Owning Land, Being Women: Inheritance and Subjecthood in India বইটি নৃতত্ত্ব বিষয়ক একটি গবেষণা-সন্দর্ভ, লিখেছেন অমৃতা মন্ডল। যথেষ্ট গুরুগম্ভীর বই, তাত্ত্বিক আলোচনায় ভরপুর। অন্তত গোড়ার দিকটা তো বটেই। নির্দিষ্ট বিষয়ে মনোযোগী পাঠক ছাড়া সাধারণ পাঠক এই ধরণের বই কমই পড়বেন হয়ত। তবু পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের মধ্যে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে ক্ষেত্র-সমীক্ষামূলক কাজ এতই অপ্রতুল যে বইটা আলাদা করে নজরে পড়েছিল। তার উপর সেই গবেষণার প্রতিপাদ্য যদি হয় কীভাবে সামাজিক-পারিবারিক-প্রজন্মগত সম্পর্ক মেয়েদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বিষয়ে নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়, তাহলে একটু নেড়েচেড়ে দেখতে ইচ্ছে হয় বৈকি। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের উত্তরাধিকার আইন চলে দায়ভাগ মতে, উত্তর ভারতের মতন মিতাক্ষরা মতে নয়। অথচ এ দেশের মেয়েদের উত্তরাধিকারের আইনি দিক নিয়ে অধিকাংশ বক্তব্য মিতাক্ষরা ধারা নিয়েই লেখা। এদিকে মেয়েদের দৃষ্টিকোণ থেকে দায়ভাগ ধারার বিভিন্ন দিক, অন্যান্য আইনের প্রেক্ষিতে তার বিশ্লেষণ বা তার সামাজিক প্রভাব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞ বৃত্তের বাইরে গণপরিসরে খুব বেশি লেখা চোখে পড়ে না। তাও বইটির দিকে আকৃষ্ট হওয়ার এক বড় কারণ।

অমৃতা ২০১৫-১৬ সালে তিন দফায় দুর্গাপুরের কাছে দেবশালা গ্রামে গবেষণার কাজে কাটিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বইটি লেখা। মেয়েদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়টি অবশ্যই বহুমাত্রিক। আলোচনার জন্য যে দিকটি অমৃতা বেছে নিয়েছেন, সেটি কৌতূহলোদ্দীপক, অনেক ভাবনার উপাদানে ঠাসা। বইয়ের মূল উপপাদ্য এই, যে মেয়েদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারকে শুধুমাত্র মেয়েদের অধিকারের চশমা পরে দেখলে পুরোপুরি বোঝা যাবে না। সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে প্রোথিত নারী-পুরুষের সম্পর্কের সঙ্গে মেয়েদের উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গীকভাবে জড়িত। অমৃতা দেখিয়েছেন, নারী-পুরুষের সম্পর্ক পরিবার তথা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অমৃতা প্রথমেই হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরেছেন। আর সেই সঙ্গে বলেছেন, সামাজিক রাজনৈতিক আইনি প্রেক্ষিত কীভাবে সামাজিক নৈতিকতার সংজ্ঞাকে ভিন্নতর দিকে ঠেলে দেয়, অধিকারের নতুন ভাষা তৈরি করে। যদিও দায়ভাগ আইনের কথা যতটা বিস্তারে থাকলে ভাল লাগত সে আশা মেটেনি, তবু দায়ভাগ মতে মেয়েদের উত্তরাধিকারের যে ফাঁকফোকর দেখিয়েছেন, সেই বিশ্লেষণ সুন্দর। ততোধিক কৌতূহলোদ্দীপক ২০০৭ সালের ওয়েলফেয়ার আইনের ধারার প্রেক্ষিতে নব্য নৈতিকতার নির্মাণ প্রসঙ্গ।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এ তো গেল তত্ত্বকথা। তৃতীয় অধ্যায় ‘The Embeddedness of Land Ownership’ থেকে আমরা শুনতে পাই অমৃতার প্রত্যক্ষ গবেষণা-অভিজ্ঞতা। লেখক দেখেন, দেবশালা গ্রামে যে কজন মেয়ের নিজস্ব সম্পত্তি আছে তাঁরা সবাই হয় বিধবা না হলে স্বামী-বিচ্ছিন্না। অবশ্য তেমন মেয়েও হাতে গোনা। এই গ্রামের ১৯৭৬ জন মেয়ের মধ্যে মাত্র চারজন মেয়ের একার নামে চাষজমির মালিকানা আছে। আর ৭৮ জন মেয়ের স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে চাষজমির মালিকানা আছে, যদিও সেক্ষেত্রে মেয়েদের নাম মালিকানার প্রথম নাম নয়। গ্রামের বাইশটি নারী-প্রধান পরিবারের মধ্যে মাত্র কয়েকজন মেয়ের নিজের নামে সামান্য বাস্তুজমি আছে। এখানে বিবাহিত, শ্বশুরবাড়িতে থাকা মেয়েরা চাষজমির ভাগ পেলেও সে জমি ভাইদের নামে দানপত্র করে দেওয়ারই চল। বদলে মেয়েদের কাছে ভাইরা বাৎসরিক ‘উপহার’ পাঠাবে। তবেই না ভাল দেখায়! চাষজমির উত্তরাধিকার নিয়ে ভাইদের সঙ্গে মনোমালিন্য হলেও মেয়েরা চট করে আইনের গোলোকধাঁধায় ঢুকতে চায় না। বিশেষত যখন দূরে, শ্বশুরবাড়িতে থাকা মেয়েদের নিজেদের পক্ষে উত্তরাধিকারে পাওয়া জমি চাষ করা খুবই সমস্যা। বাস্তুজমির ভাগ হলে অবশ্য অন্য কথা। সেটা বিবাহিত মেয়েদের বিপদে-আপদে জোরের জায়গা। বিপদের সময়ে মাথার উপরে ছাদটা তো জরুরি।

