ঠিক যেন যুদ্ধ পরিস্থিতি।

গোটা এলাকা থমথম করছে। গ্রাম প্রায় পুরুষশূন্য। টহল দিচ্ছে বিশাল পুলিশবাহিনী। গোয়েন্দা দফতরের বড়কর্তাদের আনাগোনা লেগেই রয়েছে। সর্বত্র কড়া নজরদারি। এর মাঝেই আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া বাড়ি। ফাঁকা গ্রামীণ পথে মহিলাদের ত্রস্ত চলাচল।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

বীরভূমের রামপুরহাটের বগটুই গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় ভাদু শেখের বাড়ির সামনে ইতস্তত জটলা। বাইরের লোক দেখলেই সরে পড়ছেন স্থানীয়রা। মুখ খুলতে নারাজ প্রায় সকলেই। ভাদু শেখের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য গ্রামছাড়া। গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছেন আগুনে পুড়ে মৃতদের পরিবারও। কোথাও জমায়েত দেখলেই সরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। গ্রামের সরু রাস্তায় ব্যারিকেডের হাস্যকর অথচ থমথমে উপস্থিতি।

এলাকায় অধিকাংশ মানুষই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তৃণমূল কংগ্রেসের একচ্ছত্র আধিপত্য। পুলিশ, মিডিয়া, মন্ত্রী, বিরোধী নেতা এবং সরকারি আধিকারিকদের আনাগোনায় বেশ খানিকটা হতচকিত বীরভূমের এই প্রান্তিক গ্রাম। তার মাঝেই টুকরো টুকরো কথাবার্তায় যে ছবি উঠে আসছে, তা কেবল বগটুই নয়, গোটা রাজ্যের জন্য মারাত্মক অশনি সংকেত।

ভাদু শেখ কে? কেন তাঁকে মরতে হল? বুধবার ভাদু শেখের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম তাঁকে ‘মাফিয়া’ বলে চিহ্নিত করেছেন। ভাদুর বাড়ি দেখেও চমকে গিয়ে সেলিমের মন্তব্য, “এ তো প্রাসাদ!” বস্তুত, সেলিমের প্রথম মন্তব্যের বিরোধিতা করার জায়গা নেই। ভাদু শেখ যে ‘দাবাং’ নেতা, তা বলছেন তাঁর অনুগামীরাই। তাঁর বাড়িটিও জব্বর। প্রাসাদ বলা না গেলেও বীরভূমের হতদরিদ্র গ্রামে অমন বাড়ি চোখে লাগে বৈকি! গ্রামে ঘোরাঘুরির ফাঁকেই জানা যাচ্ছে একদা পেশায় গাড়িচালক ভাদুর ছোটখাটো ‘ওয়ারলর্ড’ হয়ে ওঠার গল্প।

একদম শুরুতে ভাদু থানার গাড়ি চালাতেন। তখন তিনি কংগ্রেসের কর্মী। আঙুর শেখ নামে এক নেতার অনুগামী হিসাবেই তাঁর পরিচিতি ছিল। এরপর ২০১২ সালে যোগ দেন তৃণমূলে। তার কিছুদিন পরেই নিজের রাজনৈতিক মেন্টর আঙুর শেখকে এলাকাছাড়া করেন। এরপর উল্কাসদৃশ উত্থান। থানার ডাক মাস্টারি, টোল প্লাজার লেবার কনডাক্টরের কাজ থেকে শুরু করে বালি খাদানের দখল, তোলাবাজি — সব কিছুতেই ভাদুর দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। ২০১৩ সালের ভোটে পঞ্চায়েত সদস্য হন। ২০১৮ সালে উপপ্রধান।

