দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই বাঙালি আজ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বা খ্রিস্টাব্দের হিসাব ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছে। বঙ্গাব্দ সম্পর্কে তার উৎসাহ তাই কিছুটা স্তিমিত। পয়লা জানুয়ারি ‘নিউ ইয়ার’ পালনের জাঁকজমক তাই ছাপিয়ে যায় পয়লা বৈশাখ ‘নববর্ষ’ পালনকে। তাই বলে বঙ্গাব্দ যে একেবারে জাদুঘরে স্থানলাভ করেছে তা-ও নয়। আজও পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বাঙালিরা বহু আনন্দোৎসব বঙ্গাব্দের হিসাব মেনেই পালন করে থাকে। আর পড়শি রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় বছরই তো বঙ্গাব্দ। এহেন বঙ্গাব্দের উৎপত্তি কীভাবে এবং কার মাধ্যমে হল, সে সম্পর্কে ইতিহাসপ্রেমী বাঙালির মনে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু বঙ্গাব্দের প্রবর্তন কবে হল এবং কে এর প্রবর্তক, তা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে মতভেদ রয়েছে। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে তীব্র মেরুকরণের যুগে এই বিতর্ক আর ঐতিহাসিক মহলে সীমাবদ্ধ নেই, বরং রাজনৈতিক, এমনকি সাম্প্রদায়িক বিতর্কে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নির্মোহভাবে বঙ্গাব্দের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতামতগুলোকে ইতিহাসের নিক্তিতে বিচার করতেই এই লেখার অবতারণা।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বঙ্গাব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন লেখকের মতামত বিচার করে বলা যায়, এ সম্বন্ধে মোটামুটি চারটে মত বর্তমান। (১) তিব্বতি রাজা স্রং সন (Namri Songtsen) এই অব্দের প্রবর্তক, (২) গৌড়রাজ ও বাংলার প্রথম সার্বভৌম রাজা শশাঙ্ক বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করেন, (৩) সুলতান ‘নৃপতিতিলক’ হোসেন শাহ এর প্রবর্তক, (৪) মোগল বাদশাহ আকবর এই অব্দের প্রবর্তন করেন। নীচে প্রত্যেক মতবাদের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করা হল।
১
তিব্বতি রাজা সম্পর্কিত মতামতের মূল উৎস ফরাসি পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভি। তাঁর Nepal: Historical study of a Hindu kingdom নামক বইতে তিনি বলেছেন, রাজা স্রং সন ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মধ্য ও পূর্ব ভারত জয় করেন। সিলভ্যাঁ লেভিকে অনুসরণ করে একাধিক বাঙালি গবেষক, যেমন ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, পঞ্চানন মণ্ডল প্রমুখ মনে করেছেন তিব্বতী রাজা স্রং সন গাম্পোর (Songtsen Gampo) জন্ম যে বছর হয়েছিল, সে বছর থেকেই তাঁর পিতা স্রং সন, যিনি সাময়িকভাবে পূর্ব ভারতের কিছু অংশ দখল করেছিলেন, তিনি পুত্রলাভ স্মরণীয় করে রাখতে এই সনের প্রচলন করেন।
বৃহৎ বঙ্গের নানা অংশের সঙ্গে তিব্বতের আদানপ্রদান ঘটেছে নানা সময়ে। গাম্পো নিজে এরপর লিচ্ছবি বংশীয় রাজকন্যাকে বিয়ে করবেন, ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম তিব্বতে যাবে। গাম্পো তিব্বতি লিপি এবং ধ্রুপদী তিব্বতি ভাষা ও সেইসঙ্গে তিব্বতের সাম্রাজ্য নির্মাতা ছিলেন।
