১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় থেকেই বিরামহীন ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে অশান্ত যাত্রা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির। বিচিত্র অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগে চলেছে জন্মলগ্ন থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি এযাবৎকালের অন্যতম কঠিন ও জটিল আর্থিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার মধ্যে পড়েছে। শাসকশ্রেণির দুর্নীতি, ঘনিষ্ঠ মাফিয়াযোগ ও স্বজনপোষণের কারণে মহম্মদ আলি জিন্নার প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ, সহিষ্ণু ও গণতান্ত্রিক সমাজের ভাবনা অধরাই থেকে গেছে এবং সম্ভাবনাও অনাচারের নিঃশঙ্ক দৌরাত্ম্যের পদতলে পিষ্ট হয়েছে। সুতরাং পাকিস্তানের আজকের আর্থিক সঙ্কটকে বুঝতে গেলে এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি বোঝা জরুরি।
ক্ষমতা থেকে ইমরান খানের অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সংসদের (নিম্নকক্ষ) প্রায় অর্ধেক সদস্যের পদত্যাগ, অন্যদিকে চারটি প্রাদেশিক সংসদের মধ্যে দুটি (পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনওয়া) নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়ের (যা এবছরের অক্টোবরে হওয়ার কথা ছিল) বৎসরাধিককাল পূর্বেই ভেঙে পড়া দেশটির সামগ্রিক পরিস্থিতিকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে। যখন ইমরান খান এবং শাহবাজ শরীফ নির্বাচনী তর্জার চূড়ান্ত উত্তাপে পরস্পরকে তুলোধোনা করছেন তখন বিশেষজ্ঞরা ক্রমশ সাবধানবাণী শোনাচ্ছেন, যে এই রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তাহানির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে। মূলধারার কোনো রাজনৈতিক প্রার্থীই পাকিস্তানের চরম দুর্নীতিগ্রস্ত পরিস্থিতির কোনো বিকল্প প্রস্তাব বাস্তবায়নের রাস্তা দেখাননি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ঋণখেলাপির সঙ্কট
রাজনৈতিক সঙ্কটের সঙ্গে সঙ্গেই ঘনীভূত হয়েছে অর্থনৈতিক সঙ্কট। দোদুল্যমান ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে যুঝতে যুঝতে সাধারণ মানুষ ক্লান্ত, বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার তলানিতে, মূল্যবৃদ্ধি গগনস্পর্শী। ফলে দেশজুড়ে অশান্তি। অদূরে নির্বাচন, তাই উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তাও চরমে। প্রশাসনকে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে অসামরিক শাসন সম্বন্ধে প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হচ্ছে, কারণ পাকিস্তানের ইতিহাস বারবার এইরকম টালমাটাল পরিস্থিতিতে সামরিক শাসনের দিকে বাঁক নিয়েছে। মানবিক বিপর্যয়ের একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তান। ঠিক যেমনটা ২০২২ সালে আমরা শ্রীলঙ্কায় দেখেছি। সুবিখ্যাত ডন পত্রিকা লিখছে “পাকিস্তানে এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্যের বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে শহর এলাকায় ৪১.৯% ও গ্রামীণ এলাকায় ৪৭%। গতবছর ফেব্রুয়ারি মাসে এই বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৪.৩% এবং ১৪.৬%। অর্থাৎ খাদ্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এক বছরে তিনগুণ।”
এবছর এপ্রিল মাসে পাকিস্তান জানায় তার বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার চার বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি, যা একমাসের আমদানি বিল মেটানোর জন্যও পর্যাপ্ত নয়। এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের বোঝা দেশের উপর মারাত্মক চাপ তৈরি করেছে। এপ্রিল ২০২৩ থেকে জুন ২০২৬-এর মধ্যে পরিশোধযোগ্য ঋণের পরিমাণ ৭৭.৫ বিলিয়ন ডলার। একটি ৩৭৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির উপরে এই চাপ অবর্ণনীয়। আগামী তিনবছরে পাকিস্তানের বৃহত্তম ঋণ পরিশোধ ক্ষেত্র হল চীনা আর্থিক সংস্থাগুলো, বেসরকারি ঋণদানকারী সংস্থা এবং সৌদি আরব। ডিসেম্বর ২০০২ অবধি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ১২৬ বিলিয়ন ডলার। এই ঋণের ৭৭%, অর্থাৎ ৯৭.৫ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তান সরকার সরাসরি বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের থেকে গ্রহণ করেছে। অতিরিক্ত ৭.৯ বিলিয়ন ডলার সরকারনিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলির কাছে ঋণ।
