শাওন
গত ২৮ সেপ্টেম্বর এক বিশাল মিছিল করে উত্তর চব্বিশ পরগণার জেলাশাসকের দপ্তর ঘেরাও করলেন হাজার হাজার মিড ডে মিল রন্ধনকর্মী। চার ঘন্টার বেশি সময় জেলা সদর বারাসাতকে স্তব্ধ করে দিয়ে হরতাল চলল। তাঁদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ মিড ডে মিল অ্যাসিস্ট্যান্টস (AMMA) বা আম্মার পক্ষ থেকে কয়েক দফা দাবির কথা জানানো হল।
স্কুলের মিড ডে মিল কর্মীরা একেকটি পদে মাসে ১৫০০ টাকা মাইনে পান, তাও ১২ মাসের বদলে মাত্র ১০ মাসের মাইনে পান তাঁরা। কোনো মাতৃত্বকালীন ছুটি, উৎসবকালীন বোনাস, দুর্ঘটনাজনিত চিকিৎসা বা অবসরকালীন ভাতার ব্যবস্থা নেই। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেও মাইনে আসে না। গ্যাস সিলিন্ডার থাকা সত্ত্বেও বহু জায়গায় কাঠের আগুনে রান্না করানো হয় তাঁদের দিয়ে। কাঠের যোগাড়যন্ত্র এবং বর্ষার মধ্যে কাঠ ঠিকঠাক সামলে রাখার দায়িত্বও তাঁদেরই। ছয় ঘন্টা গরমে ধোঁয়ায় রান্না করে বাচ্চাদের খেতে দিয়ে অবশিষ্ট সামান্য খাবার বাড়ি নিয়ে গেলে ভ্রূ কুঞ্চিত হয় অনেকের। তাঁদের কোনো সরকারি নিয়োগপত্র নেই, আছে যখন তখন কাজ হারাবার ভয়, স্থানীয় রাজনৈতিক দাদাদের হুমকি। বহু জায়গায় রান্নার কাজ ছাড়াও বাথরুম পরিষ্কার বা ক্লাসরুম ঝাঁট দেওয়ার কাজ করানো হয় তাঁদের দিয়ে। সরকার ‘সাম্মানিক কাজ’ তকমা দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলেছেন, আর এই দিদিদের জুটছে একরাশ অসম্মান। সেই দিদিরা, যাঁরা শিক্ষার মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে গত ১৮ বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এলাহাবাদ হাইকোর্ট ২০২০ সালে মিড ডে মিল কর্মীদের বেগার খাটানো হচ্ছে বলে ঘোষণা করেছিল। শুধু অবিলম্বে ন্যূনতম মজুরির অনুপাতে মজুরি দেওয়াই নয়, ওই অনুপাতে বিগত ১৫ বছরের বকেয়া টাকাও মিটিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। তাতে ‘সাম্মানিক কাজ’ নামের আড়ালে একরাশ অসম্মান বন্ধ হয়নি। ওই দিন মিড ডে মিল কর্মীরা জেলাশাসক মারফত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তাঁদের সম্মান আদায়ের দাবি জানাতে গিয়েছিলেন।
কী ছিল তাঁদের দাবিপত্রে? উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো তো ছিলই; কিন্তু ওই সংক্রান্ত দাবিগুলোর কোনোটাই প্রথম দাবি হিসাবে স্থান পায়নি। যে দাবিটা সবার আগে স্থান পেয়েছিল তা হল – অবিলম্বে স্কুলে বাচ্চাদের খাবারের বরাদ্দ বাড়াতে হবে, রোজ ডিম দিতে হবে। স্কুলে এই কর্মীরা মায়ের ভূমিকা পালন করেন, সংগঠনের নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী নাম হয়েছে ‘আম্মা’। সেইজন্যই অভুক্ত বাচ্চার পুষ্টির দাবি মায়েদের সম্মান আদায়ের প্রথম শর্ত হিসাবে স্থান পেয়েছে। যেখানে ‘অভিভাবক’ সরকার বাচ্চাদের অভুক্ত রেখে দুর্গাপুজোয় হাজার কোটি খরচ করেন সেখানে আম্মা ছাড়া সমাজের ভবিষ্যৎদের কথা কে ভাববে?