গাম্পোর জন্ম ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে হয়ে থাকতে পারে, যদিও আরও কয়েকটি সালের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর জন্মসন ৫৫৭ থেকে ৬১৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যে কোনো বছরে হয়ে থাকতে পারে বলেও জানা যায়। মাৎস্যন্যায়ের কালে কামরূপ অঞ্চলে গাম্পোর নেতৃত্বে তিব্বতের সামরিক অভিযান ঘটেছিল বলে জানা যায়। ভাস্করবর্মার রাজবংশ স্রং সন গাম্পোর আক্রমণেই বিলুপ্ত হয়েছে বলে অনেক ইতিহাসবিদ অনুমান করে থাকেন। এছাড়া অতীশ দীপঙ্করের আগে থেকেই বাংলার বৌদ্ধদের সঙ্গে তিব্বতের যোগাযোগ ছিল। অতএব একটি তিব্বতি অব্দ বাংলায় প্রচলিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু এর বিরুদ্ধ যুক্তিও আছে (তমাল দাশগুপ্ত রচিত ‘বঙ্গাব্দের উৎস’ প্রবন্ধ অনুসারে)। পাল বংশের আমলের কোনো নথিতে এই বঙ্গাব্দের উল্লেখ নেই। তাঁরা প্রত্যেক রাজার রাজত্বকালের হিসাবে বছর গণনা করতেন। সেনযুগে শকাব্দের প্রচলন ছিল, কিন্তু সেই সময়ের নথিতে বঙ্গাব্দ মেনে বছর গণনার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। ফলে এই দাবির সত্যতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।
২
সুশীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গাব্দের উৎসকথা গ্রন্থে গৌড়াধিপতি শশাঙ্ককে বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কয়েক বছর হল কিছু উগ্র হিন্দুত্ববাদী শশাঙ্কই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলে জোরদার প্রচার চালাচ্ছেন। বিভিন্ন ‘ইতিহাসমূলক’ ওয়েবসাইটে, যেমন এখানে, এই বক্তব্য প্রকাশিতও হচ্ছে। এঁদের উদ্দেশ্য, সম্রাট আকবর (যিনি ধর্ম পরিচয়ে মুসলিম) বঙ্গাব্দের প্রবর্তক এই মতবাদ, যা অধিকাংশ ইতিহাসবিদই মেনে নিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে একজন হিন্দুকে তুলে ধরা। এঁদের মতে, ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। সেদিন নাকি শশাঙ্ক সিংহাসনে আরোহন করেছেন, তাই দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতে এই অব্দের প্রচলন করা হয়।
এই মতের বিরুদ্ধেও বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরা যেতে পারে। প্রথমত, ইতিহাসবিদ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বঙ্গ, বাঙ্গালা ও ভারত গ্রন্থে লিখেছেন, “এই মতের সপক্ষে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই প্রমাণ করতে হবে যে, শশাঙ্ক ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বা অন্তত ওই সময়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন। এর কোনও নিশ্চিত প্রমাণ নেই, যদিও খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীর প্রথমভাগে তাঁর রাজত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য আমাদের আছে। … শশাঙ্কের রাজ্যের সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত সীমানার মধ্যে তাঁর পরবর্তীকালীন এক হাজার বৎসরের মধ্যে তারিখযুক্ত যে বিরাট সংখ্যক লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলিতে বঙ্গাব্দ ব্যবহারের চিহ্নই নেই।” (পৃ. ১৫১-৫২)। শশাঙ্ক প্রধানত ৬০৬ খ্রিস্টাব্দেই স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ৫৯০ সাল নাগাদ শশাঙ্কের রাজত্ব যদি থেকেই থাকে, তবে তা গুপ্তদের সামন্ত রাজা হিসাবে। রোহতাসগড়ে প্রাপ্ত সিলের ছাঁচে লিখিত ‘শ্রী মহাসামন্ত শশাঙ্ক’ থেকে এ কথা প্রমাণিত হয়। একজন সামন্ত রাজা নিজস্ব অব্দ চালু করবেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
দ্বিতীয়ত, প্রাচীন যুগে বঙ্গ বলতে সমগ্র বাংলাকে বোঝাত না। তখনকার বাংলা পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, বঙ্গ, বঙ্গাল, সমতট, হরিকেল, রাঢ়, সুহ্ম, গৌড় ইত্যাদি জনপদে বিভক্ত ছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিকের বিবরণ থেকে যা বোঝা যায়, ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যবর্তী অংশই বঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। বাং জাতির মানুষ এই অঞ্চলে বাস করত বলেই হয়ত এই নামকরণ। আর শশাঙ্ক সামন্ত হিসাবে গৌড় অঞ্চলের রাজা ছিলেন। স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা জয় করেন। গৌড় বলতে বর্তমান মুর্শিদাবাদ, মালদা, বীরভূম এবং বর্ধমানের অংশবিশেষকে বোঝায়। শশাঙ্কের কর্ণসুবর্ণও এই অঞ্চলেই পড়ে। অর্থাৎ, বঙ্গ এবং গৌড় দুটো আলাদা অঞ্চল। প্রাথমিকভাবে শশাঙ্ক গৌড়ের রাজা, পরে তিনি বঙ্গ জয় করেন। তাহলে শশাঙ্ক যদি কোনো অব্দ প্রবর্তন করেই থাকেন, তবে তার নাম তাঁর নিজের নামে (যেমন বিক্রমাদিত্যের বিক্রম সম্বৎ) অথবা নিজের বংশের নামে (যেমন গুপ্ত রাজাদের গুপ্তাব্দ) অথবা নিজের প্রধান শাসনাঞ্চল গৌড়ের নামে রাখাই বেশি সম্ভব। তিনি কেন এমন একটা অঞ্চলের নামে বছরের নাম রাখতে যাবেন, যে অঞ্চলে এমনকি তাঁর রাজধানীও অবস্থিত নয়? প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, শশাঙ্ক কখনোই নিজেকে বঙ্গের অধিপতি হিসাবে চিহ্নিত করেননি। তাঁর সমসাময়িক মানুষরাও করেননি। বাণভট্ট হর্ষচরিত গ্রন্থে তাঁকে ‘গৌড়ভুজঙ্গ’, ‘গৌড়াধম’ উপাধিতে চিহ্নিত করেছেন, বঙ্গ শব্দটা কোথাও নেই।
শশাঙ্ক সম্পর্কে প্রধানতম যুক্তিটা এবার বলি। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া প্রকাশিত এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ১৪৫-এ লেখা আছে “শশাঙ্কের অধীনস্থ মাধব বর্মণ তার গঞ্জাম লেখতে গুপ্তাব্দ ব্যবহার করেন”। বঙ্গাব্দের প্রচলন যদি শশাঙ্কই করতেন, তবে তাঁর অধীন একজনের লেখতে বঙ্গাব্দ না হয়ে গুপ্তাব্দ কেন ব্যবহৃত হল? বঙ্গাব্দের আর কোনো নজির নেই কেন? পরিশেষে, শশাঙ্কের সময় যদি বঙ্গাব্দ প্রচলিত হয়েও থাকে তবে, এত রাজনৈতিক উত্থান পতনের পর এত শত বছর ধরে কি টিকে থাকতে পারে? বিশেষত যখন মাৎস্যন্যায়, পাল, সেন, বখতিয়ার, পাঠান, মোগল – এতগুলো যুগ কেউই বিশেষ করে শশাঙ্ককে মনে রাখেনি, মনে রাখার সেভাবে প্রয়োজন বোধ করেনি?