স্টেট ব্যাঙ্ক অফ পাকিস্তান ১৭ মে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পাকিস্তান মার্চ ও এপ্রিল – এই দুমাস কারেন্ট অ্যাকাউন্ট উদ্বৃত্ত দেখিয়েছে। চলতি আর্থিক বছরে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স ৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গতবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৬% বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই ঘাটতি কমেছে আমদানি ১৩.৫ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পাওয়ার ফলে। এ হল ২০২২ সালে বিলাসদ্রব্য এবং অনত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞার সরাসরি ফল। আপাতভাবে উৎসাহব্যঞ্জক মনে হলেও কারেন্ট অ্যাকাউন্টের এই তুলনামূলক সুবিধাজনক পরিস্থিতি আসলে অর্থনীতির পক্ষে ক্ষতিকর।
কাঁচামাল আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞার প্রাথমিক প্রভাব পড়ল উৎপাদন ক্ষেত্রে, যা ২০২২ সালের মোট জাতীয় উৎপাদনের ১৯% ছিল। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রকের এপ্রিল মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই ২০২২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এর মধ্যে বৃহৎ উৎপাদন ক্ষেত্র ৫.৫৬% হ্রাস পেয়েছে। তার আগের বছরে ঠিক ওই সময়ে যা ৭.৮% বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাক মার্কিন অর্থনীতিবিদ আতিফ রহমান মিঞার মতে উৎপাদন ও রফতানির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের আমদানির উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা দেশে উৎপাদনের ঘাটতি তৈরি করবে এবং নিম্নমুখী জিডিপি ঋণশোধের ক্ষেত্রে আরও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। পাকিস্তানি মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও দুর্দশা আরও ঘনিয়ে তুলবে।
প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানি মুদ্রার অবমূল্যায়ন শিল্পমূল্যের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ঘটাতে পারে, একইসঙ্গে কমিয়ে দিতে পারে উৎপাদন ক্ষমতার সদ্ব্যবহার। বাস্তবে মার্কিন ডলারের নিরিখে পাকিস্তানি মুদ্রার দাম কমেই চলেছে গত কয়েক বছরে।
ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের বেল আউট
এই পরিস্থিতিতে যথারীতি ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ) রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ১২ জুলাই ২০২৩ আইএমএফ এক্সিকিউটিভ বোর্ড পাকিস্তানের জন্য একটি ন মাসের স্ট্যান্ডবাই অ্যারেঞ্জমেন্ট হাজির করে, যার পরিমাণ ২,২৫০ মিলিয়ন এসডিআর (৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা কোটার ১১১%)। সরকারের অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থার জন্য গৃহীত কর্মসূচিকে সাহায্য করতেই এই বন্দোবস্ত।
চুক্তি অনুসারে ৮৯৪ মিলিয়ন এসডিআর (১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) জরুরি ভিত্তিতে এবং বাকি টাকা দুটি ত্রৈমাসিক মূল্যায়নের নিরিখে কিস্তিতে কিস্তিতে কর্মসূচির মেয়াদ জুড়ে প্রদান করা হবে। এক্সিকিউটিভ বোর্ডের আলোচনার ভিত্তিতে আইএমএফের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা জানিয়েছেন “Pakistan’s economy was hit hard by significant shocks last year, notably the spillovers from the severe impacts of floods, the large volatility in commodity prices, and the tightening of external and domestic financing conditions. These factors together with uneven policy implementation under the EFF combined to halt the post-pandemic recovery, sharply increase inflation, and significantly depleted internal and external buffers. The authorities’ new StandBy Arrangement, implemented faithfully, offers Pakistan an opportunity to regain macroeconomic stability and address these imbalances through consistent policy implementation”.
