~অর্ক
পার্টিতে এবং নকশালবাড়ি আন্দোলনে পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল, নাগরিক ডট নেটকে বললেন ‘কাকা’
অসীমদা, আরও একটা ২৫শে মে এল। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিউতি আলোচনা, দু চারটে অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ, কিছু আবেগপ্রবণ স্মৃতিচারণ, কিছু পোস্টার, পতাকা উত্তোলন — এর বাইরে আর কোথাও নকশালবাড়িকে দেখতে পাচ্ছেন? আপনারা গোটা দেশটাকে বদলানোর কথা বলেছিলেন, অথচ নকশালপন্থীরা নিজেরাই কত টুকরো, বলা মুশকিল। এখনও, এই ২০২১ সালে, নরেন্দ্র মোদীর ভারতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলায় আদৌ কোনও তাৎপর্য আছে নকশালবাড়ির?
আলবাত আছে। আরও অনেক অনেক দিন থাকবে। তুমি ছোট ইতিহাসটাকে দেখছ, বাইরেটা দেখছ। একটা সমাজের, দেশের, আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের ভিতরের যে অ্যালকেমি, তাকে দেখতে হবে। তবে তার আগে একটা কথা বলে নিই, ২৫শে মে নকশালবাড়ি দিবস নয়। নকশালবাড়ি দিবস ২৪শে মে। ১৯৬৭ সালের ২৪শে মে নকশালবাড়িতে কৃষক অভ্যুত্থান হয়েছিল। আর ২৫শে মে পুলিশ গণহত্যা করেছিল। তাই ২৪শে মে নকশালবাড়ি দিবস, ২৫ মে শহীদ দিবস৷ এটা ভুল করা চলে না।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
নকশালবাড়ির তাৎপর্য নিয়ে জানতে চাইলে। ভারতীয় রাজনীতি যে সংসদীয় পথে ঘুরপাক খাচ্ছিল, নকশালবাড়ি তা থেকে তাকে উদ্ধার করে। নকশালবাড়ি কৃষি বিপ্লবের রণধ্বণি শোনায়, সংসদীয় পথের অসারতাকে সামনে আনে। আর বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের কথা যদি বলি, নকশালবাড়ি ছিল জলবিভাজিকা। নকশালবাড়ির পরে কোনও কিছুই আর আগের মতো ছিল না। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্নটিকে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসা গিয়েছিল। আর বিশেষত বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রে তো আলাদা করে নকশালবাড়ির গুরুত্ব বলার প্রয়োজনই নেই। বাম রাজনীতির মৌলিক বদল ঘটিয়ে দিয়েছিল নকশালবাড়ি।
আরেকটু যদি বিশদে বলেন…
বাংলা তো বহুদিন ধরেই বামপন্থী আন্দোলনের দুর্গ। কিন্তু সবটাই সংসদীয় রাজনীতির বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল। নকশালবাড়ি সেই গত বাঁধা অনুশীলনের ধারাকে ছুড়ে ফেলে দিতে শেখাল। তেলেঙ্গানায় যা শুরু হয়েছিল, তাকে নতুন করে, আরও ব্যাপকভাবে দেশের মানুষের সামনে নিয়ে এল। ইতিহাস, বিশেষ করে সাম্প্রতিক রাজনীতি, প্রমাণ করেছে নকশালবাড়ির রাজনীতি যে কথাটা বলতে চেয়েছিল — সংসদীয় পথে কিছু হবে না, ও পথ অসার — তা সঠিক ছিল। সংসদীয় পথে যারা ছিল, তারা আজ শূন্যতে নেমে গিয়েছে। আসলে সংসদীয় রাজনীতির সত্যিই দেওয়ার কিছু নেই। মানুষের বাঁচার পথ, দেশের মুক্তির পথ ওই একটাই — সশস্ত্র কৃষি বিপ্লব। তার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু পথ একটাই।
কিন্তু অসীমদা, নকশালপন্থীদের অধিকাংশই তো এখন সংসদীয় রাস্তায় হাঁটছে। লিবারেশন বলুন, পিসিসি বলুন, এনডি বলুন, সকলেই। মাওবাদীরা বাদে সকলেই ভোটে লড়ছেন। কোথাও কোথাও কিছু আসনও পাচ্ছেন। আপনি নিজেই তো সংসদীয় পথে হেঁটেছেন। একবার তৃণমূলের সঙ্গে, পরে বামফ্রন্টের সঙ্গে…
