দেবীপক্ষের ধুমধাম ও মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া দেবত্বের ভারের মধ্যেই ভারতবর্ষের সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চ একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। না, কোনো দেবীরূপে পুজোর চেষ্টা নয়, ভারতের নিতান্ত সাধারণ মেয়েদের একটি সাধারণ তথা শারীরিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে, এখন থেকে ২৪ সপ্তাহ অবধি অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা আইন মেনেই গর্ভপাত করাতে পারবেন এদেশে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, এক্ষেত্রে বাহ্যিক কোনো সম্পর্কের উপর গর্ভপাতের অধিকার নির্ভর করবে না। অর্থাৎ শুধু বিবাহিত মহিলারা নয়, আইনি বিবাহের বাইরে থাকা মহিলা বা ধর্ষিতারাও গর্ভধারণের ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত করাতে পারবেন আদালতের শরণাপন্ন না হয়েই। মহামান্য বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের মতে এর দ্বারা চিরাচরিত পিতৃতান্ত্রিকতার বাইরে বেরিয়ে একজন নারীর নিজের শরীরের উপর সার্বিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হল।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
মনে হতেই পারে, যে কোনো মানুষেরই তো নিজের শরীরের উপর অধিকার স্বতঃসিদ্ধ। তাহলে আর এই রায় ঐতিহাসিক কেন? আসলে এই একবিংশ শতাব্দীতেও নারীর গর্ভের উপর সমাজ বা সরকারের নিয়ন্ত্রণ বিরল নয়। তাই আদালতের রায়টিকে বৈপ্লবিক মনে হয়। এ সমস্যা শুধু তৃতীয় বিশ্বের রক্ষণশীল সমাজেরও নয়। কিছুদিন আগেই প্রথম বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৭৩ সালের রো বনাম ওয়েড মামলার রায়কে বাতিল করে নতুন একটি রায় দিয়েছে, যা নিয়ে প্রতিবাদ, আন্দোলন এখনো চলছে। কী বলা হয়েছে সেই রায়ে? সোজা কথায়, সেই রায় ১৯৭৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া নারীর গর্ভপাতের অধিকারকে (যা আদৌ সমস্ত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না) বিপন্ন করে তুলেছে। ডবস বনাম জ্যাকসন উইমেনস হেলথ নামে পরিচিত আজকের মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, গর্ভপাতের অধিকার এখন থেকে আর সাংবিধানিক অধিকার রইল না। অর্থাৎ, রো বনাম ওয়েড মামলার রায়ে যে বলা হয়েছিল গর্ভাবস্থার প্রথম ট্রাইমেস্টারে ভ্রূণের উপর সরকারের কোনো অধিকার নেই, তা বদলে গেল ২০২২ সালের রায়ে। ফলে মার্কিন দেশের অধিকাংশ রাজ্যে এখন গর্ভপাত আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়ল। আরো সোজা করে বললে, নারীর গর্ভস্থ ভ্রূণের উপর নারীর একক অধিকারের স্বীকৃতি আর রইল না।
স্বভাবতই ওই ঘোষণার পরে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। কিছু রাজ্যে গর্ভপাতকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য নতুন নিয়ম চালু করা হয়। কিন্তু বহু জায়গাতেই সুরক্ষিত গর্ভপাত প্রশ্নের মুখে পড়ে। মনে করা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনগুলোতেও এই নতুন রায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে। নারীবাদী তথা প্রগতিশীলরা যতই এই রায়ের বিরোধিতা করুন, রক্ষণশীল সমাজের একটা অংশ যে এই রায়ের পাশেই দাঁড়াবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ-ও প্রশ্নাতীত যে এর ফলে নারীর শরীরের উপর তাঁর বদলে সরকারের প্রভুত্বই কায়েম হবে। আন্দোলনকারীদের মতে, এই রায়ের পর গোপন অথচ সুরক্ষিত গর্ভপাতের সুযোগ হারাবেন বহু নারী, যাঁদের মধ্যে অবিবাহিত, বিবাহবিচ্ছিন্না, ধর্ষিতা, মানসিকভাবে অসমর্থ, শারীরিক সমস্যাযুক্ত মেয়েরাও রয়েছেন, যাঁদের একমাত্র পথ গর্ভপাত।