শশাঙ্ক বঙ্গাব্দের প্রবর্তক কিনা, তা বিচারের ভার এবার পাঠকদের।
৩
ঐতিহাসিক যতীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের দাবি, সুলতান হোসেন শাহ বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। এ কথা সত্যি যে সুলতান হোসেন শাহ শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সুলতানি আমলে তিনি বাংলায় স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করেছেন। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমুক্ত উদার শাসক ছিলেন তিনি। তারপরেও বঙ্গাব্দ প্রচলনের কোনো নজির সেসময় দেখা যায় না। তার বদলে পাওয়া যায় হিজরি, শকাব্দ এবং পরগণাতির ব্যবহার।
৪
এবার চতুর্থ মতটা বিচার করা যাক। এই মত অনুসারে মোগল আমলে ইসলামিক হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাঙালিদের থেকে খাজনা আদায় করা হত। সেই বর্ষপঞ্জি ছিল একটি চান্দ্র বর্ষপঞ্জি, আর তাই সৌর কৃষিচক্রের সাথে সেই বর্ষপঞ্জির কোনো সমন্বয় ছিল না। কোনো কোনো মতে, খাজনা দেওয়ার সময়ে উৎসবের আয়োজন করার রীতি মোগল সম্রাট আকবরেরই তৈরি, আর তখন থেকেই বাংলা বছরকে বঙ্গাব্দ বলা শুরু হয়। আকবর রাজজ্যোতিষী ফতুল্লাহ শিরজীকে চান্দ্র ইসলামিক বর্ষপঞ্জি এবং সৌর হিন্দু বর্ষপঞ্জির সমন্বয় ঘটিয়ে এক বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে বলেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, এখান থেকেই বাংলা বর্ষপঞ্জির সূচনা। যেহেতু আকবরের সিংহাসনে বসার বছর (১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ) হিজরিতে ৯৬৩ সন, তাই বঙ্গাব্দ শুরু হয় ৯৬৩ সন থেকে। আকবর নাকি ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে এই বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন।
আগেই বলেছি অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই মতই মেনে নিয়েছেন। বাংলাদেশের বেশ কিছু ঐতিহাসিক, যেমন শামসুজ্জামান খান, সৈয়দ আশরাফ আলী, সিরাজুল ইসলাম, আহমেদ জামাল প্রমুখ এই দাবী উত্থাপন করেন। পশ্চিমবঙ্গবাসীদের মধ্যে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামের প্রাক্তন কিউরেটর ডঃ রমাতোষ সরকার প্রমুখ এই মতকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু এর বিরুদ্ধ যুক্তিগুলোও উপেক্ষা করার মত নয়।
প্রথমত, আকবরের সমসাময়িক কোনো নথিতে বঙ্গাব্দের প্রচলন নিয়ে একটাও কথা নেই। মোগলরা সাধারণত যে কাজ করতেন তা কোনো না কোনো নথিতে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন, এ বিষয়ে তাঁরা অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। আকবরের প্রামাণ্য জীবনী আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী আকবর কর্তৃক বঙ্গাব্দ প্রচলনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব।
দ্বিতীয়ত, আকবর ফতুল্লাহ শিরজীকে দিয়ে যে নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করান, তার নাম হল তারিখ-ই-ইলাহি। সেটা কিন্তু হিজরি বছর থেকে গণনা করা হয়নি, সেটার প্রথম বছরই ছিল আকবরের সিংহাসনপ্রাপ্তির বছর। অর্থাৎ সেটা ৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয়নি। সেক্ষেত্রে তারিখ-ই-ইলাহির সঙ্গে বঙ্গাব্দকে এক করে দেখা চলে না।
তৃতীয়ত, ইতিহাসবিদ নীতীশ কুমার সেনগুপ্ত ২০১১ সালে প্রকাশিত Land of Two Rivers: A History of Bengal from the Mahabharata to Mujib গ্রন্থে (পেঙ্গুইন বুকস ইন্ডিয়া থেকে প্রকাশিত) জানিয়েছেন, আকবরের কয়েক শতক আগে নির্মিত দুটো শিব মন্দিরে বঙ্গাব্দ শব্দটার উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ আকবরের অনেক আগেও বাংলা বর্ষপঞ্জির অস্তিত্ব ছিল।
