গত ৫ অক্টোবরের (বুধবার) একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে এই লেখার অবতারণা। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার শহরের নিকটবর্তী মাল নদীতে হঠাৎ হড়পা বান নেমে আসে। বেশ কিছু মানুষ নিহত, অনেকে আহত, অনেকে সম্ভবত নিখোঁজ। নিহতের সংখ্যা উল্লেখ করলাম না, কারণ যখন এই লিখছি তখনো সরকার, প্রশাসন জানাতে পারেনি ঠিক কতজন নিহত, আহত এবং কেউ নিখোঁজ কিনা। দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের সময় পাহাড়ি নদীতে হড়পা বান, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ঘটনার চোখে দেখা বিবরণ প্রায় সবাই জেনেছি, পড়েছি।

পাহাড়ি নদীতে প্রতিমা বিসর্জন অনেককাল বন্ধ ছিল। বর্তমান সরকারের আমলে নতুন করে আরম্ভ হয়েছে। মাল শহরের পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলা মাল নদীতে এবার প্রবল বৃষ্টির কারণে ভাঙন ব্যাপক আকার নেয়। সম্প্রতি কয়েকদিন আগেই হড়পা বানে নদীঘাটের কাছেই একটি ট্রাক ডুবে যায়। আগাম সতর্কতা ছিল, যে কোনো সময় মাল নদীতে হড়পা বান আসতে পারে। নদী নুড়ি, মাটি, বালির বস্তা দিয়ে আটকে দেওয়া মানে মৃত্যু ফাঁদ তৈরি করা। সেই ফাঁদেই তলিয়ে গেল অনেকগুলো জীবন। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে অসহায় হয়ে পড়ল বেশ কিছু পরিবার। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সলিল সমাধি হল অনেকগুলো স্বপ্নের। শিশু, মহিলা, বয়স্করাও হারিয়ে গেল মাল নদীর স্রোতে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

যাঁরা বিশ্লেষক, পরিবেশবিদ, নদী গবেষক – তাঁরা নিশ্চয়ই এই ঘটনার কার্যকারণ আলোচনা করবেন, খুঁজে বের করবেন গাফিলতি। কিন্তু আর্ত মৃতপ্রায় মানুষের চিৎকার সরকার, প্রশাসন বা আমাদের স্পর্শ করেছে কি? বেশ কয়েকবছর হল, দুর্গাপুজো শেষে বিসর্জনের আগে কলকাতার রেড রোডে কার্নিভালের আয়োজন করা হচ্ছে। একইভাবে কলকাতার অনুকরণে প্রতিটি জেলার জেলা সদরে এই কার্নিভালের আয়োজন হয়ে আসছে। সংযম সভ্য সমাজের অলংকার। শোকের আবহে সভ্য মানুষ উল্লাস করে না। কিন্তু আমাদের রাজ্যে সরকার, প্রশাসনে সংযমের অভাব। উৎসব-প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী আগেও বলেছেন “উৎসব করব না তো কি শ্রাদ্ধ করব?” রাজ্যে তাঁর অনুপ্রেরণায় মেলা, খেলা চলতেই থাকে। এটাই এখন নিয়ম। বিজয়ায় রাজ্যের এক প্রান্তে যখন শোক, হাহাকার, তখন কি রাজ্যের অন্য প্রান্তে সংগীত, আলো, বৈভবের প্রদর্শনী বন্ধ করা যেত না? সরকার চালাতে গেলে কি এতটাই হৃদয়হীন হতে হয়? উত্তরবঙ্গের প্রান্ত সীমায় কৌলীন্যহীন জনপদে বিপর্যয় বলেই কি সরকারি ব্যবস্থাপনায় রেড রোডে বিরামহীন কার্নিভালের আয়োজন এবং বহাল তবিয়তে মন্ত্রীসান্ত্রীদের মোচ্ছব? বিকৃত উল্লাস প্রদর্শনের জন্যই কি ধর্মতলায় চাকরিপ্রার্থীদের ধর্না মঞ্চ কাপড় দিয়ে ঢেকে কার্নিভাল হল? মাল নদী না হয়ে এই ঘটনা যদি দক্ষিণবঙ্গের কলকাতা লাগোয়া কোনো জনপদে হত, সরকার কি এতটা উল্লাসে মত্ত হতে পারত? নিশ্চিত বলা যায়, না। কলকাতায় বৃষ্টি মানে বাংলায় বৃষ্টি, কলকাতায় গরম মানে বাংলায় গরম – এই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। তার ব্যতিক্রম হবে কেন? মাল নদীর ঘটনা কলকাতার আশপাশে কোথাও হলে নিশ্চিতভাবে কলকাতাসহ রাজ্যের জেলায় জেলায় কার্নিভাল বন্ধ থাকত। যেহেতু মালবাজার কলকাতা থেকে বহুদূর, তাই কার্নিভাল চলছে চলবে। অবশ্য শুধু কলকাতা বা দক্ষিণবঙ্গ নয়, এই নির্লিপ্তি সামগ্রিক। তাই পাশের শহর শিলিগুড়ি, কোচবিহার, রায়গঞ্জ, বালুরঘাট, মালদা – কোথাও আলো নেভেনি। কেউ কারোর পাশে নেই।

