কোভিডের চিকিৎসা বিভ্রাট আর তথ্যমারী (infodemic) কোভিড সঙ্কটকে ক্রমাগতই জটিলতর করেছে, করে চলেছে এখনও। সচেতন চিকিৎসক-গবেষকরা সেসব ভুল তথ্য ও আচরণের বিরুদ্ধে বলে চলেছেন প্রথম থেকেই। কিন্তু মূলধারার সংবাদমাধ্যমের উচ্চকিত প্রচারের বাইরে থেকে যাওয়া সেইসব সংযত ও জরুরি সচেতনতার বার্তা হারিয়ে গেছে ওষুধ কোম্পানি আর অসাধু/ অত্যুৎসাহী কিছু চিকিৎসকের অসদাচরণের ভিড়ে আর বিভ্রান্তিমূলক সরকারি নির্দেশনামায়। এসব নিয়ে একটু বিশদে লিখেছিলাম নাগরিক ডট নেটের পাতায় গত মাসের শুরুতে। তারপরে বেশ কিছু বদল ঘটেছে, যার মধ্যে কয়েকটি বেশ স্পষ্ট:

১. যেদিন (৫/৫/২০২১) নাগরিক ডট নেটে আমার লেখাটি প্রকাশিত হয়, সেই দিনই AIIMS-এর ডিরেক্টর (যিনি একজন পালমোনোলজিস্টও বটে) ডাক্তার রণদীপ গুলেরিয়ার সাথে কথোপকথনের ভিত্তিতে দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজে একটি রিপোর্ট বেরোয় [১], যাতে ডাক্তার গুলেরিয়া যত্রতত্র ও যথেচ্ছ স্টেরয়েডের প্রয়োগ সম্পর্কে সচেতন করেন, এবং জানান যে অনেক মাইল্ড-মডারেট কোভিড রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে অকারণ স্টেরয়েড প্রয়োগের ফলে ভাইরেমিয়া হয়ে গিয়ে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

২. ল্যানসেটে প্রকাশিত ১৪ই মে-র ‘রিকভারি’ ট্রায়াল রিপোর্টের পর (এবং অনেক চিকিৎসক-গবেষকের সম্মিলিত আবেদনের প্রেক্ষিতে), প্লাজমা থেরাপি সরকারিভাবে অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত হিসাবে ঘোষিত হয়ে অবশেষে ১৭ই মে বাদ যায় কোভিডের আই সি এম আর রিভাইজড ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল থেকে [২]। এই নতুন নির্দেশিকায় মাইল্ড কোভিডে ইভেরমেকটিন ও হাইড্রোক্সিক্লরোকুইনের ব্যবহারের কথা থাকলেও, তাদের আগে ছোট ছোট করে যোগ হলো “therapies based on low certainty of evidence”।

৩. ইভেরমেকটিন ইত্যাদি কয়েকটি ওষুধ যে কার্যকরী নয় এবং ক্লিনিকাল ট্রায়ালের বাইরে যে তাদের প্রয়োগ অনুমোদিত নয়, সে বিষয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে খবর হতে থাকল, ওই প্লাজমা থেরাপি বন্ধের খবরের সঙ্গেই ১৮, ১৯, ২০শে মে জুড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ৯ই মে গোয়া সরকার ১৮ বছরের উপর সকলকে (কোভিড না হলেও, এমনকি কোভিড রোগীর সংস্পর্শে না এলেও), ইভেরমেকটিন খাওয়ানোর কথা ঘোষণা করলে, পরদিনই WHO-র মুখ্য-বৈজ্ঞানিক সৌম্যা স্বামীনাথন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বাইরে ইভেরমেকটিনের প্রয়োগ সম্পর্কে WHO-র আপত্তির কথা টুইট করেন, এবং একাধিক ইন্টারভিউ ও লেখায় এরকম সব ওষুধগুলির অকার্যকারিতার কথা জোর দিয়ে বলেন। কিছু চটি কাগজপত্র ও ‘কুকড’ ডেটা রিপোর্ট জড়ো করে, সেগুলিকে মিডিয়ার সামনে ট্রায়াল ডেটা বলে চালিয়ে, সাম্প্রতিককালে ভক্তরা তাঁর বিরুদ্ধে আইনি চিঠি জারি করেছেন (২৫শে মে) এই বলে যে, তিনি কেন ‘ভ্রান্ত তথ্য’ (!!!) প্রচার করে ভারতীয়দের ইভেরমেকটিন ও অন্যসব ওষুধ খাওয়া থেকে বঞ্চিত করতে চাইছেন! WHO-তে যাওয়ার আগে সৌম্যা ICMR-র ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন, এবং তাঁর সম্পর্কে এমন অপমানজনক মিথ্যা অভিযোগের (‘উল্টা পুলিশকো ডাঁটে চোর’ টাইপ) বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না, বরং বাজারি কাগজগুলি সৌম্যা ও WHO ভুল এবং ICMR ও আমরা ঠিক,- এই ভক্ত-ন্যারেটিভ তৈরিতেই ব্যস্ত।

৪. ইতিমধ্যে ২-ডিজি নামে নতুন এক আত্মনির্ভর অ্যান্টি-ভাইরাল (DRDO-র এক ল্যাবে প্রাথমিকভাবে প্রস্তুত করা হয়) ডি সি জি আই-এর অনুমোদন লাভ করে জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের ছাড়পত্রসহ, যা সমস্ত প্রথম সারির দৈনিকে কোভিডের অব্যর্থ ওষুধ হিসাবে প্রচারিত হতে থাকে। একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির মাধ্যমে শীঘ্রই বাজারে আসতে চলেছে এই “easy to produce, easier to consume”, বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রস্তুত খাঁটি দেশীয় বটিকাটি। ২০শে মে “2DG is the new 2G scam” একথা টুইট করে [৩] ভক্তদের বিরাগভাজন হন গুজরাটের বিশিষ্ট চিকিৎসক-গবেষক প্রফেসর সমশেখর নিম্বলকার।

৫. ইতিমধ্যে এক নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে দেশজুড়ে: ব্ল্যাক ফ্যাঙ্গাস। পশ্চিমবঙ্গেও অনেকগুলি ঘটনা পাওয়া গেছে গত এক মাসে। আজকের লেখা সেই ব্ল্যাক ফ্যাঙ্গাস নিয়ে, আর সাথে আগের লেখাটিকেও ফিরে দেখার চেষ্টা।

