অর্ক মুখোপাধ্যায়

করোনা আবহে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি কী হতে পারে, তা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। তবে পরীক্ষাটা বাতিল হয়েই গিয়েছে৷ স্থগিত নয়, বাতিল। করোনা পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হলেও আর পরীক্ষার সম্ভাবনা নেই।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সরকার করোনার ঘাড়ে দায় ফেলে পরীক্ষা বাতিল করল। বাতিল করার আগে ই-মেল মারফৎ জনমত জানার চেষ্টাও হল। তবে এই পদ্ধতির মাধ্যমে যে ‘মত’ জানা গেল, তা আদৌ কতটা জনমত আর কতটা কেবলমাত্র বিশেষ এক শ্রেণীর মত,  তা নিয়ে কিন্তু অবশ্যই বেশ খানিকটা ধোঁয়াশা রয়েই যাচ্ছে। খোলসা করেই বলা যাক। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে চলতি শিক্ষাবর্ষে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২১ লক্ষ। তাঁদের পরিজন, শুভানুধ্যায়ী, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ধরলে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি৷ কিন্তু সরকারের কাছে ই-মেল এসেছে কত? মাত্র ৩৪ হাজার। কত শতাংশ মানুষ তাহলে এই একদিনের নোটিশে মতামত জানিয়ে উঠতে পারলেন? ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও ত্রাণশিবিরে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা খুব কম নয়। বহু এলাকায় ঠিক ভাবে ইন্টারনেট সংযোগ নেই। এমন কোনও নিশ্চয়তাও নেই যে এই ৩৪ হাজার ইমেল পরীক্ষার্থী বা অভিভাবকদের কাছ থেকেই এসেছে। সময় খুব অল্প ছিল। জনমত যখন নেওয়াই হল তখন তো ফর্ম ছাপিয়ে স্কুলে স্কুলে পাঠিয়ে অভিভাবকদের কাছ থেকে তা নেওয়া যেতে পারতো। মানছি কাজটা সময় সাপেক্ষ । কিন্তু সময় তো ছিল।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ঘিরে পুরো বছরটা ধরেই এক রকমের গয়ং গচ্ছ মনোভাব ছিল সরকারের। সিলেবাস কমানোর কথা জানানো হয় অনেক পরে। তখন মাধ্যমিকের অধিকাংশ পড়ুয়ার সিলেবাস শেষ হয়ে গেছে। এরপর টেস্ট পরীক্ষা বাতিল করা হয়। আজ যদি টেস্ট পরীক্ষাটা নেওয়া থাকত, তাহলে অন্তত মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সেই মার্কসকে গুরুত্ব দেওয়া যেত। মূল্যায়ণ নিয়ে অহেতুক জটিলতা হত না। মার্চের প্রথম দিকে অনায়াসে টেস্ট পরীক্ষা নেওয়া যেত। দুঃখের বিষয় হল, সেই সময় সরকার তথা রাষ্ট্রের কাছে নির্বাচনী স্বার্থ বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। তাই দফায় দফায় নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনী জনসভায় উপচে পড়েছে ভিড়। কিন্তু টেস্ট পরীক্ষার কথা আর ভাবেনি সরকার।
আসল কথা হল ফেব্রুয়ারিতে স্কুল খোলা হয়েছিল নির্বাচনকে মাথায় রেখেই। পরীক্ষার পরিকল্পনা সেইভাবে তৈরি করাই হয়নি। এরপর ভোটের মাসে পরীক্ষা কি করেই বা সম্ভব! তাই জুন মাসের কথা বলা হল। কিন্তু ততদিনে বাড়তে শুরু করেছে করোনার প্রকোপ। ফলে পরীক্ষা বাতিল। প্রসঙ্গত, কেরলেও কিন্তু ভোট ছিল। কেরল সরকার এপ্রিলেই পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। অত্যন্ত সুচিন্তিত পদক্ষেপ। যদিও একথা ঠিক যে পশ্চিমবঙ্গের মত আট দফায় ভোট কেরলে হয় নি। কিন্তু উপায় কি কিছু বেরত না?
