ডঃ পবিত্র সরকার
আমার বাল্যকালে, পাঁচের দশকে প্রজাতন্ত্র দিবসের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল খবরের কাগজগুলো। আনন্দবাজার পত্রিকা বা যুগান্তরের মতো দৈনিক পত্রিকা ২৬শে জানুয়ারি বিশেষ রঙিন ক্রোড়পত্র প্রকাশ করত। তখন তো সাদা কালো খবরের কাগজের যুগ, তাই আমাদের কাছে ওই রঙিন ক্রোড়পত্রের আকর্ষণ ছিল অপরিসীম। যতদূর মনে পড়ে, আনন্দবাজার শিরোনাম করেছিল, ‘জাগে নব ভারতের জনতা / এক জাতি, এক প্রাণ, একতা..’
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আরো একটা বিষয় খুব বেশি করে মনে পড়ছে। সেই সময় খবরের কাগজগুলি ছোটদের সংগঠন করত। আনন্দবাজারের ছিল ‘আনন্দমেলা’, যুগান্তরের ছিল ‘সব পেয়েছির আসর’। তারা নানাবিধ অনুষ্ঠান করত। আমরা, ছোটরা গানবাজনা করতাম, অভিনয় করতাম। কেউ কেউ নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মতো ফৌজি পোশাক পরে আসত। সে এক অন্য উন্মাদনা! প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদে বা উঠোনে তেরঙা জাতীয় পতাকা তোলা হত। বাচ্চা থেকে বুড়ো গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিতাম – বন্দেমাতরম। সত্যি সত্যি একটা নতুন দেশের জন্ম হয়েছে বলে মনে হত। আমাদের নিজেদের স্বাধীন দেশ। জানি না এই প্রজন্মের কাছে সেই অনুভূতি আদৌ যথাযথ ভাবে পৌঁছে দিতে পারব কিনা।
প্রজাতন্ত্রের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক তো হল ভোটের অধিকার। সেই বিষয়ে দু কথা বলি। ১৯৫২ সালে প্রথম নির্বাচন হল। সে যে কী প্রবল উৎসাহ! স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচন। আমার তখনও ভোট দেওয়ার বয়স হয়নি। তবে আমি একটা মজার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। আমরা তখন খড়গপুরে থাকতাম। বয়স কম বলে আমাকে মহিলাদের আঙুলে ভোটের কালি লাগানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। মনে আছে, ২ টাকা মাইনে পেয়েছিলাম। এই যে একটা বিপুল উৎসাহের জোয়ার, প্রজাতন্ত্র নিয়ে, সদ্য পাওয়া স্বাধীনতা নিয়ে এই যে বিপুল প্রাণস্পন্দন – এটা বেশ কিছুদিন ছিল।
আমার অনেক বন্ধু ছিলেন কমিউনিস্ট। আমিও কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ছিলাম। কিন্তু সেটা যে খুব কমিউনিজম বুঝে তা কিন্তু নয়। আমাদের মত উদ্বাস্তু পরিবারের অনেকেই মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন দেশভাগের যাবতীয় দায় কংগ্রেসের। কংগ্রেসের জন্যই আমাদের ভিটেছাড়া হতে হয়েছে। তাই কংগ্রেস বিরোধিতার জায়গা থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির দিকে ঝুঁকেছিলাম।
উদ্বাস্তুদের সমর্থন কিন্তু ভারতীয় জনসংঘের পাওয়ার কথা ছিল। কারণ দেশভাগের ফলে তাঁদের অনেকেই খানিকটা মুসলিম বিরোধী হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু জনসংঘ কখনোই উদ্বাস্তুদের পাশে সেভাবে দাঁড়িয়েছে বলে আমার জানা নেই। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা দিন-রাত এক করে উদ্বাস্তু আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, জবরদখল কলোনিগুলো তৈরির পিছনে তাঁদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বাস্তুরা বামপন্থী দলগুলির পাশে দাঁড়ালেন। দক্ষিণ কলকাতার কলোনিগুলি যাঁরা গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের সকলেই পরবর্তীকালে সিপিআই বা সিপিআইএম দলের নেতা হয়েছিলেন।
এই বছরের প্রজাতন্ত্র দিবসটা বাকি বছরগুলির মতো নয়। আমি অধীর আগ্রহে কৃষকদের আন্দোলনের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত ওঁরা জিতে যাবেন। আর তা যদি হয়, তাহলে ভারতের বিরোধী দলগুলির জন্য সেটা একটা বিরাট শিক্ষা হয়ে থাকবে।
ভোটের রাজনীতিতে কী হবে জানি না, কিন্তু কৃষকরা একটা নতুন ভারতের জন্ম দিতে লড়ছেন। কেবল অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার নিরিখে এই লড়াইকে দেখা ভুল হবে। বলা ভাল, কৃষকরা একটা নতুন প্রজাতন্ত্রের জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁরা সফল হবেন কিনা জানি না, কিন্তু যদি তাঁরা সাফল্য পান, তাহলে হয়তো আমাদের দেশের সামনে বিপুল সম্ভাবনার দরজা উন্মোচিত হবে।
অনুলিখন – অর্ক ভাদুড়ি
চিত্র সৌজন্য : Wikimedia
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।