রিপোর্টের নাম: সারভাইভাল অফ দ্য রিচেস্ট। অক্সফ্যামের সেই রিপোর্টে উঠে এল বিশ্বজোড়া অসাম্যের করুণ চিত্র। ধনীদের আয়ের পাশাপাশি বাড়ছে দরিদ্র, ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। তারই মধ্যে বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দার ভ্রূকুটি। কর্পোরেট দানবদের অনুপ্রেরণায় পরিচালিত বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফের মত সংস্থাগুলোও মন্দার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য, বেকারত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে আর্থিক বৃদ্ধির হার। আর্থিক সমৃদ্ধির ক্ষীর খায় কর্পোরেট দানবরা, আর মন্দার ফল ভোগ করেন শ্রমজীবী মানুষ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এটাই দস্তুর। জিডিপি বৃদ্ধির হার, জাতীয় আয় বৃদ্ধির পরিসংখ্যান আমজনতার জীবনে কোনো সুদিনের বার্তা নিয়ে আসে না। অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলছে, ভারতে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা ৫০% মানুষ পেয়েছেন জাতীয় আয়ের মাত্র ১৩%। এই মন্দার মধ্যেও আন্তর্জাতিক কর্পোরেট সংস্থার আয় বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বদলে সম্পদ কমছে নিম্নবিত্ত আর গরিব মানুষের। উপর থেকে নিচে চুঁইয়ে পড়া আর্থিক সমৃদ্ধির তত্ত্বের ভাঁওতা আড়াল করা যাচ্ছে না।
অনেকের মতে, অসাম্যের ধারণা নাকি আপেক্ষিক। আর্থিক সমৃদ্ধি বাড়লে অসাম্য বাড়তে পারে। অর্থাৎ ধনী, দরিদ্রের থেকে বেশি লাভবান হলে অসাম্য বাড়ে। তার মানে এই নয়, যে দরিদ্র একেবারেই লাভবান হচ্ছেন না। ধরা যাক, সম্পদ বাড়ল ১০০ টাকা। এখন এই বাড়তি সম্পদের ৮৫ টাকাই পেল হাতেগোনা কিছু ধনী। আর্থিকভাবে একেবারে নিচে থাকা দরিদ্রের আয় বাড়ল মাত্র ২ টাকা। তাহলে অসাম্য বাড়লেও গরিবের একেবারে লাভ হচ্ছে না বলা যাবে না। এমন অপযুক্তি দিয়ে চূড়ান্ত অনৈতিক ব্যবস্থাকে নীতিসম্মত করা হয়। পণ্ডিতরা প্রশ্ন করেন না, হাতেগোনা ধনীদের সম্পদ বিপুল পরিমাণ বাড়ে কিসের বিনিময়ে? তাহলে তো এই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাকেই প্রশ্ন করতে হয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ধনীর সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের টিকে থাকাই অনিশ্চিত হয়ে পড়লে অবশ্য এই অপযুক্তি ধোপে টেকে না। অক্সফ্যামের রিপোর্টে সেই চিত্রই উঠে এল। এমন অসাম্যের পৃথিবী গড়ে উঠছে যেখানে ধনীরাই কেবল টিকে থাকতে পারবে। আর্থিক দুরবস্থায় ৯৯ শতাংশ মানুষের অস্তিত্বই বিপন্ন। যদিও শ্রমজীবী মানুষের সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ না করলে ধনীদের অস্তিত্বও বিপন্ন হতে বাধ্য। সে প্রসঙ্গে আসার আগে অক্সফ্যামের রিপোর্ট নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।