এবার অন্য কিছু সমস্যার কথায় আসা যাক। বিকল্প মুল্যায়ন পদ্ধতিতে যদি নবম শ্রেণির প্রাপ্ত মার্কস দেখা হয়, তাহলে সরকারকে আগে সুনিশ্চিত করতে হবে এই ক্ষেত্রে কোনওরকম দুর্নীতি যেন না হয়। বহু স্কুলের উপর স্থানীয় স্তর থেকে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার চাপ আসতে পারে। পর্ষদের কাছে কি ক্লাস নাইনের ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্ত মার্কসের নথি আছে ? সম্ভবত নেই। যদি না থাকে তাহলে কিন্তু অবৈধভাবে মার্কস
বাড়ানোর খেলা চলবে বলেই আশঙ্কা। এর ফলে বহু ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি হবে। মেধার অবমূল্যায়ন হবে।
সরকারের উচিত কেবল নবম নয়, নবম এবং অষ্টম শ্রেণি মিলিয়ে মার্কস নিয়ে মুল্যায়ন করা। এক বছর কোনও ছাত্রছাত্রীর রেজাল্ট খারাপ হতেই পারে। কিন্তু সে জন্য তাকে ফল ভোগ করতে হবে কেন?অবিলম্বে সরকারের উচিত সমস্ত নম্বরের তথ্য স্কুল থেকে সংগ্রহ করে নেওয়া, যাতে স্থানীয় স্তরে নম্বর বাড়ানোর অপকৌশল রোখা যায়। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের একাদশ শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগের চারটি পরীক্ষা এবং কিছু অন্য বিভাগে তিনটে পরীক্ষা হয়েছিল। কিন্তু করোনার জন্য বাকি পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ স্কুল আর ফলাফল ঘোষণা করেনি৷ পর্ষদও তেমন জোর দেয়নি। কিন্তু যদি ফলাফল প্রকাশ করা হত তাহলে সেই নম্বর ধরে মুল্যায়ন করা যেতে পারত। মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে উচ্চমাধ্যমিকে নম্বর নির্ধারিত হলে সেটি অন্যায়। এভাবে কখনও সঠিক মূল্যায়ন হতে পারে না।
এরপর প্রশ্ন আসতে বাধ্য যে পরীক্ষা বাতিল করাই কি একমাত্র পথ ছিল? সরকার কি কিছুদিন সময় নিতে পারত না? রাজ্য সরকারই দাবি করছে রাজ্যে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমছে। তাই যদি হয়, তাহলে জুলাইয়ের শেষ বা আগস্টে কি সত্যিই পরীক্ষা নেওয়া যেত না? কম নম্বারের পরীক্ষা, কম সময়ের পরীক্ষা- নেওয়া যেত না? নাকি কোন অদৃশ্য চাপ ছিল? বেসরকারি পুঁজির চাপ নয় তো? শিক্ষায় বেসরকারিকরণের ফলে কর্পোরেট লবিং এখন খুব সাধারন ব্যাপার। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান যারা প্রতিযোগিতামূলক বা প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দেয় তারা তাদের ব্যবসায়িক কারণেই চায়নি ছেলেমেয়েরা বেশিদিন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক নিয়ে আটকে থাকুক। কারন, তাদের কোর্সে ছেলেমেয়েরা ততদিন ভর্তি হবেই না যতদিন পর্যন্ত না এই পরীক্ষাগুলি সম্পন্ন হচ্ছে। এবার সবাই কম বেশি ভাল নম্বর পাবে। সরকারী কলেজে সুযোগ না হলেও বেসরকারি কলেজের কোর্সে ভর্তি হবার জন্য প্রয়োজনীয় মার্কস কিন্তু সবার থাকবে। তাই টাকা থাকলে কোর্সে ভর্তি হবার ফ্লাডগেট খুলে দেওয়া হল না তো?