আরো পড়ুন গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা মেয়েদের অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় চমকপ্রদ বললেও কম বলা হয়। অবিবাহিতা, ধর্ষিতা বা অন্যান্যভাবে অক্ষম মেয়েদের গর্ভপাতের অধিকার একটি অত্যন্ত প্রগতিশীল রায়, বিশেষত ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে। সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ এমনকি এ-ও বলেছে, যে স্বামী দ্বারা ধর্ষিতা স্ত্রীরও গর্ভপাতের অধিকার আছে। এই বিষয়টির তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। ভারতীয় আইনে এখনো স্বামী দ্বারা স্ত্রীর ধর্ষণকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না। এই নিয়ে বহু লড়াই চলেছে এবং চলছে। সেদিক থেকে দেখলে এই রায়কে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করার দিকে একটি ছোট পদক্ষেপ বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
ভারতে গর্ভপাত আইনসম্মত হয়েছিল ১৯৭১ সালে। ২০২১ সালে মেডিকাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি অ্যাক্ট বা এমটিপিএ-র মাধ্যমে সেইসব নারী পান যাঁরা গর্ভাবস্থার ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত করাতে চান। সুপ্রিম কোর্টের এখনকার রায়ের দ্বারা এই সময়সীমা শুধু বাড়ানো হল তা নয়, বিবাহ, যা একটি সামাজিক তথা আইনি বন্ধন, তা গর্ভপাতের জন্য প্রয়োজনীয় নয় বলেও ঘোষণা করা হল। বিচারকদের মতে, প্রত্যেক নারীর নিজের শরীরের উপর প্রাথমিক অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। সেই অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। বিচারকরা মেনে নিয়েছেন যে গর্ভপাতজনিত সিদ্ধান্ত নানা জটিলতার মধ্যে দিয়ে গ্রহণ করা হয়। সেক্ষেত্রে নারীর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে কোনো সামাজিক রীতির উপর জোর দেওয়া অনুচিত।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লক্ষ গর্ভসঞ্চার হয়ে থাকে, যার অন্তত ৪৪% ভাগ অনভিপ্রেত। এই ৪৪ শতাংশের অন্তত ৭৭ শতাংশ ক্ষেত্রে গর্ভপাত হয়ে থাকে। প্রতি বছর ভারতে আট লাখের কাছাকাছি গর্ভপাত হয়, যার অন্তত ১০% ক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বার মৃত্যু ঘটে। অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হয় সুরক্ষিত ও গোপন গর্ভপাত ব্যবস্থার অভাব। সাধারণভাবে রক্ষণশীল ভারতীয় সমাজে গর্ভসঞ্চার তখনই কাম্য, যখন নারী বিবাহিতা। ফলে অবিবাহিতাদের গর্ভপাতের সুযোগ কম। এছাড়া স্ত্রীকে ধর্ষণ অপরাধ বলে ধরা হয় না বলেও অনভিপ্রেত গর্ভসঞ্চার ঘটে, যে গর্ভ ধারণ করতে নারীর অনিচ্ছাকে এতদিন মূল্য দেওয়া হয়নি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই রায়ের ফলে রাতারাতি সমাজ পরিবর্তন হবে কি? উত্তর অবশ্যই না। তাছাড়া মনে রাখতে হবে, সব ধরনের গর্ভপাত এখনো ভারতে আইনসিদ্ধ নয়। কিছু ক্ষেত্রে একে এখনো অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হবে। আবার একথাও ঠিক যে আদালতের রায়ের পাশাপাশি সুরক্ষিত গর্ভপাতের বন্দোবস্ত না থাকলে কোনো পরিবর্তনই সম্ভব নয়। অর্থাৎ পথ চলা সবে মাত্র শুরু হয়েছে, এখনো অনেকটা রাস্তা বাকি অনেকটা। এইটুকু ভাবা যেতে পারে, যে এই ঐতিহাসিক রায়ের আলোয় পথের বিপদ কিছুটা হলেও কমবে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।