ওপিনিয়ন পোল হল বাগানের শিশুদের মতো, যারা প্রায়শই মাটি খুঁড়ে দেখতে চায় চারাটি কত বড় হল — বিখ্যাত এই কথাটি বলেছিলেন ইংরেজ সাহিত্যিক জন প্রিস্টলি। ওপিনিয়ন পোল গণতন্ত্রের জন্য সত্যিই আশীর্বাদ না অভিশাপ সেই বিচার কালের উপর ছেড়ে দিলেও, এটুকু পরখ করে বলাই যায় যে পরীক্ষার আগেই পরীক্ষার ফল বেরনোর এই সাসপেন্স থ্রিলার আজ গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় বিনোদনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ওপিনিয়ন পোল নামেই সব ভাষায় বিখ্যাত এই মতামত গ্রহণ প্রণালীটির উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। ১৯৬৭ সালে এর প্রথম ব্যবহারকারী ডাচ রাজনৈতিক মার্কেল ড্যাম না মার্কিন পোলস্টার ওয়ারেন মিতফস্কি, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও শোনা যায় এর প্রথম ব্যবহার খুব সম্ভবত আরো আগে, ১৯৪০-এর দশকে মার্কিন প্রদেশ কলোরাডোতে। কিছু ভোটারের মতামত নিয়ে তার ভিত্তিতে সব ভোটারের সামগ্রিক মতামতকে যতটা সম্ভব নির্ভুল ভাবে অনুমান করার চেষ্টা করা — সাধারণত এটাই হলো ওপিনিয়ন পোলের মূল উদ্দেশ্য।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সেই মতামত নানা বিষয়ের উপর নেওয়া যেতে পারে। যেমন ভোটার কোন পার্টিকে ভোট দিতে চান, কোন প্রার্থীকে বেশি পছন্দ করেন, কী কী কারণে পছন্দ করেন বা বিভিন্ন ইস্যুতে তাঁর অবস্থান কী ইত্যাদি। শুধু ভোটের শেষে কে জিততে পারে সেটা দেখা ছাড়াও, কেন জিতবে, কারা তার সমর্থনকারী বা কোন ইস্যুগুলি জনতার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এইসব নানা প্রকার জটিল বিষয়ই সমাজ গবেষকদের কাছে বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

নির্দিষ্ট সময়ের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে, বাস্তব প্রেক্ষাপট বিচার করে বিভিন্ন ইস্যুতে তুল্যমূল্য হিসাব করেই সাধারণত মানুষ ভোট দেন। এই সামগ্রিক বিচারের পরিণামই হলো আমাদের ভোট। কিন্তু বেশিরভাগ দেশেই এখনো ভোটের পছন্দটি একটা বাইনারি পছন্দ। কাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ, বা সবচেয়ে বেশি অপছন্দ — এই হল ভোটের সিদ্ধান্তের মূল নির্যাস। বাস্তব রাজনীতির বহুমাত্রিকতা কয়েক বছর অন্তর ঐ একটি ভোটের সামগ্রিকতার মধ্যে ফুটে ওঠা প্রায় অসম্ভব। তাই প্রত্যেকটি বিষয়ে এককভাবে জনমানসের আভাস বোঝার জন্যেও ওপিনিয়ন পোল এক অপরিহার্য হাতিয়ার। সমাজের গতিপ্রকৃতি, ইতিহাস বিশ্লেষণ, এমনকি শাসকের সঙ্গে নাগরিকের নির্বাচন মধ্যবর্তী মত বিনিময়ের জন্যেও এই ধরণের মতামত গ্রহণকারী ওপিনিয়ন পোলগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে এগুলি গবেষণার দীর্ঘকালীন রসদ হলেও, আমজনতার কাছে ‘খেলা’র ফলের আগেই ফল বেরনোর সাময়িক উত্তেজনাই আসল কথা।