হ্যাঁ, আমি সংসদীয় দলের সঙ্গে ছিলাম। কারণ ব্যাপক মানুষ এখনও সংসদীয় বৃত্তেই আছেন। আমি অ্যাকাডেমিশিয়ান নই। তাই আমি কী বলছি সেটা যথেষ্ট নয়। আমি যা বলছি তা সমাজের অভ্যন্তরে রেখে কতখানি শক্তি সমাবেশিত করতে পারছি, পোলারাইজেশন ঘটাতে পারছি কিনা — সেটা জরুরি। আমি বামফ্রন্টে গিয়েছিলাম আমাদের কথাটা বলতে। আমি বলতে চেয়েছিলাম বামফ্রন্টকে কেবলমাত্র সংসদীয় বৃত্তে আটকে রাখতে যাঁরা চাইছেন, তাঁরা এর প্রাণসত্তাকে হত্যা করছেন। আমাদের কাজ কেবল ভোটের পাটিগণিত কষা নয়, সর্বভারতীয় স্তরে বিকল্প নীতি তুলে ধরা। বিকল্প শিল্পনীতি, বিকল্প কৃষিনীতি। না হলে লাভ নেই।
অনেকদিন আগে আপনি আমাকে একবার খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন, জ্যোতি বসুর অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিৎ ছিল।
অবশ্যই। এখনও বলছি। একশোবার উচিৎ ছিল। ওটা টার্নিং পয়েন্ট হতে পারত। গোটা দেশের সামনে বিকল্প নীতি তুলে ধরা যেত৷ কিন্তু ওরা সেই সুযোগ হারাল।
আপনি সত্তরের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাত্রনেতাদের একজন। আপনি নিজেই বলেছেন চারু মজুমদার আপনাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আবার আপনিই চারু মজুমদারের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
হ্যাঁ, করেছি। চারুদার সমালোচনা করেছি। আমি একা নই। কানুদা, কানু সান্যাল করেছেন, আরও অনেকে করেছেন। করতে হতই। খতম লাইন যদি আমরা না নিতাম, গণসংগঠনগুলো যদি থাকত, নকশালবাড়ির পথ যদি ফলো করতাম, তাহলে সিপিআই (এমএল) এই দেশের ইতিহাস অন্যভাবে লিখত। নকশালবাড়ির পথ আর নকশালদের পথ তো এক নয়। কৃষক অভ্যূত্থানের পথ আর সন্ত্রাসবাদের পথ এক নয়। আমরা ভুল করেছিলাম।
তবুও একটা কথা বলব, চারুদা, চারু মজুমদার ছিলেন এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব। আমি ওঁকে প্রথম দেখি ১৯৬৮ সালে, উল্টোডাঙায়, সুশীতল রায়চৌধুরীর বাড়িতে। বিশ্বাস করো, মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। কী প্রবল আবেগ! আমাদের বিরাট ছাত্র-যুব সংগঠন কার্যত ওঁকে সমর্পণ করে দিলাম। আসলে ভুলটা হল প্রশ্নহীন মেনে চলায়। আমরা তো বিপ্লবী নেতৃত্ব নয়, বিপ্লবী কর্তৃত্ব মনে করতাম। পরে আমি যে দুটো দলিল দিয়েছিলাম, তা নিয়ে আলোচনাই হল না।
আপনি হাতে-কলমে অনুশীলনের কথা বলছিলেন…
হ্যাঁ, হাতে কলমে কাজ করতে গিয়েই তো দেখলাম চারুদার লাইন ভুল। আমরা বাংলা-বিহার-ওড়িশা সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটির উদ্যোগে ২০ হাজার কৃষককে নিয়ে কাজ শুরু করি। টানা দেড় বছর চারুদার লাইন অনুশীলন করি৷ ওই এলাকায় বড়, ছোট মিলিয়ে ১২০ জন জোতদার খতম হয়। চারুদা বলেছিলেন এতে কৃষকের উদ্যোগের দ্বার খুলে যাবে। তা যদি হত তাহলে ২০ হাজার কৃষকের বিপ্লবী ফৌজ পরিণত হত ২০ লক্ষে। তা কিন্তু হয়নি। দু বছর পরে আমরা ২০০ জনে পরিণত হলাম। না, রাষ্ট্রীয় খুন বা গ্রেফতারি এর কারণ নয়। অধিকাংশ কৃষক বসে গেল। বহু রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে আমরা বুঝলাম ওই পথ ভুল, ও পথে হবে না। চারুদা ভুল বলেছেন। চারুদা কেন, স্বয়ং ভগবান এসে বললেও আমি এ কথা বলব। আমি নিজে অনুশীলনের মাধ্যমে জেনেছি এই পথ ভুল।
