মৃণাল শতপথী
মৃণাল শতপথী

গাছগুলো বড় হয়েছে। দুটো ঝাউ, গোটা চারেক দেবদারু, পেয়ারা, আম, সোনামুখী ডাবের গাছ। পাঁচিলের গা ঘেঁষে বেল ফুলের সারি। এক ঝাঁক বৃষ্টির পর ফুল ধোয়া গন্ধ আসে ব্যালকনিতে। বাবাম নাক টেনে খানিকটা গন্ধ নেয়। তার হাফ প্যান্ট, নীল গেঞ্জির বুকে হলুদে লেখা ‘হে ইউ!’ গাছগুলো দাদুর লাগানো। বাগানে বেড়ানোর সময় দেবদারুর গায়ে হাত রেখে বলেন, এই বড় হতে দেখাটাই আনন্দের, বুঝলি। কথাটা বাবাম তেমন বোঝেনি। কিছু বুঝতে না পারলে স্বভাবত গম্ভীর বাবামের একটা ভ্রূ সামান্য কুঁচকে থাকে।

ঝাউয়ের সারা গায়ে ছেঁড়া ছেঁড়া মাকড়সার জালের মতো জল। পাঁচিলের একটা অংশে চোখ পড়তেই অবাক হয় বাবাম। তারই বয়সী একটি ছেলে পাঁচিলের উপর উঠে এসেছে! বাবাম খানিক আড়াল নেয়। ছেলেটা লাফিয়ে বাগানে নামে। পেয়ারা গাছটার ঝুঁকে থাকা ডাল থেকে টপাটপ কয়েকটা পেয়ারা ছিঁড়ে নিয়ে পকেটে পোরে, পাঁচিলের গায়ে দুটো ফুল তুলে নিয়ে শোঁকে, আরেকবার পাঁচিল ডিঙিয়ে চলে যায়। বাবাম সহজে কিছুতে অবাক হয় না, তবে এই ঘটনায় তার ভ্রূ কুঁচকে যায়।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

অতনু এবং নন্দনা মুখোমুখি বসে। ডাইনিং টেবিলের বিপরীত মেরুতে। নন্দনা মন দিয়ে দুধে ভেজানো কর্নফ্লেক্স খায়। চামচে অল্প তুলে ধরে থেকে বাম হাতের তর্জনী টেনে টেনে ফেসবুক স্ক্রল করে যায়। অতনু ধীরে কফিতে চুমুক দেয়, এতটাই ধীরে যে মাঝে মধ্যেই জিভ কফির নাগাল না পেয়ে মগের গা চেটে যাচ্ছে। বছর কুড়ির বিবাহিত জীবন দুজনের, শেষ কয়েক বছর নিজেদের মধ্যে একটি বাক্য বিনিময় হয়নি, একটিও নয়, অন্তত মুখে। নন্দনা অতনুর জামা-প্যান্ট ইস্ত্রি করে রেডি রাখে, কফি-জলখাবার, অন্যান্য টুকিটাকি। সচরাচর এক বিছানায় তারা থাকে না, নিতান্ত প্রয়োজনে একজন চোরের মত অন্ধকারে এসে দাঁড়ালে অন্যজন সাড়হীন শুয়ে থাকে পাশ ফিরে।

চামচের দুধটুকু জিভে নিতে নিতে অতনুর হোয়াটসঅ্যাপ ফুট দশেক দূরত্ব থেকে আসে নন্দনার ফোনে — শনিবার দিল্লি যাচ্ছি। অতনুর মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপ টোন, উত্তরে নন্দনা কেবল তিনটে ডট পাঠিয়েছে।

 

দেবলীনা নিঃসাড়ে সিঁড়ির শেষ ল্যান্ডিংয়ে এসে দাঁড়ায়। খোলা ছাদের দরজা ভেজানো, মা কথা বলছে ফোনে, সে আড়ি পাতে।

‘বাইরে কীভাবে দেখা করব অংশু? ঘরে এসো, না টুনু কিছু বলবে না। আচ্ছা ঘরে কেউ না থাকলেই এসো, আচ্ছা কোলে মাথা রেখো, ঠিক আছে, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দেব। বলছি তো বাইরে নয়!’