পদ্ধতিগতভাবে দেখলে, ওপিনিয়ন পোল আদপে রাশিবিজ্ঞানের স্যাম্পলিং থিওরি বা নমুনা সংগ্রহ তত্ত্বেরই এক প্রয়োগমাত্র। আমরা যেমন চাল কেনার আগে বস্তা থেকে কয়েকটা চাল তুলে দেখে নিই চালগুলি সরু না মোটা, এবং কয়েকটি চাল দেখেই ধারণা করে নিই সেই পুরো এক বস্তা চালের গুণগত মান কিরকম হতে পারে, ঠিক তেমনই ওপিনিয়ন পোলে কিছু বাছাই করা ভোটারের মত নিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করি বাকি সবার মতামত কীরকম হতে পারে।

তবে মূল ধারণাটি রাশিবিজ্ঞান থেকে এলেও, স্যাম্পলিং থিওরি এই মতামত গ্রহণের এক নির্দিষ্ট পদ্ধতি মাত্র। সমাজ এতই জটিল, আর মানুষের মন বোঝা এতই শক্ত, যে কালে কলেবরে জনমত অন্বেষণের এই শাখাটি আজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক স্বতন্ত্র শাখায় পরিণত হয়েছে, যার পোশাকি নাম সেফোলজি। টিভির সান্ধ্য তরজা গুলিতে আজকাল চোখ রাখলেই বোঝা যায় এই সেফোলজিস্ট বা ‘পলিটিকাল পন্ডিত’রা আজ রাজনৈতিক নেতাদেরও টেক্কা দিতে কতটা তৈরি।

সময়ের সাথে সাথে গণমাধ্যমে ওপিনিয়ন পোলের ব্যবহার যত বেড়েছে, জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বেড়েছে বিতর্ক। ওপিনিয়ন পোল নিয়ে সাধারণ মানুষের ধন্দ মূলত দু প্রকার। “কতটা পথ পেরোলে তবে মানুষ চেনা যায়”-এর মত কাকে এবং কতজনকে জিজ্ঞেস করলে তবে মানুষের মন বোঝা যায়, সেটাই হল যাবতীয় সংশয় ও বিতর্কের মূল উৎস। প্রথমত, কতজনকে জিজ্ঞেস করা হলে তবে ভাল করে সবার মতামত বোঝা সম্ভব এবং দ্বিতীয়ত, যাদের জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তারা কতটা প্রতিনিধিত্বমূলক অর্থাৎ তাদের মধ্যে বাস্তবের নানা বিদ্যমান বিভিন্নতা কতটা স্পষ্ট প্রতিফলিত হচ্ছে এই প্রশ্নগুলিই সমাজবিজ্ঞানীদের কাছেও প্রধান চ্যালেঞ্জ।

কজনকে প্রশ্ন করা হলে তা সবার মন বোঝার জন্যে যথেষ্ট? কত বেশি সেই সংখ্যা, কতই বা কম? অর্থবল বা সময়ের অভাবে কাছে যত কম সংখ্যক উত্তরদাতাকে জিজ্ঞেস করে কাজ মিটে যায় সমীক্ষকদের পক্ষে ততই মঙ্গল। কিন্তূ তাতেই আবার লুকিয়ে বিপদ। বড্ড কম হয়ে গেলে সত্য ধরা দেবে কেমনে? এই ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলেই কেল্লা ফতে!

