ইতিহাস ফিরে দেখতে গিয়ে কখনো কখনো মনে হয়, ভাগ্যিস এ দেশে দেশভাগের মতন একটা দুঃসহ ঘটনা ঘটেছিল। নিতান্ত অকরুণ ভাগ্যের জোর ধাক্কা ছাড়া আর কী-ই বা এ দেশের সব শ্রেণির মেয়েদের অন্তঃপুর থেকে টেনে বাইরে বার করে আনতে পারত? তবু যে কিন্তুটুকু থেকে যায়, তা এই, যে দেশভাগের মতন বড় মাপের কোনো ঘটনার প্রভাব তো সোজা, সরল, একমুখী হয় না, সবার জীবনে সমানও হয় না। এইরকম জোরদার ঘটনার অনুরণন চলে বহুদিন। শুধু রাজপথের মহার্ঘ ধুলো উড়িয়েই তার শান্তি নেই, গলি-উপগলি এমনকি শুঁড়িপথেও তার কম্পন অনুভূত হয়। সেইভাবেই ইতিহাসের করাল ছায়া পড়েছিল ’৪৭-এর এক জাতিকার জীবনে। নিতান্ত নিম্নবিত্ত, উদ্বাস্তু পরিবারের অশিক্ষিত মেয়ে। তবে “দাদা, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম”-এর মতন ক্লাসিক হাহাকার তাঁর গলায় শোনা যায়নি। বরং বাঁচার তাগিদে নিজের পথ নিজে তৈরি করে নিয়েছেন। পথ মানে সে এক অশ্রুতপূর্ব পথ! তার আগে কোনো বাঙালি কন্যা ক্যাবারে ডান্সার হওয়ার কথা ভাবেনি বোধহয়। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, মিস শেফালির কথাই বলছি। ছয়ের দশকের কলকাতার রাতপরী।
মিস শেফালি। প্রথমে ফারপোজ, পরে গ্র্যান্ড হোটেলের নাচের ঘর থেকে তিনি রাতের কলকাতা শাসন করেন। সে দুনিয়া অবশ্য মধ্যবিত্ত কলকাতার হাতের বাইরে। হাতেগোনা বিত্তশীল, কর্পোরেট ম্যানেজার ছাড়া সেই দুনিয়ায় আমজনতার প্রবেশ নাস্তি। সেই আগল ভাঙলেন বিশ্বরূপার মালিক রাসবিহারী সরকার। ১৯৭১ সালে। মিস শেফালিকে আপামর কলকাতা চিনল বিশ্বরূপা, সারকারিনার কমার্শিয়াল থিয়েটারের বিজ্ঞাপনে, পাতাজোড়া লাস্যময়ী ছবিতে। থিয়েটারের ক্যাশবাক্স উপচে পড়ল তাঁর দৌলতে। কমার্শিয়াল বাংলা থিয়েটারে তিনি একটা নতুন প্রবণতা তৈরি করলেন। সেই সঙ্গে সূচনা হল এক তুমুল বিতর্কের। জীবনের শেষ দিন অবধি সেই বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
শেফালির আত্মজীবনী সন্ধ্যারাতের শেফালি (অনুলিখন: শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়) বেরিয়েছিল ২০১৪ সালে। সেই বই খুবই দরদী কলমের স্বাক্ষর বহন করে। সেই সঙ্গে বিস্ফোরক মশলায় ভরপুর। মানুষ আরতি দাস ওরফে মিস শেফালিকে উল্টে পাল্টে দেখার সব উপকরণই মজুত তাতে। তবু সেই বই আসলে ব্যক্তিকে ঘিরে, সময় সেখানে পার্শ্বচরিত্র। পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে, সেই সময়ের পটভূমিকায় তৃতীয় চোখে মিস শেফালির একটা মূল্যায়ন দরকার নয় কি? বিশেষত আজকের এই বিশ্বায়নোত্তর দুনিয়ায়, যখন নারী শরীর নিয়ে ধ্যানধারণা সেই সাত বা আটের দশকের থেকে অনেকটাই বদলেছে, সেই নতুন সময়ের মেয়েরা কী চোখে দেখছেন মিস শেফালিকে আর সেই সময়ের বাঙালি সমাজকে?