ব্ল্যাক ফ্যাঙ্গাস নামকরণটি যে ভুল তা এতক্ষণে জেনে গেছেন প্রায় সকলেই। আসল নাম মিউকরমাইকোসিস। এ এক প্রকার মারাত্মক ছত্রাকের সংক্রমণ, বিনা চিকিৎসায় যা কেড়ে নিতে পারে নির্দিষ্ট অঙ্গ, এমনকি প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে। প্রথম সারির দৈনিকের খবরে আমরা দেখেছি যে এই সংক্রমণে অনেক তরুণের চোখ নাক সম্পূর্ণ কেটে বাদ দিতে হয়েছে, এবং অনেককে বাঁচানোও যায়নি [৪]। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোভিড হাসপাতালে দীর্ঘদিন থাকাকালীন বা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে দেখা যাচ্ছে, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাক দিয়ে অতিরিক্ত ডিসচার্জ (রক্তের মতো অথবা বাদামি/কালচে বর্ণের), মুখমণ্ডলে ব্যথা, মুখের এক দিকে বা অংশ বিশেষে ফোলা ভাব এবং সাড়হীনতা (অবশ ভাব/ নাম্বনেস), মুখের ভিতর উপর দিকে বা নাকের ভিতরে (নোজ-ব্রিজের উপরেও কখনও বা) দ্রুত হারে বেড়ে চলা কালো ছোপ, চোখে দেখার অসুবিধা (অস্বচ্ছ দৃষ্টি বা একই জিনিস দুটি করে দেখতে পাওয়া, যার চিকিৎসা পরিভাষায় নাম ডিপ্লোপিয়া), জ্বর, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা কিংবা কাশি/বমির সঙ্গে রক্তপাত। অনেকসময়ই বুঝতে সময় লেগেছে রোগীর, পরিজনদের এমনকি চিকিৎসকদেরও। যতক্ষণে বোঝা গেছে, ততক্ষণে সংক্রমণ ছড়িয়ে গেছে বহু দূর। মুখমণ্ডলের এক বা একাধিক সাইনাস আক্রান্ত হয়ে সন্নিকটস্থ অঙ্গগুলি (চোখ, নাক, মস্তিস্ক) বিপর্যস্ত (ROCM: রাইনো-অর্বিটো-সেরিব্রাল মিউকরমাইকোসিস), কিংবা শ্বাসনালিসহ ফুসফুসে (পালমোনারি মিউকরমাইকোসিস) বা পৌষ্টিকতন্ত্রেও (গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল মিউকরমাইকোসিস) সংক্রমণ ছড়িয়ে গেছে কখনও কখনও। সারা শরীরে ছড়িয়ে যাওয়া অ্যাডভান্সড ডিসেমিনেটেড মিউকরমাইকোসিস হয়ে মৃত্যুও হয়েছে। অঙ্গহানিসহ ব্যাপক শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি, উচ্চ মৃত্যুহার ও চিকিৎসার বহুল ব্যয়ভারের জন্যে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কোভিডজনিত মিউকরমাইকোসিস (CAM: কোভিড অ্যাসোশিয়েটেড মিউকরমাইকোসিস)।
একদল অত্যুৎসাহী নেটিজেন, যাঁদের অনেকেই কোভিড কিছুই নয় বলে আসছিলেন সেই প্রথম থেকেই, এবারেও নেমে পড়েছেন আসরে সকলকে এই বলে আলোকিত করতে যে এই ছত্রাক সংক্রমণ নতুন কিছু নয় এবং এতে ভয় পাওয়ার বা চিন্তিত হওয়ার মতো কিছুই নেই। আর উল্টোদিকে চলছে এর চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজনীয় জরুরি ওষুধের ঘাটতি, এবং তা নিয়েও ভ্যাকসিনের মতন সংকীর্ণ রাজনীতি। অতি সাম্প্রতিককালে সংযোজিত হয়েছে ওষুধের সেই ঘাটতি মেটাতে একটি আত্মনির্ভর সমাধানের দাবি — নিরাময়ে ব্যবহার্য ওষুধগুলির অন্যতম একটি ওষুধের (এমফোটেরিসিন-বি, সংক্ষেপে AMB, কিংবা আক্রান্ত কোষ-কলায় ভালোভাবে প্রবেশ করতে পাড়ার জন্যে তার বিশেষ লাইপোসোমাল প্রিপারেশন, সংক্ষেপে LAMB, যে দুটি ফর্মুলেশন-ই কেবলমাত্র হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে বারেবারে ইন্ট্রাভেনাসলি প্রয়োগ করলে তবেই কার্যকরী হওয়া সম্ভব), একটি ন্যানো-ফাইব্রাস দেশীয় সাস্টেইনড রিলিজ ওরাল প্রিপারেশন যা নাকি “দামে কম এবং মানে ভালো” (যার এখনো ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরুই হয়নি), তার শীঘ্রই বাজারে এবং অতঃপর দুয়ারে এসে পৌঁছনোর মতো চটকদার খবর । আর এসবের মধ্যেই পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে যে, সারা পৃথিবী জুড়ে ঘটে চলা কোভিড-১৯ অতিমারীর পাশাপাশি দেশের অনেক রাজ্যই এই মিউকরমাইকোসিস সংক্রমণকে আলাদা করে একইসঙ্গে হয়ে চলা মহামারী হিসাবে চিহ্নিত করতে বাধ্য হয়েছে। কোভিড সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী ঘটনা হলেও কেন হঠাৎ করে মিউকরমাইকোসিসের এত বাড়বাড়ন্ত কেবলমাত্র ভারতেই, তা ভাবনায় ফেলেছে চিকিৎসক-গবেষকদের সকলকে।

