গর্ভপাত নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়, এর ব্যাপ্তিও বিশ্বব্যাপী। আর বিশ্বায়নের অন্যতম প্রধান মুখ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই বিতর্কেই নতুন করে অগ্নিসংযোগ করেছে। গত ২৪ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে যখন গর্ভপাতকে মহিলাদের সাংবিধানিক অধিকারের আওতার বাইরে এনে ফেলল এবং সেইসঙ্গে ওই দেশে ৫০ বছর ধরে চালু থাকা গর্ভপাতের বৈধতাকে বিপন্ন করল, তখন এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমেরিকার সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হল। ভারতেও এসে লাগল সেই বিতর্কের ঢেউ, যদিও ভারতে গর্ভপাত বিষয়ক আইন প্রগতিশীল এবং মহিলাদের নিরাপদে গর্ভপাত করানোর সুযোগ আইনস্বীকৃত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৩ সালের রো বনাম ওয়েড মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে গর্ভপাতকে মহিলাদের সাংবিধানিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। দেশটির রাজনৈতিক তথা ধর্মীয় রক্ষণশীলদের কাছে ১৯৭৩ সালের রায় ছিল এক বড় আঘাত। মানবাধিকার তথা মহিলাদের অধিকারের লড়াইয়ে ওই রায়কে এক বলিষ্ঠ ও সদর্থক পদক্ষেপ হিসাবে স্বাগত জানানো হয়। আর ২০২২ সালের রায়ে বড়সড় ধাক্কা খেল আমেরিকার প্রগতিশীল, উদারনৈতিক মহল এবং মহিলাদের অধিকার তথা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা মানুষ ও সংগঠনগুলো। এই রায়ের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যগুলো নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী গর্ভপাত নিয়ন্ত্রণ বা রোধ করার জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারবে। ইতিমধ্যেই চোদ্দটির বেশি রাজ্য গর্ভপাতকে অবৈধ করার আইন চালু করতে পদক্ষেপ নিয়েছে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বিতর্কিত এই রায় নিয়ে আরও আলোচনার আগে কিছু পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারা বিশ্বে ১০০০ গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে ৩৪-৩৭ জন গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেন; আইনের চোখে বৈধতা সেখানে বিশেষ ভূমিকা পালন করে না। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বে প্রতি বছর ২৫ মিলিয়ন অসুরক্ষিত গর্ভপাত ঘটে ও এর অধিকাংশই ঘটে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরো জানাচ্ছে যে মাতৃত্বকালীন (maternal) মৃত্যুর প্রধান কারণ বিপজ্জনক গর্ভপাত। অসুরক্ষিত গর্ভপাতের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৩৭,০০০ মহিলার মৃত্যু হয়। ওই প্রতিবেদনে এ-ও দাবি করা হয়েছে যে সঠিকভাবে চিকিৎসকের সাহায্য নিয়ে গর্ভপাত করালে গর্ভপাতের জেরে মৃত্যু প্রায় নির্মূল করা সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব দেশে গর্ভ আটকানোর উপায়গুলো সহজলভ্য নয়, সেখানেই অসুরক্ষিত গর্ভপাতের হার বেশি।
কাজেই আজকের বিতর্কের পরিমণ্ডলে, যেখানে গর্ভপাতবিরোধী গোষ্ঠী ভ্রূণের বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে সোচ্চার (যদিও তাদের যুক্তির সিংহভাগ যতটা আবেগতাড়িত ততটা বিজ্ঞাননির্ভর নয়), তাদের কাছে সোজা প্রশ্ন – নারীর জীবনের কি কোন দাম নেই? এই একবিংশ শতাব্দীতেও নারীর শরীর কি শুধু সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র?
