কলকাতার বরানগর এলাকার পি এন রায় হাসপাতাল কবে কী কারণে বন্ধ হয়ে গেছে তা আর আমাদের মনে নেই। হাসপাতালের নামটা কিন্তু থেকে গেছে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত National Institute for the Orthopaedically Handicapped (NIOH)-এর ওয়েবসাইটে। কারণ এই প্রতিষ্ঠান শুরু হয়েছিল বন্ধ হয়ে যাওয়া হাসপাতালের জমি অধিগ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠানটা এখন নাম বদলে National Institute for Locomotor Disabilities (NILD)। আসলে handicapped শব্দটি নেতিবাচক বলে প্রতিবন্ধী আন্দোলনের মানুষ দাবি করেন এবং আমাদের দেশের সরকারও তাঁদের দাবিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমরা অবশ্য NILD নামের পাশে এখন লিখি ‘দিব্যাঙ্গ’, কারণ প্রধানমন্ত্রী মোদী মনে করেন প্রতিবন্ধী মানুষ আসলে দিব্যাঙ্গ (দিব্য+অঙ্গ)।
ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা বুঝতে পারি, ভারতের প্রতিবন্ধী মানুষের পুনর্বাসনে এই প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রথম এই ধরনের প্রতিষ্ঠান খোলার কথা আমরা পেয়েছিলাম। প্রতিষ্ঠান চালু হওয়ার সময় থেকে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বললে অনেকেই এই প্রতিষ্ঠান খুলতে ইন্দিরা গান্ধীর সক্রিয় ভূমিকার কথা বলে থাকেন। ১৯৭৮ সালে কলকাতার বুকে উদ্বোধন হওয়া ইনপ্সটিটিউটকে বিনা মূল্যে জমি অধিগ্রহণ করতে দেওয়ায় বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকাও মনে রেখেছেন তাঁরা। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা হিসাবে কাজ শুরু করলেও এই ইনস্টিটিউট পরে স্বায়ত্তশাসিত এক সংস্থা হিসাবে গড়ে ওঠে। এখানে বলে রাখা ভাল, যে দেশে যে চারটে এইরকম ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছিল বধির, দৃষ্টিহীন এবং মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য, সেগুলো কিন্তু অনেক পরে শুরু হয়েছে। ভারতবর্ষের প্রতিবন্ধীদের জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট হিসাবে প্রথম ইনস্টিটিউট কলকাতার এই প্রতিষ্ঠানই। প্রায় দশ হাজার বর্গমিটার জমিতে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানের কাজ প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা, গবেষণা কেন্দ্র এবং বিভিন্ন কোর্স চালানো। এই ক্যাম্পাসের ভিতরেই রয়েছে তিনটে আঞ্চলিক কেন্দ্র: দৃষ্টিহীন, বধির ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা যুক্ত শিশুদের জন্য কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক শাখা। এই ক্যাম্পাস অনেকটা বড় জায়গা নিয়ে, আছে প্রচুর গাছপালা। আছে বিশাল গ্রন্থাগার, যেখানে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে নানা ধরনের গবেষণার বই পাওয়া যায়। আছে অত্যন্ত সুন্দর প্রেক্ষাগৃহ, যা সম্পূর্ণভাবে প্রতিবন্ধী বান্ধব অর্থাৎ barrier free।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এই প্রতিষ্ঠান যখন চালু হয়, তখন মাত্র এক টাকার টিকিট কেটে প্রতিবন্ধী মানুষ যে কোনো চিকিৎসার সুবিধা পেতেন। এখানে বিনামূল্যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি করে দেওয়া, অপারেশন করা, সবরকমের থেরাপি করার ব্যবস্থা ছিল । পরে হাসপাতালে টিকিটের দাম পাঁচ টাকা, দশ টাকা, কুড়ি টাকা হয়। বাড়তে বাড়তে এই ২০২১ সালে সে টিকিটের দাম চল্লিশ টাকা। টিকিটের দাম বাড়ানোর পিছনের কারণ হিসাবে শোনা যায়, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রতিষ্ঠানের উপর আয় বাড়ানোর জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে। কারণ সরকার বাজেট কমাতে শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানের আধিকারিকরা বলেন টিকিটের বর্ধিত দাম সত্ত্বেও তাঁদের হাসপাতালে প্রতিদিন অন্তত ৩০০ থেকে ৪০০ প্রতিবন্ধী মানুষ আসেন। শুধুমাত্র কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবন্ধী মানুষ নয়, এই কেন্দ্রের আওতায় গোটা পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারত রয়েছে। তবে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান থেকেও কিন্তু অসংখ্য প্রতিবন্ধী মানুষ এই হাসপাতালে আসেন।