মিউকরমাইকোসিস রোগটি পুরোনো হলেও এটি যথেষ্টই চিন্তার নানাবিধ কারণে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ এই রোগের জন্যে দায়ী ছত্রাকের দ্রুত কোষ-কলার ভিতরে প্রবেশ করার ক্ষমতা এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ওষুধের এদের প্রভাবিত করার স্বল্প ক্ষমতা। ছত্রাক এবং এই রোগের বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে, এটি একটি অপর্চুনিস্টিক ফাঙ্গাল ইনফেকশন যা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে আমাদের শরীরকে আক্রমণ করতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগী, যাঁরা কোন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার জন্যে ইমিউনোসাপ্রেসিভ থেরাপির মধ্যে আছেন, অ্যান্টি-ক্যান্সার থেরাপি করাচ্ছেন, দেহের কোন অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে, বা কোন কারণে দীর্ঘদিন যাঁদের হাসপাতালে (বিশেষত আই সি ইউ-তে) ভর্তি থাকতে হয় (যাঁরা হয়ত অনেকরকম অ্যান্টিবায়োটিক, এমনকি কোনও কোনও অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ওষুধও পেয়েছেন আরো রকমারি ওষুধের সঙ্গে), তাঁদের মধ্যেই প্রধানত এই সংক্রমণ আগে দেখা গেছে। মনে রাখা জরুরি, সবসময়েই কিন্তু এটি একটি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক সমস্যা হিসাবে গণ্য হয়, এবং অতি দ্রুত এর চিকিৎসা শুরু করা জরুরি। মিউকোরালিস কিন্তু সাধারণভাবেও যেকোনো অপরিছন্ন বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে পারে (যেমন, খাবার বা যে কোন জৈব বস্তু পচছে এমন কোন জায়গায়, অপরিষ্কৃত ঘরে / শৌচালয়ে, নিয়মিত পরিষ্কার না হওয়া হাসপাতাল, অ্যাসাইলাম, কেয়ার হোম, ক্যাম্প, বা বিভিন্ন নির্মাণ ক্ষেত্রে), বাতাসে স্পোর হয়ে। কিন্তু সাধারণভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল না হলে মনুষ্য শরীরকে এদের আক্রান্ত করার ক্ষমতা তেমনভাবে থাকে না। কিন্তু আক্রমণ করলে, এবং দ্রুত বোঝা না গেলে, তার চিকিৎসা অনেকসময়ই খুব কঠিন হয়ে পড়ে। কেবলমাত্র সুনির্দিষ্ট কিছু অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ওষুধ (ইন্ট্রাভেনাস AMB, অথবা পোসাকোনাজোল বা আইসাভুকোনাজোল — এই শেষোক্ত দুটি ওষুধ ইন্ট্রাভেনাস বা ওরাল দু ভাবেই ব্যবহার করা যায় ক্ষেত্র বিশেষে) এর প্রতিকার হিসাবে আছে, তবে অনেকসময়েই রোগীর প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে দেহের বিশ্রীভাবে আক্রান্ত অংশ অপারেশন করে কেটে বাদ দিতে হয় (সার্জিকাল ডিব্রাইডমেন্ট)।
একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ (নেহাত অনামী নন, টিভিতে তিনি নিয়মিত বাইট দিতে থাকেন নানা বিষয়ে), দেখলাম হপ্তা খানেক আগে একটি খবরের চ্যানেলে প্রবল আত্মবিশ্বাসে পুরো শরীর দুলিয়ে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কী তা বুঝিয়ে এমনকি চিকিৎসাটাও বলে দিচ্ছেন। অতি উৎসাহে তিনি জানালেন, ভরিকোনাজোল (এটিও এন্টিফাঙ্গাল ওষুধ, যদিও মিউকরে কার্যকরী নয়) দিয়েও নাকি মিউকরের চিকিৎসা করা যাবে। না, আসলে যাবে না। ওই নির্দিষ্ট তিনটি ওষুধ ছাড়া আর কোন ওষুধ দিয়েই যাবে না [৫]। তিনি দেখলাম সেই সুযোগে AIIMS-কে মিথ্যা সাইট করে দাবি করলেন যে, প্রয়োজনে স্টেরয়েডের বদলে অন্য ‘স্টেরয়েড স্পেয়ারিং’ একটি এজেন্ট দিয়েও কোভিডের চিকিৎসা করা যাবে। কিন্তু না, এটাও সম্ভব নয় কোনভাবেই, এবং ক্লিনিকাল ট্রায়ালের দূরতম আয়ত্তেও যে ড্রাগ নেই, AIIMS-কে মিথ্যা সাইট করে সেরকম নতুন আরেকটি ব্র্যান্ড বাজারে লঞ্চ করতে চাওয়া শুধু মানুষকে বোকা বানানোই নয়, প্রাণঘাতী এবং গর্হিত অপরাধ। আসলে সরকার যখন নিজেই দিশেহারা সঠিক চিকিৎসা-নির্দেশিকা তৈরি করতে, তখন এরকম হবেই, হতেই থাকবে। মড়কের সুযোগে সব দোকানীই নিজের জ্ঞান ও দক্ষতার পসরা খুলে বসবেন তাতে আর সন্দেহ কী। সে তিনি যোগ গুরু, হোমিওপ্যাথ, জ্যোতিষ-বাস্তু, ইমিউনিটি-চা / পানীয় কোম্পানির বিক্রেতা বা শহরের বুকে চুটিয়ে আয় করা মানুষকে আরো লুটে নিতে চাওয়া অ্যালোপ্যাথ কিংবা ঝাঁ চকচকে নার্সিংহোমের মালিক, যেই হোন না কেন (এঁরা সবাই গভীরভাবে সংযুক্তও। সেই অন্তঃসম্পর্ক নিয়ে লেখা অবশ্য খুব সহজ নয়)।
ডায়াবেটিসের সাথে মিউকরমাইকোসিসের বা কম বেশি প্রায় সমস্ত ফাঙ্গাল ইনফেকশনের ঘনিষ্ঠ সহাবস্থানের কথাও আজ প্রায় সকলেরই জানা। এক দল বলছেন যে ভারতে ডায়াবেটিস বর্তমানে অনেক বেশি, এবং কোভিড আরো অন্য সব ভাইরাল ফিভারের মতো নিজেও একদিকে রক্তে শর্করার মাত্রা কিছুটা বাড়িয়ে দেয়, আর অন্য দিকে কোভিডজনিত প্রদাহ কমাতে ব্যবহৃত স্টেরয়েডও ডায়াবেটোজেনিক। ফলত সব মিলিয়ে যে শর্করায় ভারী একটা পরিবেশ, তা এই মিউকর সংক্রমণকে এত বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু এখানে মনে রাখা জরুরি যে সারা বিশ্বের সব জায়গাতেই গুরুতর কোভিডজনিত ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে স্টেরয়েডের ব্যবহার হয়েছে, কিন্তু অন্যত্র এমন মিউকরের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি। এর ব্যাখ্যা কী? এক দল বলছেন যেহেতু ভারতে আগে থেকেই মিউকরের ঘটনা বেশি ছিল, বিশেষত ডায়াবেটিসজনিত, তাই এখনও তা বেশি। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে এ কথা দিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতির সম্যক ব্যাখ্যা করা যায় না, কেন না প্রথম বিশ্বের তুলনায় ভারতে মিউকর বেশি পাওয়া গেলেও, তা কখনওই বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনীয় নয়। ২০১৯-এ প্রকাশিত হওয়া যে এপিডেমিওলজিকাল রিভিউ পেপারটি অনুযায়ী কথাগুলি বলা হচ্ছে, যেখানে কানাডা বা ফ্রান্সে প্রতি ১০ লক্ষ জন্যে ১.২ জনের মিউকর হতো, ভারতে সেখানে প্রতি ১ লক্ষে ১৪ জনের (যখন পর্তুগালে প্রতি ১ লক্ষে ৯.৫ জনের) [৬], সেটির তথ্যসূত্রগুলিকে একটু খতিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, তাতে যে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক পরিসংখ্যানগুলি, সেগুলি আসলে ভিন্ন সময়ের। কোথাও কোথাও সেই সময়ের ব্যবধান প্রায় আধ দশকেরও বেশি, কাজেই প্রথমত এই তুলনামূলক পরিসংখ্যান সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এবং তারপরেও আছে তথ্য সংগ্রহে বায়াস ইত্যাদি বিষয়। এছাড়াও এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, প্রথম বিশ্বের আর কোন জায়গা থেকেই কোভিডজনিত মিউকরের প্রাদুর্ভাবের কথা কিন্তু শোনা যায়নি। ভারতে এর আগে মিউকরের এত প্রাদুর্ভাবের কথা কিন্তু কোন চিকিৎসকেরই জানা নেই। কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান এবং ট্রপিক্যাল ডিজিজের প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ বিভূতি সাহা জানাচ্ছেন যে আগে যেখানে তাঁরা গোটা রাজ্যে এক-দু বছরে একটি বা দুটি মিউকর আক্রান্ত রোগী পেতেন, সেখানে এখন সবেমাত্র দেখতে শুরু করেই মে মাসের প্রথম কয়েক সপ্তাহেই তাঁরা প্রায় ১৭টি তেমন রোগী দেখে ফেলেছেন; তাঁর আরো আশঙ্কা যে অন্য রাজ্যের মত পশ্চিমবঙ্গেও এই সংখ্যাটা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে [৭]। উত্তর ভারতে যেখানে মিউকরের হার বেশি, সেখানেও ডাক্তার গুলেরিয়া জানাচ্ছেন যে আগে যেখানে দিল্লিতে দু মাসে একজন পালমোনারি মিউকরের রোগী আসতেন, এখন সেখানে দিনে ১৫ জনের বেশি তেমন রোগী। সরকারিভাবে মিউকরে আক্রান্তের সংখ্যা প্রকাশ করা না হলেও, ইতিমধ্যেই সারাদেশে প্রায় ১৫০০০ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত বলে ধরা হচ্ছে, যার মধ্যে গুজরাটে প্রায় ৪০০০ জন, মহারাষ্ট্রে ৩০০০-র বেশি, কর্নাটকে প্রায় ১৫০০ জন। অবিশ্বাস্য ভাবে বাড়ছে কেস-লোড। ডাক্তার সাহা সঙ্গতভাবেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এই রাজ্য সবে মিউকরের রোগী পেতে শুরু করেছে, এবং অচিরেই এ সংখ্যা বাড়তে থাকবে। বিশ্বের সব দেশই গুরুতর কোভিডে স্টেরয়েড ব্যবহার করলেও, কেবলমাত্র ভারতেই এই মিউকর এপিডেমিকের কারণ কী হতে পারে এবং কীভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব?
এসবের সুস্পষ্ট কোনো উত্তর এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, সম্ভবও নয় এত দ্রুত এর উত্তর খুঁজে পাওয়া। বিশেষত যেখানে আমাদের দেশে আর সব তথ্যের মতো ক্লিনিকাল ডেটাও সেভাবে রাখা হয় না। মনে রাখা দরকার সঠিকভাবে এই CAM-এর কারণ কেবল তখনই নির্দিষ্ট করা সম্ভব হবে, যখন সমস্ত বা অনেক হাসপাতালের ও রোগীর ডেটা যত্ন করে সমীক্ষা করা হবে। তার আগে নয়। এখন শুধু সম্ভাব্য যে ব্যাখ্যাগুলি উঠে আসছে তাই নিয়েই এই লেখা, কোভিড চিকিৎসা বিভ্রাটের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে।