বহু ছাত্রছাত্রী উচ্চমাধ্যমিকে বা মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করে। সেই ফলাফল তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে পরবর্তীকালে সাফল্য পেতে। অনেক ছাত্রছাত্রী এই দুই পরীক্ষায় নিজেদের জাত  চেনায় এবং ফলাফলের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এই ফলাফল তাদের উচ্চশিক্ষা চালিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। বহু দরিদ্র ছাত্রহাত্রী লড়াই করে ভাল ফল করে, তারপর আর্থিক সাহায্য পেয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করে। স্বাভাবিক ভাবেই  প্রশ্ন উঠবে এই ফল থেকে আর্থিক বৃত্তির জন্য ছাত্রছাত্রীদের বাছা কি আদৌ সম্ভব হবে? অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা কি বৃত্তি পেয়ে যাবে? প্রকৃত মেধাবীরা কি বৃত্তি থেকে বঞ্চিত থাকবে? মেধা থাকলেও এই ধরনের মূল্যায়নের জন্য বৃত্তি না পেয়ে অনেক ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষার পথ বন্ধ হয়ে যাবে না তো?
মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা প্রায় ১৬ মাস ধরে পড়াশোনা করেছিল। পরীক্ষা না হবার সিদ্ধান্ত তাঁদের পক্ষে চরম হতাশাজনক। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা তবুও প্রবেশিকা পরীক্ষায় নিজেদের প্রমান করার সুযোগ পাবে। কিন্তু মাধ্যমিক জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। এই পরীক্ষার অভিজ্ঞতা ছেলেমেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। তারা বুঝতে পারে নিজেদের অবস্থা। বুঝতে পারে ঠিক কতটা প্রস্তুত ছিল তারা। এই অভিজ্ঞতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পরীক্ষা না হওয়ায় অনেক ছাত্রছাত্রী উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। এর দায় কে নেবে? পরীক্ষা নিতে কেন এই অনীহা? দিনহাটার বাসিন্দা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। মাধ্যমিক দিতে না পারার যন্ত্রনায় নিজেকে শেষ করে দিয়েছে সে। অভিভাবকদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। ছেলে মেয়েদেরকে বোঝাতে হবে – ‘জীবন সবকিছুর চেয়ে বড়’, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের চেয়েও।
এভাবে পরীক্ষা বাতিল হওয়া কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রের জন্য বেশ বড়সড় অশনিসংকেত। পরীক্ষা না হওয়া মানে মেধার সঙ্গে আপোষ। শিক্ষায় বাণিজ্যকরন আপোষ করতে শেখায় মেধার সঙ্গে। শিক্ষা পণ্য হয়ে ওঠে। মেধার গুরুত্ব কমে। ভয় হয়, আস্তে আস্তে পরীক্ষা ব্যবস্থাটাকেই বাতিল করে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে না তো? মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক বাতিল ঠিকই, কিন্তু এর বিপদ তো কেবল পরীক্ষার্থীদের নয়। বড় বিপদের আশঙ্কাটা কিন্তু সকলের জন্যই। সকলেই নিশ্চয় বুঝতে পারছেন পরীক্ষার কোন বিকল্প আমাদের সীমিত শিক্ষা পরিকাঠামোয় নেই। পরীক্ষা বাতিল করে বহু ছাত্রছাত্রীর স্বপ্নে জল ঢেলে দেওয়া হল। তবে দেখার বিষয় অগস্ট মাস পর্যন্ত সরকার কেমন ভাবে করোনা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ পালন করে। কারণ, ২১ জুলাই কিন্তু তার আগেই আসবে।

লেখক সমাজকর্মী ও গৃহশিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

  1. যাদের পাঁচটা subject এ পাঁচটা tuition পড়ার পয়সা আছে, বাড়িতে থেকে দেড় বছর ধরে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়েছে আর প্রস্তুতি নিয়েছে, তাদের জন্য পরীক্ষা না হওয়া খুবই হতাশাজনক। অন্যদিকে যে সব দরিদ্র ছেলেমেয়ে দেড় বছর ধরে বাড়ি বসে আছে, পয়সার অভাবে tuition পড়তে পারে নি, অনেককেই পড়া ছাড়িয়ে দিয়ে কাজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, পরীক্ষা হলে তাদের মেধার মূল্যায়ন টা কি ঠিক হতো? কিছু স্বচ্ছল অংশের ছাত্রছাত্রীর সুবিধা এবং বাকিদের সমস্যায় ফেলে প্রকৃত মেধা যাচাই সম্ভব হতো? সরকারি স্কুল বন্ধ করে রাখার সময়ই তো আসল ক্ষতি হয়ে গেছে, তখন তো কেউ কিছু বলে নি।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.