গর্ভপাত বিতর্কে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, যাঁরা গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার পক্ষে, তাঁরা কিন্তু মহিলাদের অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের মূল আর্থ-সামাজিক কারণগুলো নিয়ে বিচলিত নন; অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের ফলে যে শিশুরা ভূমিষ্ঠ হয়, তাদের লালন পালনের জটিলতা নিয়েও বিচলিত নন। বলাই বাহুল্য, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (CEDAW) সহ একাধিক মানবাধিকার দলিলে লিপিবদ্ধ মহিলাদের মৌলিক মানবাধিকার ও ক্ষমতায়ন নিয়েও তাঁরা ভাবিত নন।
গর্ভপাতবিরোধীদের একাংশ ধর্ষিতাদের গর্ভপাতের অধিকারেরও বিপক্ষে। স্বভাবতই মনে হয়, মূল সমস্যা শুধু গর্ভপাতের বৈধতা বা অবৈধতা বিতর্ক নয়; সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার সাথে তার গাঁটছড়া বাঁধা। মুখে আজ আমরা যতই নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলি না কেন, আমাদের সমাজ, সে আমেরিকাই হোক আর আফগানিস্তান, মেয়েদের সমান মর্যাদা দিতে এখনো অক্ষম। বলার অপেক্ষা রাখে না, বহু মহিলাও পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার। কাজেই গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে যে অনেক মহিলাও স্বাগত জানান, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এবার দেখা যাক, গর্ভপাতের বৈধতার সঙ্গে মানবাধিকারের তথা মহিলাদের ক্ষমতায়নের সম্পর্কটা কোথায়? গর্ভপাত অবৈধ হলে কাদের মানবাধিকার সবার আগে সংকুচিত হবে? মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের এই নতুন রায় ও সংশ্লিষ্ট জটিলতা তথা মানবাধিকারের দিক নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের লিঙ্গসাম্য ও মহিলাদের অধিকার নিয়ে কর্মরত সংস্থা UN Women বলেছে “To be able to exercise their human rights and make essential decisions, women need to be able to decide freely and responsibly on the number and spacing of their children and to have access to information, education and services”
লিঙ্গ নির্বিশেষে নিজের শরীরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার। সন্তান ধারণ করা বা না করা, সন্তানের জন্ম দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়টি একান্ত ব্যক্তিগত এবং প্রাইভেসির অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে UN Women আরো বলে “The ability of women to control what happens to their bodies is also associated with the roles women are able to play in society, whether as a member of the family, the workforce, or government.”
CEDAW ছাড়াও ১৯৯৪ সালের International Conference on Population and Development (ICPD)-এ অংশ নেওয়া ১৭৯টি দেশ, যার মধ্যে আমেরিকাও ছিল, একমত হয় যে অসুরক্ষিত গর্ভপাত বন্ধ করা উচিত এবং গর্ভপাত তথা পরবর্তী জরুরী চিকিৎসা পরিষেবা সকলের পাওয়া উচিত। Sustainable Development Goal – SDG 3-তেও “unsafe abortion” বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে এবং জাতিপুঞ্জের সদস্য দেশগুলো তা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। বিগত ২৫ বছরে প্রায় পঞ্চাশটি দেশ গর্ভপাত রোধ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে নিরাপদ গর্ভপাতের পথ প্রশস্ত করেছে। এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকার এই নতুন পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নানা প্রতিবেদন থেকে উঠে আসা তথ্য বলছে, অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের শিকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিশোরী এবং আর্থিকভাবে নিম্নবর্গের মহিলারা। আমরা জানি, পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় আর্থিক সাম্য সুদূরপরাহত। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং/অথবা জাতি, বর্ণ, ধর্মের দিক থেকে সংখ্যালঘু মানুষের কাছে সামাজিক ন্যায়ও প্রায়ই অধরা থেকে যায়। বিপন্ন জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও আবার শিশু, কিশোরী, নারী বেশি বিপন্ন। সেইজন্যই মানবাধিকারের দলিলে বারবার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এদের মানবাধিকার সুরক্ষিত করার কথা বলা হয়েছে। গর্ভপাত নিষিদ্ধ করলে গর্ভপাতের সংখ্যা যে আদৌ কমে না, একাধিক গবেষণায় তা উঠে এসেছে। যা ঘটে তা হল অসুরক্ষিত, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, হাতুড়ের সাহায্যে লুকিয়ে গর্ভপাত। তার ফলে বহু কিশোরী, পূর্ণবয়স্ক মহিলা, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বা যাঁরা নিজেদের কোনো বিশেষ লিঙ্গের মানুষ বলে মনে করেন না এবং গর্ভপাত করাতে চান, তাঁদের অকালে মৃত্যু হয়। আমেরিকার মত দেশে যারা আর্থিকভাবে সক্ষম তারা অন্য রাজ্য বা দেশে, যেখানে গর্ভপাত বৈধ, সেখানে গিয়ে যথাযথ চিকিৎসার সুযোগ নিতে পারবেন, কিন্তু যারা আর্থ-সামাজিকভাবে দুর্বল, তাদের অবৈধ গর্ভপাতের ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
তাহলে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করে কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হবে? উত্তরে নীতিবাগীশদের যুক্তির আড়ালে মহিলাদের নিয়ন্ত্রণ করার সেই চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক অভিলাষের মুখটাই দেখা যায়।
আরও পড়ুন জয়েশভাই জোরদার: অন্যরকম স্বপ্নের গল্প
এখানে উল্লেখ করা দরকার, গর্ভপাত সমর্থন করার অর্থ ব্যাপকভাবে গর্ভপাতে উৎসাহ দেওয়া নয়। গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার থেকে অনেক বেশি গঠনমূলক কাজ হল অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমিয়ে আনা। এর জন্য দরকার শিক্ষা। স্কুলে যৌনশিক্ষা চালু করতে ভয় না পেয়ে কিশোর-কিশোরীদের যথাযথ যৌন শিক্ষার ব্যবস্থা করা। যুবক-যুবতীদের গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জোগানো এবং সেই ব্যবস্থা গ্রহণে তাদের আগ্রহী করে তুলতে প্রচার। দরকার উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা, যাতে হবু মা ও সন্তানের সার্বিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়। দরকার মা-বাবাদের সন্তানের জন্মদানের আগে ও পরে প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। উপর্যুক্ত অনেক সুবিধাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিরল। আর শুধু মার্কিন কেন, বেসরকারিকরণের যুগে, অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার যুগে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই উল্লিখিত পরিষেবা ও পরিকাঠামো নেই। এই আবহে যখন অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের ঘটনা ঘটে, তখন তা থেকে বৈধ ও নিরাপদ উপায়ে মুক্তির দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল মরার উপর খাঁড়ার ঘা দেওয়ার সামিল।
গর্ভপাত কমানো নিশ্চয়ই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, কিন্তু সেজন্য দরকার সত্যিকারের লিঙ্গসাম্য – পরিবার থেকে কর্মক্ষেত্র, সর্বত্রই। দরকার শিক্ষা ও প্রচার। তার পাশাপাশি নিরাপদ গর্ভপাতের সুযোগ যাতে সবার আয়ত্তে থাকে তা নিশ্চিত করা দরকার।
এসব না করে নৈতিকতার নামে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা মানে বহু মেয়েকে অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। গর্ভপাতের বৈধতার বিরোধিতা তাই জীবনের জয়গান নয়, বরং অনেক জীবনকে অকালে মৃত্যুর হাতে সঁপে দেওয়ার পরোয়ানা। এর বিরুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, মানবাধিকারে তথা নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী মানুষের এক হওয়া দরকার। সেদিক থেকে দেখলে আশার কথা এই যে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের এই বিতর্কিত রায়টি পরোক্ষভাবে ও দেশে এবং বিশ্বব্যাপী মহিলাদের অধিকারের লড়াইকে আরও জোরদার করতে সহায়ক হল। আমেরিকায় তথা বিশ্বজুড়ে এই রায়ের প্রতিবাদে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, সেটাই যৌথ প্রতিবাদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।