গুরুতর কোভিডে স্টেরয়েড দিয়ে প্রদাহ কমানোর সময় স্টেরয়েডের প্রভাবে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কথা মাথায় রেখে সমস্ত হাসপাতালে ভর্তি তেমন রোগীর নিয়মিত শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা হয়, এবং তাঁদের ইনসুলিনও দেওয়া হয় প্রয়োজনমত। কাজেই সে ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত সুগারের তত্ত্ব সরাসরি খাটে না। তাহলে কোভিডের সঙ্গে যুক্ত মিউকরমাইকোসিসের প্রাদুর্ভাবের সম্ভাব্য কারণগুলি কী কী হতে পারে? এবার আমরা তা আলোচনা করব:
১. স্টেরয়েডের অপ্রয়োজনীয় ও যথেচ্ছে প্রয়োগ: গুরুতর কোভিড ছাড়াও মাইল্ড/মডারেট অসুখে, কেবলমাত্র জ্বর এলেই বা কোভিড উপসর্গ দেখা দিলেই স্টেরয়েডের অপ্রয়োজনীয় ও যথেচ্ছ প্রয়োগ। AIIMS-র ডাক্তার গুলেরিয়া এবং CSTM-র ডাক্তার সাহা দুজনেই এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন আমাদের। স্টেরয়েডের এই অপপ্রয়োগ প্রথম বিশ্বের কোন দেশেই কখনওই হয় না, কোভিডে তো নয়ই। এটি অবশ্যই একটি প্রয়োজনীয় দিক যা সম্পর্কে এখনই সতর্ক হওয়া উচিৎ। বিশ্বব্যাপী নির্দেশিকা মেনে নাগরিকের পাতায় আমি ৫ই মে লিখেছিলাম, অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমেনি যে রোগীর, যিনি অক্সিজেন পাচ্ছেন না, তাঁকে যেন কোনওভাবেই কোভিডে ওরাল স্টেরয়েড দেওয়া না হয়। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডাক্তার বিভূতি সাহাও সেকথা মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি। “কেউ অতি উৎসাহে, আবার কেউবা নলেজ গ্যাপ থেকে” এরকম করছেন, এবং এই আচরণ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার, বলেছেন ডাক্তার সাহা। আমার কাছে এবং অনেকের কাছেই আছে রাজ্যের শীর্ষ মেডিকেল প্রতিষ্ঠানের এক বিভাগীয় প্রধানের নাম পৃষ্ঠার ব্যাকগ্রাউন্ডে মার্জ করিয়ে দিয়ে বানানো কোভিডের একটি ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল, যাতে স্পষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে স্যাচুরেশন কমে যাওয়ার অপেক্ষা না করেই “গেম চেঞ্জার” ওরাল স্টেরয়েডের প্রয়োগ। সেই AIIMS-এর মেডিসিন বিভাগের পুরোনো নির্দেশিকাটির মত, যা আমি এই সাইটে আগের লেখাটিতে উল্লেখ করেছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের আরো বেশ কয়েকজন অত্যুৎসাহী বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক এবং রেসিডেন্টকেও আমি গত এক মাস ধরে এই বলে খুব হৈ চৈ করতে দেখেছি যে, কোভিডে স্টেরয়েডই হলো “গেম চেঞ্জার”। যারপরনাই হতাশ লেগেছে। মন্ত্রীরা বলছেন যুদ্ধ, বিজ্ঞানের সান্ত্রীরা বলছেন গেম। চিকিৎসা বা বিজ্ঞানের ইতিহাস বলে ‘গেম চেঞ্জার” বলে কিছু হয় না। বিজ্ঞানের এমন অতিসরল বিজয়গাথার তাৎক্ষণিক আস্ফালনের বাইরে এই শব্দবন্ধের আর কোনও অস্তিত্ব ও তাৎপর্য নেই, একথা বোঝা আশু প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী নির্দেশিকার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, ডাক্তার গুলেরিয়া এবং ডাক্তার সাহার পরামর্শ অনুযায়ী, বিনা সাপ্লিমেন্টাল অক্সিজেনের কোভিড রোগীকে (অর্থাৎ, যাঁদের অক্সিজেন দিতে লাগছে না, স্যাচুরেশন ঠিক আছে, এমন যাঁরা), সিস্টেমিক স্টেরয়েড দেওয়া অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার।
২. দূষিত অক্সিজেনের প্রয়োগ বা নোংরা অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহারের তত্ত্ব: দ্বিতীয় যে কারণটি ভাবা হচ্ছিল প্রথমে, কন্টামিনেটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন বা অপরিষ্কার জলের কারণে দূষিত অক্সিজেনের প্রয়োগ বা নোংরা অক্সিজেন মাস্কের ব্যবহার মিউকরের এই প্রাদুর্ভাব, এ কারণটি সবচেয়ে দুর্বল কারণ বলে এখন মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা [৮]। এ প্রসঙ্গে আরও মনে রাখা জরুরি যে মিউকর যেমন সংক্রামক নয় (একজন ব্যক্তি থেকে আর একজনের মিউকর কখনওই হতে পারে না), তেমনি অক্সিজিনেশন, হিউমিডিফায়ার বা জল দ্বারাও এটি বাহিত হয় না। যদিও সম্পূর্ণ তথ্য এখনও সামনে আসেনি, তবে যাঁরা আদৌ অক্সিজেন পাননি, তেমন পোস্ট-কোভিড রোগীদের মধ্যেও মিউকর দেখা গেছে। বরং মাস্ক পরে থাকলে মিউকরের স্পোর ঢুকতে পারে না শরীরে। এমনকি বাতাসে তখন তা থাকলেও নয়। কাজেই জনপরিসরে মাস্ক কেবলমাত্র কোভিডই নয়, মিউকরের বিরুদ্ধেও কার্যকরী। এখানে মনে রাখা জরুরি যে, স্পোর শরীরে ঢুকলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক থাকলে মিউকরে আক্রান্ত হওয়ার কথা নয়। একটি জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে একজন ENT-র ডাক্তারবাবুকে দেখা গেছে, যিনি খুব উত্তেজিত হয়ে সারাদিন স্টিম নেওয়াকেই মিউকরের কারণ বলে দাবি করছেন। ওঁর দাবি স্টিম নেওয়ার ফলে নাকের ভিতরের সিলিয়া নষ্ট হয়ে গিয়ে স্পোর ঢুকে পড়ে মিউকর হচ্ছে। এই ছেলেমানুষি দাবির কোনো ভিত্তি নেই, কারণ প্রথমত সব সিলিয়া নষ্ট হওয়ার মতো সারাদিন স্টিম নেওয়া এক অসাধ্য কাজ, আর দ্বিতীয়ত স্পোর শরীরে প্রবেশ করা আর মিউকর হওয়া — এ দুটি কোনওভাবেই একই বিষয় নয়। যাঁরা ইতিমধ্যেই মিউকরে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের কেউ সারাদিন কেন, একবারও স্টিম নিয়েছেন বলে জানা যায়নি। মিউকরের একমাত্র কারণ হতে পারে কোনও কারণে দুর্বল হয়ে পড়া শারীরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, আর শরীরে ফাঙ্গাল গ্রোথের উপযুক্ত পরিস্থিতি। কোভিড হলে সিম্পটম্যাটিক রিলিফের জন্যে স্টিম নিলে তা থেকে কোনওভাবেই মিউকর হয় না। আর অনেক ক্ষেত্রেই নাকের উপরে, ভিতরে বা মুখে যে মিউকর দেখা যাচ্ছে, তা শরীরের ভিতরের পালমোনারি বা অন্য মিউকরের থেকে হওয়া সেকেন্ডারি ইনফেকশন।
