‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ পালন করছি আমরা। ১৯২২ সালে বিজলী এবং মোসলেম ভারত পত্রিকায় একই সময়ে কবিতাটি প্রকাশের পর কেটে গেছে একশোটি বছর। এই কবিতার হীরকদ্যুতি আজও অম্লান। মাত্র বাইশ বছর বয়সে লেখা কবিতাটিতেই সূচনা হয়েছিল সামগ্রিক নজরুল মননের। এই কবিতার দুরন্ত গতি একাধারে শাণিত ফলার মতো পূর্বাপর ছিন্নভিন্ন করে প্রচলিত বিশ্বাস, আবার সেই উচ্চকিত নির্ঘোষ যখন রৌদ্রতপ্ত, মলয় বাতাসের মতো প্রেম এসে হাত বুলিয়ে যায় রণক্লান্ত বিদ্রোহীর শিরে।
সাতাত্তর বছর বেঁচেছিলেন নজরুল, বলা ভালো দেহটি বেঁচে ছিল, আসলে নজরুল বেঁচেছিলেন তেতাল্লিশ বছর। অতলান্ত প্রাণপ্রাচুর্য ভরা একটি মানুষ ভেসে চলেছিলেন সময়ের মহাসমুদ্রে একাকী নৌকোর মত। সেই সমুদ্রটিকে কল্পনা করতে ইচ্ছে হয়। আকাশে ক্ষীণ চাঁদের আলো, তারই খানিক আভা এসে পড়েছে অন্ধকার ঢেউয়ের শরীরে। বাতাসের বেগ বাড়লে উত্তাল সাগরে বেগবান, উথাল পাথাল এক নৌকো। যায় যায়, ওই ডুবে যায়! সমুদ্র শান্ত হয় আবার। মৃদুমন্দ ঢেউয়ে নৌকোটির দোলাচল, ধীর তার লয়। দূরে গোলাপি একটি মেঘ সামনে রেখে বুঝি বা পৌঁছতে হবে সেখানে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির সামগ্রিক লয়ের এমনই চড়াই উতরাই, কখনো পৌঁছয় সাংগীতিক তার সপ্তকে আবার মুহূর্তে প্রশান্তির উদারায়। নজরুলের সুরের তারটিও এভাবে বাঁধা, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতুর্য!’
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
জীবনভর পীড়িত হয়েছেন। তাঁর মানসিক গঠনটির যদি ব্যবচ্ছেদ হয় তবে ব্যথার কোষসজ্জা ছাড়া ভিন্ন কিছু চোখে পড়ে না। মহাকবির জন্মলগ্নই তো সূচিত হয় শরবিদ্ধ মৈথুনে। বেদনাহীন কোনো মহাকাব্য হয় না। চরম দারিদ্রের পীড়ন নজরুলের সৌখিন কাব্যচর্চার পরিসর গড়ে তোলেনি। “পারি নাই বাছা মোর হে প্রিয় আমার/ দুই বিন্দু দুঃখ দিতে,/ মোর অধিকার, আনন্দের নাহি নাহি/ দারিদ্র্য অসহ,/ পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ/ আমার দুয়ার ধরি, কে বাজাবে বাঁশি/ কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি/…”
শৈশবেই কাজ করছেন পাঁউরুটির দোকানে। পিতৃহারা। অনেকগুলি ভাইবোন এবং মায়ের দায়িত্ব। অনাহার, ক্ষুধার সঙ্গে নিবিড় পরিচয় তখন থেকেই। তবু দুখুমিঞা কেবল নিজের দুঃখে বিহ্বল নয়। সেই দোকানে খাবার চাইতে আসা ক্ষুধায় কাতর বৃদ্ধ ভিখারি ফকিরকে লুকিয়ে রুটি দেয় সে। দোকানি জানতে পেরে বন্ধ করে দেয় ফকিরের আসা। একদিন দুখুমিঞা তাকে আবিষ্কার করে রাস্তার ধারে পড়ে থাকতে, অনাহারে মৃত এক মানব শরীর। নানা ধরনের কায়িক শ্রমে দেহ-মন শানিত হয়ে উঠছে নজরুলের, দারিদ্র, অভাবের সঙ্গে নিয়ত যুঝবার ফলে তৈরি হচ্ছে কাঠিন্য, বেপরোয়া, সময়ে সময়ে উদ্ধত এক মনন। আবার