বাংলায় একটা প্রবাদ আছে – বিপদ কখনো একলা আসে না। এর দোসর আরও একটা প্রবাদ আছে – গোদের উপর বিষফোঁড়া। করোনা পরবর্তী পৃথিবী এই কথাটা থেকে থেকেই উপলব্ধি করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দরুন জ্বালানি সংকট ও তীব্র মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি নাতিশীতোষ্ণ ইউরোপ দেখেছে অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ। অন্যদিকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টিতে বন্যা কবলিত হয়ে পড়ছে পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মত চরম জলবায়ুর দেশগুলো, যাদের অর্থনৈতিক সংকট এমনিতেই চরমে।

জুন মাস থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টির জেরে বন্যায় ডুবে গিয়েছে পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অংশ, মারা গিয়েছেন হাজারের বেশি মানুষ। তার মধ্যে একশোরও বেশি মারা গিয়েছেন চলতি সপ্তাহেই। ধ্বস এবং হড়পা বানে ধ্বংস হয়েছে দশ লক্ষের মত বাড়ি, গ্রামকে গ্রাম ভেসে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ। অর্থাৎ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার নিরিখে গড়ে সাতজনে একজন। বৃষ্টি আপাতত বন্ধ হলেও ইতিমধ্যেই সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার রাস্তা ধ্বংস হয়েছে, ধ্বসে পড়েছে দেড়শোর বেশি সেতু। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ-পশ্চিমের বালুচিস্তান অঞ্চল। উত্তরের সোয়াট উপত্যকা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দক্ষিণে বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশ আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। সিন্ধের দক্ষিণে উঁচু রাস্তা এবং রেললাইনের উপর আশ্রয় নিয়েছেন বহু মানুষ। দুই কিলোমিটারব্যাপী অস্থায়ী তাঁবুও খাটানো হয়েছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কলেরা, ডায়রিয়া ইত্যাদি জলবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবের আশংকা প্রকাশ করেছে। দেড়শো মিলিয়ন ডলার সহায়তার আশ্বাসও দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের সরকারি হিসাবেই এই বন্যার দরুন সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দশ বিলিয়ন ডলার। সাম্প্রতিককালে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের কাছেও সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে পাকিস্তান সরকারের বিদেশমন্ত্রক। পাকিস্তান দেশটার অর্ধেকের কাছাকাছি এই মুহূর্তে জলের তলায়। পাশাপাশি আফগানিস্তানেও গত তিন-চার মাসের মধ্যে একাধিক হড়পা বানে প্লাবিত হয়েছে ছ লক্ষ একর জমি, প্রাণ হারিয়েছেন বারোশোর বেশি মানুষ।

বিশ্ব জলবায়ু বিপন্নতা সূচক (গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স) অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটে গড়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দশটি দেশের মধ্যে যথাক্রমে সপ্তম ও অষ্টম স্থানে আছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। দ্বিতীয় স্থানে মায়ানমার এবং নবম ও দশম স্থানে যথাক্রমে থাইল্যান্ড ও নেপাল। এছাড়া রয়েছে পুয়ের্তো রিকো, মোজাম্বিক, ফিলিপিন্স, হাইতির মতো ছোট ছোট দেশগুলো। এই সূচকের মান দুটো জিনিসের উপর নির্ভর করে। জলবায়ুজনিত দুর্যোগ একটা দেশে কতটা আকছার ঘটে এবং কী ব্যাপ্তিতে, আর দুর্যোগ সামাল দেওয়ার ক্ষমতাই বা কতটা? বাংলাদেশে বন্যা বাৎসরিক ব্যাপার। পাকিস্তান ইতিপূর্বে ভয়ঙ্কর বন্যা দেখেছে বারো বছর আগে। জলবায়ু বিপন্নতার এই দীর্ঘকালীন তালিকার প্রথম দশে নাম না থাকলেও, তালিকায় প্রথম দশ-বিশের মধ্যেই থাকে ভারত এবং শ্রীলঙ্কাও। জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোর অবদান প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর তুলনায় যৎসামান্য, কিন্তু তার ফলাফল এই দেশগুলোতে সবচেয়ে প্রবল। এর একটা কারণ ক্রান্তীয় জলবায়ুর সহজাত দুর্যোগপ্রবণতা। আরেকটা কারণ অবশ্যই দারিদ্র্য, জনঘনত্ব এবং উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব। একদিকে বেআইনি নির্মাণের কারণে এখানকার শহরাঞ্চলের নিকাশি ব্যবস্থা বেহাল। অন্যদিকে সংরক্ষণের অভাবে প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর জলধারণ ক্ষমতা এবং নদীর বহন ক্ষমতা কমে যাওয়ার জন্য বিস্তীর্ণ উপত্যকাগুলোও সহজে প্লাবিত হয়। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশের সিলেট এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়ে ভয়ংকর বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল একইরকম কারণে। মেঘালয়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে সেই জল সিলেট উপত্যকায় নেমে আটকে যায় উপযুক্ত প্রাকৃতিক নিকাশি ব্যবস্থার অভাবে।