৩. প্রচুর সংখ্যক রোগী ও হাসপাতালের অপরিচ্ছন্ন-অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ: এই তৃতীয় কারণটিকেও মিউকরের একটি সম্ভাব্য কারণ বলে ভাবা হচ্ছে, যদিও সম্পূর্ণ তথ্য হাতে আসার আগে এটিকে নিশ্চিতভাবে কারণ হিসাবে দেখা মুশকিল। তবে অনেকসময়ই হাসপাতালের বাড়ি বাড়ানো হচ্ছে রোগীর সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে, আর অন্যদিকে রোগী ভর্তি চলছে। অর্থাৎ এসময় হাসপাতালের একদিক হয়ে গেলো কনস্ট্রাকশন সাইট, আর অন্যদিকে প্রচুর রোগী থাকায়, ও অপ্রতুল সাফাইকর্মী ও অনুপযুক্ত তত্ত্বাবধানের কারণে বাথরুম সহ সব জায়গা অপরিষ্কার হয়ে থাকছে। কোভিড রোগীদের প্রতি আশঙ্কাবশত অনেকসময় কেউ যাচ্ছেন না ওয়ার্ড-এ রুটিন পরিষ্কারে, বদলানো হচ্ছে না এমনকি রোগীদের বিছানার চাদর বা জামাকাপড়। অনেক রোগীই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশিদিন ভর্তি থাকছেন হাসপাতালে। তবে এসব কোনো যুক্তিই তেমন জোরালো নয়, কেননা ইমিউনিটি ঠিক থাকলে এককভাবে এই কারণগুলির জন্যেই শুধু মিউকর হতে পারে না, এবং কোভিড-পূর্ববর্তী সময়েও এই সমস্যাগুলি বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালে কমবেশি থাকতোই বলা যায়। তবে অন্য আর সব কারণের সঙ্গে এই কারণটি যুক্ত হয়ে গিয়ে মিউকরের সম্ভাবনাকে বাড়াতে যে পারে না, তেমন কিন্তু নয়। সমস্ত তথ্য সামনে এলে, আমরা হয়তো দেখবো যে কোনো একটি নয়, একাধিক কারণের উপর্যুপরি সমাপতনের ফলে মিউকর আজ এপিডেমিক হিসাবে দেখা গেছে।
৪. অকারণ জিঙ্কের ব্যবহার: কোভিড চিকিৎসায় জিঙ্ক সহ নানা অপ্রয়োজনীয় যে উপকরণগুলি ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলি সবই সন্দেহের তালিকায় এখন। এদের মধ্যে জিঙ্ক যে ফাঙ্গাল গ্রোথে সাহায্য করে করে সে বিষয়ে অনেক প্রমাণিত সমীক্ষা আছে। সত্যি কথা বলতে সভ্যতায় ফাঙ্গাসের বিবর্তন এবং টিকে থাকা জিঙ্ক সহ অন্য নানা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের উপর অনেকাংশে নির্ভর করেই সম্ভব হয়েছে [৯]। তাই মাত্রাতিরিক্ত (দৈনিক প্রায় ৫০ মিলিগ্রাম করে জিঙ্ক আরো নানা অদ্ভুত সব ড্রাগ ককটেলের সঙ্গে, যেখানে জিঙ্কের দৈনিক প্রয়োজন ক্ষেত্র ভেদে মাত্র ৮-১২ মিলিগ্রাম, এবং এর প্রায় সবটাই যাঁরা নিয়মিত সুষম আহার করতে পারেন, তাঁরা সেখান থেকেই পান) জিঙ্কের ব্যবহারকে কোভিডজনিত মিউকরের প্রাদুর্ভাবের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে দেখা হচ্ছে। বিশেষত কোভিডে যেখানে প্রদাহের ফলে শরীরে ফেরিটিনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়, সেখানে ওই বিপুলভাবে বর্ধিত আয়রন লোডের উপস্থিতিতে, অতিরিক্ত জিঙ্ক এবং অন্য নানা মিনারেলস ক্ষতিকারক হয়ে ওঠা খুবই সম্ভব। মেডিসিনের সেই মিডিয়ার মুখ ডাক্তারবাবু দেখলাম অত্যন্ত বিরক্ত হচ্ছেন এমন সব সন্দেহে, এবং ক্যামেরায় দৃঢ়তার সঙ্গে জানাচ্ছেন যে দৈনিক ৫০ মিলিগ্রাম জিঙ্ক খাওয়াই যায় (মনে রাখা দরকার বাজারের সবচেয়ে জনপ্রিয় জিঙ্ক-ওয়ালা মাল্টি-ভিটামিনটিতে জিঙ্ক থাকে মাত্র ১০ মিলিগ্রাম করে, যা আমাদের গড় দৈনিক প্রয়োজন)। তাঁকে সমর্থন করে কিছু অত্যুৎসাহী নেটিজেন বলছেন যে তাঁরা আগেও অনেক জিঙ্ক খেয়েছেন, কিন্তু তাঁদের কখনো মিউকর হয়নি। মনে পড়ে যাচ্ছে, সেই বিনা অক্সিজেনে ‘ওরাল স্টেরয়েড’ দেওয়ার যুক্তির কথা, যে ‘ওরাল স্টেরয়েড’ তো অন্য রোগেও দেওয়া হয়! কিন্তু এটা তো অন্য রোগ নয়, এটা কোভিড, যেখানে অন্যতম ‘acute phase’ মার্কার ফেরিটিন বহুগুন বেড়ে গেছে। এমতবস্থায় দৈনিক ৫০ মিলিগ্রাম করে জিঙ্ক (যার প্রায় সবটাই উদ্বৃত্ত) খাওয়ানো, একজন ইমিউনিটি কমে যাওয়া করোনারোগীকে, একেবারেই কোনো কাজের কথা নয়। জিঙ্ক, সঙ্গে শরীরে বিপুল আয়রন, ব্যাকগ্রাউন্ডে কমে যাওয়া ইমিউনিটি আর হরেক অন্য ওষুধ, মিউকরকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি হিসাবে একে তেমন মন্দ বলা যায় না (তাত্ত্বিকভাবে)। সতর্ক হওয়া কিন্তু জরুরি, আর তাই ডাক্তার ল্যান্সলট পিন্টো স্পষ্ট জানাচ্ছেন যে কেবল জিঙ্কই নয়, ইভেরমেকটিন, ফ্ল্যাভিপিরাভির সহ দুরকম অ্যান্টিবায়োটিক্স, নানা অদ্ভুত অননুমোদিত ড্রাগ ককটেলের ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত কোভিড-চিকিৎসায় [৮]। একজন বিখ্যাত অধ্যাপককে মনে পড়ছে, এ প্রসঙ্গে যিনি কিছুদিন আগে আক্ষেপ করছিলেন এই বলে যে “আমরা কোভিডের চিকিৎসা করছি না স্কার্ভির বলো তো? যেভাবে ভিটামিন-মিনারেলস প্রেসক্রিপশন চলছে, এ তো মনে