২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাসের ছাত্র ছিলাম। একদিন রাখালদার ক্যান্টিনে কয়েকজন সহপাঠিনীর সাথে শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আমার বক্তব্য ছিল, ওগুলো পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের চিহ্ন, অতএব বর্জনীয়। তাদের বক্তব্য ছিল, শাঁখা-সিঁদুর পরলে সুন্দর দেখায়, তাই ওগুলো ভাল। এর অর্ধ দশক পরে আমরা সকলেই বিয়ে করেছি। সেদিনের বন্ধুদের সাথে ২০০৫ সালের পর আর সাক্ষাৎ হয়নি, কিন্তু তারা কেউ বৈপ্লবিক হয়ে উঠে শাঁখা-সিঁদুর ত্যাগ করেছে এমন সংবাদ পাইনি। আমি নিজে মন্ত্র পড়ে বিয়ে করব না, এই দাবিতে কিঞ্চিৎ ধুলো ওড়ানোর পর মন্ত্র পড়েই বিয়ে করেছি। বেঁকে বসেছিলাম বলে আমৃত্যু প্রগতি চর্চা করা, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি করা আত্মীয়রা, কোন মন্ত্রের কী মাহাত্ম্য, কেন মন্ত্র না পড়লে বিয়ে সম্পূর্ণতা পায় না — এসব বুঝিয়েছিলেন। বিয়ের পরে বউয়ের শাঁখা-সিঁদুর পরাও বন্ধ করতে পারিনি। আমার মত অসংখ্য পুরুষ এরপরেও নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ (কেউ কেউ নাস্তিক) বলে। তাতে খুব একটা দোষ দেখি না, কারণ ‘ফিমেল এজেন্সি’। ভারতীয় উপমহাদেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের উচ্চবর্গীয় পুরুষ আমরা। ‘ফিমেল এজেন্সি’ কথাটা ২০০৩ সালে আমার জানাই ছিল না, পরবর্তীকালেও আমার মাতৃভাষায় এই অর্থবোধক কোনো শব্দবন্ধের সন্ধান পাইনি। তাই আমাদের ধারণায় শাঁখা-সিঁদুর কেউ পরে না, সর্বদাই পরানো হয়। হিজাব বা বোরখাও পরানো হয়। কিন্তু বর্তমান বিতর্কে যা জরুরি, তা হল বাঙালি হিন্দু উচ্চবর্গীয় মহিলা ও পুরুষরা অনেকে শাঁখা-সিঁদুর পরায় ফিমেল এজেন্সি থাকে মানলেও হিজাব বা বোরখা পরায় ফিমেল এজেন্সি থাকতে পারে তা মানেন না। ফলে যে মুসলমান পুরুষের বাড়ির মেয়ে, বউরা হিজাবি, তারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বা নাস্তিক বললে আমরা হাসাহাসি করি। অতএব কর্ণাটকে যা হচ্ছে, তাকে কেবল লিঙ্গ রাজনীতি দিয়ে বিচার করে স্রেফ রাষ্ট্র মেয়েদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে বলে চেঁচামেচি করা মস্ত ফাঁকি। আসলে রাষ্ট্র মুসলমানদের কোণঠাসা করছে, মুসলমান মেয়েদের লেখাপড়া করার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে।

