২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরের তুঘলকি নোটবন্দির আরেক দফা স্বীকৃতির ব্যবস্থা করে দিয়ে গত সোমবার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে নোটবন্দির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতিতে কোনো ভুল ছিল না। ছ বছর আগের সেই সন্ধ্যায় রাতারাতি দেশের মানুষের হাতে থাকা টাকার ৮৬ শতাংশকে বাতিল ঘোষণা করার পিছনে সরকারের যুক্তি ছিল, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল হলে প্রচুর কালো টাকা ধরা পড়বে, বিশেষত সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের জন্য টাকার জোগান বন্ধ হয়ে যাবে, বাজারে চালু থাকা পাঁচশো, হাজারের নকল নোট বাতিল হয়ে যাবে এবং আগামীদিনে ডিজিটাল ও নগদবিহীন অর্থনীতির পথ সুগম হবে।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাতিল হয়ে যাওয়া নোটের ৯৯ শতাংশের বেশি ব্যাঙ্কে জমা পড়ে গেছিল, অর্থাৎ নকল নোট এবং কালো টাকার সরকারি যুক্তি ধোপে টেকেনি। উপরন্তু দেখা গেছিল, ২০১৮ সালের মার্চ মাসের মধ্যে বাজারে চালু নোট ও মুদ্রার মূল্য নোটবন্দির আগের মূল্যকে ছাপিয়ে গেছে এবং এই চালু টাকার ৮০ শতাংশই হল নোটবন্দির পরে বাজারে ছাড়া নতুন পাঁচশো ও দু হাজার টাকার নোট। ২০২২ সালের শেষের দিকে বাজারে চালু নোট ও মুদ্রার মূল্য ঠিক প্রাক-নোটবন্দি মূল্যের চেয়ে প্রায় ৭২ শতাংশ বেশি। সুতরাং নোটবন্দির ফলে ভারত যে নগদবিহীন অর্থনীতি হয়ে উঠেছে একথাও বলা চলে না। আসলে যা হয়েছে তা হল দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে জোরদার ধাক্কা দিয়ে সাধারণ মানুষের অন্তহীন হয়রানির বিনিময়ে পুরনো নোট সরিয়ে নতুন নোট আনা। গত ছ বছরে ডিজিটাল পেমেন্ট নিঃসন্দেহে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তার পিছনে নোটবন্দির চেয়ে প্রযুক্তিগত উন্নতির ভূমিকাই মুখ্য। অনলাইন ব্যাঙ্কিংয়ের সুবিধা, সহজে ফোনের বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে পেমেন্টের সুবিধা, ফোনপে, জিপে, পেটিএম, ইউপিআই ইত্যাদির ব্যবহার বৃদ্ধির প্রধান কারণ প্রযুক্তির বিকাশ, শস্তা ইন্টারনেট, শস্তা স্মার্টফোন, বিশেষত যুবসমাজের প্রবল ফোন নির্ভরতা, এবং অবশ্যই করোনা অতিমারীর সময়কার টাকা হস্তান্তরে ভীতি। বাকি রইল জাল টাকার প্রশ্ন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২০২২ সালের মে মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী, জাল টাকার পরিমাণ ২০২১-২২ অর্থনৈতিক বর্ষে বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি এবং হাস্যকরভাবে জাল পাঁচশো টাকার নোট বেড়েছে ১০০ শতাংশের বেশি, জাল দু হাজার টাকার নোট বেড়েছে প্রায় ৫৪ শতাংশ। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে উদ্ধার হওয়া মোট জাল নোটের ৬০ শতাংশই দু হাজার টাকার নোট। কয়েক মাস আগেই জনৈকা মডেলের ফ্ল্যাটে পাওয়া যে তাড়া তাড়া গোলাপি নোটের ছবি পশ্চিমবঙ্গবাসী মাত্রেরই চোখে ভেসে উঠবে, তার পরে আর কোন নোট কত কালো সে গল্পে না যাওয়াই ভাল।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

বস্তুত, সরকারের দেখানো সব যুক্তিই ব্যর্থ – এই মর্মে নোটবন্দির ষষ্ঠ বর্ষপূর্তিতে মোদী সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন তেলেঙ্গানার মন্ত্রিসভার সদস্য কে টি রামা রাও। রাহুল গান্ধী সহ বিভিন্ন বিরোধী নেতা বারবার নোটবন্দি নিয়ে মোদী সরকারের সমালোচনায় সরব হয়েছেন। অমর্ত্য সেন থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গবেষক, চিন্তক এবং অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞের সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হয়েছে মোদী সরকারের এই হঠকারী সিদ্ধান্ত।

নোটবন্দির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানানো যে ৫৮ আবেদনের প্রত্যুত্তরে সুপ্রিম কোর্টের এই রায়, সেই আবেদনকারীদের মধ্যে ছিল কিছু সমবায় ব্যাঙ্ক, আইনজীবী এবং সাধারণ নাগরিক। তাঁদের একাংশের বক্তব্য ছিল, নোটবন্দির ঘোষণা ভারত সরকারের পরিবর্তে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছ থেকে আসা উচিত ছিল। কাঙ্খিত উদ্দেশ্যপূরণে ব্যর্থতা ছাড়াও যে সমালোচনা বারবার উঠে এসেছে তা হল নোটবন্দির ঘোষণার ক্ষেত্রে সরকারের আগাম পরিকল্পনার অভাব এবং পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব। অসংগঠিত ক্ষেত্রে ছাঁটাই ও বেকারত্ব বৃদ্ধি, মধ্য ও ক্ষুদ্র শিল্পে ধস নামা থেকে শুরু করে এটিএমে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থতা, প্রাণহানি এবং সাধারণ মানুষের চূড়ান্ত নাজেহাল হওয়া – সবই সেই অব্যবস্থা ও অসম্পূর্ণ পরিকল্পনার নজির। ঠিক এইখানেই বিজেপির মুখে বুলি ফুটিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়। রায়ে বলা হয়েছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনা করে যথাযথ আইনি পদ্ধতি মোতাবেকই নোটবন্দীর সিদ্ধান্ত। স্বভাবতই এই রায়কে লুফে নিয়েছে বিজেপি। প্রাক্তন আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বা বর্তমান আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু, কেউই বিরোধী নেতৃত্বকে নোটবন্দির সমালোচনা করার জন্য কটাক্ষ করতে ছাড়েননি।