হচ্ছে যেন ফিফটিন্থ-সিক্সটিন্থ সেঞ্চুরি ভয়েজ চলছে, সবাই জাহাজে, ভিটামিন লা-পাত্তা, স্কার্ভি-মড়ক চলছে।” ভিটামিন সি সমেত নানা মাল্টিভিটামিন কড়া ডোজে জিঙ্কের সাথে দেওয়া যে কোভিডে কোন কাজের নয়, তা কিন্তু ট্রায়ালে বোঝা গেছিল অনেক আগেই। কিন্তু প্রেসক্রিপশন বন্ধ হয়নি। নানান ইন-ভিট্রো মডেলের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়ে, কড়া ডোজের এলিমেন্টাল জিঙ্ক ইভেরমেকটিনের সাথে প্রয়োগ করে করোনা ভাইরাসকে যে মেরে ফেলা যাবেই — এ বিষয়ে নিশ্চিত মত প্রকাশ করেছেন অনেকেই। এখন এত “চমৎকার” সব “পুষ্টিকর” ড্রাগ ককটেল আর নানা অ্যান্টিবায়োটিক্স, অ্যান্টিভাইরাল (সঙ্গে স্টেরয়েড থাকলে তো সোনায় সোহাগা),- ফাঙ্গাসের আনন্দের সঙ্গে বেড়ে ওঠার এর চেয়ে ভাল পরিবেশ আর খুব কমই হতে পারত। কোভিড চিকিৎসার যে নানারকম প্রেসক্রিপশন (সরাসরি রোগীকে পরীক্ষা করে লিখে দেওয়া বা না দেখেই টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে), হাতে আসছে, তাতে প্রায় সবরকম ওষুধ একটা করে মিশিয়ে যে দীর্ঘ প্রেসক্রিপশনের চেহারা দেখছি, তাতে একথা হলফ করে বলা যায় যে, এরকম যাচ্ছেতাই প্রেসক্রিপশন চলতে থাকলে, মিউকর তো বটেই, অচিরেই আরো অনেক কোভিডজনিত জটিলতা দেখা যাবে, চিকিৎসা বিভ্রাটেই আমরা হারাবো আরও অনেক সাথীকে।
৫. স্টেরয়েডের অতিরিক্ত ডোজ এবং অধিক সময় ধরে প্রয়োগ: মিউকর মহামারীর আরো একটি বড় কারণ হল স্টেরয়েডের অতিরিক্ত ডোজ এবং অধিক সময় ধরে প্রয়োগ। ডায়াবেটিস সারা পৃথিবীর সব দেশের অনেক মানুষের থাকলেও, তাঁরা গুরুতর কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর স্টেরয়েড পেলেও (হাই-ফ্লো অক্সিজেন বা মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশনে থাকাকালীন), তাঁদের কারোরই মিউকর সংক্রমণ দেখা যায়নি। খেয়াল করলে দেখা যাবে, নভেম্বরে অক্সফোর্ডের যে বিখ্যাত ডেক্সামেথাসোন ‘রিকভারি’ ট্রায়াল ডেটা অনুযায়ী কোভিডজনিত ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে স্টেরয়েডের ব্যবহার সর্বজনস্বীকৃত হয়, তাতে সাপ্লিমেন্টাল অক্সিজেনের সঙ্গে কেবলমাত্র দিনে একবারে ৬ মিলিগ্রাম, প্রতিদিন এই ডোজে সর্বোচ্চ ১০ দিন ওরালি ডেক্সামেথাসোন দিয়ে, ডোজ “taper” না করেই বন্ধ করে দেওয়া হয় (অর্থাৎ, ক্রমান্বয়ে ডোজ কমানোর বদলে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়, শর্ট-টার্ম ইউস বলে) [১০]। ডেক্সামেথাসোন একটি খুবই সহজলভ্য ও সস্তা ওষুধ, বহুদিন ধরে এর ব্যবহার. তৎসত্ত্বেও ICMR এর অল্টারনেটিভ হিসাবে অন্য একটি স্টেরয়েডও ব্যবহার করা যাবে বলে জানায় — মিথাইলপ্রেডনিসোলোন। ফার্মাকোলোজিক্যালি ৩০ মিলিগ্রাম মিথাইলপ্রেডনিসোলোন হলো ৬ মিলিগ্রাম ডেক্সামেথাসনের সমান, কিন্তু ICMR-এর প্রোটোকলে বলা হয় দেহের ওজনের প্রতি কিলোগ্রামে ১ থেকে ২ মিলিগ্রাম এই ডোজে ইন্ট্রাভেনাস মিথাইলপ্রেডনিসোলোন দিতে, দিনে দুবার ভাগ করে (যার মানে একজন গড়পড়তা ৬০ কিলোগ্রাম ওজনের মানুষ তাঁর রোগের জটিলতার প্রেক্ষিতে চিকিৎসকের বিবেচনাসাপেক্ষে দৈনিক ৬০ থেকে ১২০ মিলিগ্রাম অব্দি মিথাইলপ্রেডনিসোলোন পেতে পারেন, যা কিনা ১২ থেকে ২৪ মিলিগ্রাম ডেক্সামেথাসনের সমান। অর্থাৎ বৈশ্বিক সুপারিশের দ্বিগুণ বা চতুর্গুণ ডোজে আমাদের গুরুতর কোভিড রোগীরা স্টেরয়েড পাচ্ছেন। যাঁর ওজন যত বেশি, তিনি তত গুণ বর্ধিত ডোজে পাচ্ছেন, ৯০ কিলোগ্রাম ওজনের ব্যক্তি পাচ্ছেন নির্দিষ্ট ডোজের অন্ততপক্ষে ৩ থেকে ৬ গুণ বেশি ডোজের স্টেরয়েড। বন্ধুদের কাছে শুনছি অনেক জায়গাতেই প্রথমেই একটা আরো অনেক বেশি হাই-লোডিং ডোজও দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ওজন-অনুপাতে, অনেকসময়ই স্টেরয়েড চলছেও অনেক বেশিদিন ধরে। ICMR-এর এপ্রিলের প্রোটোকলেও কিন্তু ছিল ০.৫ থেকে ১ মিলিগ্রাম প্রতি কিলোগ্রাম ওজনের সাপেক্ষে মিথাইলপ্রেডনিসোলোন প্রয়োগের কথা, যা ১৭ই মে-র নির্দেশিকায় বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়। রোগের গুরুত্ব অনুযায়ী স্টেরয়েডের মাত্রার এতখানি ইচ্ছে মত তারতম্য চিকিৎসকদের ফিল্ড আইডিয়ার উপর ছেড়ে দেওয়া হল। যাঁরা সংখ্যায় অপ্রতুল, কাজের চাপে বিধ্বস্ত; পরিস্থিতি সামলাতে জুনিয়র বা শিক্ষানবিশ ডাক্তার, এমনকি চিকিৎসা পাঠক্রমের সিনিয়র বর্ষের ছাত্রছাত্রীরাও হাত লাগিয়েছেন। ইতিমধ্যেই এই বিপুল সংক্রমণের অভিঘাতে নাজেহাল তাঁরা সবাই। হাসপাতাল পরিকাঠামোর বাইরে, গ্রামীণ অঞ্চলে/ দেশের বিস্তীর্ণ যেসব অঞ্চলে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অপ্রতুল, সেখানে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন অ-ডাক্তার বহু মানুষ: যেমন, ওষুধ বিক্রেতা, ফিজিওথেরাপিস্ট, হাসপাতালের ঠিকা কর্মী, অবসরপ্রাপ্ত করণিক, শিক্ষক, এবং অনেক উৎসাহী তরুণ স্বেচ্ছাসেবীও, যাঁদের এসব সম্পর্কে সম্যক কোন ধারণা নেই, যাঁদের ভরসা ICMR বা AIIMS-এর প্রোটোকল, আর সেসব থেকে চুঁইয়ে আসা এদিক ওদিকের কিছু টিপস। অতএব নির্দেশিকা যদি ঠিক না হয়, তা বানাতে যদি যথেষ্ট যত্ন না নেওয়া হয়, তাহলে এমন সব বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।