কর্ণাটক সরকার ইতিমধ্যেই রাজ্যের স্কুল, কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে কয়েক দিনের জন্য, এবং গতকাল কর্ণাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ঋতুরাজ আওয়াস্তির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ হিজাবি ছাত্রীদের পিটিশনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হিজাব বা বোরখা এবং গেরুয়া বস্ত্র — কোনোটাই পরা যাবে না, এমন বলেছেন। ছাত্রীদের আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে এবং দেবদত্ত কামাথ প্রতিবাদ করেন। তাঁদের বক্তব্য, এমন রায় সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত নাগরিকদের স্বাধীন ধর্মাচরণের অধিকার লঙ্ঘন করে। কিন্তু বিচারকরা রাজ্যে শান্তি ফেরাতে চান, এই যুক্তিতে দু পক্ষকেই ধর্মীয় পোশাক পরতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ প্রথমত, সাংবিধানিক অধিকার স্থগিত রাখা চলে — এমন দৃষ্টান্ত তৈরি হল। দ্বিতীয়ত, একটা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার একটা ধরনকে তাদের উত্যক্ত করার উদ্দেশ্যে তৈরি বিশেষ আচরণের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে দেওয়া হল। এমনটা করা হল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু মেয়ের স্কুল, কলেজে পড়ার অধিকারকে বিপন্ন করে। নিঃসংশয়ে বলা যায়, হিন্দু মেয়েদের পড়ার অধিকার একটা গোটা রাজ্যে একদিনের জন্যও বিপন্ন হলে “হিন্দু খতরে মে হ্যায়” চিৎকারে কান পাতা দায় হত। তখন বিচারব্যবস্থায় বিশ্বাস রাখা ইত্যাদি ভাল ভাল কথা কারোর খেয়াল থাকত না। টিভি চ্যানেল, সোশাল মিডিয়া, রাস্তাঘাট — সর্বত্র চর্চা হত দেশটা জেহাদিদের হাতে চলে গেছে। কেউ স্বেচ্ছায় হিজাব/বোরখা পরুক আর অনিচ্ছায় পরুক, লেখাপড়া করতে হলে ওটা ত্যাগ করে স্কুল কলেজে আসতে হবে — এই বক্তব্যের আসল উদ্দেশ্য তার লেখাপড়া নিশ্চিত করা নয়, তার লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

জনপ্রিয় স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান কুণাল কামরা তাঁর এক শোতে বিজেপি সরকারের তিন তালাক নিষিদ্ধ করা নিয়ে বলেছিলেন, আইনটা পাস হওয়ার পর বিজেপির লোকেদের ঢাকঢোল নিয়ে উল্লাস করতে দেখে ভাবলাম, এরা তো মুসলিম মহিলা নয়! এদের এত উল্লাসের কারণ কী? তারপর বুঝলাম, এরা মুসলিম মহিলাদের ক্ষমতায়নে উল্লসিত নয়। এরা আসলে মুসলিম পুরুষদের বিশেষ সুবিধা চলে যাওয়া উদযাপন করছে। হিজাব বিতর্কেও এ কথা মনে রাখা জরুরি। মুসলমান মেয়েদের হিজাব পরে পড়াশোনা করতে না দেওয়া মানে হিন্দুত্বের এক ঢিলে অনেক পাখি মারা।

শাঁখা-সিঁদুর, ঘোমটা চালু করেছিল পুরুষরা, হিজাবও তাই। অতএব মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদেরও বুঝিয়ে দেওয়া হল, “তোদের মেয়েদেরও আমাদের মর্জি মত চলতে হবে। দ্যাখ কেমন লাগে।” কর্ণাটক হাইকোর্টের মামলার রায় কী হবে জানা নেই, কবে হবে তা-ও অনিশ্চিত। ভারতীয় আদালত “তারিখ পে তারিখ”-এর জন্য প্রসিদ্ধ। তার উপর রায়ে যে পক্ষ অসন্তুষ্ট হবে, তারা হয়ত উচ্চতর আদালতে যাবে। মামলা যত দীর্ঘ হবে, মেয়েগুলোর স্কুল কলেজে যাওয়া তত বেশিদিন বন্ধ থাকবে। ইতিমধ্যে অন্যান্য রাজ্যেও একই হুজ্জত শুরু হবে। উপরন্তু, এরপর দাবি উঠবে হিজাব/বোরখা পরে চাকুরিস্থলেও যাওয়া চলবে না। সব মহিলাই মুসকানের মত অসমসাহসী এমন ভাবার কারণ নেই। তাছাড়া আমরা ভিডিওতে দেখেছি, কিছু ছাত্রছাত্রী হিজাবি মেয়েদের নিজেদের নিরাপত্তায় ঘিরে রেখে কলেজ থেকে বার করে নিয়ে যাচ্ছে। অফিস কাছারিতে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। স্কুল কলেজের পড়ুয়াদের চেয়ে বড়রা বরাবরই বেশি সাম্প্রদায়িক। তার উপর আছেন কতিপয় প্রগতিবাদী। তাঁরা দাড়ি চুলকে বোঝাতে বসবেন, কেন হিজাব প্রতিক্রিয়াশীল, অতএব ওটা ত্যাগ করেই চাকরি করতে বেরোনো উচিত। ঠিক যেমন সবরিমালা মন্দিরে মহিলাদের ঢুকতে দেওয়ার সুপ্রিম কোর্টের আদেশ যখন কেরালা সরকার বলপূর্বক বলবৎ করছিল, তখন অনেক প্রগতিবাদী জোর তর্ক করছিলেন, মন্দিরে ঢোকা ব্যাপারটাই প্রতিক্রিয়াশীল। একটা কমিউনিস্ট সরকার কেন এতে মদত দেবে? অর্থাৎ মহিলারা মন্দিরে ঢুকতে চাইলেও সে ইচ্ছার মূল্য নেই। পুরুষরা প্রগতিশীলতার যে সংজ্ঞা ঠিক করবেন মহিলারা তার বাইরে কিছু ভাবলে তা প্রগতিশীলতা নয়।

