দেখতে গেলাম নাটক
মনটি হল আটক
এ কী দেখি ঠিক?
“বড়ই প্রাসঙ্গিক!”
দৃশ্যপট ১
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
লেখক: ভানুমতীর খেল কথাটা শুনেছেন তো? বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করা একটা প্রবচন। যার প্রকৃত অর্থ ভেলকিবাজি। “লাগ ভেলকি লাগ” বলে আমাদের শিবতুল্য ওস্তাদ যেই তার ডমরু, ইয়ে মানে, ডুগডুগিটি বাজালে, অমনি বরফি জাদুকরের কাঠির ছোঁয়ায় যেমন হাল্লার সৈন্যরা চটপট যুদ্ধে নেমে পড়েছিল, ঠিক তেমনভাবেই তিনটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে কয়েকজন চরিত্র… আহা! আবার ভুল হয়ে গেল। কয়েকটি যেন সুতোয় বাঁধা পুতুল নেমে পড়লে মঞ্চে। তাদের মানসিক টানাপোড়েন দর্শককে নিয়ে গেল এমন এক কঠোর বাস্তবে যা আদতে ভয়ংকর এবং ‘সাধারণ’ মননে বিভীষিকা তৈরি করে।
পাঠক: কিসের কথা হচ্ছে বলুন তো? খালি বাজে বকা।
লেখক: ও হো! বলিনি না? আরে চেতনার মারীচ সংবাদ নাটকের কথা বলছি। জন্ম ১৯৭২ সালে। তৎকালীন মহাকরণের ক্যান্টিনে প্রথম অভিনয় হয়। নাট্যকার অরুণ মুখোপাধ্যায়, পরিচালকও তিনি। নিজে একজন বামপন্থায় বিশ্বাসী নাট্যকর্মী, তাই রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বামপন্থী সংগঠন কো-অর্ডিনেশন কমিটির রাজ্য সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য তৈরি হয়েছিল এই নাটক। সারা পৃথিবী জুড়ে তখন যুদ্ধের দামামা। বহুবছর ধরে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখন কলকাতা শহরকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। অরুণবাবু ভারতের পুরাণ থেকে মৌলিক কাহিনীটি বেছে নিয়ে উনবিংশ শতকের বাংলার জমিদারদের অত্যাচার পেরিয়ে পৌঁছলেন পৃথিবীর যুদ্ধবিলাসী নব্যসাম্রাজ্যবাদী মাতব্বর দেশ আমেরিকায়। যারা মনে করে তারা সব জানে, সব বোঝে। সারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার শুধু তাদেরই আছে। তার জন্যে যদি যুদ্ধ লাগাতে হয় তো লাগাও। মিশর থেকে ইরাক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম, সিরিয়া, ইউক্রেন – আমেরিকার দাদাগিরি চলছে সবখানে। আচ্ছা, আমেরিকা যদি দেশ না হয়ে কোনো মানুষ হত, তাহলে কি তাকে আমরা বুদ্ধিজীবী বলতুম?
ও মা! হাসলেন না যে? আমি তো জোক করলুম।
দৃশ্যপট ২
[দরজায় টোকা পড়ার শব্দ]
লেখক: আরে ওস্তাদ যে! কী ব্যাপার, হঠাৎ আমার কাছে? এই লেখায় কোনো ইনপুট দিতে চাও নাকি?
ওস্তাদ: হো ইনপুট ফিনপুট হৎসৎ হামি বুঝে না বিবিজি। তোবে হামাদের লাটক সোম্পর্কে একটা কথা বলতে এলাম।
লেখক: বলো শুনি।
ওস্তাদ: আপনের ঘরে আপনি জে গেস জ্বালান, তাতে তো লইটের বেওহার করতে হয়, নিজে থেকে তো জ্বলে না লিসচই, তো হামাদের মারীচ সোঙবাদ ভি ওরম গেসলাইটিংওলা লাটক আছে।
লেখক: গ্যাসলাইটিং? মানে?
ওস্তাদ: হেই দেখিয়েছেন, হে আপনাদের মোতো সিক্ষিত লোকেরা যদি হর ওয়াক্ত এটার মানে, হোটার মানে জিজ্ঞাসা কোরেন, তবে তো মহা মুস্কিল! আচ্ছা সোনেন, গেসলাইটিং হল এক ধোরনের চাপ। কিসের উপর চাপ? না মানুষের মোনের উপর চাপ। বুঝেছেন?
লেখক: এক মিনিট। সরি ওস্তাদ, মানে মনের উপর চাপ পড়লে তো তাকে ডিপ্রেশন বলে বা ফ্রাস্ট্রেশন বলে বলেই জানি…
ওস্তাদ: ওহ বিবিজি! এ চাপ নিজে থেকে হোয়্না। বাহার সে এক আদমি ইয়া ফির এক দল লোগ আপনের বিভেচনা সোম্পর্কে প্রস্নো তুলবে, আপনাকে বাধ্য করবে অন্যায় কত্তে, আপনি প্রতিবাদ করলে বা করব না বললে এমন সব কথা বলে আপনেকে দিসাহারা করে দেবে যে তখোন আপনি খুদকোহি পুছেঙ্গে কি কোনটা ঠিক আছে? আপনি যেটা বিসোয়াস করেন সিটা নাকি এ লোকটা যা বলছে সিটা। তারপর এক সময় আপনার লিজের উপর আর জোর থাকবে না। আর এ লোগগুলো আপনাকে বাধ্য করবে – কী যেনো বোলে, কী যেনো বোলে (তুড়ি মেরে মনে করার চেষ্টা), ওই আপনাদের ভালো বাংলায় যেনো কি বোলে?
