চাতক পাখির ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের কোনো না কোনো সংবাদমাধ্যমে, সামান্য হলেও, লেখা হবে উপমহাদেশের সদ্যপ্রয়াত কিংবদন্তি জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে। বেশ কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পরেও সেরকম কোনো লেখালিখি অন্তত আমার চোখে পড়েনি। মাও সে তুং বলেছিলেন, কোনো কোনো মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারি। নিঃসন্দেহে জাফরুল্লাহর মৃত্যু পাহাড়ের মতই ভারি। ঘটনা হল, মাও পাহাড়ের উপমা টেনেছিলেন যাঁর মৃত্যুর পরে, তিনি প্রায় রূপকথার নায়ক – নর্মান বেথুন।

চীন বিপ্লবের কঠিন সময়ে ব্রিটিশ ডাক্তার বেথুন ছুটে গিয়েছিলেন গেরিলাদের পাশে। তারপরের ঘটনা তো ইতিহাস। প্রাণ বিপন্ন করে বেথুন জনগণের সেবা করতে করতেই মারা যান। ঠিক যেমনভাবে রণক্ষেত্রে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের স্বার্থে চিকিৎসা করতে করতে প্রাণ দেন আর এক মহানুভব, ভারতের ডাক্তার দ্বারকানাথ কোটনিস। এই দুজনের জীবন রূপকথার মতই বছরের পর বছর সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার স্বপ্ন দেখা বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করেছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

বলতে একটুও দ্বিধা নেই, ওই দুই রূপকথার সর্বত্যাগী ডাক্তারের পাশে নিশ্চিতভাবে জায়গা পাবেন জাফরুল্লাহ। কিন্তু কিন্তু করে হলেও বলব, কখনো কখনো মনে হয় জাফরুল্লাহর ভূমিকা বেথুন বা কোটনিসের চেয়েও কঠিন ছিল। বেথুন বা কোটনিস পাশে পেয়েছিলেন নিষ্ঠাবান কমিউনিস্টদের, আদর্শবাদী একটি দলকে। মাও সেতুং, চৌ এন লাইয়ের মত নেতাদের। জাফরুল্লাহর লড়াই ছিল একক যুদ্ধ

তিনি তখন ইংল্যান্ডে। এফআরসিএসের শেষ ধাপের ছাত্র, শৌখিন তরুণ। সাজসজ্জায় সদা ফিটফাট, আধুনিক। বিলাসবহুল জীবন তাঁকে আকর্ষণ করে। নিজের প্লেন চালাবার লাইসেন্স পেয়ে গেছেন। কিন্তু একটা যুদ্ধ, স্বদেশের মুক্তি সংগ্রাম রাতারাতি তাঁকে অন্য এক জাফরুল্লাহ করে দিল। সমাজতন্ত্রের উপর তাঁর দুর্বলতা অবশ্য দীর্ঘদিনের। ডাক্তারি পড়ার সময়েই সক্রিয় ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কাজে। মওলানা ভাসানীর প্রতি অনুরাগও অনেককালের।

সময়টাও তখন ছিল অন্যরকম। দেশে দেশে মুক্তির সংগ্রাম তুঙ্গে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার ত্রাস। সে সময়ের বিশ্ব পরিস্থিতি আর পূর্ববাংলার মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ছবি যে এক ছিল না, এটা ব্যাখ্যা করার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হওয়ার দরকার পড়ে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সমাজতান্ত্রিক শিবির দ্বিধাবিভক্ত। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আহ্বান থাকলেও তা সমাজতান্ত্রিক হবে এরকম সম্ভাবনা দূর অস্ত। তবুও পাকিস্তানের বিপক্ষে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় বাঙালি তখন উদ্বেল। শেখ মুজিবুর রহমান জেলে। ভাসানী ভারতে প্রায় নজরবন্দী। অস্থায়ী সরকারের প্রধান তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্ব আপাতদৃষ্টিতে কণ্টকহীন মনে হলেও ওয়াকিবহাল মহল জানে যে বাস্তবে তা ছিল না। তবুও অকুতোভয় বাঙালী সেদিন প্রাণ তুচ্ছ করে স্বাধীনতার জন্য পথে নেমেছিলেন। বাংলা মায়ের দামাল সন্তানদের আবেগ স্পর্শ করেছিল দুনিয়ার সমস্ত মুক্তিকামী মানুষকে। দেশে দেশে জনমত গড়ে উঠতে লাগল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।

