~শম্ভূ মান্না~

সম্প্রতি রাজ্য সরকার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল বলে ঘোষণা করল। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়, একথাও ঠিক। আবার জুলাই-আগস্ট মাসে করোনা সংক্রমণের হার যে অনেক কমবে, এটাও ডাক্তার বিশেষজ্ঞরা বলছেন। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী কয়েক দিন আগেই ঘোষণা করেছিলেন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। শিক্ষামন্ত্রী একই বক্তব্য পেশ করেছিলেন। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে প্রায় ২১ লক্ষ পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। তাই হঠাৎ একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কয়েক দিনের মাথায় বিশেষজ্ঞ কমিটি (যে কমিটিতে কোন শিক্ষক প্রতিনিধি ছিলেন না) রিপোর্ট দেওয়ার পরই ২২ ঘন্টার মধ্যে ছাত্র-অভিভাবক-জনসাধারণের কাছ থেকে ইমেলে মতামত চাওয়া হল, পরীক্ষা হবে কিনা। সরকারের কথা অনুযায়ী মতামত এসেছে ৩৪,০০০ এবং তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত ঘোষণা। এটা সত্যিই কি ছাত্র-অভিভাবক-জনসাধারণের মত? কারণ পশ্চিমবঙ্গে এখনো বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর অভিভাবক ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন না। তার উপর তিন জেলায় ইয়াস ঝড়ে বহু মানুষ আজও আশ্রয়হীন। তাহলে অনলাইনে এত দ্রুত পাওয়া এই মতামতের মূল্য কতটুকু? রাজ্যের কত শতাংশ অভিভাবক বা পরীক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন? কতজন ইমেল পাঠানোর সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত, তা-ও কি ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিল না?

আবার কোভিড প্রোটোকল মেনে হোম সেন্টারে প্রতিদিন দুটো বিষয়ে ৫০% নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া যেত।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সেই অর্থে বিদ্যালয়ে গত বছর থেকে শিক্ষাদান খুব বেশি হয়নি, একথা ঠিক। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা দীর্ঘদিন যতটুকু পেরেছে প্রস্তুতি নিয়েছে। তাদের আশা ছিল পরীক্ষা হবে। সেই ছাত্রছাত্রীদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হলো কি? পরীক্ষার্থীরা ২১ লক্ষ, সব মিলিয়ে মতামত এসেছে মাত্র ৩৪ হাজার। এটা বাস্তবের প্রতিফলন নয়।

যে শিক্ষক শিক্ষিকারা ছাত্রছাত্রীদের দীর্ঘদিন পরিচর্যা করেন, এক্ষেত্রে তাঁদের মতামত চাওয়াও দরকার ছিল। আলাদাভাবে তাঁদের মত এল না। এমনকি শিক্ষক সংগঠনের নেতৃত্বের সঙ্গেও কথা বলা হল না। শিক্ষক সমাজের অধিকাংশ পরীক্ষা গ্রহণের পক্ষে। কথা উঠেছে, সরকার দীর্ঘদিন লকডাউন করছে। তাহলে পরীক্ষায় যুক্ত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে সবাইকে পরীক্ষার কদিন ঘরবন্দি রাখলেই তো করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা কমত এবং ছাত্রছাত্রীদের হোম সেন্টারে পরীক্ষা নেওয়া যেত। প্রসঙ্গত যারা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে, পাসফেলহীন শিক্ষাব্যবস্থায় প্রায় কোন পরীক্ষা না দিয়েই তারা দশম শ্রেণীতে উপস্থিত হয়েছে। এমনকি এ বছর টেস্ট পরীক্ষা পর্যন্ত হয়নি। এদের সরাসরি পাস করিয়ে দেওয়া হলে ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়।

আগামী দিনে এই বছরের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের কিসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে তা নিয়ে অস্পষ্ট থাকবেই। উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীরা কিভাবে উচ্চশিক্ষার পাঠ নেবে বা বিভিন্ন বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাবে, তা কি পরীক্ষা না নিয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব? মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা ওই ধরনের লেখাপড়ায় নানাভাবে সমাজের এক এলিট অংশের ছাত্রছাত্রী সুযোগ পাবে। হয়ত অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হবে। কিন্তু সাধারণ পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা কোন স্ট্রিমে কীভাবে ভর্তি হবে, তা নিয়ে কিন্তু সম্পূর্ণ ধোঁয়াশা রয়েছে। আমাদের রাজ্য সরকার সম্প্রতি “দুয়ারে” নানা কর্মসূচি নিচ্ছে। ভোট, টিকা থেকে শুরু করে ত্রাণ পর্যন্ত দুয়ারে। কষ্ট করে হলেও সরকার শেষ পর্যন্ত বাড়িতে বসিয়ে এই ছাত্রছাত্রীদের দুয়ারে পরীক্ষা নিতে পারত। কারণ সমস্ত প্রশ্নপত্রসহ পরীক্ষার সরঞ্জাম তৈরি। সরকার কিন্তু সে পথেও হাঁটল না।

প্রশ্ন আরো আছে। ইতিমধ্যেই অধিকাংশ শিক্ষক সহ সুপার স্প্রেডারদের বড় অংশের ভ্যাক্সিনেশন হয়ে গেছে। ফলে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে। পরীক্ষা অনলাইন অথবা অফলাইন — দুরকম ব্যবস্থা রেখেও করা যেতে পারত। যাদের পক্ষে অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব তারা দিত,যাদের পক্ষে সম্ভব নয় তাদের অফলাইনে দুয়ারে পরীক্ষা নেওয়া যেত। আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই মূল্যায়ন হয়ে এসেছে। ফলে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা ছাত্রছাত্রীরা দিতে পারল না, এতে বড় হতাশা তৈরি হবেই। ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের এক মেধাবী ছাত্রী পরীক্ষা না হওয়ার ঘোষণায় হতাশায় আত্মঘাতী হয়েছে। অন্যান্য সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলি বাতিল করা হলেও তাদের আভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের নানারকম ব্যবস্থা রয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের নেই।

তাই আমি মনে করি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা না নেওয়া কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রীকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিল।

নিবন্ধকার পেশায় শিক্ষক।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.