তবে বিজেপির আস্ফালনে কান দেওয়ার আগে দেখা দরকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ঠিক কী বলা আছে। নোটবন্দির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবার জায়গায় সুপ্রিম কোর্ট আদৌ নেই, কেন না কোনো অর্থনৈতিক নীতির যৌক্তিকতা বিচার বিচারব্যবস্থার আওতার বাইরে। সুপ্রিম কোর্ট কেবল বলতে পারে এই নীতি নির্ধারণের আইনি অধিকার সরকারের ছিল কিনা এবং সেই নীতির প্রয়োগ আইনানুগ হয়েছে কিনা। তারা সেটুকুই বলেছে। রায়ে বলা হয়েছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কেন্দ্রীয় বোর্ডের সম্মতিক্রমে যে কোনো সিরিজের নোট বাতিলের অধিকার কেন্দ্রীয় সরকারের আছে, নোটবন্দির সিদ্ধান্তে কোনো আইনি গলদ ছিল না, পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নোটবন্দির পিছনে সরকারের ঘোষিত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, বাতিল নোট পাল্টানোর জন্য নির্ধারিত সময়সীমা যথেষ্ট এবং সেই সময়সীমার বাইরে বাতিল নোট নেওয়ার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অন্য ব্যাঙ্কগুলোকে বাধ্য করতে পারে না।

আরো পড়ুন দুদিনের ব্যাঙ্ক ধর্মঘট: লড়াইটা কেবল ব্যাঙ্ককর্মীদের নয়

নোটবন্দির ফলাফল নিয়ে কোনো কথাই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কিন্তু বলা হয়নি। বরং স্পষ্ট বলা হয়েছে, এই নীতির পিছনে সরকারের ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলো পূরণ হল কিনা তা সুপ্রিম কোর্টের বিচার্য নয়। নাগরিকদের হয়রানির বিষয়টায় আবেদনকারীদের পক্ষ থেকে জোর দেওয়া হলেও সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারে নীরব থেকেছে। বিচারপতি এসএ নাজিরের নেতৃত্বাধীন পাঁচজন বিচারপতির বেঞ্চের চারজনই নোটবন্দির সিদ্ধান্ত আইনানুগ বলে মত দিলেও বিচারপতি বিভি নাগরত্ন এই ঘোষণাকে বেআইনি বলেছেন।

নোটবন্দির
বিচারপতি বিভি নাগরত্ন। ছবি: টুইটার

তাঁর মতে নোটবন্দির মত একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সংসদের মাধ্যমে নেওয়া যেতে পারত। আরও যে জরুরি প্রশ্ন তিনি তুলেছেন, তা হল পুরো প্রক্রিয়ায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দূরদৃষ্টির অভাব। নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে না গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে সম্মত হওয়ার অসংবেদনশীল নিষ্ক্রিয়তা।

লক্ষণীয় যে সেপ্টেম্বর মাসের শেষে যে শুনানি হয়েছিল, বিচারপতি নাজির এবং গাওয়াই সেখানে এই মামলার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সাম্প্রতিক অতীতে রাফালে চুক্তি, বাবরি মসজিদ, গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে মামলায় মোদীর ক্লিন চিট – সব বিষয়েই সুপ্রিম কোর্টের রায় বিজেপির পক্ষে গিয়েছে। বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন এবং রাজনৈতিক তথা গণপ্রতিক্রিয়ার ভয় কোন ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কতটা প্রভাবিত করেছে তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ থাকলেও, শেষপর্যন্ত মোদী সরকার একের পর এক ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টের স্ট্যাম্প দেখিয়ে নিজেদের নৈতিকতা প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছে। এমনকী নোটবন্দির রায়েও এই রায়ের সীমাবদ্ধতার কথা বলা থাকলেও তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবে না।

নোটবন্দির সময়ে বড়লোকের হাতে থাকা কালো টাকা উদ্ধারের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালের সংসদীয় রিপোর্ট বলে নোটবন্দির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সৎ করদাতা এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষ, কিন্তু তাতে মোদী সরকারের সদিচ্ছার প্রতি আস্থা হারাননি ভোটাররা। এখন কংগ্রেসের পি চিদম্বরম থেকে শুরু করে জয়রাম রমেশ বা মল্লিকার্জুন খড়গে, প্রত্যেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে এই রায় নোটবন্দীর যাথার্থ্য বা সাফল্য কোনোটাই প্রমাণ করে না। সিপিআই, সিপিএমের তরফেও একই বক্তব্য রাখা হয়েছে। কিন্তু বলা বাহুল্য, নোটবন্দির যাবতীয় বৈধ সমালোচনাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার জন্যে এই রায়কে ব্যবহার করতে বিজেপি কসুর করবে না।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.