নিজের অপ্রাপ্তি, বেদনা মানুষের বিপুলা পৃথিবীতে দেখে খুঁজে পাচ্ছেন আশ্চর্য এক দুঃখ প্রলেপ, অস্ত্রের মতো ঝকমকিয়ে উঠছে কখনও, “উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি বাণী ক্ষুরধার/ বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার।” বৃদ্ধ ফকিরের অনাহারে মৃত্যু জন্ম দেয় কবি নজরুলের। সেই মৃত শরীর দেখে এসে বারো বছরের কিশোরের প্রথম কবিতা রচনা। নিজের বেদনার তারে বেঁধে নিচ্ছেন অপরের দুঃখ, ব্যথা হয়ে উঠছে সার্বজনীন।
ঔপনিবেশিক শাসনের বিভীষিকা, বিশ্বযুদ্ধ। নজরুল চিনছেন স্বদেশকে। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে চলে যাচ্ছেন বালুচিস্তান। রুশ সীমান্ত। একাধারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীর স্বরূপ অন্যদিকে রাশিয়ায় শ্রমিক-কৃষক-সৈনিকের একযোগে শান্তি, রুটি আর জমির দাবিতে অভ্যুত্থান। এই দুইয়েরই সাক্ষী নজরুল। ফিরে এসেই লিখছেন ‘বিদ্রোহী।’ যেন বা একক এক রণভেরী বাজিয়ে দিলেন এসে, যা অক্লান্ত বিপ্লবীর মতই উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি নিয়ে। “আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না…” এই রণদামামার আপাত কাঠিন্যের অন্তরে চিরকাল বয়ে গেছে প্রেমের নির্ঝর। এত অপ্রাপ্তি অভাব জ্বালা যন্ত্রণার মহাবিশ্বে নজরুল আস্থা রেখেছেন প্রেমে। নারীর প্রেম। প্রেমহীনতায় একজন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ভালবাসার বীজ বপনের জন্যেই তার জীবনভর মহাসংগ্রাম। লং মার্চের সময় সমগ্র চীন যখন উদ্বেল, গাছের তলায় নিভৃতে বসে দুই প্রেমিকজন। বিপ্লবীরা ক্ষিপ্ত, এখন কি এসবের সময়? মাও সে তুং শান্ত করেন তাদের, বলেন, আমাদের যাবতীয় যুদ্ধ বিগ্রহ, বিপ্লব, লং মার্চ তো আসলে এদের জন্যেই, এমন নিরুদ্বেগ, প্রেমপূর্ণ পৃথিবীর নির্মাণে।
নজরুলের জীবনে সেই প্রেমও এসেছে অতল রক্তক্ষরণ নিয়ে। পারিবারিক অভাব শুধু নয়, দুখুমিঞার সেনাবাহিনীর চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার পেছনে ছিল প্রেমের অভিমান। তাই তাঁর উপন্যাসের নায়ক নুরু প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। উপন্যাসের উৎসর্গ পত্রেও অনামা নারীর প্রতি নিরুচ্চার অভিমান। মনে রাখতে হবে নুরু নজরুলেরও ডাকনাম! ছুটে গেছেন এক নারী থেকে অন্য নারীর কাছে তারই অন্বেষণে। নার্গিস আসার খানমকে বিয়ে করলেও, আশ্রয় চেয়েছেন প্রমীলা সেনগুপ্তের কাছে। আবার বিবাহিত জীবনের আরেক অধ্যায়ে প্রেম হাতছানি দিয়ে ডাকে তাঁকে। এবার এক বিদুষী কন্যা। একতরফা প্রেমে উদ্বেল এক কবির নানাবিধ ছেলেমানুষী! প্রেম পেতে এমনকি অঙ্কশাস্ত্রে পারদর্শী হতে চেয়েছিলেন তিনি বন্ধুকে লেখা একটি চিঠিতে, কারণ তাঁর ধারণা হয়েছিল মেয়েটি অঙ্কে সুপণ্ডিত বলেই প্রত্যাখ্যান করছেন নজরুলকে!
