ইরান জ্বলছে। সারা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়া বেয়ে সেই খবর আমাদের দেশেও এসে পৌঁছেছে, কিন্তু তার আঁচ তেমন অনুভব করিনি। অথচ ইরানের এই সদ্য উত্তাল হিজাববিরোধী আন্দোলনের আগেই আমাদের দেশে হিজাব বিতর্ক শিরোনামে এসেছিল। দুটি ঘটনার মূলেই যদিও হিজাব, ঘটনা দুটোর রূপ, সূচনা ও উদ্দেশ্যে আকাশপাতাল তফাত।

কাজেই ভারতীয় নারী হিসাবে ইরানের হিজাব বিতর্ক নিয়ে মতামত দিতে গেলে নিজের দেশের অবস্থার বিচার না করে পারি না। সে কথায় পরে আসছি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আমি ব্যক্তিগতভাবে ধর্মে বিশ্বাসী নই। পৃথিবীর এমন কোন ধর্ম আছে যা পুরুষতান্ত্রিকতার ঊর্দ্ধে? যুগে যুগে সমাজ কোনো না কোনোভাবে ধর্মের নামে মহিলাদের অধিকার খর্ব করার চেষ্টা চালিয়েছে। কিছু ধর্মের সংস্কার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের কাছে আজও ধর্মের জয়ধ্বজা ওড়ানোর সহজতম পথ হল মহিলাদের নানা বাঁধনে বেঁধে রাখা। মহিলা-পুরুষের সমানাধিকার এখনো আধুনিক সমাজে আধুনিক মানুষের ধর্মাচরণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠেনি।

কথায় বলে যেখানে নিপীড়ন সেখানেই প্রতিরোধ। এই চিরন্তন সত্যের প্রতিফলনই বোধহয় আমরা আজ ইরানে দেখছি। এককালের প্রগতিশীল ইরান ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পরে ক্রমশ রক্ষণশীল হয়ে উঠল। ধর্মের নামে বিশেষ করে মহিলাদের উপর নেমে এল আচার-বিচার, পোশাক পরিচ্ছদের বিধিনিষেধ। হিজাব পরা আইনত বাধ্যতামূলক হল ১৯৮৩ সালে, বাড়ল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ‘নীতি পুলিস’ (গাতে-ই-এরাদ)-এর রমরমা। মধ্যে অবশ্য সংস্কারপন্থী রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ খাতামি এই বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করেন। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরী মাহমুদ আহমাদিনেজাদের অতিরক্ষণশীল অবস্থান আবার ধর্মীয় গোঁড়ামির গোড়ায় জল ঢালে, বাড়ে নিয়ন্ত্রণ। দেশটির প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনিও হিজাব পরাকে সমর্থন করেন। কাজেই ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের কাছে হিজাব ও হিজাবের আড়ালে মহিলাদের স্বাধীনতা খর্ব করার প্রক্রিয়া সামাজিক ও ধর্মীয় স্বীকৃতি পায়।

এখানেই একটা গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক বিশ্বের মানুষের চোখের আড়ালেই থেকে যায়। ইসলামিক বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন ইরানের সাধারণ মানুষ কি সত্যিই খুশি হয়ে মেনে নিয়েছিলেন? উত্তর হল – না। ১৯৭৯ সালের পরে এত বছর কেটে গেলেও ইরানের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ নীতি পুলিসি এবং তার ভিতর দিয়ে মৌলিক অধিকার খর্ব করার প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানাননি।

ইরান একটি আদ্যন্ত আধুনিক দেশ। সে দেশের মহিলারা কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের টেক্কা দিয়ে চলেছেন সব ক্ষেত্রেই। অথচ ধর্মের নামে মহিলাদের অধিকার সংকুচিত করার সামাজিক চাপ, দেশ গঠনে তাদের অবদানকে যথেষ্ট স্বীকৃতি না দেওয়ার ক্ষুদ্রতা ইরানের নারী মানতে পারেননি। কাজেই ইরানের হিজাববিরোধী বিক্ষোভ এসেছে সে দেশের মেয়েদের অন্তর থেকে, পুষ্ট হয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে, শক্তি আহরণ করেছে তাদের মানবাধিকার চেতনা ও শিক্ষা থেকে। এরপর রাষ্ট্রের কিছু দমনমূলক পদক্ষেপ বহুদিন জমে থাকা ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে। হিজাব না পরায় কুর্দি তরুণী মাসা আমিনীকে গ্রেফতার করা এবং ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশের হেফাজতে তার মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর, বিক্ষোভে সামিল হওয়ার জন্য ইরান জুড়ে ১২০০-র বেশি আন্দোলনকারী গ্রেফতার হয়েছেন, ৭৬ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।