লেখক: বশ্যতা স্বীকার করা?
ওস্তাদ: হাঁ ঠিক, ওহি। এ ‘মারীচ সঙ্গবাদ’ ভি এক্কেবারে হোই গেসলাইটিং গোল্পো আছে।
দৃশ্যপট ৩
লেখক: বুঝলেন মশাই, ওস্তাদের কথায় আমি যা বুঝলুম, বিশ্বের মানুষকে কোনোভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে খালি একটা যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে হবে। সেখানে কখনো দশানন আসবেন মারীচকে বোঝাতে, কখনো ম্যাকি বা স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আসবেন বোঝাতে গ্রেগরিকে। অথবা ঈশ্বর লেঠেলকে বুঝিয়েসুঝিয়ে জমিদার ও নায়েব মশাই চাইবেন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লাগাতে।
ছবিগুলো খুব চেনা চেনা লাগছে না? দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরী থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাদুড়িয়া, উত্তরপ্রদেশের মীরাট বা মুজফফরনগরের ঘটনাগুলো কিন্তু এই গেল দশ বছরেই ঘটেছে। গ্রেগরিকে দেখে মনে পড়ে যায় ইউক্রেনীয় চিত্রসংবাদিক পিয়েরে জাকারজেউস্কিকে অথবা মার্কিন সাংবাদিক ব্রেন্ট রিনউডকে। এঁরা তো চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বলি। আবার ধরুন এই ঈশ্বর লেঠেল বা নায়েব, জমিদার – এঁরাও আছেন এই জগতে। কেউ সিন্ডিকেট নামে, কেউ ব্লক সভাপতি নামে, আবার কেউ মন্ত্রী-আমলা-সরকার নামে।
অথচ এই মারীচ, গ্রেগরি বা ঈশ্বর লেঠেলরা কেউই কিন্তু লড়াই করতে চায় না। তারা প্রত্যেকে প্রতিবাদ করে, তারা জানায় তাদের কোনো প্রবৃত্তি নেই যুদ্ধে। আসলে তারা জানে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ইতিহাস সৃষ্টি করেন সাধারণ মানুষ, কিন্তু তা লেখা হয় শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার তিনটি লাইন মনে করিয়ে দেয়।
আমাদের ইতিহাস নেই
অথবা এমনই ইতিহাস
আমাদের চোখমুখ ঢাকা
আরো পড়ুন বিজন ভট্টাচার্য: জনতার শিল্পী, যাঁকে জনতা গ্রহণ করেনি
শেষ পর্ব
নাট্য সমালোচক: এই যে এত কথা শুনলেন, ভাল লাগল? লাগল না তো! কারই বা এত জ্ঞান, এত কচকচানি ভালো লাগে? এটুকু বলতে পারি, বিভিন্ন সময়ে এই নাটকটি বিভিন্ন গুণিজনের অভিনয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। তবে গত ১৯ নভেম্বর ২০২২ তারিখের মঞ্চায়ন ছিল একেবারে ভিন্ন। এক কথায় অসাধারণ। চেতনার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে অরুণবাবু তাঁর দুই সুযোগ্য পুত্রের সহযোগিতায় সেদিন এই উপস্থাপনা করলেন। বৃদ্ধ মানুষটি নিজে নেচে গেয়ে ভরিয়ে দিলেন মঞ্চ। দুটি বিশেষ গান এই নাটককে ঋদ্ধ করেছে। একটি গান বিখ্যাত ‘মেরিবাবার দায়’, অন্যটি সুপরিচিত ‘বন থেকে বেরোল টিয়ে’। একসময় এই ‘মেরিবাবা’ গেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন বিপ্লবকেতন চক্রবর্তী। এবার সুমন মুখোপাধ্যায়ের অসাধারণ গায়কী, গানের সুর ও সঙ্গতে কিছু পরিবর্তন গানটিকে আরও উত্তম করে তুলেছিল।

অরুণবাবু নিজে বলেছেন এই নাটক আর যেদিন অভিনয় করতে হবে না, সেদিন বুঝতে হবে আমরা এক বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে পেরেছি। দুর্ভাগ্যবশত সেই সময় এখনো আসেনি।
চেতনা দলের প্রাণ এই তিনজন ছাড়া সেদিন মঞ্চে ছিলেন কলকাতা নাট্যজগতের সব তাবড় তাবড় অভিনেতারা। মারীচকে ঘিরেই একজোট হয়েছিলেন তাঁরা। ওস্তাদ চরিত্রে দেবশঙ্কর হালদার, মারীচ চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী, দশানন চরিত্রে শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, ম্যাকি চরিত্রে বিপ্লব বন্দোপাধ্যায়, গ্রেগরি চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য, জমিদার চরিত্রে মেঘনাদ ভট্টাচার্য, ঈশ্বর লেঠেল চরিত্রে কৌশিক অধিকারী – কাকে ছেড়ে কার কথা বলি? সবশেষে ঋষি বাল্মীকি চরিত্রে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য ‘কমিক রিলিফ’ গোটা নাটকের প্রাণ হয়ে ওঠে।

আর দেরি করবেন না। কবে কোথায় মঞ্চস্থ হচ্ছে খোঁজ নিয়ে মারীচ সংবাদের পরবর্তী অভিনয়টা দেখেই ফেলুন।
– মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।