এই কৌতূহল অনেকটাই মিটিয়েছে কলকাতার ক্যাবারে বাঙালি, যৌনতা এবং মিস শেফালি। বিশ্লেষণ করেছেন ঐশিকা চক্রবর্তী। মানবীবিদ্যার শিক্ষক হিসাবে, একজন পারফর্মার হিসাবে আর সর্বোপরি একজন মেয়ে হিসাবে ব্যক্তি আরতি দাসের অজস্র সাক্ষাৎকার নিয়ে আর সেইসঙ্গে তাঁর পূর্বোল্লিখিত জীবনী ও তাঁর জীবনের ছায়া সম্বলিত বিভিন্ন টেক্সটের ভিত্তিতে লেখা এই বইতে তিনি সমকালীন সংস্কৃতির জগতে মিস শেফালির জায়গা নিরূপণের চেষ্টা করেছেন। সেইসঙ্গে উন্মোচন করেছেন বাঙালির তৎকালীন সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির বিবিধ দিক। এই বই কোনো সরলরৈখিক বিবরণ নয়; না বর্ণনার দিক দিয়ে, না তত্ত্বগতভাবে। মিস শেফালি যেমন গোটা ডান্স ফ্লোর জুড়ে নিখুঁত ছন্দে নিজের শরীরী মায়া ছড়িয়ে দিতেন, ঠিক তেমনই অনায়াসভাবে এই বইয়ের বিশ্লেষণ বিস্তার পেয়েছে বহু মাত্রায়, বহু দৃষ্টিকোণ জুড়ে।
বইটিকে সাজানো হয়েছে বেশ কয়েকটি পর্বে। তার মধ্যে ‘ঝি, বেশ্যা, কেরানি-দিদিমণি: একলা উদ্বাস্তু নারী’ পর্বে বিভিন্ন প্রাক-গবেষণার সূত্র ধরে খতিয়ে দেখা হয়েছে সেদিনের উদ্বাস্তু মেয়েদের অবস্থা। দরিদ্র, অশিক্ষিত মেয়েরা গৃহশ্রম দেবে, অন্তঃপুরের অন্তরালে তাদের কপালে যৌন লাঞ্ছনা জুটলেও কোনো প্রতিবাদ করবে না। তাকে আমরা করুণা করতে পারি, কিন্তু সে যদি নিজের স্বাধীন অস্তিত্বের সন্ধানে নিজের পথ নিজে তৈরি করে নেয় এবং সেই সঙ্গে খুঁজে পায় নিজের প্যাশন – সে যদি স্রেফ অবস্থার শিকার হয়ে থাকতে সরাসরি অস্বীকার করে, মেকলে সাহেবের শিক্ষা ও ধর্মের আওতায় তৈরি সমাজের ‘ভাল মেয়ে’-র আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে সদর্পে প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে তাকে কীভাবে দেখতে হয় এই প্রশ্নের উত্তর এর আগে বাঙালি সমাজের শেখার সুযোগ হয়নি। মনে রাখতে হবে, সেইসময়ের শিক্ষিত বাঙালি মেয়েদের শিক্ষকতা করাও আদতে অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণেই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে সমাজ। অর্থোপার্জন মেয়েদের আত্মবিকাশের জন্য, তাদের পরিপূর্ণভাবে ফুটে ওঠার জন্য প্রয়োজন – এই ভাবনা আসতে আরও অনেক সময় লেগেছে।
মিস শেফালির প্রস্তুতি পর্ব ঐশিকা দেখেছেন একজন পারফর্মারের চোখ দিয়ে। আলাপচারিতায় শেফালি নিজেই লিডো রুমের দর্শকদের সম্পর্কে বলেছেন “নাচ নয়, নাচ ওরা বোঝেই না। ওরা আমাকে – আমার শরীরকে দেখতে আসত”। অথচ তারপরেও তাঁর এক নম্বর নৃত্যশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন মোছেনি। প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন নৃত্যকৌশল শিখেছেন। এমনকি অনেক পরেও যখন তিনি খ্যাতির (বা কুখ্যাতিও বলা যায়) শিখরে, তখনো জেদ করে ভারতীয় ধ্রুপদী নাচ শিখেছেন। এছাড়াও নিজেকে ক্রমাগত ওই গ্র্যান্ড হোটেলের জীবনের জন্য তৈরি করে গেছেন। নাচের শৈল্পিক দিক নিয়ে তিনি এতটাই মশগুল যে বারবার নিজেকে আলাদা করেছেন অন্য নর্তকীদের থেকে, যারা বিনা প্রস্তুতিতে, নাচের শৈলী আয়ত্ত না করেই বা নাচের ব্যাকরণ, ইতিহাস না জেনেই আসর গরম করে। প্রেমে পড়েছেন, তবু বিবাহের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন, বলেছেন, “স্বামী-সংসার-সন্তান নিয়ে জড়িয়ে পড়লে আমার নাচের কী হত?” দুঃখ করেছেন, “থিয়েটার না আমার নাচটাকে অনেক সস্তা, অনেক চটুল করে দিয়েছিল। ক্যাবারে যে কী জিনিস, এ ড্যান্সার যে কোথা থেকে তৈরি হল, এ সব কেউ বোধহয় আর ভাবত না। বুঝতেও পারত না।”
অথচ এই চেতনা, তাঁর নিজের শিল্পের প্রতি এই আত্মনিবেদন তাঁকে প্রার্থিত সম্মান এনে দেয়নি। তবু ‘সীমাবদ্ধ’ শীর্ষক পর্বে দেখানো হয়েছে, এরপরেও ইন্টেলেকচুয়াল বাঙালির কাছে শেফালি কেমন শুধু অবক্ষয়ের প্রতীক হিসেবেই রয়ে গেছেন। ক্যাবারে ডান্সার থেকে শিল্পী হয়ে ওঠার স্বীকৃতিটুকু তাঁর কপালে জোটেনি। ঐশিকা লিখেছেন “যে সংস্কৃতিমনস্ক, ইন্টেলেকচুয়াল, প্রগতিশীল বঙ্গবাসী বিপ্লবের কবিতা লেখে, হাংরি জেনারেশনের গদ্য/কবিতা যেখানে বৈপ্লবিক প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যকর্মের শিখর ছোঁয়, সেখানে মাঝরাতের শহরের প্রমোদরসের উপকরণ হয়ে একটা অর্ধনগ্ন শরীরের পেশাদারী অশ্লীলতা কেন গ্রহণযোগ্য হয় না – সেটাই শেফালির মাথায় ঢোকে না।”
অথচ শংকরের চৌরঙ্গী থেকে সম্রাট ও সুন্দরী – মিস শেফালির ছায়া স্পষ্ট উপন্যাসগুলিতে। এই দুটি উপন্যাসের নাট্যরূপেরও তিনি মঞ্চসফল অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টি দিয়ে দেখা সেই দুটি উপন্যাসকে গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখা বলে মেনে নিতে আজও অনেক বাঙালি পাঠকেরই অসুবিধা হবে না। তবু মিস শেফালিকে কিন্তু কয়েক দশকের ব্যবধানেও শিল্পীর স্বীকৃতি দিতে তাঁদের আপত্তি। মৃত্যুর পরেও তাঁর নৃত্যের শৈলী নয়, নগ্নতাটুকুই তাঁদের একমাত্র বিবেচ্য। তাঁদের কাছে থিয়েটারে নাচা আর বেশ্যাবৃত্তি প্রায় সমার্থক। সে শেফালি যতই বলুন না কেন, যে তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কেউ তাঁর গায়ে আঙুল ছোঁয়াতে পারেনি। বস্তুত তাঁর বিভিন্ন সময়ের আলাপচারিতায় যেন তথাকথিত বেশ্যাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার সচেতন প্রয়াসই লক্ষ্য করা যায়। এ বিষয়ে আলোচ্য বইয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। বর্তমান আলোচক তাতে না-পাওয়ার দুঃখ অনুভব করেছেন।