উৎসাহী প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ জানিয়েছেন যে এই বেল আউট প্রক্রিয়া পাকিস্তানের অর্থনীতিকে মন্দার হাত থেকে রক্ষা করবে। এটা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে আশু থেকে মাঝারি চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে এবং পরবর্তী সরকারকে কোষাগার সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার রাস্তা দেখাবে।
Alhamdulillah, I am pleased to announce that Pakistan has reached a Staff-Level Agreement with the IMF on a nine-month US$3 billion Stand-By Arrangement. This Arrangement will help strengthen Pakistan’s foreign exchange reserves, enable Pakistan to achieve economic stability, and…
— Shehbaz Sharif (@CMShehbaz) June 30, 2023
দেশের অর্থমন্ত্রী ঈশাক দার মনে করেন এবার সব ঠিক দিকে এগোচ্ছে।
লাহোরের অর্থনীতিবিদ আলি খিজিরের মত হল “সরকার ও আইএমএফ এই চুক্তি করতে না পারলে মুদ্রা এবং মুদ্রাস্ফীতি সরকারের হাতের বাইরে চলে যেত।” তিনি আরও বলেন “বৈদেশিক মুদ্রার অভাব, জ্বালানি, খাদ্য, ওষুধ ও পণ্যদ্রব্যের ব্যাপক অভাব ঘটাতে পারত। এখন অবস্থা উন্নতির দিকে যাবে, কারণ মুদ্রার স্থিতিশীলতা আসবে এবং ধীরে ধীরে মুদ্রাস্ফীতির হার হ্রাস পাবে।”
অন্য মত
তবে দেশে বা আন্তর্জাতিক স্তরে সকলেই যে উৎসাহের এই জোয়ারের অংশীদার এমনটা মোটেই নয়। CADTM পাকিস্তানের সদস্য আব্দুল খালিকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এই সাম্প্রতিক আর্থিক স্বস্তি এবং কট্টরপন্থী দেশগুলোর উপর নির্ভরতা পাকিস্তানের আর্থিক স্থিতাবস্থার জন্য জরুরি রাজনৈতিক সংস্কারগুলো করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। তিনি আরও বলেন “পাকিস্তান আইএমএফের সঙ্গে বেল আউট চুক্তি করতে মরিয়া। কিন্তু সঙ্কটমোচনের জন্য এটা সঠিক রাস্তা নয়। আইএমএফ যে নীতিগুলোর ভিত্তিতে ফান্ডিং করে তা পাকিস্তানের খাদ্য ও শক্তির ক্ষেত্রে নির্ভরতা ও অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুলবে, অসাম্য বাড়বে এবং কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থার প্রবণতা নতুন করে বৃদ্ধি পাবে। এই আর্থিক পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র রাস্তা হল একটি বিস্তৃত ঋণ মকুব এবং তার সাথে সংসদীয় ঋণ নিরীক্ষণ কমিশন তৈরি করা।”
এ প্রসঙ্গে লক্ষণীয়, পাকিস্তানের জন্মের ১১ বছর পর, ১৯৫৮ সাল থেকে, আইএমএফের সঙ্গে ওই দেশের ২২টা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সাতের দশকে তেলের দাম বৃদ্ধির সময় থেকেই দেশটা ঋণের ভারে ভারাক্রান্ত। তখন থেকেই সাধারণ মানুষ ব্যাপক বৈদেশিক ঋণের কুফল ভোগ করছেন। ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী সরকারগুলো বিপত্তারণ হিসাবে আইএমএফের কাছে হাত পেতেছে। এই বেল আউট বাবদ ঋণগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাহিত হয়ে পাকিস্তানের আইএমএফের আর্থিক নীতি বাস্তবায়নের লীলাভূমিতে পরিণত হওয়া সুনিশ্চিত করেছে। পশ্চিমী দেশগুলোর দ্বারা সমর্থিত সামরিক শাসন কায়েম করতেও এই ঋণ আর অনুদান ব্যবহৃত হয়েছে। জিয়া উল হক (১৯৭৭-৮৮) বা পারভেজ মুশারফের (১৯৯৯ – ২০০৮) শাসন তার উদাহরণ। পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের একটা বড় অংশ ‘odious debt’, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