এবার আসি এই প্রতিষ্ঠানে যে কোর্সগুলো চালু আছে তার কথায়। এখানে রিহ্যাবিলিটেশন নার্সিং, প্রস্থেটিক্স এবং বিভিন্ন ধরনের থেরাপির মাস্টার্স ডিগ্রি অব্দি পড়ানো হয়। ক্যাম্পাসের ভিতরেই রয়েছে শিক্ষার্থীদের হোস্টেল। শুধু ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নয়, ভুটান থেকে এসে এই হোস্টেলে থেকে প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের কাজ শিখে দেশে ফিরে গেছেন — এ রকম মানুষও আছেন।
হঠাৎ করেই মোদি সরকারের মনে হয়েছে, তারা এই প্রতিষ্ঠানকে আর জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেবে না। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের একটি ক্লাস্টার তৈরি হবে, তার হেড অফিস হবে ওড়িশার কটক থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে গ্রামের এক হাসপাতালে। কলকাতার প্রতিষ্ঠানটা হবে শুধুমাত্র এক শাখা। ফলে এখান থেকে কর্মী ছাঁটাই, বাজেট বরাদ্দ কমানো ইত্যাদির আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীসংখ্যা একশোর কাছাকাছি। যে পোস্টগুলো খালি হচ্ছে, সেগুলোর জন্য চুক্তিভিত্তিক কর্মী চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, নতুন নিয়োগ বন্ধ। এসব গত ৪-৫ বছর ধরেই লক্ষ করা যাচ্ছিল। সরকারপক্ষ কিছু না বললেও, শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন এন জি ও-র সঙ্গে কথা হচ্ছে। হয়ত ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠান এনজিও হিসাবেই কাজ করবে, পিপিপি মডেলে চলবে কিছুদিন। তারপর সরকার আস্তে আস্তে পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নেবে। অত বড় জমি, বাড়িগুলোর কী হবে তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। সরকারের হাবভাব দেখে মনে হয়, তাঁদের কাছে এই মুহূর্তে NILD তাদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের অন্যান্য অনেক রাস্তাঘাট, প্ল্যাটফর্ম, বিমানবন্দর বিক্রির মত এই প্রতিষ্ঠান ও কি বিক্রি করে দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার? আপাতত তাদের কাজকর্ম দেখে কিন্তু সেরকমই আশঙ্কা হচ্ছে।
আরো পড়ুন স্কুল খুলছে, কিন্তু প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের কী হবে?
পি এন রায় হাসপাতালের কথা যেমন আমাদের কারোর মনে নেই, তেমন করে এত বড় প্রতিষ্ঠান, এত বড় কর্মকান্ডও কি স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে? ভবিষ্যতে কোনো দিন কি দেখা যাবে যে এই প্রতিষ্ঠান ভেঙেও তৈরি হচ্ছে ফ্ল্যাটবাড়ি, শপিং মল? এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ডিরেক্টর ডাক্তার অশোক সেনগুপ্ত বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন । জাকার্তায় এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিতে গিয়ে তিনি আর ফিরে আসেননি। তাঁর কথাই বা আমরা কজন মনে রেখেছি? এই মুহূর্তে বাংলার প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মীরা এবং নেতৃত্ব কলকাতা থেকে হেড অফিস সরিয়ে নেওয়া বন্ধ করতে চাইছেন। কারণ এতে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাঁরা। ওঁরা স্থির করেছেন প্রথমে ধর্নায় বসবেন, দরকারে বৃহত্তর আন্দোলনের পথে যাবেন। এছাড়াও চিঠিপত্র লিখছেন দিল্লিতে, এবং নবান্নে।
এক প্রতিবন্ধী মানুষ তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যখন পায়ে চোট লেগেছিল, তখন তো অনেকদিন হুইল চেয়ার ব্যবহার করেছিলেন; ভোটের ফল বেরোবার দিন অব্দিও তাঁকে আমরা হুইল চেয়ারেই দেখেছি। তবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস সরিয়ে নেওয়ার বিপক্ষে তিনি কেন একটাও কথা বলছেন না? বাংলার প্রতিবন্ধী মানুষ কি তাঁকে ভোট দেননি? তাঁর হুইল চেয়ার ব্যবহার নিয়ে বিরোধী দলগুলোর ব্যঙ্গ বিদ্রুপের সমালোচনা তো প্রতিবন্ধী আন্দোলনের মানুষ সব থেকে বেশি করেছিলেন। ভোটে জিতে আসার পর তিনি কি সে কথা ভুলে গেছেন?
এদেশে প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবনে বাধা অনেক । Barrier বা বাধাসর্বস্ব জীবনে আরও বেশি বাধা হয়ে দাঁড়ায় সরকারি বঞ্চনা। এই বঞ্চনা দূর করতে পারত রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যা ক্ষমতাসীন কোনো দলই দেখাচ্ছে না।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।