বিভ্রান্তির আরেকটি বিষয় হলো সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের রকমফের নিয়ে। তা সে সামাজিক হতে পারে বা আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক হতে পারে বা যে কোনো পরিচিতিভিত্তিক। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদের শেষ নেই, অগত্যা সমাজও অসংখ্য শ্রেণীতে সদাবিভক্ত। অর্থ, শিক্ষা, বয়স, ধর্ম বা দেশ, কাল, জাতি, লিঙ্গ বিভেদের কোন শেষ নাই, ভাঙার চেষ্টাও বৃথা তাই। বিভেদই যখন দস্তুর, সেখানে সমাজের মূল প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলি কে ধর্তব্যের মধ্যে না আনলে মানুষের দলবদ্ধ গতিপ্রকৃতিগুলি অধরা থেকে যা যায়।

মানুষ এক সামাজিক জাতি, বা বলা ভাল দলবদ্ধ জীব।। তার চিন্তা ভাবনায় সর্বদা প্রভাব ফেলতে থাকে তার নিত্য সামাজিক অবস্থান, যা কিনা গড়ে ওঠে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী ও গোষ্ঠীর মধ্যে তার দৈনন্দিন চলাফেরায়। তাই বিভিন্ন শ্রেণীর যে নিজস্ব গতিপ্রকৃতি ও চরিত্রগত অবস্থান, তার থেকে সেই শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তির মনোভাবেরও কিছুটা পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব। সর্বোপরি এই শ্রেণীগত বিভাজনের যে বৈচিত্র্য সমাজে বিরাজমান, তা নমুনার মধ্যে প্রতিফলিত না হলে অনুমান একপেশে বা পক্ষপাতপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

ধরা যাক, সেই চালের বস্তার শুরুর দিকে কিছু সরু চাল আছে এবং তলার দিকে অনেক মোটা চাল রাখা আছে । ক্রেতা যদি শুধুই উপরের দিকের চালগুলি পরখ করে পুরো বস্তাটা কিনে নিয়ে যায়, তাহলে যত বেশি সংখ্যার চালই সে উপর থেকে খুঁটিয়ে দেখে থাকুক না কেন, সে ঠকবেই। আমাদের সমাজ যে সেই চালের বস্তার থেকে আরো বহু গুণ জটিল তা বলাই বাহুল্য, সুতরাং ততোধিক জটিলতর এই মতামত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলি।

ভাবতে অবাক লাগলেও, নমুনার সংখ্যা মোট জনসংখ্যার যত সামান্য শতাংশই হোক না কেন, তার উপর মোটেই পূর্বাভাসগুলির সঠিকতা নির্ভর করে না। ওপিনিয়ন পোল ঘিরে এটাই সাধারণ মানুষের সবচেয়ে ভুল ধারণা। শুধু নমুনার সংখ্যাটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সঠিক অনুমানের জন্য। বস্তুত, মাত্র পাঁচ হাজার লোকের জনমত বিচার করেও কী করে গোটা ভারতবাসীর জনমত অনুধাবন করা সম্ভব — এই ধাঁধারই সমাধান করে স্যাম্পলিং তত্ত্ব। যে কোন পরিসংখ্যানের কাজেরই মূল উদ্দেশ্য থাকে দুটি — সঠিক পদ্ধাতিতে নমুনা সংগ্রহ এবং যথাসম্ভব নির্ভুল অনুমান। অতীত হতে আগামীর কত কাছাকাছি দ্রুত পৌঁছনো যায়, সেখানেই রাশিবিজ্ঞানের মুন্সিয়ানা। তথ্য থেকে সত্যের পথে ধাবিত হওয়ার পাথেয় হলো স্ট্যাটিসটিক্স। অতীতের তথ্য, নতুন নাম থেকে সংগৃহীত তথ্য এবং কার্য ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক বাকি সবরকম তথ্য মিলিয়েই গড়ে ওঠে ভবিষ্যদ্বাণীর গাণিতিক মডেলগুলি।