নতুন বছরে প্রকাশিত সারভাইভাল অফ দ্য রিচেস্ট নামের রিপোর্ট জানাচ্ছে, পঁচিশ বছরের মধ্যে প্রথম বিশ্বে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বাড়ছে পেটভরা পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা। বিনিময়ে ধনকুবেরদের সম্পত্তির পরিমাণ রেকর্ড হারে বাড়ছে। ২০২০ সাল থেকে বিশ্বে যত সম্পদ বেড়েছে তার দুই তৃতীয়াংশের মালিক মাত্র এক শতাংশ মানুষ। অতিমারিতে তাদের সম্পদ বিপুল পরিমাণ বেড়েছে। বিলিয়নেয়ারদের (যাদের সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার বা তার বেশি) প্রতিদিন গড়ে ২৭০ কোটি ডলার সম্পদ বাড়ছে। পাশাপাশি ৮০ হাজার কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত। দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধিতে কোটি কোটি মানুষের টিকে থাকাই দায়।
রিপোর্টে ভারতের অসাম্যের লজ্জাজনক চিত্রও উঠে এসেছে। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গরীব মানুষের বাস ভারতে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক, মানব উন্নয়ন সূচকে এই দেশের চিত্র প্রতিবেশী অনেক দেশের থেকেই খারাপ। রিপোর্ট জানাচ্ছে, আর্থিক দিক থেকে উপরে থাকা ১০ শতাংশ ধনী দেশের মোট সম্পদের ৭২ শতাংশের মালিক। দেশে যে পরিমাণ সম্পদ বেড়েছে, তার ৬২ শতাংশের মালিক এক শতাংশ ধনকুবের। অর্থাৎ আর্থিক বিকাশের ক্ষীরের সিংহভাগ খেয়েছে এই এক শতাংশ ধনকুবের। পাশাপাশি নিচে থাকা ৫০ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের মাত্র তিন শতাংশের মালিক। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে নিচের তলায় থাকা ৩০ শতাংশ মানুষ আক্ষরিক অর্থেই আজ রিক্ত। উন্নতি উপর থেকে নিচে চুঁইয়ে পড়ছে না। নিচের তলাকে রিক্ত করে সম্পদের পাহাড় গড়ছে মুষ্টিমেয় কর্পোরেট কর্তা।
রিপোর্টেও সেই তথ্য ধরা পড়েছে। ভারতের ৭০ শতাংশ মানুষ পেটভরা পুষ্টিকর খাবার পান না। অপুষ্টিজনিত রোগে এই দেশে প্রতি বছর ১৭ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যান। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, বেকারত্ব বাড়ছে। রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশের ৮৪ শতাংশ পরিবারের প্রকৃত আয় অতিমারীর বছরে (২০২০-২১) কমেছে। অথচ কর্পোরেট সংস্থাগুলির মুনাফা বেড়েছে ৭০ শতাংশ। অতিমারীর দুবছরে ভারতে বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ৬৪ জন বেড়ে হয়েছে ১৬৬। দেশে ১০০ জন ধনী ব্যক্তির মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৫৪ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। ভুললে হবে না, ২০২২-২৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে মোট বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ৪০ লক্ষ কোটি টাকারও কম। প্রধানমন্ত্রীর ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ নীতির হাতে গরম প্রমাণ। শুধুমাত্র আদানি কোম্পানির কর্ণধারের সম্পদ অতিমারীতে বেড়েছে আট গুণ। আর ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশে প্রতিদিন গড়ে ১১৫ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন।