এখানেই অমৃতা এও জানাতে ভোলেননি যে উত্তরাধিকারের বিষয়টিও কেমন নারী-পুরুষের লিঙ্গনির্ভর জীবনযাপনের ভিন্নতার উপর নির্ভর করে। প্রত্যেকের নিজ নিজ ভাল থাকার সংজ্ঞার সঙ্গে সেই প্রশ্ন অনুপুঙ্খভাবে জড়িত। “Well-being depends not only on a woman’s sense of herself as an individual, but also on her relationship with others in her extended family and community.” অমৃতা শ্রীমতি বসুর কথা উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, এই কারণেই মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তি লাভের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অধিকারের দাবি নয়, স্নেহ-ভালবাসার অধিকার।

মেয়েদের ভূসম্পত্তির অধিকার বিষয়টিকে অমৃতা কয়েকটি কেস স্টাডি মারফত জানিয়েছেন। প্রতিমার বৈধব্যের ছবি বোধহয় শুধু গ্রামীণ বললে ভুল করা হবে। শহুরে এলাকায় এখনো তেমনভাবে কান পাতলে বিধবা ননদের বাপের বাড়িতে থাকা নিয়ে ননদ-বৌদির দ্বন্দ্বের আভাস পাওয়া যায়। অধিকার নয়, প্রয়োজনটাই বড়। প্রয়োজন না থাকলে আবার বিবাহিত মেয়ের পৈতৃক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার কিসের? ভাইদের কাছে হাত পাতবে কেন তারা? তারা খুব বেশি হলে স্বামীর জমির ভাগ পাবে, সে সম্পত্তিও সন্তানরা বড় হলে তাদের নামে লিখে দেবে, প্রাপ্তবয়স্ক পুত্রসন্তান মাকে দেখবে। অমৃতার বিবরণে গৌরী-দান হওয়া কুলীনের ঘরের বিধবা শিবু দিদিমার কথা, স্বামী-বিচ্ছিন্ন মানুদিদির বা অর্চনার কথা পড়তে ভাল লাগে। বিশেষ করে শিবু দিদিমার কথা জানতে পারা এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। অমৃতা যা দেখেছেন, যেমনটি দেখেছেন তেমনটিই বলেছেন। মেয়েদের সমানাধিকারের আইনি দাবি আর সাংস্কৃতিক-সামাজিক বাস্তবতা যে আলাদা, সেকথাও বারবার মনে করিয়েছেন।

শেষ অধ্যায়ে অমৃতা আলোচনা করেছেন গ্রামীণ সমাজের কর্তব্য আর দায়িত্বভিত্তিক নৈতিকতার কথা। গ্রামীণ চিন্তায় এখনো পুত্রসন্তানের পিতামাতার প্রতি ঋণকে অপরিশোধ্য হিসাবে দেখা হয়। আমাদের প্রচলিত বিবাহ প্রথায় কন্যাসম্প্রদান আর কনকাঞ্জলির মত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মেয়েদের কীভাবে ‘পর’ করে দেওয়া হয়, সেকথা অমৃতা বিশদে আলোচনা করেছেন। বিবাহিত মেয়েদের “বাপের বাড়ির কাছে হাত পাততে কেমন লাগা”-র অনুভূতিকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। অমৃতার সমীক্ষাস্থল দেবশালা গ্রামের অধিকাংশ মেয়েই স্বাধীন-উপার্জনহীন গৃহবধূ। তাদের কাছে সাংসারিক কাজই ধর্ম। অমৃতা বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন যে সেখানকার বিবাহিত মেয়েরা কন্যা হিসাবে বা বধূ হিসাবে সাংসারিক সেবাকর্মের প্রতিদানে নিজেদের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করে। সাংসারিক কর্তব্য পালনের, বয়স্কদের দেখাশোনা, যত্নআত্তি করার পুরস্কার। নারীর সমান অধিকারের শুষ্ক দাবি তাদের অচেনা।

