শুনুন, স্পেশাল ফোর্সের মেজর গৌরব চৌধুরীকে চেনেন তো? না চিনলে বলে রাখি, গৌরব হলেন ভারতের মাননীয় রাষ্ট্রপতির স্পেশাল গার্ডের এডিসি। রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার খাতিরে সুদর্শন এই ব্রাহ্মণ সন্তানের নিজের কোনও সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নেই, তবু তাঁর নামে হাজার হাজার পেজ চলে, চালান তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্তরা। তিনি কীভাবে হাঁটেন, দাঁড়ান, রাষ্ট্রপতি বা ফার্স্ট লেডির সাথে কীভাবে কথা বলেন, তাঁর ইউনিফর্মের কোথায় প্যারা কমান্ডো, কোথায় বলিদান, কোথায় রাষ্ট্রপতির নিজস্ব কর্মী লেখা লোগো রয়েছে – এইসব নিয়ে ভেঙে পড়ে রিলসের লাইন মোবাইলের স্ক্রিনে। স্বয়ং রাষ্ট্রপতির নামেই এত পেজ নেই, এমনকি তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলও রাষ্ট্রপতি ভবন নামে। অথচ প্রায় এক চাঁদ পরে যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে তার একজন প্রার্থী, যাঁর নাম দ্রৌপদী মুর্মু, টুইটারে নিজের হ্যান্ডেলের নাম রেখেছেন প্রেসিডেন্ট মুর্মু।

রাষ্ট্রপতির নিজস্ব বাহিনীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর পিছনে দন্ডায়মান কোনো শ্যামলবরন পুরুষকে দেখেছেন কি? দেখেছেন কোনো মহিলাকে? ২০০৭ সালে মিডিয়া যখন প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি মহারাষ্ট্র প্রদেশ কংগ্রেসের সভানেত্রী প্রতিভা পাটিলকে নিয়ে পড়েছিল, তারপর এমনকি মহিলা রাষ্ট্রপতির পাশেও কোনো মহিলা এডিসি পেয়েছিলেন কি? মহিলা রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন বলে লম্বা চওড়া কথাবার্তার সময়ে ২০০২ সালের লক্ষ্মী সায়গলকে মনে ছিল? নাকি যুদ্ধ ও দাঙ্গার গরম বাজারে মিসাইলম্যানকে ব্যবহার করে ঈষৎ উষ্ণতা বন্টন হয়েছিল? সেবার ১৮ জুলাই সর্বমোট ১০,৩০,২৫০ ভোটের মধ্যে মাত্র ৯,২২,৮৮৪ ভোট পেয়ে কালাম সাহেব ২৫ জুলাই থেকে রাইসিনা হিলসে থাকতে শুরু করেন। আবার ধরুন, তার আগেরবার দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএন সেশন পেলেন ৫১,০০০ ভোট আর প্রতিদ্বন্দ্বী কে আর নারায়ণন পেলেন ৯,৫৭,০০০-এর কাছাকাছি ভোট। ফলে মন্ডল পরবর্তী রোদেলা দিনের রুদালিতে নারায়ণী অস্ত্রে প্রথম দলিত প্রেসিডেন্ট পেল ভারত। যদিও তার প্রায় কুড়ি বছর পরে আরেকজন যখন দ্বিতীয় দলিত রাষ্ট্রপতি হলেন, তাঁকে সস্ত্রীক সাংবিধানিকভাবে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান এবং সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র বর্ণাশ্রমিক পরিচয়ের কারণেই মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

ফলত একথা খুব স্পষ্ট যে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে লোকসভা এবং রাজ্যসভায় যে দলের সংখ্যাগত আধিপত্য থাকে, সারা দেশে আইনসভার সদস্যদের মধ্যে যাদের প্রাধান্য থাকে, তাদের প্রার্থীই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাইসিনা দখল করেন। আর তাতে দলিত, মুসলমান, আদিবাসী বা মহিলা – কারোর জীবনেই বিশেষ প্রভাব পড়ে না। সুতরাং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই সংক্রান্ত শুচিতা নিয়ে মাঠে ময়দানে লড়াই করা মানুষদের সময় নষ্ট করা মানায় না। বরং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সংক্রান্ত ভড়ং বা গা জোয়ারিটাকেই চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

এবারের নির্বাচনে ওড়িশার দ্রৌপদী মুর্মুর হয়ে নরেন্দ্র মোদী মনোনয়ন জমা দিলেন। মুর্মু একজন আদিবাসী, ওড়িশার প্রাক্তন বিধায়ক ও মন্ত্রী, ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন রাজ্যপাল এবং প্রায় ২৫ বছর ধরে ওড়িশায় বিজেপির রাজ্য স্তরের নেতা। গুজরাটের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল আনন্দীবেন প্যাটেল, বিহারের নীতিশ কুমারকে টপকে দ্রৌপদী শেষ মুহূর্তে এনডিএ প্রার্থী হয়েছেন। আর বহু প্রতীক্ষার পর বিরোধী জোটগুলো একেবারে শেষ মুহূর্তে একজোট হয়ে বিজেপির প্রাক্তন মন্ত্রী ও তৃণমূলের জাতীয় স্তরের সদ্যপ্রাক্তন নেতা যশোবন্ত সিংকে তাদের প্রার্থী নির্বাচিত করেছে।