আমাদের ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ নির্বাচনী পদ্ধতিতে ভোট শেয়ারের থেকে অনেক বেশি উৎসাহ উদ্দীপনা থাকে কোন দল কটা আসন পেলো তাই নিয়ে, কারণ আসন সংখ্যাই এই ব্যবস্থায় ক্ষমতার চূড়ান্ত নির্ণায়ক। কাজেই বেশিরভাগ সমীক্ষকেরই উদ্দেশ্য থাকে কোন দল কত আসন পেতে পারে সেই আভাস দেওয়া। ভারতবর্ষের লোকসভা নির্বাচনের ওপিনিয়ন পোল করতে গিয়ে ৫৪৩টা আসনের প্রত্যেকটা থেকেই মতামতের নমুনা সংগ্রহ করার মত বিস্তৃত ও ব্যাপক অনুশীলনের সংস্থান অনেকসময়ই সমীক্ষাকারী সংস্থার থাকে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের দেশে আসন সংখ্যার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য যদি প্রতি আসনে সাড়ে তিন হাজার লোকের মতামত নেওয়া যায়, তাহলে প্রায় নির্ভুলভাবেই প্রতি আসনের ফলাফল অনুমান করা সম্ভব। কিন্তু সেই পদ্ধতিতে গোটা দেশে ১৯,০০,৫০০ লোকের মতামত নিতে হয়, যা প্রায় কোন সমীক্ষাকারী সংস্থার পক্ষেই সম্ভব নয়। শুধু অর্থবল নয়, উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সমীক্ষক পাওয়াও দুষ্কর হয়। এখানেই স্ট্যাটিসটিকাল সাইন্স বা রাশিবিজ্ঞানের প্রবেশ।

তবে প্রাপ্ত ভোট শতাংশের থেকে আসন সংখ্যা অনুমানের প্রক্রিয়াটিই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও জটিল। বিভিন্ন আসনে এক এক দলের ভোট শতাংশগুলি সমানভাবে নয়, একেকরকমভাবে ছড়িয়ে থাকে। কোন ওপিনিয়ন পোলে যদি প্রধান দুই দলের মধ্যে ভোট শতাংশের পার্থক্য চার শতাংশের কম হয়ে যায় তাহলেই আসন সংখ্যা নির্ধারণের কাজটি খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই এখানে শুধুই অঙ্কের কারসাজি পর্যাপ্ত নয়। সাথে বাস্তবের নানান খুঁটিনাটি, বিভিন্ন ইস্যু ও আবেগ, তৃণমূল স্তরের তথ্য সংযোজনের জন্য রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ভূমিকাও অতি প্রয়োজনীয়।

এখানেই স্ট্যাটিসটিকাল মডেলগুলির মূল কার্যকারিতা। তবে কোন স্ট্যাটিসটিকাল মডেলই ধ্রুব সত্য নয়, তা মানুষের হাতেই তৈরি। তাই মানুষের মতই ত্রুটিমুক্ত নয়। যে কোনো মডেল নির্মাণেই উক্ত বিশেষজ্ঞদের ডোমেইন নলেজ বা ক্ষেত্র জ্ঞানের ভূমিকাই নির্ভুলতার প্রধান নির্ধারক।

বিদেশে ব্যবহৃত মডেলগুলি সাধারণত আমাদের দেশে খাটে না। এত বৃহৎ ও বিচিত্র এই উপমহাদেশের বাস্তব অতীব জটিল, সমাজ বহুধাবিভক্ত। প্রথম বিশ্বের উন্নত দেশগুলির আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সাথে আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার তুলনা অমূলক, অর্থহীন। আবার ওপিনিয়ন পোল এবং নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে মতামত পাল্টে যাওয়ার প্রবণতাও বিদেশের তুলনায় আমাদের দেশে অনেক বেশি। কাজেই বহু সময়েই একেকটি আসনভিত্তিক পৃথক পৃথক মডেল ব্যবহারও আমাদের দেশে দস্তুর। আসনের পাশাপাশি এই বিভাজন অন্যান্য উপায়েও করা হয়, যেমন কোনো গোষ্ঠী বা এলাকাভিত্তিক বিভাজন। সমাজের যে কোন একটি অংশে বা এলাকায় জনমত পরিবর্তনের নমুনা হিসেবে করে বৃহত্তর সমাজের সামগ্রিক জনমতের পূর্বাভাস দেওয়ার কাজ করে এই খটমট মডেলগুলি।