ডেট জাস্টিস সংস্থার টেস উলফেন্ডেনের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। “আইএমএফের ক্রমাগত পূর্বতন ঋণগ্রহীতাদের বেল আউটের কৌশল একেবারে ভ্রান্ত। ফলে পাকিস্তানের মানুষের উপর চেপে বসছে কঠোর ব্যয়সঙ্কোচের দায়। দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা এই দুর্দশা আরও ঘনীভূত হয়েছে ধনীদের তৈরি জলবায়ু সঙ্কটে। যেমন ২০২২ সালের প্রবল বন্যা জলবায়ু সঙ্কটেরই ফল। এসবের পরিবর্তে পাকিস্তানের প্রয়োজন ঋণ বাতিল এবং অনুদানভিত্তিক তহবিল গঠন যা দেশটিকে জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে।”
আগামী নমাসে তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার পর পাকিস্তান আইএমএফের চতুর্থ বৃহত্তম ঋণ গ্রহণকারী দেশে পরিণত হবে। নজিরবিহীন আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকা দেশটা গত আর্থিক বছরে এই তালিকায় পাঁচ নম্বরে ছিল। পাকিস্তানের ঋণের একটা বড় অংশ বহুজাতিক অর্থলগ্নি সংস্থাগুলোর কাছে (প্রায় ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এরপর আছে বিশ্বব্যাঙ্ক (১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) এবং আইএমএফ (৭.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কের থেকেও পাকিস্তান ভালরকম ঋণ নিয়েছে।
পাকিস্তানের কিষাণ রাবিতা কমিটির (২৬ কৃষক সংগঠনের সম্মিলিত নেটওয়ার্ক) সাধারণ সম্পাদক ফারুক তারিখ মনে করেন পাকিস্তান সরকার আপাতত বাঁচার রাস্তা বার করলেও দেশের মানুষের বাঁচার কোন রাস্তা খোঁজেনি। তাঁর মতে “পাকিস্তানের উপর আইএমএফের চাপানো শর্তাবলী আন্তর্জাতিক স্তরে নজিরবিহীন। দেশের শাসকশ্রেণির উপর প্রবল চাপ তৈরি করেছে এই সংস্থা এবং তাদের প্রতিটি শর্ত মানতে বাধ্য করেছে। ভূ-রাজনীতিও এই খেলায় বড় ভূমিকা পালন করছে। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় আর্থিক সহযোগী চীন পাক-চীন অর্থনৈতিক করিডোরে প্রতিশ্রুত ৬০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২৫ বিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যেই প্রাথমিকভাবে লগ্নি করেছে ঋণের আকারে। আইএমএফ ভীত যে পাকিস্তান তাদের ঋণ চিনের দেনা মেটাতে ব্যবহার করতে পারে।”
জুন থেকে অক্টোবর ২০২২ ভয়ানক বন্যার ফলে ২০০ মিলিয়ন জনসংখ্যার পাকিস্তান এখনো ক্ষতবিক্ষত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হওয়া এই বন্যায় আনুমানিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের ধ্বংস ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। লক্ষ লক্ষ বাড়ি, কৃষি খামার ধ্বস্ত হয়েছে। নিদারুণ অর্থকষ্টে ভুগতে থাকা দেশটা এই ধাক্কায় ঋণখেলাপির দায়ে পড়েছে।
পাকিস্তানের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া থেকে বোঝা যাবে জলবায়ু সঙ্কট থেকে কীভাবে এমন দুর্বল দেশগুলো বাঁচবে, যারা হয়ত সারা পৃথিবীর গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের অতি সামান্য অংশের জন্য দায়ী। এটাও লক্ষণীয় যে দূষণ সৃষ্টিকারী ধনী দেশগুলো কীভাবে এবং কতটা এই পুনর্গঠনে সহায়তা করে।
আরো পড়ুন বন্যার গ্রাসে পাকিস্তান: উন্নয়নশীল দেশের চিন্তার কারণ
ফারুক তারিখ আরও বলেছেন “গতবছরের বিধ্বংসী বন্যায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হওয়ার পরেও আইএমএফের কঠোর শর্তাবলী কোন সহানুভুতিপূর্ণ শৈথিল্য ব্যতিরেকেই প্রযুক্ত হয়েছে। সরকার বন্যাদুর্গতদের যথাযথ পুনর্বাসন দিতে পারেনি। চার মিলিয়ন মানুষ এখনো রাস্তার ধারে ক্যাম্পে বাস করছেন। এখনো পাকিস্তানকে COP27-এর লস ও ড্যামেজ চুক্তির আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি পালিত হয়নি।”