আর্থিক অসাম্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জাতি ও লিঙ্গগত বৈষম্য। অক্সফ্যাম রিপোর্ট জানাচ্ছে, এ দেশে লিঙ্গ বৈষম্যের সঙ্গে আর্থিক অসাম্যের সম্পর্ক বেশি প্রকট। মহিলাপ্রধান পরিবারগুলোর দারিদ্র্যের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অবস্থাই সবচেয়ে করুণ। ভারতে প্রতি সাতটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার মহিলাপ্রধান। কর্মরত মহিলাদের মধ্যে মাত্র ১৯ শতাংশ নিয়মিত বেতন পান। পুরুষদের মধ্যে এই হার ৬০ শতাংশ। পুরুষ শ্রমিক এক টাকা রোজগার করলে, মহিলা শ্রমিক পান ৬৩ পয়সা। উচ্চবর্ণের শ্রমিক যত মজুরি পান, দলিতরা পান তার ৫৫ শতাংশ মজুরি। শহর ও গ্রামের মধ্যেও আয়ের বৈষম্য রয়েছে। গ্রামাঞ্চলের শ্রমিক শহরাঞ্চলের অর্ধেক আয় করেন। কয়েকদিন পরেই ঘটা করে দেশে প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হবে। দেশের সংবিধানে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। রাষ্ট্র সমানাধিকারের কথা বলেছে। কর্পোরেট দাসানুদাস সরকার আজ কেবল সংবিধানের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকেই বিপন্ন করছে না, গড়ে তুলছে চূড়ান্ত অসাম্যের দেশ।
অক্সফ্যাম অসাম্য কমাতে কর কাঠামোতে বড়সড় বদল আনার প্রস্তাব দিয়েছে। বলা হয়েছে, পরোক্ষ কর কমিয়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো প্রয়োজন। ধনকুবেরদের সম্পদের উপর কর বসালে অসাম্য অনেকখানি কমবে। বিশ্বের ধনকুবেরদের থেকে পাঁচ শতাংশ কর নিলে সেই অর্থে ২০০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করা যাবে, ক্ষুধার্ত মানুষের অন্নের ব্যবস্থা করা যাবে। দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নের নামে ধনকুবেরদেরই কর কমানো হয়েছে। একই চিত্র ভারতের। জিএসটি আদায় বৃদ্ধি দেখিয়ে সরকার আর্থিক বিকাশের দাবি করছে। জিএসটি আসলে কারা দিচ্ছেন? রিপোর্ট বলছে আদায় হওয়া জিএসটির ৬৪ শতাংশই দিয়েছেন নিচের তলার অর্ধেক মানুষ (অর্থাৎ যাঁরা মোট সম্পদের মধ্যে মাত্র তিন শতাংশের মালিক)। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে আমজনতার নাভিশ্বাস ওঠার বিনিময়ে সরকারের রাজস্ব বেড়েছে। অতিমারীর সময়েই সরকার পেট্রোপণ্যে আয় বাড়িয়েছে। ২০২০-২১ সালে পেট্রোপণ্যে অন্তঃশুল্ক আয় তার আগের বছরের থেকে ৭৯ শতাংশ বেড়েছিল। অথচ বিশ্ববাজারে তখন অপরিশোধিত তেলের দাম রেকর্ড হারে কমেছিল। অন্তঃশুল্কের হার বাড়িয়ে আমজনতার পকেট কেটেছে সরকার। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ আর্থিক বছরের মধ্যে পেট্রোলের অন্তঃশুল্ক বেড়েছে ১৯৪ শতাংশ। ডিজেলে বেড়েছে ৫১২ শতাংশ। অধিকাংশ রাজ্য সরকার ভ্যাট না কমিয়ে পেট্রোপণ্য থেকে আয় বাড়িয়েছে। জিএসটি বাড়লেও রাজ্য সরকারগুলোর আয় বাড়ে। এভাবেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে সরকার।
আরো পড়ুন ‘১৯৯১ থেকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পথ ত্যাগ করার ফল গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ১০১তম স্থান’