বর্তমান বিতর্ক যে হিজাবে থামবে না, মহিলাদের দমন করাতেও নয়, সেটা কিন্তু বুঝে নেওয়া দরকার। সন্দেহ নেই ক্রমশ হিন্দু মহিলারা কী পরে বাইরে বেরোবেন তা নিয়েও গুন্ডামি প্রেরিত বিতর্ক তৈরি করা হবে, কারণ মৌলবাদ এবং সংখ্যাগুরুবাদ তার নিজের সম্প্রদায়ের মহিলাদেরও বন্ধু হয় না। কিন্তু উপস্থিত এ দেশের সংখ্যাগুরুবাদের পাখির চোখ মুসলমানের অধিকার হরণ। অতএব কিছুদিন পর মুসলমান পুরুষের ফেজ পরা নিয়েও আপত্তি করা হবে। বাড়িতে ফেজ পরো, অন্যত্র নয় — এমন বলা হতে পারে। তারপর বলা হবে অত ইঞ্চির বেশি দাড়ি রাখা যাবে না। যে প্রগতিশীলরা আজ ফিমেল এজেন্সিকে পাত্তা দেন না, সব ‘চয়েস’ মেনে নেওয়া যায় না বলেন — তাঁরা সেদিনও নির্ঘাত বলবেন ফেজ পরা আসলে পশ্চাদপরতা, সুতরাং বর্জনীয়। লম্বা দাড়ি রাখার অপকারিতা নিয়েও পশ্চিমবঙ্গের টিভি চ্যানেলে অনায়াসে বিতর্ক চলতে পারে, উত্তর সম্পাদকীয় কলমে লেখালিখি হতে পারে, ছন্দ মিলিয়ে মিষ্টি কবিতাও লেখা হবে নিশ্চয়ই। সে কবিতা ফেসবুকে ভাইরালও হবে। রাজ্য সরকার হয়ত বলবে “আমরা সব ধর্মকে সমান গুরুত্ব দিই। তাই দাড়ি কাটায় বিশেষ ভর্তুকি দেওয়া হবে।” কারণ বাংলা প্রগতিশীল মানুষের রাজ্য।