এই স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ইরানের সাধারণ মানুষের মানবাধিকার অর্জনের আকুতির স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। কাজেই এর উদ্দেশ্য গঠনমূলক, যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পক্ষপাতী। উল্লেখ্য, এত ঘটনার পরেও ইরান সরকার তার হিজাব বাধ্যতামূলক রাখার অবস্থানে অনড়। সাত বছরের বেশি বয়সের সব মহিলাকে হিজাব পরতে হবে এবং এমন ঢিলেঢালা জামা পরতে হবে যাতে শরীরের কোনো অংশ বা দেহসৌষ্ঠব প্রকাশ না পায়। বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসি বিক্ষোভ দমনে আরও কঠোর হওয়ার কথাই বলেছেন। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, মানুষ সঙ্গত অধিকারের লড়াইয়ে নামলে তাদের দমন করা যায় না।

এবার আসা যাক ভারতের হিজাব বিতর্কে। প্রথম কথাই হল আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান সকলকে তাদের ধর্মাচরণ করার স্বাধীনতা দিয়েছে। এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রয়েছে বিশেষ অধিকার, যাতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের চাপে তাদের মৌলিক অধিকার, ধর্ম পালন, নিজস্ব সংস্কৃতির লালনপালন বা খাদ্যাভ্যাস হারিয়ে না যায়। দেশটার নাম ভারত, যা শুধু একটা দেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে বৈচিত্র‍্যের মধ্যে ঐক্যস্থাপন দেশ গঠনের প্রাথমিক শর্ত।

সরকারি তথ্য থেকেই প্রমাণ হয়, এ দেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ এখনো অনেকাংশেই পিছিয়ে আছেন। শিক্ষায়, সমাজে আর্থিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা পিছনের সারিতে। তার উপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তথা রক্ষণশীল ধর্মীয় পরিবেশে মহিলারা আরও পিছিয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারগুলোতেও পরিবর্তন আসছে, মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার গুরুত্ব তারাও অনুধাবন করছে। তাই এখন অন্তত স্কুলে মুসলিম ছাত্রীদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এদের অনেকেই আসে হিজাব পরে। এ নিয়ে কোন বিতর্ক ছিল না। যে মুসলিম পরিবার হিজাব পরায় বিশ্বাসী নয়, সেই পরিবারের মহিলারা হিজাব না পরতেই অভ্যস্ত। হিজাবের বিরোধ এ দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের মহিলাদের স্বতঃস্ফূর্ত বিরোধ নয়। আজ হিজাব যদি মুসলিম ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার ছাড়পত্র হয়, তাহলে একদিন হয়ত এরাই রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে, আনবে সংস্কার। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা গেল উলট পুরান। হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামল সংখ্যাগুরু হিন্দু সমাজের একাংশ, ধর্মীয় রক্ষণশীলতায় যারা নিজেরা মোটেই পিছিয়ে নেই। হিজাব এ দেশে সামাজিক সংস্কারের বিষয় না হয়ে রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠল, যা বর্তমানের ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিকে আরও তীব্র করে তুলতে মদত জোগায়।

ধর্ম খুবই স্পর্শকাতর ব্যাপার। হিন্দুধর্ম বা অন্যান্য ধর্মে বহু সংস্কার হয়েছে, ইসলামেও হয়েছে। কিন্তু তার কাণ্ডারীরা ছিলেন সেই ধর্মেরই মনীষীরা। অন্য ধর্মের লোকেদের প্রতিবাদে বা আইন আদালতের রায়ে কোনো মৌলিক ধর্মীয় সংস্কার হয়েছে এবং তার সার্থক প্রয়োগ হয়েছে এমন উদাহরণ বিরল। আইন একটি পর্যায়ে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়, কিন্তু তা সামাজিক বৃহত্তর গঠনমূলক আন্দোলনকে বৈধতা দিতে। ইরানের হিজাববিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে তাই ভারতের সংখ্যাগুরুর হিজাববিরোধিতা তুলনীয় নয়।

এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার উল্লেখ না করলে চলে না। কর্ণাটকের হিজাববিরোধ যেভাবে সংবাদের শিরোনামে এসেছে বা চর্চিত হয়েছে; ইরানের মহিলাদের আন্দোলন কি সেইভাবে প্রাইম টাইমে সময় পেয়েছে? তাহলে এ দেশে হিজাব কি মানবাধিকারের প্রশ্ন, নাকি নিছকই বিভেদের রাজনীতির?

আরো পড়ুন হিজাব না হলেও হিজাবির পক্ষ নিতেই হবে আমাদের

পরিশেষে বলা আবশ্যক, তিন তালাক হোক বা হিজাব, কিংবা মহিলাদের মনুসংহিতার পাকে বেঁধে রাখার প্রয়াস, যেখানেই মানুষের, মহিলাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, আমাদের তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। কিন্তু সেই আওয়াজ তোলার মধ্যে থাকা দরকার সততা, স্বচ্ছতা এবং সদুদ্দেশ্য। দরকার মানবাধিকার সম্পর্কে সম্যক ধারণা, সংবিধানের উপর ভরসা, আর নিজের দেশের বাস্তব প্রেক্ষিত সম্পর্কে ধারণা। তা না হলে নারী-পুরুষ সমানাধিকারের স্লোগান তুলতে গিয়ে নারীদের সমানাধিকারের লড়াইটাকে আরও কঠিনই করে তোলা হবে।

ইরানের হিজাববিরোধী আন্দোলনের উপর যেমন সারা বিশ্বের নজর থাকবে, তেমনি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গণতন্ত্র ভারতে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার কতটা সুরক্ষিত, সেদিকেও থাকবে দৃষ্টি। বিপ্লব আমদানি করা যায় না, বিপ্লব চাপিয়ে দেওয়া যায় না। শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত, সচেতন মুসলিম মহিলারা অদূর ভবিষ্যতে নিজেরাই অতিরক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবেন। তার জন্য আজ তাদের শিক্ষার অবাধ সুযোগ থাকা একান্ত প্রয়োজন। দরকার সেই আন্দোলনের দিনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়াই ধর্মমত নির্বিশেষে তাদের পাশে থাকা। পরিবর্তনই তো একমাত্র সত্য, কিন্তু তার পথকে সুগম করাটাই আমাদের সমষ্টিগত দায়িত্ব, রাজনীতির জালে জড়িয়ে তাকে জটিল করা নয়।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগোলাম ফরিদ
পরবর্তী নিবন্ধআজম শেখের ঘোড়া
নিবন্ধকার সমাজকর্মী। ফুড ফার্স্ট ইনফরমেশন অ্যান্ড একশান নেটওয়ার্ক (ফিয়ান), পশ্চিমবঙ্গের জেনারেল সেক্রেটারি। পলিটিকাল ইকোলজিতে ডক্টরেট। একাধিক জাতীয়, আন্তর্জাতিক সংগঠন ও  জাতিসংঘের কিছু কমিটির সদস্য

2 মন্তব্য

  1. আপনার যুক্তি অনুযায়ী সতীদাহ প্রথা রদ করা অনৈতিক ছিল কারন বিদেশী শাসক সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর ওপর তা “জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিল” , বিধবা বিবাহ আইন পাস করাও “জোর করে চাপিয়ে দেওয়া” । রিগ্রেসিভ প্রথা ব্যান করা কি “বিপ্লব চাপিয়ে দেওয়া” ? অবশ্য হিজাব পড়া নেতিবাচক অর্থেও চয়েস , এবং মানুষের চয়েসের অধিকারকে রক্ষা করা যেকোন গনতান্ত্রিক দেশের অবশ্যই দায়িত্ব। কিন্তুু হিজাব পরা আর শাখা সিঁদুর পরাকে এক করে দেখানো বা সংখ্যালঘু ধর্মীয় অধিকার সম্পূৰ্ণ রক্ষা করা গনতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.