যতদিন তিনি গ্র্যান্ড হোটেলের সিংহদ্বারের পিছনে ছিলেন, ততদিন তাঁকে নিয়ে বিশেষ টানাপোড়েনও ছিল না। তাঁর থিয়েটারে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল এক অদ্ভুত বিতর্ক। সেই বিতর্কের একদিকে রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক নারী-যৌনতার নির্মাণ। শুধুমাত্র নারীদেহের শুদ্ধতা, পবিত্রতাকে ঘিরে গড়ে ওঠা এক ধরণের যৌন-নৈতিকতার নির্মাণ, যা ‘মেল গেজ’-এর নোংরামিকে উচ্ছেদ করতে পারে না, উল্টে নারীদেহকে বোরখা পরিয়ে রাখায় বিশ্বাসী। উল্টোদিকে রয়েছে স্থূল, বাণিজ্যিক বুদ্ধির “যা কিছু হাটে বিকোয় তা-ই পণ্য” মানসিকতা আর সর্বোচ্চ লাভের জন্য খুল্লমখুল্লা নারীমাংসের প্রদর্শনী। সংস্কৃত বনাম অসংস্কৃত। সংস্কৃতি বনাম অপসংস্কৃতি। সেই বিতর্ক রাজনৈতিক তরজায় আরও জোরদার হয়। আলোচ্য বইয়ের ‘পেটের দায় নাকি প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র’ পর্বে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ সহযোগে যে তত্ত্ব ফুটে উঠেছে, তা যে কোন ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের মতই প্রায়-অবিশ্বাস্য। তবু তখনকার নির্বাচিত সরকারগুলির কার্যকলাপ খতিয়ে দেখলে যেন সেই তত্ত্বে কিছুটা প্রতীতিও জন্মায়। বামফ্রন্ট সরকার মনে করত মেয়েদের অর্ধনগ্ন পশ্চিমা নাচ হল বুর্জোয়া অপসংস্কৃতি। তা বন্ধ করার জন্য তারা প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ বিভিন্ন ভূমিকা নেয়। রাষ্ট্র, পিতৃতন্ত্র আর নারী শরীর বিষয়ে মধ্যবিত্তের নৈতিকতার বোধ – তিনে মিলে তৈরি করে এক প্রবল সুসংস্কৃতির ভাষ্য, যার তলায় হারিয়ে যায় নারীর শরীরের অধিকারের কথা। সেইসঙ্গে মিস শেফালি আমাদের সংস্কৃতি জগৎ থেকে অদৃশ্য হয়ে যান, এক ধূসর প্রান্তিকতায় তাঁকে ঠেলে দেওয়া হয়। নতুন রাজনৈতিক জমানায় তাঁকে ‘বিষকন্যা’ আখ্যা দেওয়া হয়। এই যে যৌন নৈতিকতার বোধ, খেয়াল করলে দেখা যাবে এ-ও কিন্তু ভারি লিঙ্গনির্ভর। তিন ভুবনের পারে (১৯৬৯) ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তুমুল জনপ্রিয় হয়েছেন সিনেমার পর্দায় পাড়ার ইভ টিজারের রোল করে, তাঁর ‘কে তুমি নন্দিনী/আগে তো দেখিনি’ গানের সঙ্গে কোমর দুলিয়ে টুইস্ট নাচ তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তায় ভাটার টান ধরায়নি কিন্তু। অথবা সেই লোকগুলো, যারা রোজ বিশ্বরূপা বা সারকারিনার বক্স অফিস ভরাত, তাদের দিকে কি কেউ কখনো বিচারের আঙুল তুলেছে?