বীরভূমের এক তৃণমূল নেতার দাবি, ভাদুকে অধিকাংশ সময় ৮-১০ জনের বাহিনী ঘিরে থাকত। মাসিক ২০-৩০ হাজার টাকা জনপ্রতি খরচ করে সেই বাহিনী পুষতেন ভাদু। না পুষে তাঁর উপায়ও ছিল না। কারণ একাধিক অপরাধে অভিযুক্ত ভাদুর শত্রুর সংখ্যা বাড়ছিল। বালি খাদানের দখল নিয়ে দলেরই একটি অংশের সঙ্গে তাঁর বিবাদ শুরু হয়। ছোট লালন, সোনা শেখ, পলাশ শেখের মতো একসময়ের বিশ্বস্ত অনুগামীরা ভাদুর হাত ছেড়ে দেন। শুরু হয় খোলাখুলি লড়াই। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে খুন হন ভাদুর ভাই বাবর শেখ। তারপর মরতে হল ভাদুকেই।

বগটুই গ্রাম জুড়ে এখন অসংখ্য প্রশ্ন পাক খাচ্ছে। কেন অনুব্রত মণ্ডল আগ বাড়িয়ে টিভি বিস্ফোরণের তত্ত্ব দিলেন? কাকে আড়াল করতে চাইলেন তিনি? কেনই বা বিধানসভায় দাঁড়িয়ে আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ভাদুকে “জনপ্রিয় নেতা” বলে বসলেন? সিউড়ির জেলা তৃণমূল শেষ অবধি কোন পক্ষ নেবে? কলকাতার শীর্ষ নেতৃত্ব কী করতে চায় তা-ও এখনো ঝাপসা।

ধোঁয়াশা এখনো অনেক। শোনা যাচ্ছে, আলাউদ্দিন নামে পরিচয় দিয়ে একজন ব্যক্তি নিজেকে মৃতদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে পরিচয় দেয়। ওই ব্যক্তিই মৃতদেহ ‘শনাক্ত’ করে। অথচ মৃতদের আত্মীয়রা জানাচ্ছেন, তাঁরা এই আলাউদ্দিনকে চেনেনই না। বারবার ফোন করা সত্ত্বেও পুলিশ এবং পঞ্চায়েত প্রধান তাঁদের হাতে দেহ দেননি। দেহ দেওয়া হয় এই আলাউদ্দিনের হাতে। তার সঙ্গে কথা বলেই সমাহিত করা হয় মৃতদের।

প্রশ্ন উঠছে, এত তাড়াহুড়ো করে মৃতদেহ কবর দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? কার নির্দেশে এ কাজ করল পুলিশ?

মৃতের সংখ্যা নিয়েও তো সংশয়। জেলা পুলিশ সুপারের বয়ান এবং রাজ্য পুলিশের বড়কর্তার বয়ান মিলছে না। নগেন্দ্র ত্রিপাঠী বলেছেন ১১ জন মারা গিয়েছেন, মনোজ মালব্যের দাবি আটজন। দমকলকর্মীরা আবার জানিয়েছেন, সোমবার রাতেই তাঁরা তিনটি দেহ উদ্ধার করেন, মঙ্গলবার সকালে উদ্ধার করা হয় আরও সাতটি দেহ।

বগটুই গ্রাম এখন কার্যত বধ্যভূমি। মৃত্যুর গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আছে। কতজন মারা গিয়েছেন এখনো অস্পষ্ট। আহতরা সকলে সুস্থ হবেন কিনা তা-ও অজানা। বেশ কয়েকজন নিখোঁজ, তাঁদের মধ্যে এক সদ্য বিবাহিত দম্পতিও আছেন।

রামপুরহাট গণহত্যা আরও একবার প্রমাণ করল, পশ্চিমবঙ্গ একটা জ্বলন্ত চুল্লির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তোলাবাজি, লুটপাট, গা জোয়ারির উপর দাঁড়িয়ে থাকা তৃণমূল সরকার নিজেই নিজের গায়ে আগুন দিচ্ছে। সবচেয়ে যা যন্ত্রণার, এই আগুনে কেবল তৃণমূল পুড়ছে না, পুড়ছেন বাংলার গরীব, প্রান্তিক, অসহায় মানুষ।

জীবিত আনিসের চেয়ে মৃত আনিসকে বেশি ভয় পাচ্ছে মমতা সরকার?

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.