শুধু এই আন্দোলনের জন্য নিশ্চয়ই নয়, বরং দেশজোড়া সমস্ত আন্দোলনের চাপেই কেন্দ্রীয় সরকার মিড ডে মিলে মাথাপিছু বরাদ্দ প্রায় ১০% বৃদ্ধি করল। এই বৃদ্ধিতে খুশি হওয়ার কিছুই নেই। প্রতিদিন ডিম দিতে গেলেও বরাদ্দ আরও অনেক বাড়াতে হবে, তার জন্য লাগাতার আন্দোলনই শেষ কথা বলতে পারে।
আরো পড়ুন সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার চক্রান্তের অঙ্গ দুর্নীতি
আসলে মিড ডে মিল কর্মীদের এই প্রবল বঞ্চনার একটা ভিত্তি রয়েছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য ও শিক্ষার প্রতি যে অবহেলা সরকারি নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থেকেছে, এটা তারই ধারাবাহিকতা। ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে ব্যবহার করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গণআন্দোলনের ফসল হিসাবে মিড ডে মিল, তথ্যের অধিকার, একশো দিনের কাজ, বনভূমির অধিকার, খাদ্যের অধিকার ইত্যাদি আইনত আদায় করা গেছে বটে, কিন্তু এগুলোর কোনোটাই সরকারি নীতি হয়ে ওঠেনি। এই অধিকারগুলো তাই সরকারিভাবে ব্রাত্যই থেকে গেছে। এগুলো শ্রমজীবী মানুষের প্রতি অসম্মানজনক এক ব্যবস্থার মাঝে শ্রমজীবীদের হাতিয়ার। স্বভাবতই, এগুলো সাবলীলভাবে চলবে – একথা ভাবা রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় নয়। এগুলোকে সচল রাখতে, বাস্তবায়ন করতেও দীর্ঘ সংগ্রামের প্রয়োজন হবে। শ্রমজীবী জনগণের কাছে তাঁদের সম্মান, আত্মমর্যাদা সবচেয়ে বড় জিনিস। তা রক্ষার স্বার্থে যা যা পরিবর্তন আনা দরকার তার জন্য লড়াই অব্যাহত রাখলে তবেই প্রতিটি অধিকার স্বীকৃতি পেতে পারে। এই অধিকার আদায়ের লড়াই বিচ্ছিন্নভাবে দেখার বিষয় নয়। প্রতিটি অধিকারের প্রতি অকুণ্ঠ দায়বদ্ধতা, নিরলস সংগ্রাম এবং যেখানেই লড়াইয়ের ঐক্য সম্ভব সেখানেই ঐক্যবদ্ধ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
আম্মার প্রথম দাবি থেকে তেমন ঐক্যেরই ইঙ্গিত মিলছে। নদীয়া জেলার শান্তিপুর ব্লক থেকে তার যাত্রা শুরু হয়। শান্তিপুরের মিড ডে মিল দিদিরা একত্রিত হয়ে এই সংগঠন তৈরি করে বিগত ২৭ জানুয়ারি কৃষ্ণনগরে নদীয়ার জেলাশাসকের কাছে তাঁদের দাবিগুলো নিয়ে ডেপুটেশন দেন। তারপর শান্তিপুরে অনুষ্ঠিত হয় মিছিল এবং প্রথম আম্মা সম্মেলন। সম্মেলন থেকেই স্থির হয়েছে, আম্মা কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না এবং সংগঠন উপর থেকে হুকুম জারি করে নয়, গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হবে। এটা একেবারেই মিড ডে মিল কর্মীদের নিজস্ব সংগঠন হয়ে উঠবে। যাঁরা কেন্দ্র ও রাজ্য – উভয়ের বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়তে চাইবেন, তাঁরাই এই লড়াইয়ে স্বাগত। উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা অভিযানে সংহতি জানাতে প্রায় একশো জন মিড ডে মিল কর্মী শান্তিপুর থেকে বারাসাত এসে মিছিলে হাঁটলেন সেদিন। সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ভারতবর্ষে শ্রমজীবী জনগণের জন্য অন্যতম জরুরি ইস্যু। আম্মা সংগঠনের সাফল্য লুকিয়ে আছে এই ইস্যুতে ব্যাপক ঐক্য গড়ে তোলার দায়বদ্ধতার মধ্যে।
নিবন্ধকার গণআন্দোলনের কর্মী। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
[…] আরো পড়ুন শুধু নিজেদের জন্য নয়, শিশুদের জন্যও লড়… […]