দেবলীনা হতভম্ব দাঁড়িয়ে থেকে নিচে নেমে আসে। মিনিট পাঁচেক পর মা।

‘কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’

‘নান অফ ইয়োর বিজনেস।’

‘না বলছি এতটাই প্রাইভেট ছাদে যেতে হয়!’

‘মুখটা বেড়ে যাচ্ছে টুনু!’

‘অংশু আমার এক্স মা, গা ঘিনঘিন করে না তোমার?’

‘গলা তুলে কথা বলবে না, চেঁচালে আস্তে চেঁচাও!’

‘আস্তে চেঁচানো যায় না মা!’

সিলিংয়ে একটা হলুদ মথ এসে বসেছে। অপলক তাকিয়ে দেবলীনা মায়ের সঙ্গে কাল্পনিক সংলাপ শেষ করে মৃদু শ্বাস ছাড়ে, শরীর উল্টে, বালিশে নাক-মুখ খানিক গুঁজে রেখে বাতাস না নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে কিনা তার পরীক্ষা করে।

 

তীর্থঙ্কর খুব মন দিয়ে জানালায় রাখা টবে ঘৃতকুমারীর পাতা লক্ষ করেন। বর্ষা নামতেই পাতাগুলো দিব্যি সতেজ হয়ে উঠেছে। সারা গ্রীষ্ম ঝিমিয়ে থাকে। মরু দেশের প্রাণ, এ দেশেও শিকড় গেড়ে দিব্যি থাকা যায়। তীর্থঙ্করের যা বয়স তাতে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা থাকে না, তবু প্রাণের জন্ম তিনি দিতে পারেন। সন্তানকে বড় হতে দেখে বুক যেভাবে ভরে ওঠে, গাছেদের বেড়ে ওঠায় সেই অনুভব ফিরে পান। বাগানভরা তাঁর সন্ততি। বাইরে তাকিয়ে তাঁর মনে হয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থেকেও একেকটা গাছ আসলে নিঃসঙ্গ, মানুষের মতই।

বাবাম ঘরে আসে। হাত দুটো পেছনে করে খানিকটা তফাতে দাঁড়ায়।

‘দাদু?’

‘বলে ফ্যালো।’

‘বাগানে চোর এসেছিল, হাফ-প্যান্ট পরে।’

‘চোর?’

‘দুটো পেয়ারা আর একটা ফুল নিয়ে গেছে।’

পাঁচিলের ওপাশে ঝোপড় পট্টি। রেলের জায়গা দখল করে বিস্তীর্ণ স্লাম। থিকথিকে আবর্জনায় পোকামাকড়ের মত এক ধরনের মানুষ। সর্বক্ষণ হা-হা খিদে পেটে নিয়ে ছেলেগুলো এর বাড়ি তার বাড়ির পাঁচিল ডিঙিয়ে বেড়ায়। গাছের একটা ফল যদি রাখা যায় এদের জ্বালায়। তীর্থঙ্করের কপালে ভাঁজ। কাঁটাতার লাগানোর কথা কতদিন ধরে ভাবছেন।

‘সন্তোষকে খবর দিতে হবে। পাঁচিলে কাঁটাতারটা এবার লাগানো দরকার।’

 

মায়ের বয়স কত হল? ফট্টি-ফাইভ প্লাস, ফিফটি? সে জানে এ বয়সেও প্রেমে পড়ে মানুষ। মনে মনে অংশুকে মায়ের পাশে দাঁড় করিয়ে দেখে, নাঃ কিছুতেই মানায় না! মেয়ের বয়সী একটা ছেলের সঙ্গে যে আবার মেয়ের প্রাক্তন!

‘আই হেট ইউ মা!’

‘সিনেমার ডায়ালগ দেওয়া বন্ধ করো।’

‘তুমি একজন আনফেথফুল মহিলা, বাবার সঙ্গে ট্রেচারি করছ!’

‘ঠাস করে একটা চড় লাগাব টুনু!’

‘তাতে সত্যিটা চাপা পড়বে না!’

‘কীসের সত্যি, সত্যি-মিথ্যে বোঝার বয়স হয়েছে তোমার?’

‘ইউ আর আটারলি ক্রেজি!’