চতুর্থত, তমাল দাশগুপ্তের পূর্বোক্ত প্রবন্ধ অনুযায়ী “১৫৮৪ সালে বাংলার অতি অল্প অংশ আকবরের মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। ১৫৭৬ সালে শেষ পাঠান সুলতান, দাউদ কররানীর মৃত্যু ঘটেছে, গৌড়ে আকবরের প্রতিনিধি অতীব অসহায়, এবং গৌড় বঙ্গে তখন বারো ভুঁইয়ার রাজত্ব চলছে। এমতাবস্থায় যে রাজস্ব আকবরের প্রায় কিছু আদায়ই হয় না, সে রাজস্বের জন্য আকবর নতুন অব্দ তৈরি করে ফেলবেন? তপন রায়চৌধুরী বলেছেন যে ১৫৯৪ সালের আগে গৌড়বঙ্গের ওপরে মোগল অধিকারের কোনও স্থায়িত্ব ছিল না। এর দশ বছর আগেই আকবরের নির্দেশে বঙ্গাব্দ তৈরি হওয়ার কথা কাজেই বিশ্বাসযোগ্য নয়”।
উপরের যুক্তিগুলোর মধ্যে শেষের যুক্তিটার বিরুদ্ধে বলা যেতে পারে, ১৫৭৫ সালে কররানিকে পরাজিত করার সম্পূর্ণ বিহার (যা বাংলার অন্তর্গত ছিল) এবং পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের কিছু অংশ আকবরের দখলে এসেছিল। কাজেই অধিকৃত সেই অংশে নতুন অব্দ চালু করা আকবরের পক্ষে অসম্ভব নয়। হয়ত পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীরের আমলে মোগল শাসনের বিস্তারের সাথে সাথে সেই অব্দ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অপর তিনটে যুক্তির বিরুদ্ধে কিছু বলা সত্যই কঠিন।
আবার শামসুজ্জামান খানের মতে, সম্ভবত নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সর্বপ্রথম পুণ্যাহের রীতি (খাজনা আদায় করার জন্য একটা উৎসবের দিন) চালু করেন। আর তা করার সময়েই তিনি আকবরের বার্ষিক খাজনা আদায়ের নীতি গ্রহণ করেন। অর্থাৎ, হয়তো আকবর নন, বঙ্গাব্দ প্রচলন করেন মুর্শিদকুলি খাঁ। এ কথা মেনে নিলে আইন-ই-আকবরী বইতে বঙ্গাব্দ প্রচলনের কথা না থাকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু এতে নীতীশবাবুর যুক্তি খণ্ডন করা যায় না। তাছাড়া, মুর্শিদকুলির নথিপত্রেও বঙ্গাব্দ প্রচলনের কথা স্পষ্ট করে লেখা নেই।
কাজেই, সবদিক বিচার করে দেখা যাচ্ছে যে বঙ্গাব্দের প্রবর্তন কীভাবে হয়, তার কোনো সর্বসম্মত উত্তর নেই। একাধিক পরস্পরবিরোধী মত আছে, তাদের পক্ষে বিপক্ষে অসংখ্য যুক্তিও আছে। ইতিহাসে এমন মতপার্থক্য মোটেই বিরল নয়। সমস্যা হয় যখন এই মতপার্থক্য রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়। তখন নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চার বদলে কোনো একটা মতকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা যুক্তি ও ইতিহাস বিকৃতির সূচনা হয়। আকবরকে বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হিসাবে চিহ্নিত করাকে তখন “সাংস্কৃতিক আগ্রাসন” আর “বাঙালি জাতিসত্তাকে গ্রাসের চেষ্টা” হিসাবে দেগে দেওয়া হয় এবং অসংখ্য বিরুদ্ধ যুক্তি থাকা সত্ত্বেও শশাঙ্ককে এর কৃতিত্ব দিয়ে দেওয়া হয়। তাই নিজের মত চাপিয়ে না দিয়ে নিরপেক্ষভাবে বঙ্গাব্দের উৎপত্তি সম্পর্কিত ইতিহাসের চর্চা করা প্রয়োজন।
মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ: গতায়াতের ভুবন
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
আকবরের আগেই বাঁকুড়ার মন্দিরে বঙ্গাব্দের উল্লেখ থাকার যে দাবী করা হয় সেটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। নীতিশ কুমার সেনগুপ্ত কোনো তথ্যসূত্র বা Reference ব্যতিরেকেই এই ভুল কথাটি লিখেছেন।
তাঁর দেওয়া তথ্য যে ভুল সেটি আমি একটা বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে দেখিয়েছি প্রামাণ্য তথ্যসূত্রসহ।
এখানে দেখতে পারেন
https://m.facebook.com/groups/1803711656387813/permalink/5550618361697105/