পুরনো সমাজবাদী জাফরুল্লাহকে ফিরিয়ে আনল মুক্তিযুদ্ধ। বিলাতি ঠাটবাট ভুলে তিনি সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়লেন মানবতার লড়াইয়ে। ছিঁড়ে ফেলে দিলেন পাকিস্তানি পাসপোর্ট। ট্র্যাভেল ভিসা নিয়ে প্লেনে চড়ে পাড়ি দিলেন স্বদেশের পথে। দামাস্কাসে প্লেন থামলে পাকিস্তানের সেনা ঘিরে ফেলল বিমান। যাত্রীরা সবাই একে একে নেমে গেলেন, জাফরুল্লাহ ও তাঁর এক বন্ধু তখনো প্লেনের ভিতরে। পাকিস্তান দাবি করল এই দুজনকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্লেনে উঠে বিনা অনুমতিতে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না। বিমানের আধিকারিকরা সাফ জানিয়ে দিলেন, ওই দুজনের কাছে পাকিস্তানের পাসপোর্ট নেই। ফলে তাঁরা যে পাক নাগরিক তা প্রমাণ করা যাবে না।

আজ যখন চারদিকে পুঁজির ঝলকানি, তখন অবাক হয়ে ভাবি, দেশের প্রতি কতটা টান থাকলে একজন তরুণ ঝকঝকে কেরিয়ারের হাতছানি উপেক্ষা করে এমন অনির্দিষ্ট জীবনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন।

বাংলাদেশ জন্ম নিল। নতুন সরকারের দেশ গড়ার ডাকে সাড়া দিয়ে জাফরুল্লাহ সাভারে গড়ে তুললেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। নামটি পছন্দ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কত মানুষকে কম পয়সায় সুস্থ করে তুলেছে তা বলে শেষ করা যাবে না। আমি সাভারে জাফরুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়েও গিয়েছি। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ, সুযোগ থাকতেও কখনো নিজের চিকিৎসা করাতে বিদেশে যাননি। বলতেন, আমার নিজেরই যদি নিজেদের হাসপাতাল নিয়ে অনাস্থা থাকে, তাহলে আমি কীভাবে লোককে এখানে আসতে বলব? জাফরুল্লাহ কর্পোরেট পুঁজির ওষুধ নীতির তীব্র বিরোধী ছিলেন। গণস্বাস্থ্যে তাঁর মস্ত অবদান বহুজাতিক কোম্পানির ওষুধ নীতির বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

অদ্ভুত বর্ণময় চরিত্র ছিল তাঁর। জীবনে আওয়ামী লীগ করেননি। মৃত্যুর দুদিন আগে প্রকাশ্যে বলে দিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীজ পুঁতেছিলেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী। অথচ বঙ্গবন্ধু বলতেও তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন। বলতেন মুজিব ভাইয়ের মতো অমন বড় দিল খুব কম লোকের থাকে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে ছিল সুসম্পর্ক। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার কুর্সিতে বসেই জাফরুল্লাহর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। জাফরুল্লাহ পরামর্শ দিয়েছিলেন, আপনি দেওয়ালে বঙ্গবন্ধুর পাশে মওলানা ভাসানীর ছবি রাখুন। তাঁদের ঠিক নিচে রাখুন জেনারেল ওসমানী ও মেজর জিয়াউর রহমানের ফটো।

আরো পড়ুন মওলানা ভাসানী: জনগণের পবিত্র হিংসার প্রফেট

বোঝাই যায়, আজকের রাজনীতিতে ইউটোপিয়ার কোনো জায়গা নেই। ফলে তিনি না হলেন বিএনপি, না বাংলাদেশের সরকারের পক্ষের লোক। কিন্তু এটা নিশ্চিত, জাফরুল্লাহর মৃত্যু একটা যুগের সমাপ্তি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের দুর্ভাগ্য, তাদের সেভাবে পরিচয়ই হল না বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক বীর সেনানীর সঙ্গে, যিনি শুধু মানবপ্রেমিক ডাক্তার ছিলেন না, ছিলেন সমাজতন্ত্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত একজন স্বপ্নসন্ধানী।

– মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.