আইএমএফের সঙ্গে চুক্তির কারণে বিদ্যুতের মূল্য অনেকখানি বেড়েছে। শোনা যাচ্ছে আইএমএফের নির্দেশেই গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে পাকিস্তানের আর্থিক নীতি কঠোর হওয়া আবশ্যক। বলা বাহুল্য, সুদের হার বৃদ্ধিকে আইএমএফ স্বাগত জানিয়েছে। তাদের সুপারিশ হল পাকিস্তান যেন বিদ্যুৎ শিল্পে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনে, বেতন এবং পেনশন খরচও কমিয়ে ফেলে। পেনশন বিলোপ করা আইএমএফের প্রধান লক্ষ্য।
পাকিস্তান আসন্ন ঋণখেলাপি এড়াতে পেরেছে, তবে ফারুক তারিখ মনে করিয়ে দিচ্ছেন “রাষ্ট্র কিন্তু ইতিমধ্যেই নানা দিকে ব্যর্থ। কোভিড অতিমারী আরও ২০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিয়েছে। সরকারের সাম্প্রতিক ব্যয়সঙ্কোচ নীতিতে আরও ১০ মিলিয়ন মানুষ ওই সীমার নিচে নেমে যাবেন। সরকারি কর্মচারীদের ৩৫% বেতন বৃদ্ধি হয়েছে, যদিও দাবি ছিল ১০০%। বেসরকারি কর্মীদের কোনো সুরাহাই হয়নি।”
অক্সফ্যামের মতে দেশের শীর্ষে থাকা জনসংখ্যার ১% নিচুতলার ৭০% মানুষের তুলনায় অনেক বেশি সম্পদশালী। এই অসাম্য দেশের আর্থসামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়। দেশের শীর্ষে থাকা ১০% পরিবার ৪২% উপার্জন করে আর নিচুতলার ৫০% মানুষ উপার্জন করে মাত্র ১৩%। এর অর্থ হল, পাকিস্তানের ধনী পরিবারগুলো দরিদ্র নিম্নবর্গের তিনগুণ বেশি রোজগার করে। যদি রোজগারের বদলে সম্পদ কথাটা ব্যবহার করা হয় তাহলেই যথাযথ হয়। অক্সফ্যামের বিশ্লেষণ দেখাচ্ছে দেশের ১% ধনী পরিবার দেশের সম্পদের ২১.৯% দখল করে রেখেছে আর তলার ৫০% মাত্র ৪.৪% সম্পদের অধিকারী। ফলে পাকিস্তান মানব সুরক্ষা সূচকে ১৪৪তম স্থান পেয়েছে, মানব বিকাশ সূচকে ১৫৪ এবং ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সংক্রান্ত সূচকে ১৪০তম স্থান দখল করেছে। আইএমএফের সঙ্গে চুক্তি নিশ্চিতভাবেই এসব ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে লাভবান করবে না।
ঐতিহাসিক তারিক আলির কথায় “বাণিজ্যিক পুঁজিবাদ, বিদেশি সাহায্য, রাষ্ট্রপোষিত একচেটিয়া কারবার, বেআইনি আমদানি রফতানি কারবার এবং অর্থ পাচারের স্কিম – এইসব মিলে পাকিস্তানে ধারাবাহিক সঙ্কট তৈরি করেছে।” ক্ষমতার শিকারিরা ক্ষমতা অপব্যবহারের জন্য ওঁত পেতে আছে। তারা কর দিতে অনিচ্ছুক, প্রত্যেকটা মূলধারার রাজনীতিবিদ নিজেদের চারপাশে স্তাবক বলয় তৈরি করে। ক্ষমতার মইয়ে নিচের দিকে থাকা লোকজনকে নানা প্রলোভন দেখায়, বিশালাকার মিলিটারি বাজেটের মাধ্যমে সরকারী কোষাগারের ক্ষীরটুকু তুলে নেয়। শাসকশ্রেণির মধ্যে কমিশন-দালালির খেলা খুবই জনপ্রিয়।
পুরনো কায়দার দুর্নীতি এখনো চলছে তবে ইন্টারনেটের ব্যবহার জীবন অনেক সহজ করেছে, অনেকক্ষেত্রেই কাগজপত্রের প্রয়োজন থাকে না, ধনীরা সহজে লুঠের বখরা লুকিয়ে ফেলতে পারে। তবে আজকের দিনে সবটা লুকিয়ে ফেলাও যায় না, মানুষ দেখতে পায় কী চলছে। তারা রাজনীতিবিদ এবং তাদের খদ্দেরদের উপরে বিশ্বাস হারিয়েছে। পাকিস্তান এখন দুর্ভাগ্যজনকভাবে আইএমএফের উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতি চলছে, অন্যদিকে প্রচণ্ড দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অর্থহীন এক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত করে অর্থপূর্ণ কাজের পাঠ থেকে বঞ্চিত করছে।
মানুষের দুর্দশার দিকে দৃষ্টিপাত না করে পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি আর্থিক সংস্থাগুলোর নির্দেশে ধারাবাহিকভাবে দেশের মেহনতি মানুষের উপর দেনার বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। দরিদ্র জনসাধারণের সঙ্কট বেড়েই চলেছে।
– মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।