আরো পড়ুন গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা মেয়েদের অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া
শুধু সেইসব বিতর্কের তলায় চাপা পড়ে যায় এক অনভিজাত স্বাধীন নারীর খেটে খাওয়ার অধিকার, যিনি বলেন “মিস শেফালির কাছে এই বিনোদনের বাজারটাই তো একটা ‘কমোডিটি’। মধ্যবিত্তের খিদে, উচ্চবিত্তের বিলাস আর নিম্নবিত্তের লোলুপতা – এই সবকিছুই মই হিসেবে আমাকে তরতর করে উপরে নিয়ে গিয়েছিল। একটু উল্টোদিক দিয়ে দেখ না একবার! আমার নিজের শরীরকে ইচ্ছে মত ব্যবহার করার ইচ্ছেটাকে তোমরা নস্যাৎ করো কী করে?”
অবাক হয়ে ভাবতে হয় ‘৪৭ সালে জন্মানো, কৈশোরে কেরিয়ারে প্রবেশের সময় নিজের নামটুকুও প্রায় ঠিক করে সই করতে না পারা কটা বাঙালি মেয়ে এইভাবে ভাবতে পেরেছে? বা ভাবলেও মুখ ফুটে বলে উঠতে পেরেছে? “মাই বডি, মাই রাইট” – তৃতীয় ধারার নারীবাদের এই দৃপ্ত উচ্চারণ তো কিছুদিন আগেও চারপাশে শোনা যেত না মোটেই।
শেফালি নিজেকে একজন ‘অ্যাচিভার’, একজন ‘এন্টারটেইনার’ বলেই ভেবেছেন আজীবন। কিন্তু সমাজ কি আদৌ মেনেছে তাঁর সেই দাবি? ঐশিকা দেখিয়েছেন, সেই একই সময়ে কিন্তু হাংরি জেনারেশনের পুরুষ লেখকরা লিখতে চেয়েছেন “যৌন পরমানন্দের (অরগ্যাজম) মত প্রাণবান” লেখা। সেই লেখাকে বা সেই সাহিত্যিকদের কিন্তু বাতিল করা হয়নি। ঐশিকা লিখেছেন, “সাহিত্যের পাতায় যে অশ্লীলতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক, সেই অশ্লীলতাই নারীদেহে চাক্ষুষ করলে হয়ে যায় অনৈতিক। মন্দ জিনিস (অক্ষরে) পড়া আর (শরীরে) দেখার মধ্যে বিস্তর তফাত। বিশেষত সেই শরীর যদি স্বেচ্ছায় শ্লীলতার বেড়া ভাঙ্গে।” মেয়েদের এই স্বেচ্ছায় বেড়া ভাঙার ‘এজেন্সি’ মেনে নিতে সমাজের বড্ড আপত্তি। বাস্তবের শেফালি সমাজের বলে দেওয়া পথে হাঁটেননি। বারবার বাঁধা গতের বাইরে গিয়ে নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, নিজের শর্ত নিজে বলে দিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, সেই উদ্ধত স্বাতন্ত্র্যের ছটা সহ্য করার মত পরিণত ছিল না সেদিনের বাঙালি সমাজ। সেই সময়ের সাধারণ বাঙালি বাড়ির মা মাসিদের “মেনে চলো-মানিয়ে চলো” গণ্ডির বাধ্যতার মধ্যে তিনি বড়ই বেমানান।
বইটি সুলিখিত, সুখপাঠ্য। বিদ্যায়তনিক পরিভাষায় পরিপূর্ণ নয় মোটেই। সবচেয়ে বড় কথা, তত্ত্বকথার উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও এই বইয়ে শেফালি পূর্ণ মানুষের মতন ফুটে উঠেছেন, তত্ত্বকথার দর্পণে প্রতিফলিত খণ্ডিত মানুষ হিসাবে নয়। এটাই বড় পাওয়া।
কলকাতার ক্যাবারে
বাঙালি, যৌনতা এবং মিস শেফালি
লেখক: ঐশিকা চক্রবর্তী
প্রকাশক: গাঙচিল
দাম: ৩২৫ টাকা
~ মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।