কবি নাজিম হিকমত লিখেছিলেন “বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।” একবিংশ শতাব্দীর ফাইভ জি যুগে সেই শোক কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র কয়েক মিনিটে। সামাজিক মাধ্যমে কমেন্ট, লাইক, দুঃখের ইমোজি, শেয়ারের মধ্যেই শোক শেষ হয়ে যায়। শোক আজ আর রাগে পরিণত হয় না। সরকারের কথা বাদ থাক, সহনাগরিক সমাজ শোকার্ত মালবাজারের সমব্যাথী হয়ে সমস্বরে বলেছে “এই উল্লাস বন্ধ হোক। কার্নিভাল বয়কট করো”? সমস্বর না হোক, বামপন্থী প্রগতিশীল নাগরিক সমাজও তো সেই অর্থে রাগে ফেটে পড়ল না। সামাজিক মাধ্যমে সরকারকে প্রশ্নবানে বিদ্ধ করল না। কেন এই বিকৃত উল্লাস? কার অবহেলায় এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল? কে নেবে এর দায় – এসব প্রশ্নে গর্জে উঠতে দেখলাম না তেমন কাউকে। কেউ তো রাস্তা অবরোধ করে বলল না, বন্ধ করো কার্নিভাল? অথচ কয়েকদিন আগেই কলকাতার রুবি পার্কের হিন্দু মহাসভার পুজোয় গান্ধীজির অসুর অবয়বের প্রতিবাদে সামাজিক মাধ্যম উত্তাল হয়েছিল। মালবাজারের ঘটনায় তেমনটা হল না। বিক্ষিপ্তভাবে সামাজিক মাধ্যমে দুঃখ প্রকাশ পেলেও পরক্ষণেই নিউজফিড ভরে গেছে রিলে, উৎসবের ছবিতে।

আরো পড়ুন উত্তরবঙ্গ: যেসব প্রশ্নের উত্তর কেউ চায় না, কেউ দেয় না

বাম আবর্তে থাকা মানুষের এমন আত্মকেন্দ্রিক অবসর যাপন মানায় না। সামাজিক চাপে শুধু মাত্র জলপাইগুড়ি শহর বাদে কোথাও কার্নিভাল বন্ধ হয়নি। এমন নয় যে কার্নিভাল বন্ধ হলেই সমস্ত অনাচার বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু নিশ্চিতভাবে পীড়িত জনগণ এই বার্তা পেতেন যে গোটা বাংলা তোমাদের সমব্যথী। চা বাগানের কুলি, কামিনদের বস্তিতে জানান দেওয়া যেত যে তাদের আর্তি অবশিষ্ট বাংলাকে স্পর্শ করেছে। জেলায় জেলায়, কলকাতায় কার্নিভাল বন্ধ করার সোচ্চার দাবি বামপন্থীদের দিক থেকে ওঠা উচিত ছিল। শোক সঞ্চারিত করতে না পারা বামপন্থীদের ব্যর্থতা। বামপন্থীদের ব্যর্থতার কারণেই সরকার উন্মাদের মত কার্নিভাল আয়োজন করতে পারল। নাগরিক সমাজ বয়কট না করে দলে দলে কার্নিভালে সামিল হল।

গত শতাব্দীর শেষ লগ্নে, আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাতে জলপাইগুড়ি শহরকে গ্রাস করেছিল তিস্তা। অকাল প্লাবনে যাঁরা হারিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা আজও এই প্রজন্মের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছেন। তখন টিভি ছিল না, নব ঘোরানো রেডিও মারফত অবশিষ্ট বাংলা খবর পেয়েছিল জলপাইগুড়ি ভালো নেই। সেদিনের বামপন্থীরা শোক সঞ্চারিত করেছিলেন। সেই শোক আজও আমাদের মনে আছে পরম্পরায়। আর আজ মালবাজার, মাল নদী, হড়পা বান, নিহত মানুষ, তাদের স্বপ্ন হারিয়ে গেল হৃদয়হীন ব্যবস্থার উল্লাসে। নিউজ ফিডে সামান্য দুঃখবিলাসে মিলিয়ে গেল মাল নদীর আর্তনাদ।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.