রাসের সূচনা হয়। কান পাতলেই শোনা যাবে মেলাঘরের আক্রান্ত বামকর্মীর দিদির আর্ত চিৎকার “কেউ আছোনি মেলাঘরে আম্রাগে বাঁচাও। আমার কাকুরে কাইটা ফেলাইছে”। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চলছে সন্ত্রাসের রাজত্ব। দেদার অগ্নি সংযোগ, লুঠতরাজ, বাড়ি ভাংচুর, রাবার বাগানে আগুন, প্রাণঘাতী আক্রমণ – কোনোটাই বাকি রাখছে না বিজেপি-আশ্রিত দুর্বৃত্তরা। সহিংস আক্রমণে এখন পর্যন্ত দুজন মৃত। সিপিএম দলের বিবৃতি অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৬০০ জন দৈহিকভাবে আক্রান্ত, পাঁচশোর কাছাকাছি বাড়ি ভাংচুর হয়েছে। একের পর এক ঘটনা উঠে আসছে, যেখানে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর বাড়িঘর, বইপত্র – সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মহিলা, শিশুরাও আক্রান্ত। বামকর্মীরা অনেকে বাঁচার জন্য জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন আগরতলার দশরথ দেব ভবনে। কবে বাড়ি ফিরবেন জানেন না।
আরো পড়ুন ত্রিপুরার পুরভোট: গণতন্ত্রের বস্ত্রহরণ এবং বঙ্গ মিডিয়ার আশ্চর্য চেহারা
কয়েকদিন আগে কথা প্রসঙ্গে ত্রিপুরার এক সাংবাদিক বন্ধু বলছিলেন, ওখানে বিজেপির আক্রমণ, সহিংসতা তাৎক্ষণিক কিছু নয়। তারা ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ চালায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে এক বামকর্মীর বাড়িতে মোট ১৮ বার আক্রমণ হয়েছিল। বাড়িঘর, জীবিকা সবকিছু ধ্বংস করে আক্ষরিক অর্থে সর্বস্বান্ত করে দেওয়াই ওদের লক্ষ্য। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। অমরপুর, বিশালগড়, ডুকলি, গন্ডাছড়া, জিরানিয়া, কৈলাশশহর, কুমারঘাট, বামুটিয়া, তেলিয়ামুড়া, খোয়াই, ধর্মনগর – সন্ত্রাস সর্বত্র এবং অবাধ। পরাজিত মাত্রই সাময়িকভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়ে, পরে সামলে নেয়। ত্রিপুরায় বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট শতাংশ বিজেপির চেয়ে খুব কম নয়। তার উপর গণতন্ত্র রক্ষায় মোথা যদি বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তাহলে এই পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব।
১৯৬৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যসংখ্যা ছিল ২০ লক্ষ। তারা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৬৬ সালে এক বছরের মধ্যে রাজনৈতিক গণহত্যার ফলে পার্টিকে আত্মগোপন করতে হয়। সেনাবাহিনী কয়েক লক্ষ পার্টি সদস্যকে খুন করে। ইন্দোনেশিয়ায় এই ঘটনা চলার সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির পাশে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীন – কেউ দাঁড়ায়নি।
দেরিতে হলেও পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্ট কেন্দ্রীয় মিছিলের ডাক দিয়েছে। পলিট ব্যুরোও দেশজুড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের কর্মসূচি নিয়েছে। কিন্তু কংগ্রেসসহ বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক দল ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগঠনগুলিকে সংগঠিত করে এই নির্মম বর্বরতার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ সংগঠিত করার পরিকল্পনা এখনো নেই, যা কাম্য ছিল।
সিপিএমবিরোধী বামপন্থী রাজনৈতিক দল, গণসংগঠন, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা যদি সিপিএম আক্রান্ত বলে চুপ করে থাকেন, তাহলে ভুল করছেন। ত্রিপুরা রাজ্যে আক্রান্ত গণতন্ত্র, আক্রান্ত মানবতা। যাঁরা আক্রান্ত, সিপিএম কর্মী পরিচয়ের আগে তাঁদের পরিচয় হল তাঁরা মানুষ। ত্রিপুরায় যা হচ্ছে তা সভ্য সমাজে চলতে পারে না। ত্রিপুরায় নির্বাচনোত্তর হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করা সভ্য মানুষের লজ্জা শুধু নয়, অপরাধও বটে।
মতামত ব্যক্তিগত, তথ্য লেখকের
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।