মা কি তার ইয়াংগার এজটাকে মিস করে? অথবা বাবার সঙ্গে একটা অসুখী জীবন? জানালার পর্দাটাকে মুঠো করে ধরে দাঁড়িয়ে থেকে দেবলীনা কাল্পনিক সংলাপ শেষ করে।

 

তাদের পাঁচিল পেরিয়ে এভাবে কেউ ঢুকতে পারে সেটাই কল্পনাতীত বাবামের কাছে। সে টের পায় তার ভেতরে মৃদু উত্তেজনা, একটা অসম্ভব কাজ সম্ভব হতে দেখলে যেমন হয়, ম্যাজিকের মত। এই কাজটা করার কথা তার স্বপ্নেও আসবে না। অথচ অবলীলায় করলো ছেলেটা, তারই বয়সী। বাড়িতে মা, বাবা, দাদু এবং দিদির এক জায়গাতে মিল, তারা মনে করে ঘরের বাইরের পৃথিবীটা খুব খারাপ। পাশের নোংরা বস্তি, লোকজনের মুখের ভাষা খারাপ প্রভাব ফেলে। বাবা প্রায়ই ফ্ল্যাট কিনে চলে যাবার কথা বলে। দাদু তাঁর বাগান ছেড়ে কোথাও যাবেন না। দাদু মরে গেলে এই জায়গা বেচে তারা অন্য কোথাও চলে যাবে বাবাম জানে, যেখানে বস্তি নেই, এই ছেলেগুলো নেই। বাবাম তার আট বছরে গেটের বাইরে একবারও যায়নি একা।

ছেলেটাকে চোর মনে হয়, দাদুকে গিয়ে বলে তাই। তবু কাঁটাতার লাগানোর কথায় ভাল লাগে না তার। ছেলেটা তো আর ঢুকতে পারবে না। পেয়ারাগুলো এমনিতেই কেউ খায় না এ বাড়ির। পাখি এসে ঠোকরায়, কাঠবিড়ালি আধখাওয়া ফল মাটিতে ফেলে যায়, বাগান নোংরা হয়। ছেলেটাকে তার আর দেখা হবে না। আজ কি সে আবার আসবে? একদম কাছ থেকে তাকে দেখতে চায়। বাবাম নিচে বাগানে নেমে আসে। সোনামুখী ডাবগাছটার আড়ালে দাঁড়ায়। তাকে দেখলে ছেলেটা আসবে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও ছেলেটা আসে না। বিকেলের ছিটেফোঁটা রোদ বাগানের ডালপালায়। বাবাম ধীরে পাঁচিলের কাছে এসে দাঁড়ায়। দুটো ইট থাক করে রেখে তাতে পা দিয়ে চেটো তুলে পাঁচিলের মাথাটা পায়। ওঠার আগে মুখ ফিরিয়ে বিঘত বাড়িটার দিকে তাকায়। কেউ দেখে ফেললে? কেউ দেখার নেই সে জানে। এ বাড়ির লোকেদের কারও দিকে তাকাবার সময় নেই। শুরুতে ভয় করে একটু, তারপর ভর দিয়ে শরীরটা তুলবার চেষ্টা করে। তার গড়নটা ভারি, কষ্ট হয়, হাঁচোড়পাঁচোড় করে, হাঁটু ঘষে নুন ছাল উঠে যায়, জ্বালা করে।

 

দেবলীনা বালিশে নাক-মুখ গুঁজে ফোঁপায়। নন্দনা তার কাঁপতে থাকা পিঠে হাত রাখে।

‘কী হয়েছে টুনু?’

‘বাবা দিল্লি গেল, আমাকে জানাল না একবার!’

‘এই কারণে কাঁদছিস, যাঃ!’

‘বাবা আমাকে এখন ইগনোর করে মা।’

‘বাবা দিল্লি যায়নি।’

দেবলীনা হাতায় চোখ রগড়ে উঠে বসে।

‘কোথায় গেছে?’

‘মন্দারমণি।’

‘অফিসের কাজে?’

‘না।’

দেবলীনা জানে বাবা দিল্লি যায়নি। ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছি বলে বেরিয়ে যায়, স্নিগ্ধা বোলপুর থেকে ফোন করে, লীনা তোর বাবাকে দেখলাম রে, সঙ্গে এক মহিলা অ্যান্ড আয়াম ড্যাম শিওর সে তোর মা নয়!

‘তুমিও বাবাকে একটা শিক্ষা দাও!’