অসীমদা, আপনাদের আন্দোলন গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু নকশাল আন্দোলনের ইতিহাসটা দেখলে বড্ড বেশি পুরুষ প্রাধান্য চোখে পড়ে। অথচ সেই ২৫শে মে-র অধিকাংশ শহীদই কিন্তু নারী।
আমরা পারিনি। আমাদের ভুল। আমাদের ব্যর্থতা। পার্টিতে, আন্দোলনে পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশ, মানসিকতা ছিল। তা নিয়ে সচেতনতাও ছিল না। মেয়েরা লড়েননি তা নয়। এগিয়ে আসেননি, তাও নয়। কিন্তু তাঁদের আমাদের ঘাটতির জন্য, পার্টির ঘাটতির জন্য যা হওয়া উচিৎ ছিল, তা হয়নি। এই ব্যর্থতা খোলাখুলি মেনে নিতে হবে।
বরং, অন্ধ্রের কমরেডরা এই বিষয়ে অনেক সফল। হয়ত তেলেঙ্গানার ধারাবাহিকতার কারণেই। মহিলাদের যে উজ্জ্বল উপস্থিতি আমি ওখানে দেখেছি, তা বাংলায় দেখিনি। একজন মহিলা যিনি লড়ছেন, এগিয়ে আসছেন, যদি ভাবা হয় তিনি কেবল মিটিংয়ে চা করবেন, তাহলে সেটা যে বিরাট ব্যর্থতা, এটা স্বীকার করা উচিৎ।
আবার একটু সাম্প্রতিক সময়ে ফেরা যাক। বামপন্থীদের সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে, কেন পারছেন না তাঁরা। কী মনে হয়?
দেখো, এর উত্তর একটু বড় পরিসরে বললেই ভাল। সংক্ষেপে দুটো কথা বলব। প্রথমত, আমাদের মেনে নিতে হবে যে আমরা হেরে গেছি। গোটা দুনিয়া জুড়েই আমরা, বামপন্থীরা, দক্ষিণপন্থীদের কাছে মোটের উপর পরাজিত। আমরা যখন রাজনীতিতে এসেছিলাম, তখন ছিল বামপন্থার জোয়ারের যুগ। রাশিয়া, চিন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ইস্ট ইউরোপ। দেশে দেশে মুক্তিসংগ্রাম। আর এখন? বিশ্ব জুড়ে বামপন্থীদের পিছু হঠার সময়। কেন এমন হল? হল, কারণ নতুন প্রযুক্তিবিপ্লবকে বামপন্থীরা অ্যাড্রেস করতে পারেনি। দক্ষিণপন্থীরা নয়া উদারবাদ, বিশ্বায়ন এসব দিয়ে বিষয়টাকে ধরতে পেরেছে। আমরা পারিনি। তাঁর সময়ে মার্কস যে কাজটা করতে পেরেছিলেন, সেটা করা যায়নি। এটা একটা দিক।
আর একটা দিক হল, আমাদের গণতন্ত্রকে আরেকটু গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এই যে ওরা বলে না বাম-গণতান্ত্রিক জোট, আমি বলি ওই নামটা একটু পাল্টে নিতে হবে, শুধু নামের জন্য না, চর্চার জন্য। গণতন্ত্রটাকে আগে রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক বাম জোট। এটা খুব জরুরি৷ নাহলে এই সময়টাকে ধরা যাবে না। আর জোটের শর্টকাট রাস্তাটা ছাড়া উচিত। ওভাবে হয় না, সম্ভব নয়।
একটা শেষ প্রশ্ন। আপনার এই ‘কাকা’ নামটা কী করে এল?
হা হা হা হা, এটা একটা জব্বর প্রশ্ন। এটা কলেজের ব্যাপার। আমি তো বেশি বয়সে ঢুকেছিলাম। সহপাঠীরা নাম ধরে ডাকত না। আবার দাদাও বলতে চাইত না। ওই থেকে কাকা। ‘কী কাকা, কী খবর? আরে কেমন আছো, কাকা?’ এই রকম। তারপর থেকে আমি সবারই কাকা হয়ে গেলাম…
নকশালবাড়ি আন্দোলন ও ভারতে বামপন্থার অতীত ও ভবিষ্যত – ছবি উইকিপেডিয়া থেকে।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।