পাশাপাশি ধনকুবেরদের কর কমেছে। ২০২০-২১ আর্থিক বছরে কর্পোরেট কর আগের বছরের থেকে ১৮ শতাংশ কম আদায় হয়। আদায় হওয়া কর্পোরেট করের পরিমাণ ছিল ২০১৬-১৭ সালের থেকেও কম। অথচ সেই চার বছরে কর্পোরেট মুনাফা বহুগুণ বেড়েছে। কর্পোরেট কর কম আদায়ের কারণ অতিমারী নয়, সরকারের নীতি। ২০১৯ সালে কর্পোরেট কর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ শতাংশ করা হয়। নতুন কোম্পানির ক্ষেত্রে সেই হার ১৫ শতাংশ। কেন্দ্রের বাজেটেও এই কর ব্যবস্থার অনৈতিক দিক প্রমাণিত হয়। ২০২২-২৩ সালের বাজেটে সরকারের মোট আয়ের ৫৮ শতাংশ করের মাধ্যমে আসবে বলে ধরা হয়। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি জিএসটি থেকে (১৬ শতাংশ)। জিএসটিসহ বিভিন্ন পরোক্ষ কর কারা বেশি দেন? নিচের তলার ৫০ শতাংশ মানুষ। উপর তলায় থাকা ১০ শতাংশ মানুষের থেকে ছয় গুণ বেশি পরোক্ষ কর দেন তাঁরা। গরীব মানুষের খাবার জোটাতেই আয়ের বড় অংশ চলে যায়। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য উল্লেখ করে অক্সফ্যাম রিপোর্ট জানাচ্ছে, ভারতের আর্থিকভাবে নিচুতলায় থাকা ২৫ শতাংশ মানুষের খাবার জোটাতে আয়ের ৫৩ শতাংশ চলে যায়। আর খাবারের জন্য ২৫ শতাংশ ধনীর খরচ হয় আয়ের ১২ শতাংশেরও কম। খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পরিষেবায় খরচ কমাতে গরীব মানুষ বাধ্য। শিক্ষা, চিকিৎসার খরচ বাড়ছে আর কর্পোরেটদের কর কমছে। নানা আর্থিক সুযোগ দিয়ে তাদের ঘুরপথে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। ২০২০-২১ আর্থিক বছরে কর্পোরেটদের কর ছাড় ও নানা সুযোগ দিতে গিয়ে সরকারের এক লক্ষ কোটি টাকার বেশি রাজস্বের ক্ষতি হয়েছে।
ভারতীয় বিলিয়নেয়ারদের সম্পদের উপর তিন শতাংশ কর নিলেই জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের আগামী পাঁচ বছরের খরচ উঠে যাবে। তাদের থেকে দু শতাংশ কর নিলে সরকারের ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় হবে, যা দিয়ে দেশের অপুষ্ট মানুষদের তিন বছর পুষ্টিকর খাবার দেওয়া যাবে।
অক্সফ্যামের হিসাব, ভারতীয় বিলিয়নেয়ারদের সম্পদের উপর তিন শতাংশ কর নিলেই জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের আগামী পাঁচ বছরের খরচ উঠে যাবে। তাদের থেকে দু শতাংশ কর নিলে সরকারের ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় হবে, যা দিয়ে দেশের অপুষ্ট মানুষদের তিন বছর পুষ্টিকর খাবার দেওয়া যাবে। দেশের ধনীতম ১০ জনের থেকে চার শতাংশ সম্পদ কর নিলে শিক্ষায় প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করা যাবে। ধনকুবেরদের থেকে সম্পদ কর নিয়ে পরোক্ষ কর কমানোর মাধ্যমেই অসাম্য কমানো যাবে বলে অক্সফ্যামের মত।