নন্দনা শুকনো হাসে। কিছু বলে না।

‘ও অংশু ফোন করেছিল। ইন ফ্যাক্ট প্রায়ই করে।’

দেবলীনার একবার মনে হলো মা কনফেস করবে।

‘জঘন্য একটা ছেলে। আমি তার মায়ের বয়সী, আমাকেই কিনা, কী অবস্থা আজকালকার ছেলেদের! গলা যেই কড়া করেছি ফোন কেটে দিয়েছে। আর ফোন করার সাহস হবে না। তুই বেরিয়ে এসে বেঁচে গেছিস।’

দেবলীনা হঠাৎ মা-কে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ওঠে।

‘কী হল আবার!’

‘বাবা তোমাকে না জানিয়ে মন্দারমণি কেন যায় মা!’

হোয়াটসঅ্যাপ টোন নন্দনার ফোনে। অতনুর মেসেজ — মিস ইউ!

 

পাঁচিলটার ওপর উঠে আসতে পেরেছে সে। এমন অবস্থায় তাকে দেখলে মা হার্টফেল করবে, বাবা হাঁ করে চেয়ে থাকবে যেমন খেতে বসে রবি ঠাকুরের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। থপ করে ওপাশের মাটিতে লাফিয়ে পড়ে সে। দূরে বাস রাস্তা। একপাশে রেল কলোনি, অন্য ধারে বড় এলাকা জুড়ে বস্তির শয়ে শয়ে ঘর। মহাকায় এক জলের ট্যাঙ্ক। একপাশ ফুটো হয়ে ঝরনার মতো জল পড়ছে। উদোম কতগুলি কালোকুলো বাচ্চা এই সন্ধেবেলা লাফিয়ে লাফিয়ে চান করছে সেই জলে। তাদের অসুখ করে না? সেই ছেলেটা কোথায়? সরু গলি ধরে বস্তিতে ঢোকে বাবাম। এমন ছোট ছোট ঘুপচি ঘর, মানুষ থাকে নাকি চড়ুই পাখিরা? বাবাম হাঁটতে থাকে। অদেখা অবাক এক জগত। উঠোনে তোলা উনুনে রান্না করে একটি বউ। ধোঁয়ায় আবছা নীল হয়ে আছে জায়গাটা। বউটা হাসে, কন চাইয়ে বেটা? তুম আয়ে কাঁহাসে? সেই ছেলেটা কোথায়? ছোট একটি মেয়ে আঁকশি দিয়ে ফুলের ডাল ঝুঁকিয়ে এনেছে, ফুল তুলতে গেলেই আঁকশি ছাড়া হয়ে ছিটকে উঠে যাচ্ছে ডাল। উদোম বুকে বাচ্চাকে দুধ দিচ্ছে মহিলা, তাকে দেখছে অবাক চোখে। দুটো লোক ছেঁড়া দড়ির খাটিয়ায় বসে আয়েস করে বিড়ি টানতে গল্প করছে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দুজন মানুষ!

সন্ধে নামে আরও। বস্তির ঘরে ঘরে লন্ঠন, কালিপড়া হ্যারিকেন, হুক করে নেওয়া কারেন্টের বাল্ব জ্বলে উঠছে ক্রমে। বস্তি পেরিয়ে আবর্জনার স্তূপে উঁচু হয়ে থাকা জায়গাটায় আসে। পাহাড়ে চড়ার মত করে উঠে এসে দাঁড়ায় সেটার মাথায়। পশ্চিমাকাশে ঘন মেঘ, জোনাকির মতো অজস্র আলোয় ভরে উঠছে ঘরগুলো। বাবামের মনে হয়, এর চেয়ে সুন্দর কিছু সে আগে দেখেনি। বাড়ি ফিরবার কথা ভুলে যায়, সেই ছেলেটার কথাও তার আর মনে থাকে না।

আরো পড়ুন বিদ্রোহ আর প্রেমের দিব্যি

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাজা সুরমানের উপাখ্যান
পরবর্তী নিবন্ধবিজয়া
গল্পকার, ঔপন্যাসিক। শিক্ষকতার সূত্রে জঙ্গল মহলের সাথে নিবিড় সম্পর্ক। মানুষ-বন্যপ্রাণ সংঘর্ষ নিয়ে লেখা তাঁর গল্প 'বিতংস' দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুই।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.