আরো পড়ুন অপর ভুবনের গবেষণা, গবেষণার অপর ভুবন

অমৃতার লেখা অবশ্যই আমাদের এক টুকরো সাম্প্রতিক বাস্তবের মুখোমুখি করে। উত্তরাধিকারের প্রেক্ষিতে গ্রামবাংলার এক ভিন্নতর কৃষিভিত্তিক পিতৃতান্ত্রিক হিন্দু জীবন-অভিজ্ঞতাকে তিনি আমাদের সামনে পেশ করেছেন। লিঙ্গভেদে উত্তরাধিকারের ধারণার বিভিন্নতার বাস্তবতাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে, কারণ বিশ্লেষণ করে এক ধরণের ভালমন্দ বিচারের মুখে ফেলা নৃতত্ত্বের গবেষক হিসাবে বোধহয় তাঁর কাজ ছিল না। তাই সেকথা থাক। তবে দায়ভাগের নিয়মকানুন কীভাবে মেয়েদের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সাহায্য বা বিরোধিতা করেছে সে বিষয়ে কোনো আলোচনা তেমনভাবে না থাকায় পরিবারের উপর রাষ্ট্রের প্রভাব ততটা পরিস্ফুট হল কি? বিশেষত দায়ভাগ তো বাংলায় আজকের প্রথা নয়, সেই কোন কাল থেকে চলে আসছে। সেখানে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মেয়েদের উত্তরাধিকারের কথা স্বীকৃত হলেও কেন পশ্চিমবঙ্গেও মেয়েদের জমি-বাড়ির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এত করুণ অবস্থা – তা নিয়ে আলোচনা পেলে আরও ভাল হত। মেয়েদের নিজেদের সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পুরুষ আত্মীয়ের হাতে তুলে দেওয়ার মধ্যে যে অক্ষমতা ফুটে ওঠে তা-ই বা তাদের সম্পত্তির অধিকার পাওয়ার পথে কতটা সহায়ক? সামাজিক নৈতিকতার ক্রমপরিবর্তনশীল সংজ্ঞা, পার্সোনাল ল সহ আইনি কাঠামোর বিভিন্ন পরিবর্তন কীভাবে গ্রামীণ সমাজকে প্রভাবিত করে নতুনতর দিকে পরিচালিত করছে এবং তার প্রভাবে মেয়েদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ধারণা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে বদলে যাচ্ছে তারও কোন পরিষ্কার ছবি পাওয়া গেল না। বিশেষত ক্রমাগত নগরায়নের ফলে, নগর আর গ্রামের দূরত্ব ক্রমশ কমে যাওয়ার ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে মেয়েদের তথাকথিত লিঙ্গনির্ধারিত ভূমিকা এবং উত্তরাধিকারের মত অতিবাস্তব বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তার বদল হচ্ছে তারও কোন দিশা মিলল না। অথচ অর্চনাদির মতন একজন স্বাধীন-উপার্জনশীল মানুষের উত্তরাধিকারের বিশ্লেষণের প্রসঙ্গে হয়ত সেই অবকাশ ছিল।

তবে অপ্রাপ্তি থাকলেও একথা ঠিক যে আমাদের শহুরে শিক্ষিত সীমিত গন্ডিতে যখন মেয়েদের উত্তরাধিকার বিষয়টা তুলনায় অনেকখানি চোখ সওয়া হয়ে গেছে, তখনো পশ্চিমবঙ্গে চাষের জমি সমেত মেয়েদের যে কোনো ধরনের জমির মালিকানার সামগ্রিক পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে তাকে ব্যাখ্যা করা মুশকিল হয়। এমন পরিস্থিতিতে এইরকম ক্ষেত্র-সমীক্ষা খুব কাজের। চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় আমাদের প্রকৃত অবস্থান। ভবিষ্যতে অন্য ধর্মের মেয়েদের মধ্যে, ছোট এবং বড় শহরের মেয়েদের মধ্যেও এই ধরণের কাজ হলে উপকার বৈ অপকার নেই।

Owning Land, Being Women: Inheritance and Subjecthood in India
Writer: Amrita Mondal
Publisher: De Gruyter
দাম: ৬৮৭৪ টাকা

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.