চিন্তাটা নতুন নয়। অসাম্যের প্রেক্ষাপটে অনেকেই এখন আবার সেই নিদান দিচ্ছেন। আসলে কর নীতি রাষ্ট্রের আর্থিক নীতির থেকে আলাদা নয়। সেই নীতি আবার এখন দুনিয়ার কর্পোরেট দানব এবং বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফের মত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নয়া উদারনীতিতে গরীব, নিম্নবিত্তের জন্য ভর্তুকি কমিয়ে ঘুরপথে ধনকুবেরদের ভর্তুকি দেওয়াই দস্তুর। কর ছাড়, কর রেহাই, নানা আর্থিক সুযোগ দেওয়া, ব্যাঙ্কের অর্থ লুঠের ব্যবস্থা করে সেই ভর্তুকি দেওয়া হয়। বিনিয়োগ বৃদ্ধির অজুহাতে বিভিন্ন অঞ্চলে এবং শিল্পক্ষেত্রে নানা সুযোগ দেওয়া হয়। তাতে বিনিয়োগ বা প্রকৃত কর্মসংস্থান কত হয় তার হিসাব মেলে না। নতুন বিনিয়োগের বিনিময়ে কত মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছেন, জীবিকা হারাচ্ছেন তার হিসাবও করা হয় না। নয়া উদারনীতিতে বিকাশ মানে হচ্ছে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের বিনাশ। সামাজিক সম্পদকে কর্পোরেট সম্পদে পরিণত করতে পরিবেশ ধ্বংস করা, প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করা। কোটি কোটি মানুষ জীবিকা হারিয়ে যেখানে শস্তার শ্রমবাহিনীতে পরিণত হন। লিঙ্গ ও জাতিগত বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক অসাম্য আরও প্রকট হয়।
লগ্নি পুঁজি, ফাটকা কারবার, জুয়াচুরির মধ্য দিয়ে ক্রমে স্ফীত হয়। ঋণনির্ভর অর্থনীতি ভোগবাদী সংস্কৃতিকে পুষ্ট করার পাশাপাশি গরীব, নিম্নবিত্তকে দেনার জালে জড়ায়। ক্রয় ক্ষমতার বাইরে গিয়েও পণ্য কেনার সংস্কৃতি শেষ পর্যন্ত সংকট ডেকে আনে। ২০০৭-০৮ সালের বিশ্বব্যাপী মন্দা যার প্রমাণ। সেই সঙ্কট থেকে বাঁচতে বিষকেই ওষুধ মনে করা হচ্ছে। কর্পোরেট দুনিয়াকে আরও সুযোগ করে দিতে আমজনতার আর্থিক সঙ্কট বাড়ানো হচ্ছে। পরোক্ষ করই কেবল বাড়ছে না, কর্পোরেট দুনিয়াকে কর ফাঁকি দেওয়ার নানা বন্দোবস্ত করে দেওয়া হচ্ছে। যে দেশে ১০০ জন ধনকুবেরের সম্পদ সরকারের বাজেট বরাদ্দের থেকে বেশি, সে দেশে ধনকুবেররাই সব পরিচালনা করে। এই চিত্র বিশ্বব্যাপী। ২০২০ সালের একটি তথ্য অনুসারে দশটা বহুজাতিক কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ মাত্র দুটো দেশ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন) ছাড়া অন্যান্য দেশগুলোর জিডিপির চেয়ে বেশি। অর্থাৎ এই কোম্পানির মোট সম্পদকে জিডিপি ধরলে সেটা বিশ্বের তৃতীয় ধনী দেশ। বিপুল সম্পদের অধিকারী কর্পোরেট সংস্থাগুলোই আজ নীতি নির্ধারণ করছে। নির্বাচিত সরকার বশংবদ না হলে ক্ষমতাচ্যুত করা হচ্ছে। সংসদীয় গণতন্ত্রও আজ কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণাধীন, এদেশে নির্বাচনী বন্ড যার বড় প্রমাণ। কর্পোরেট আগ্রাসনের প্রতিরোধ হলেই রাষ্ট্র আজ হিংস্র। দেশের মানুষের করের অর্থে চলা রাষ্ট্রবাহিনী দেশবাসীকে সন্ত্রস্ত করছে।