প্রথমত, এটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, আঞ্চলিক স্তরে যুযুধান বিরোধিতার ধারাবাহিকতা এবং ভবিষ্যতেও সংঘর্ষের যথেষ্ট কারণ সত্ত্বেও জাতীয় স্তরে এমন জোট, নিদেনপক্ষে বিজেপিবিরোধী সর্বদলীয় জোট একান্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই একীকরণকে সবলভাবে সফল করার মধ্যে দিয়েই আগামী লোকসভায় বিজেপির ফ্যাসিবাদের দুর্বার বিরোধিতা ফলপ্রসূ হতে পারে। বড় পরিসরের রাজনৈতিক জয়ের সম্ভাবনার কাছে রাজ্য স্তরের স্থানীয় অপরাধনামার খতিয়ান কোনোভাবেই গৌণ নয়। তাই আত্মঘাতী দিশাহীনতার মর্মান্তিক পরিণতি ও সঠিক সময়ে সিদ্ধান্তহীনতার মাসুলের ধারাবাহিকতাকে স্মরণে রাখাই সময়ের দাবি।

এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে ভাবতে গিয়ে এগোনো যেতে পারে গবেষক সুরথ কুমার মালিকের প্রবন্ধ ‘উড়িষ্যার দলিত প্রতিবাদ সাহিত্য ও আন্দোলনের উৎপত্তি, ঐতিহাসিকতা এবং অধ্যবসায়’ (সেজ, ফেব্রুয়ারি ২০২১) নিয়ে। সেখানে সুরথ বলছেন, ওড়িশায় সামাজিক ইতিহাসের বর্ণনায় দলিত সাহিত্যের কি অপরিসীম গুরুত্ব, কিম্বা ভারতের মধ্যে যে রাজ্যে নিম্নবর্ণের সাহিত্যের মূল্য নির্ধারণকে উচ্চবর্ণের করিৎকর্মা মানুষ সবথেকে আগে দখলে এনেছেন সেই ওড়িশার কথা। সেই ওড়িশার কথা, যেখানে হাজার হেনস্থার পরেও ঔপনিবেশিক বা উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে অন্য রাজ্যের মত কোনো সংগঠিত দলিত আন্দোলন গড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। এসব নিয়ে রাজ্যের এক সময়ের মন্ত্রী দ্রৌপদীর কোনো বক্তব্য বা সক্রিয়তার সন্ধান পাওয়া যায় কি? অতি বড় শত্রুও দ্রৌপদীকে এই বদনাম দিতে পারবেন না যে ২০০৮ সালে ওড়িশায় উগ্র দক্ষিণপন্থীদের দ্বারা সংগঠিত হিংসা ও দাঙ্গার বিরুদ্ধে তিনি কোনো কথা বলেছেন। বিধানসভা বা সরকারি দপ্তরের নথিতে এমন কোনো উল্লেখ নেই। কন্ধমালে ২০১২ সালে এক সন্ন্যাসিনীর যৌন নির্যাতনের পর দ্রৌপদী কী ভূমিকা নিয়েছিলেন তা-ও জানা যায় না।

আরো পড়ুন যশোবন্তকে সমর্থনে বামপন্থী কর্মীবাহিনী হতাশ হয়ে পড়বে

বরং জানা যায় ২০১৫ সালে ওড়িশার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক দ্বারা রাজ্য বিধানসভায় উপস্থাপিত এক শ্বেতপত্রের কথা। সেই শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে নারীর প্রতি হিংসার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাঁচ বছরে (২০১০-২০১৫) ধর্ষণের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গিয়েছে । ২০১০ সালে ১,০২৫; ২০১৫ সালে হয়েছে ২,২৮৬।

তফসিলি জাতি, উপজাতির মানুষের উপর অত্যাচারের ঘটনাও ওই পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০১০ সালে তাঁদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা নিয়ে মামলার সংখ্যা ছিল ১,৫৮৯; ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২,৫০৪। এর মধ্যে ১,৮১৬টি ঘটনা দলিত ও মহাদলিতদের বিরুদ্ধে এবং ৬৮৮টি ঘটনা আদিবাসীদের বিরুদ্ধে। ২০১৪ সালে ২,২৬৬, ২০১৩ সালে ২,২৯৮, ২০১২ সালে ২,৫২২ এবং ২০১১ সালে ১,৬৬২; অর্থাৎ অত্যাচারের ধারাবাহিকতা বেড়েছে। সেই শ্বেতপত্র বলে দলিত ও মহাদলিতরা আদিবাসীদের তুলনায় তুলনামূলকভাবে অধিকতর নৃশংসতার শিকার হন। নৃশংসতার প্রকৃতি বহুবিধ, যার মধ্যে রয়েছে ধর্ষণ, হত্যা, বাড়ি পোড়ানো, ফসল ধ্বংস করা, গণআক্রমণ, শারীরিক ও মানসিক আক্রমণ এবং নির্যাতন। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওড়িশার বিভিন্ন আদালতে তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রায় ৯০টি নৃশংসতার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। রাজ্য সরকার এসসি/এসটি (পিওএ) আইন, ১৯৮৯ এবং বিধিমালা, ১৯৯৫-এর বিধান অনুযায়ী দ্রুত বিচারের জন্য কোনো বিশেষ আদালত গঠন করেনি।

এসব লড়াইয়ে দ্রৌপদী কোথায় ছিলেন – সে প্রশ্ন করা দরকার। ভ্রান্ত বিরোধিতা ও শিশুসুলভ বৈরিতা ত্যাগ করে রাজনৈতিক লড়াইয়ের সবরকম সম্ভাবনাকে স্বাগত জানাতে হবে। একইসঙ্গে সমস্তরকম অবিচার, অত্যাচার ও অপরাধের বিরুদ্ধে চালিয়ে যেতে হবে রাস্তার লড়াই।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.