সিএমসি-ভেলোরের মতো কিছু ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠানের কথা বাদ দিলে, নিয়মিত ক্লিনিকাল প্রোটোকল বানানো এবং নিয়মিত আপডেট করা হয় না দেশজুড়ে। জুলাই ২০২০-র পরবর্তী ICMR নির্দেশিকা এপ্রিল ২০২১-এর, তারপরে অবশ্য ১৭ই মে-র। ভালো ক্লিনিকাল নির্দেশিকার গুরুত্ব উল্লেখ করে তাই WHO, CDC ইত্যাদির অধীনে হওয়া RCT-র তথ্য অনুযায়ী সরকারি স্তরে তেমন সর্বজনগ্রাহ্য নির্দেশিকাকে লাগু করতে বারবার আবেদন জানিয়েছেন চিকিৎসক-গবেষকরা [১১]। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা! কেন্দ্র বা রাজ্য কোন স্তরেই তেমন তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। আসলে যাঁরা আমাদের সরকারি পরামর্শদানকারী বিভিন্ন কমিটিতে থাকেন, তাঁরা নিজেরা এত বেশি বলতে ভালবাসেন এবং আত্মনির্ভরতা আমাদেরও এতটাই আত্মস্থ হয়ে গেছে যে সারা পৃথিবীর তথ্য, ক্লিনিকাল নির্দেশিকা নিতে আমরা চাই না। তাই শতাধিক চিকিৎসক-গবেষকের (এঁরা অনেকেই ভারতীয়) সম্মিলিত প্রয়াসে নির্মিত https://www.indiacovidsos.org/ -এর সুন্দর ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল থাকলেও, তার প্রচার বা ব্যবহারে অনীহা কেন্দ্র, রাজ্য উভয়েরই।
একাধিক আঞ্চলিক ভাষায় সেসব নির্দেশিকা সহজ করে দেওয়া হয়েছে এই ওয়েবসাইটে, নিয়মিত সংযোজন ও প্রয়োজনে জরুরি বদলও করা হয় এই সাইটের নির্দেশিকায়। দেশের অগ্রগণ্য জাতীয় দৈনিকে এর কথা এসেছেও অনেকবার। এমনকি @mygovindia রিটুইটও করেছেন এই সাইটের পরামর্শ। তাও কার্যক্ষেত্রে সেসবের তোয়াক্কা না করেই চলে অন্যরকম ব্যবহার। অচিরেই আত্মনির্ভরতার উপর অটুট আত্মবিশ্বাসে একটুও চিড় না ধরলে আমরা আরও ডুবতে বসব। আরো কত মানুষকে মারা যেতে হবে একথা আমাদের বিশ্বাস হওয়ার আগে? হতাশ লাগে বড়।
লেখা শেষ করার আগে আর একটা কথা না বললেই নয়: সেটা হল তথ্য বা ডেটা ‘কুক’ (রান্না) করা, যা কিনা প্রথম বিশ্বের বাইরের দেশগুলিতে বেশ সহজ এবং চালু অভ্যাস, প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই। সহজ করে বললে ব্যাপারটা এরকম যে নির্দিষ্ট কোন কাজ হাতে-কলমে না করেই (বা করে অন্যরকম ফল দেখতে পাওয়া সত্ত্বেও), কাজটি করা হয়েছে বলে, কতকগুলি পূর্বনির্ধারিত ও কাঙ্খিত ফল তালিকাভুক্ত করে প্রকাশ করা। যে কোন ক্ষেত্রেই এর ফল ভয়াবহ, ক্লিনিকাল ট্রায়ালে তো বটেই। কিন্তু সুবিধা হল সিস্টেমের ভিতরে কোনো ‘whistleblower’ বা খুবই সৎ তদারককারী না থাকলে সীমিত পরিকাঠামোর দেশগুলিতে এই কাজ করা খুবই সহজ। এই ডেটা ‘কুক’ করে কত হাজার হাজার সমীক্ষাই না নানা বিষয়ে প্রকাশিত হয় রোজ। ভরসার কথা এই যে কখনও ডেটা ‘কুক’ করে আবার কখনও অনিচ্ছাকৃত ভুলের কারণে পাওয়া, বা ভুল তথ্যসম্ভার থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত কিন্তু গ্লোবাল-মাল্টিসেন্টর-লার্জ স্কেল RCT-তে এসে খারিজ হইয়া যায়, এখানেই RCT-র মাহাত্ম্য। কলার উঁচিয়ে আমরা একে বিজ্ঞানের মাহাত্ম্যও বলতে পারি। প্লাজমার কথাই ধরা যাক। তত্ত্বগতভাবে এর প্রয়োগে কোভিড নিরাময় সম্ভব, একথা বোঝার সাথে সাথেই ট্রায়াল শুরু হয়। ভারতের ৩৯টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ৪৬৪ জন রোগীর ওপর সম্পন্ন হয় ICMR-PLACID ট্রায়াল। এটি একটি মাল্টিসেন্টার RCT হলেও কেবলমাত্র ICMR-এর অধীনে দেশের ভিতরেই এই ট্রায়াল সম্পন্ন হয়। এর ফলাফলে বলা হয়, প্লাজমা থেরাপি কার্যকরী হতে পারে কেবলমাত্র কিছু নির্দিষ্ট রোগীর ক্ষেত্রে, এবং সে ক্ষেত্রে ডোনারের প্লাজমাতে কোভিড অ্যন্টিবডির পরিমাণও বেশি থাকতে হবে [১২]।
দ্রুত প্রচার হয় এইসব বার্তা, আর আমরা সামাজিক মাধ্যমে দেখতে থাকি গত দেড় থেকে চার মাসের ভিতর কোভিড থেকে সেরে উঠেছেন এমন মানুষের কাছে প্লাজমার জন্যে আবেদন। বেসরকারি হাসপাতালগুলি নানা অসহায় মানুষের কাছ থেকে জোর করে, বিনা পয়সায় (কখনো বা তাঁদের বাড়ির ভর্তি থাকা রোগীক পয়সা নিয়ে যে রক্ত বিক্রি করেছে, তার বিনিময়ে অন্যায়ভাবে) প্লাজমা সংগ্রহ করে অকল্পনীয় চড়া দামে তা বিক্রি করতে থাকে অন্য অসহায় মানুষের কাছে। অনিয়ন্ত্রিত মানুষখেকো বাজারের নিয়মে যোগ হয় শোষণের আরেকটি নতুন অস্ত্র। এসবের মধ্যেই এপ্রিল ২০২১-এর ICMR নির্দেশিকা নির্দিষ্ট প্রোটোকল মেনে প্লাজমা থেরাপি জারি রাখে, সাথে আর সবও, যা আমি আগের লেখায় বলেছিলাম। রেমডেসিভির, প্লাজমাসহ আরও নানা উপকরণের দাওয়াই দিয়ে দিয়ে, ক্রমাগতই ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে আমাদের বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রের ‘উচ্চ’-মানের পরিষেবা।
অবশেষে ১৪ই মে, ২০২১ দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানে ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১১,৫৫৮ জন রোগী নিয়ে ইংল্যান্ডের ১৭৭টি সরকারি হাসপাতালে চলা প্রায় আটমাসব্যাপী ‘রিকভারি’ ট্রায়াল ডেটা, যাতে স্পষ্টতই দেখা যায় কোভিডের মৃত্যুহার প্লাজমার প্রয়োগে একটুও কমে না, এমনকি আরোগ্যলাভেও কোনওরকম প্রভাব প্লাজমা থেরাপির নেই [১৩]। ইতিমধ্যেই একাধিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, যাঁদের মধ্যে এমনকি সরকারের কাছের অনেকেও ছিলেন, তাঁরা ওই রিকভারি ট্রায়াল ডেটা দেখিয়ে দেশের মুখ্য বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টাকে চিঠি লিখেছেন [১৪] প্লাজমার ব্যবহার দ্রুত বন্ধ করার আর্জি জানিয়ে। কারণ দেখা যায় যে ভাল করতে না পারলেও, ব্যাপক ব্যবহারের ফলে নানারকম নতুন মিউট্যান্ট স্ট্রেন তৈরিতে প্লাজমার অবদান থাকতে পারে। তাঁদের ওই চিঠিতে তাঁরা প্লাজমা নিয়ে কালোবাজারি এবং রোগীর পরিবারের হেনস্থার কথাও তুলে ধরেন। ওই চিঠির কপি তাঁরা ICMR-এর ডিরেক্টর জেনারেল এবং AIIMS-র ডিরেক্টরকেও দেন। এতসবের পরে ১৭ই মে-র পরিবর্তিত ICMR নির্দেশিকায় প্লাজমা বাদ যায় এবং ১৯শে মে সরকারিভাবে তা টুইট করে জানানো হয়। ব্যাপারটি দ্রুত আলোচিত হতে থাকে মিডিয়ায় [১৫]। যদিও সুস্পষ্টভাবে কোনও অপ্রমাণিত থেরাপিই বন্ধের কোনও কড়া নির্দেশিকা আজও নেই বাজারে, রাজ্য বা কেন্দ্র কোনো তরফেই, বাজারের নিয়ম মেনেই নেই।
কিন্তু মনে রাখা জরুরি যে, অকার্যকারী হিসাবে প্রমাণিত এবং এখনো কার্যকারিতা অপ্রমাণিত —- এমন ওষুধগুলির অকারণ ও যথেচ্ছ ব্যবহার WHO, CDC বারবার করে নিষেধ করেছে [১৬]। কারণ সেখানে সবসময়েই লুকিয়ে আছে অনেক অজানা বিপদের সমস্যা। মনে রাখা দরকার, এই ওষুধগুলি “এমনি এমনি খাই, খেলে ক্ষতি নাই”, ব্যাপারটা একেবারেই এমন নয়। কোভিড সংক্রমণে শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও স্বাভাবিক সময়ের মতো একই থাকেনা একেবারেই, সতর্কতা তাই এসময়েই বেশি জরুরি। অতি দ্রুত এইসব অপ্রমাণিত ওষুধের ব্যবহার বন্ধ না হলে, সামনে আসতে পারে আরও নানা সংক্রমণ, অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্স সহ আরো জটিল সব সমস্যা। মিউকরে কার্যকরী ওষুধ লাইপোসোমাল AMB এতটাই দামি, এবং বেশিরভাগ সময়ই এই রোগ কোন ওষুধেই হার না মেনে যেভাবে জীবন কেড়ে নিতে পারে, তাতে এর প্রাদুর্ভাব আটকানোর চেষ্টা করা ছাড়া বিশেষ গত্যন্তর নেই। আর তাই অবিলম্বে কোভিডের সঠিক চিকিৎসা নির্দেশিকার উপর জোর দিতেই হবে, নচেৎ কদিন পর দিল্লীর মতো এ রাজ্যেও মিউকরের তথ্য গোপন করার আইনি নোটিশ জারি করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না [১৭]। এর সঙ্গে হয়ত দেশজুড়ে আসতে চলেছে মাল্টি-ড্রাগ রেসিস্টেন্ট নানা ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন [১৮], এবং আরও অনেক অজানা রোগ।
আত্মনির্ভরতার বাগাড়ম্বর থেকে বেরিয়ে কোভিড মোকাবিলায় উপযুক্ত নির্দেশিকা কার্যকরী করা আশু প্রয়োজন, এবং একই সাথে আবশ্যক বেসরকারি ক্ষেত্রের স্বাস্থ্য ব্যবসায় কড়া আইনের সাহায্যে লাগাম টানা। নচেৎ আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলির ভিতরে ক্রমশ পশ্চাদপসরণই করতে থাকব কেবল, আরো বহু কোটি সঙ্গীর মৃত্যুর বিনিময়ে।