“এ মোর নিশীথ রাতের গোপন সাথী, মোদের দুইজনারে জনম ধরে কাঁদতে হবে গো/ শুধু এমনি করেই সুদূর থেকে একলা জেগে রাতি।” প্রেম বিড়ম্বিত ব্যথাতুর নজরুল।
জীবনের নানা পর্যায়ে যেমন মুসলমান বলে মেনে নিতে হয়েছে অবমাননা, বন্ধু শৈলজানন্দের মেসের ভৃত্য তাঁর খাবার থালা ধুতে অস্বীকার করায় সেই মেস ছেড়ে চলে যান মুজফফর আহমদের বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতির অফিসে। তাঁর কাছেই সাম্যবাদের পাঠ। সেই পাঠ অপূর্ণ হলেও তার মর্মকথা নজরুলের সাহিত্যের প্রাণভ্রমর। নিপীড়ন আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে অক্লান্ত এক কবি, আপোষহীন এক কলম ধার ধারেনি শিল্পের সৌখিনতার। বজ্রনির্ঘোষের মতো ফেটে পড়েছে শব্দাবলী। আরবি, ফার্সি বাংলা যখন যা যথাযথ মনে হয়েছে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন। কবিতা লেখার জন্য জেল খেটেছেন কবি, আর লিখেছেন শেকল ভাঙার গান। গোটা দেশ সেই গানে কবিতায় পেয়েছে উজ্জীবন, প্রাণের স্পর্শ। শিল্পের শর্ত আর তবে কীসে? তাই বুদ্ধিজৈবিক তাচ্ছিল্য থামাতে পারেনি তাঁর কবিতার গতি, প্রকৃতিকে। “অমর কাব্য তোমরা লিখিও বন্ধু যাহারা আছো সুখে।” প্রাণচঞ্চল, অস্থির, বিস্ফারিত আবেগ — এ সমস্তকিছুর সম্মিলিত রূপের নাম নজরুল।
অনুবাদ করেন ফার্সি উর্দু, হিন্দি ইংরেজি সাহিত্য, ওমর খৈয়াম, কুরআনের আয়াত, লিখে চলেন প্রাণঢালা সুরে শ্যামাসঙ্গীত, বিপুল কবিতা ও গান, গদ্য সাহিত্য। অন্যদিকে একাদিক্রমে জর্জরিত হতে থাকেন ব্যক্তিগত দুঃখ শোকে। মায়ের প্রতি অভিমানে চিরজীবনের মতো পরিবার ছেড়ে যান, সন্তান শোকে আকুল হন আর প্রেমের আর্তির হাহাকার একেবারে নির্বাক হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত। প্রেম দিতে এসেছিলেন, প্রেম নিতে এসেছিলেন, না পেয়ে অভিমানে এই প্রেমহীন পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন সে কথাও জানিয়েছিলেন।
নজর উল ইসলাম অর্থ ইসলামের নজর বা দৃষ্টি। কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে তা কেবল এক কবির দৃষ্টি হয়ে জেগে আছে আমাদের অন্তর্লোকে। কোথাও পড়েছিলাম, হ্যারিসন রোডের এক মধ্যরাতে রিক্সাওয়ালাকে বলছেন “সারাজীবন তো অন্যকে বয়ে নিয়ে গেলি, আজ আয়, তুই রিক্সায় বোস, আমি চালাই !”
সেই একাকী নৌকোর কথায় ফিরে আসি যে পাড়ি দিয়েছিল কোন এক ক্ষীণ জ্যোৎস্না রাতে। কেবলই মনে হয় সভ্যতার কঠিনতম সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম নামক একশো বাইশ বছরের এক বিদ্রোহী ছায়াময় নৌকায় আসীন না হয়ে আমাদের এই দুস্তর পারাবার অতিক্রম করবার উপায় নেই।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।