ওপিনিয়ন পোলের সমান জনপ্রিয় এক্সিট পোল। ভোটার ভোট দিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বেরোবার সময় তাঁর সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া হয় বলেই এর নাম এক্সিট পোল। সাধারণত এক্সিট পোলকে ওপিনিয়ন পোলের থেকে বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়। যেহেতু ভোট দেওয়ার অনতিবিলম্বেই মতামত নেওয়া হয়, তাই দেখা গেছে সময়ের ফাঁকে মতামত পাল্টে যাওয়ার ঝুঁকি সেখানে তুলনামূলকভাবে কম। যদিও অন্যান্য সমস্যাগুলি বিরাজমান, যেমন উত্তর দিতে অস্বীকার করা বা সত্যিটা ভয়ে না বলা, ইত্যাদি।

অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে আমাদের দেশে এক্সিট পোলের আরেক অনন্য সমস্যা হল মহিলাদের কম অংশগ্রহণ । সাধারণত একটি পরিবার যেহেতু একসাথে ভোট দিতে যায় , ভোট দিয়ে বেরোবার সময় সেই পরিবারের কাউকে জিজ্ঞেস করলে পরিবারের কর্তাই এগিয়ে এসে উত্তরটি দেন বাড়ির মহিলাদের দিতে না দিয়ে। এমনিতেই আমাদের মতো পশ্চাদপদ পুরুষতান্ত্রিক দেশে মহিলাদের স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তার চেয়েও বেশি যে কোন রাজনৈতিক মতামত খোলাখুলি ব্যক্ত করাই এখনো দুর্লভ। তাই মহিলাদের মতামত সঠিকভাবে প্রতিফলিত করা আমাদের দেশের ওপিনিয়ন বা এক্সিট পোল — দুটিতেই চ্যালেঞ্জ।

রাজনৈতিক সমীক্ষায় এমনিতেই অংশগ্রহণে অনিচ্ছুকের সংখ্যা বেশি, তার উপর বিরোধী দলের ভোটারদের প্রকাশ্যে মতামত ব্যক্ত করার অনিচ্ছাও বেশি। সমীক্ষার অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর দিলেও অনেকেই কাকে ভোট দেবেন সেটি গোপন রাখতে চান। টেলিফোনিক বা অনলাইন সার্ভেতে কাকে ভোট দেবেন অনেক সময় জানালেও মুখোমুখি সমীক্ষায় এই সমস্যা খুব বেশি। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই যে কোন সমীক্ষায় এরকম অনিচ্ছুকের সংখ্যা অন্তত কুড়ি শতাংশ, যা অনুমান প্রক্রিয়াকে কঠিনতর করে তোলে। তাই ভোট দেওয়ার মত সিদ্ধান্তগুলি সরাসারি মৌখিকভাবে জানতে না চেয়ে আড়ালে চিরকুটে লিখেও বন্ধ বাক্সে অনেক সময়ে জমা নিয়ে আসা হয়।

অন্যান্য যে কোন প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একাধিকবার বিভিন্নভাবে করে যাচাই করে নিতে হয় উত্তরগুলি সঙ্গতিপূর্ণ কিনা, উত্তরদাতা কোন উত্তর গোপন করছেন কিনা। আবার প্রশ্নগুলি দীর্ঘ বা সময়সাপেক্ষ হলেও উত্তরদাতার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। বর্তমানে এক্সিট পোলের থেকেও পোস্ট পোল অর্থাৎ ভোটদানের দু-তিন দিনের মধ্যে সমীক্ষা করার অভিজ্ঞতাকে সবচেয়ে উপযোগী মনে করা হয় আমাদের দেশে। একই লোকেদের ভোটের একমাস আগে করা সমীক্ষা আর ভোটের পরের দিন করা সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে ৩০ শতাংশ অবধি পুরোনো মতামতের পরিবর্তন ঘটতে পারে ।