নির্বাচিত তথ্যসূত্র:

১. https://indianexpress.com/article/india/steroid-use-too-early-may-be-causing-drop-in-oxygen-aiims-chief-randeep-guleria-7300712/

২. https://www.icmr.gov.in/pdf/covid/techdoc/COVID_Management_Algorithm_17052021.pdf

Click to access COVID_Management_Algorithm_170521.pdf

৩. https://twitter.com/ProfSomashekhar/status/1395430073084174347?s=20

8. https://www.thehindu.com/news/national/doctors-warn-of-severe-post-covid-secondary-infections/article34572159.ece
https://indianexpress.com/article/explained/mucormycosis-diabetes-covid-patients-symptoms-treatment-explained-7320996/

৫. https://www.cdc.gov/fungal/diseases/mucormycosis/treatment.html

৬. Prakash, H., & Chakrabarti, A. (2019). Global Epidemiology of Mucormycosis. Journal of fungi (Basel, Switzerland), 5(1), 26. https://doi.org/10.3390/jof5010026

৭. https://www.youtube.com/watch?v=CFlCrqTkcvA

৮. https://qz.com/india/2012257/why-india-has-so-many-cases-of-mucormycosis-or-black-fungus/

৯. Wilson D. (2015). An evolutionary perspective on zinc uptake by human fungal pathogens. Metallomics : integrated biometal science, 7(6), 979–985. https://doi.org/10.1039/c4mt00331d

১০. https://www.nejm.org/doi/full/10.1056/NEJMoa2021436

১১. এ বিষয়ে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক, বিশদ ও সাম্প্রতিক লেখা: https://scroll.in/article/995866/getting-clinical-practice-guidelines-right-is-crucial-for-india-to-control-the-pandemic

১২. https://www.bmj.com/content/371/bmj.m3939

১৩. https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(21)00897-7/fulltext

১৪. https://science.thewire.in/the-sciences/covid-public-health-experts-pen-concerns-about-plasma-to-psa-vijayraghavan/

১৫. https://science.thewire.in/health/icmr-removes-plasma-therapy-from-covid-19-management-protocols/

১৬. https://www.thehindu.com/news/national/who-chief-scientist-soumya-swaminathan-interview-covid-19-response-over-next-6-18-months-critical/article34574108.ece

১৭. https://science.thewire.in/health/new-regulations-suggest-delhi-government-will-censor-info-about-black-fungus/

১৮. https://www.thehindu.com/opinion/lead/slowing-the-pace-of-indias-mucormycosis-threat/article34644652.ece

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.