অতিমারীতে রাষ্ট্রের সেই চরিত্র আরও স্পষ্ট হয়েছে। ২০২০ সালের ২৪ মার্চ লকডাউন চালু করার পর ২৬ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে। এক লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার সেই প্যাকেজে আর্থিক সঙ্কটে পড়া মানুষদের হাতে সরাসরি অর্থ দেওয়ার কোনো কথাই ছিল না। বেশিরভাগটাই ছিল বাজেটে বরাদ্দ অর্থ খরচের কথা। বাজেটের বাইরে নতুন খরচ ধরা হয় ৮৫ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যখাতে মাত্র ১৫ হাজার কোটি টাকা। তারপর মে মাসে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ২০ লক্ষ কোটি টাকার আরেকটা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। দিন কয়েক ধরে তা নিয়ে ভাষণও দেন। কিন্তু এই প্যাকেজেও সরকারি খরচ মাত্র ২ লক্ষ ১৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ দু দফায় মোট প্রায় ২২ লক্ষ কোটি টাকার ঘোষিত প্যাকেজের মধ্যে সরকারের খরচ মাত্র তিন লক্ষ দু হাজার কোটি টাকা। মন্ত্রীদের ভাষণবাজি, ভার্চুয়াল মিটিং আর যাতায়াতে বোধহয় এর চেয়ে বেশি টাকা খরচ হয়। এটা যদি হয় ভন্ডামি, তাহলে তার সঙ্গেই ছিল কর্পোরেট দালালির ব্যবস্থা। দ্বিতীয় প্যাকেজের সিংহভাগই ব্যাঙ্কের ঘাড়ে চাপানো হয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নগদের জোগান দেবে এবং ঋণের ব্যবস্থা করবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তহবিলে ভাগ বসানোর যে নীতি সরকার নিয়েছে এ তারই প্রতিফলন। চাহিদার অভাবে অর্থনীতি ধুঁকলে ঋণ দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না। ঋণ দিলেই বিনিয়োগ বাড়বে তার নিশ্চয়তা নেই। সরকারের প্যাকেজে প্রতিরক্ষা, রেল, বিদ্যুৎ, খনিসহ নানা ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের পথ আরও মসৃণ করা হল। অত্যাবশকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ, শ্রম, পরিবেশ সংক্রান্ত আইন ও বিধিগুলো শিথিল বা সংশোধন করে কর্পোরেট দখলদারি বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়। তারপর প্যাকেজ অনুসারেই একের পর এক রচিত হয় আইন সংশোধনের খসড়া।
দু দফায় মোট প্রায় ২২ লক্ষ কোটি টাকার ঘোষিত প্যাকেজের মধ্যে সরকারের খরচ মাত্র তিন লক্ষ দু হাজার কোটি টাকা। মন্ত্রীদের ভাষণবাজি, ভার্চুয়াল মিটিং আর যাতায়াতে বোধহয় এর চেয়ে বেশি টাকা খরচ হয়।
জানা ছিল সরকারের আঠারো মাসে বছর। কিন্তু পুঁজির দালালি করতে গিয়ে সরকার যে তিরিশ বছরের কাজ ছমাসে করে দিতে পারে অতিমারী না হলে সেটা জানা যেত না। ১৯৯১ সাল থেকে যে সংস্কার নামক সংহার পর্ব চলছে, তা লকডাউনের প্রথম ছমাস বহু যোজন এগিয়ে যায়।
কর কাঠামোর সংস্কার অসাম্য কিছুটা কমাতে পারে, কিন্তু দূর করতে পারে না। ন্যায়ও আনতে পারে না। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাটাই চূড়ান্ত অন্যায়, অমানবিক। সেখানে শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্যে ভাগ বসিয়ে মুনাফা হয়। শ্রমশক্তির দাম যত কম হবে, মুনাফা তত বাড়বে। জিডিপি বাড়লে আর্থিক বিকাশের কথা বলা হবে। তাকে আড়াল করতেই অসাম্য বৃদ্ধিকে আর্থিক সমৃদ্ধি বলা হয়। ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক সংকট এখনও কাটেনি, আরও ঘনীভূত হওয়ার পথে। সেই সংকটে এই উৎপাদন ব্যবস্থা বদলই অসাম্য দূর করার একমাত্র পথ।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।