ওপিনিয়ন পোল নিয়ে আগ্রহের সাথে সাথেই অভিযোগ ও সমালোচনাও কম নয়। পেড নিউজের মতোই পেড পোলের অভিযোগ উঠেছে একাধিকবার, জনমত পূর্বাভাসের নামে জনমত প্রভাবিত করার অভিযোগও বিস্তর। সমাজ গবেষকদের মধ্যেও এই নিয়ে মতবিরোধ এখনও বিদ্যমান।

নির্বাচনের আগেই নির্বাচনের ফলের পূর্বাভাস প্রচার করলে কোনো পার্টির পক্ষে বা বিপক্ষে হাওয়া তোলা সম্ভব এবং তা পরবর্তী ভোটের সিদ্ধান্তগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে, এমন সমালোচনা আছে। একে বলা হয় ‘ব্যান্ডওয়াগন এফেক্ট’। কারণ মানুষ অনেক সময়েই নিজের ভোট নষ্ট না করে যে জিততে পারে তাকেই ভোট দিতে চান। এই অভিযোগ ঠিক না ভুল তা নিয়ে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জলঘোলা হয়েছে। জল এতদূর গড়িয়েছে যে ভারত সহ অনেক দেশেই ভোটের কিছুদিন আগে থেকে ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওপিনিয়ন ও এক্সিট পোলের ফল বেরনো নিষিদ্ধ করে দিয়েছে আদালত।

আমাদের দেশে ওপিনিয়ন পোলের ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা সেই নব্বইয়ের দশক থেকে। সাম্প্রতিককালে বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ওপিনিয়ন ও এক্সিট পোলের পূর্বাভাস না মেলার উদাহরণ ভুরি ভুরি। তা সে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনই হোক বা সদ্য শেষ হওয়া পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। ২০১৬ সালেও একটি প্রখ্যাত সংস্থার শুধুমাত্র এক্সিট পোল ছাড়া আর কোনো ওপিনিয়ন পোলই তৃণমূলের বিপুল জয়ের আভাস দিতে পারেনি। একই পুনরাবৃত্তি এবারও। বরং একটি সংস্থাও এবার এই বিপুল আসন সংখ্যা মেলাতে পারেনি। কোন একটি কারণে এতগুলি বিশেষজ্ঞ সংস্থা একসঙ্গে ব্যর্থ হয় তা কিন্তু নয়। আসলে আমাদের সমাজ এতই জটিল এবং রাজনীতি এতই পরিবর্তনশীল যে মানুষের মন এত সহজে কারুর কাছেই ধরা দেয় না।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

2 মন্তব্য

  1. বিষয়টির অন্তর্নিহিত জটিল তত্ত্ব এবং পদ্ধতি সরল ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় এই বিষয় নিয়ে এইধরণের প্রচেষ্টা আগে চোখে পড়েনি। নবীন লেখক সমাজবিজ্ঞানের এই আধুনিকতম প্রয়োগের বিষয়ে নবীন পাঠকদের কথা ভেবেছেন, তারজন্য তার অসংখ্য ধন্যবাদ প্রাপ্য।

  2. সেফোলজি এবং ওপিনিয়ন পোল নিয়ে বাংলায় এইধরণের লেখা আগে চোখে পড়েনি। সমাজবিজ্ঞানের এই অত্যাধুনিক প্রণালীর অন্তর্নিহিত তত্ত্ব এবং তার জটিল প্রয়োগ সম্বন্ধে খুব সরল ভাবে লেখক আলোচনা করেছেন যা যেকোনো শাখার পাঠাভ্যাসী পাঠকের বোঝবার জন্য অনুকূল। নবীন লেখক যে এইভাবে এই বিষয়ের নবীন পাঠকদের কথা ভেবে লিখেছেন, তারজন্য প্রভূত ধন্যবাদ তার প্রাপ্য।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.