সন্ধে হলেই বাংলা মেগাসিরিয়ালে দেখা যায় সম্ভ্রান্ত হিন্দু উচ্চবর্ণ একটা লোকের দুটো বউ — একজন স্বীকৃত, আরেকজন এমনি এমনি। দুজনের মধ্যে তীব্র রেষারেষি চলছে, চিত্রনাট্য এমনি এমনি বউয়ের প্রতি সহানুভূতিশীল। স্বীকৃত বউ মানেই দজ্জাল, কুটিল। আবার যে সিরিয়ালের চিত্রনাট্য স্বীকৃত বউয়ের প্রতি সহানুভূতিশীল, সেখানে যত দোষ অন্য মহিলাটির। দুটি ক্ষেত্রেই বাবুটি ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেন না, নেহাত ছলাকলায় পা হড়কে গেছে। এ সম্পর্কে পরিবারের অন্যরা, এমনকি রেজিস্টার্ড স্ত্রীও দেখা যায় নিঃসন্দেহ। শ্বশুরমশাই অকালকুষ্মাণ্ডটিকে ত্যাজ্যপুত্র করতে চাইলেও স্ত্রী বাধা দেন। তাতেই প্রমাণ হয় তিনি কত মহান। ভদ্রজন হাঁ করে এসব গেলেন, তারপর বোরখা পরা বা লম্বা দাড়ির মুসলমান দেখলে বলেন “ওরা ভীষণ গোঁড়া, ব্যাকডেটেড।”

কর্ণাটকের হিজাব কাণ্ডে বোধহয় একটাই লাভ হয়েছে। আক্রমণটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে যাওয়ায় আমাদের কারো কারো শিরদাঁড়া দিয়ে শেষপর্যন্ত ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেছে। আমাদের খেয়াল হয়েছে “এভাবেই শুরু হয়”। ব্যাপারটা ভাল। কারণ কবি বলেছেন, আসলে রাত্রির অবসানে প্রভাত হয় না। যখন চিত্ত জাগে, তখনই প্রভাত হয়। কিন্তু সত্যি কথাটা হল, শুরু অনেক আগেই হয়েছে। আমরা ঘুমোচ্ছিলাম।

সারা ভারতে গরুর মাংস খাওয়া বা নিয়ে যাওয়া বা বিক্রি করার অপরাধে কতজন মুসলমানকে পিটিয়ে মারা হয়েছে — এখন আর তার সঠিক হিসাব পাওয়া মুশকিল হবে। সোশাল মিডিয়ায় “মুসলমান বিক্রেতার থেকে জিনিস কিনবেন না, ওদের অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করুন” বলে ডাক দেওয়া হয়েছে। সে ডাক একেবারে বৃথা যায়নি। লকডাউনের সময়ে মুসলমানরাই করোনা ছড়াচ্ছে, এরকম প্রচারের জেরে পশ্চিমবঙ্গেও কোনো কোনো এলাকায় মুসলমান ফলওয়ালা, সব্জিওয়ালাকে খেদিয়ে দেওয়ার ঘটনা শোনা গেছে। মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হয়েছে। প্রথমে দেশব্যাপী আন্দোলন, তারপর অতিমারীর ধাক্কায় সরকার সে আইন প্রয়োগ করে উঠতে পারেনি। বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত, নিজস্ব স্বর আছে এবং হিজাব বা বোরখা পরেন না — এমন মুসলমান মহিলাদের ছবি নিয়ে তাঁদের কাল্পনিক অনলাইন নিলামও হয়েছে।

কিন্তু আমাদের অনেকেরই এতদিন বক্তব্য ছিল, ওসব মুসলমানদের সমস্যা, ওরা বুঝুক গে। এবার বোধহয় একটা মেয়েকে এক পাল ছেলের তাড়া করা দেখে খেয়াল হয়েছে, কলেজে ওই মেয়েটার মত বোরখা বা হিজাব পরা মেয়ের সংখ্যা কম, আমাদের ছেলেমেয়েরাই বেশি। কলেজ গুন্ডামির জায়গা হয়ে উঠলে, এসবের জেরে বন্ধ হয়ে থাকলে আমাদের ছেলেমেয়েদেরও বিপদ। অবশ্য খেয়াল যে হয়েছে, এ হয়ত আমার কল্পনাবিলাস। শুরু যেভাবেই হোক, শেষ যে এভাবে হয় না ইতিহাসে তার প্রমাণ আছে। এখনো যদি না সকলে না বুঝি, যে হিজাবের না হলেও হিজাবির পক্ষ নিতেই হবে, তাহলে আমাদের শেষটাও একইভাবে হবে।

তথ্যসূত্র:

১। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.