২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে তাসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক দেখান যে তাপপ্রবাহের প্রভাব নিয়ে গবেষণায় সেই অঞ্চলগুলোই তুলনামূলকভাবে উপেক্ষিত থেকে যায়, যেখানে তাপপ্রবাহজনিত ক্ষয়ক্ষতির আশংকা সবচেয়ে বেশি। এর প্রধান কারণ উপযুক্ত তথ্য ও পরিসংখ্যানের অভাব। একই পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির ভার প্রথম বিশ্বের একটা উন্নত দেশের তুলনায় একটা ছোট এবং দরিদ্র দেশের পক্ষে অনেক বেশি এবং সুদূরপ্রসারীও।

পাকিস্তান
বন্যার ফলে পাকিস্তানে এক ১০০ কিলোমিটার বিস্তৃত প্রাকৃতিক লেক তৈরি হয়েছে, যা এখন উপগ্রহ চিত্রেও ধরা পড়ছে। ছবি সাউথ এশিয়া ইনডেক্সের টুইটার হ্যান্ডেল থেকে

অস্থায়ী এবং শস্তার নির্মাণ সহজে ভেঙে পড়ে প্রাণহানি হয়, বহু মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন, আশু ফসল নষ্টের পরেও বন্যার ফলে চাষের জমি দীর্ঘকালের জন্য অনাবাদী হয়ে পড়ে, গবাদি পশু মারা যায় এবং নানারকম রোগের শিকার হয়। যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ক্ষতিও দীর্ঘকালীন। কাজেই আর্থিক ক্ষতি বাদ দিয়ে মৃত্যু এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তিও অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনেক বেশি। বিশেষত দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো ভীষণভাবেই আন্তর্জাতিক সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে আপৎকালীন সাহায্যের মোট আবেদনের মাত্র ৫৪% মঞ্জুর করা সম্ভব হয়েছিল। উন্নত দেশগুলোর মিলিতভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু সংক্রান্ত বিপর্যয় মোকাবিলা বাবদ দেয় অনুদানের পরিমাণ ২০২০ সালের মধ্যে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ২০০৯ সালে, কোপেনহেগেন সম্মেলনে। কিন্তু বাস্তবে ২০২০ সালে এই অনুদানের পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ৮০ বিলিয়ন ডলার। ভৌগোলিক বন্টনের হিসাবে এর মাত্র ৮% পৌঁছয় নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে, ৬৯ শতাংশ যায় মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। আবার সেই অর্থেরও সিংহভাগ খরচ হয় বিপর্যয়জনিত ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে। সামান্য অংশই বিপর্যয়ের সম্ভাবনার প্রস্তুতিতে ব্যয় হয়, ফলে দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের পথে খুব একটা এগোনো যায় না। জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ ২০৩০ সাল নাগাদ বেড়ে দাঁড়াবে ৩০০ বিলিয়ন ডলার।

আরো পড়ুন যুদ্ধ মানে কেবল জীবনহানি নয়, পরিবেশ ধ্বংসও

উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ না করলে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিক থেকেও সহায়তার সম্ভাবনা কমে। ঠিক যেরকম জুলাই মাসে আফ্রিকার কঙ্গো উপত্যকায় বিস্তীর্ণ ক্রান্তীয় অরণ্য তেল উত্তোলনের জন্য নিলামে চড়ায় কঙ্গোর সরকার। তাদের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ না করলে নিজের দেশের আর্থিক উন্নয়নের জন্য তারাও তাদের দেশের আভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক সম্পদ ইচ্ছামত ব্যবহার করবে। ক্রান্তীয় অরণ্যগুলোর নীচে আটক কার্বনের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। কঙ্গো উপত্যকায় খননের ফলে ৫.৮ বিলিয়ন টন কার্বন বাতাসে মেশার সম্ভাবনা আছে, যা স্থানীয় এবং বিশ্ব জলবায়ু – উভয়ের পক্ষেই অত্যন্ত বিপজ্জনক। সুদূর দক্ষিণ প্রাচ্য, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার বিস্তীর্ণ ক্রান্তীয় অরণ্য অঞ্চল পৃথিবীর ফুসফুসের মতো কাজ করে। অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে থাকা আমেরিকা বা চীন থেকে যে কার্বন বায়ুমণ্ডলে মিশছে তা শুষে নেওয়ার জন্যও তাই প্রয়োজন দক্ষিণ গোলার্ধের গরীব দেশগুলোকে। প্রথম বিশ্বের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় তাই দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্বের হক আছে, নিছক প্রত্যাশা নয়।

আবার কঙ্গোর দৃষ্টান্ত অত্যন্ত বিপজ্জনক, কেন না উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করছে না – এই যুক্তিতে নিজের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করা আদতেই নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ। পাকিস্তান যতটা কার্বন নির্গমন করে, তা বিশ্বের মোট কার্বন নির্গমনের এক শতাংশেরও কম। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপে পাকিস্তানের মানবসম্পদ ও অর্থনীতি যে অনুপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হল তা সামান্য নয়। উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে সহায়তার দাবি আরও জোরদার করে তোলার পাশাপাশি এই আভ্যন্তরীণ বাস্তবতাও মাথায় রাখা প্রত্যেক উন্নয়নশীল দেশের পক্ষেই ভাল।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।