২০১৬। বাংলায় বিধানসভার নির্বাচন। দেওয়ালে দেওয়ালে ছড়ায় ছয়লাপ :

ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল,

ঘরে ঘরে তণমূল।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আজ ২০২১। সামনে ফের বিধানসভার নির্বাচন। ফ্লেক্সে ফ্লেক্সে দেখা যাচ্ছে :

কৃষ্ণ-কৃষ্ণ হরে-হরে,

বিজেপি এবার ঘরে ঘরে।

কোনও কর্মসূচি, কোনও জ্ঞানগর্ভ রাজনৈতিক বিতর্ক নয়, এই প্রকার দ্বিপদী ছড়াই যেন সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে! রাজনৈতিক গভীরতা যেন হয়ে পড়েছে অর্থহীন!

পশ্চিমবঙ্গে এই রাজনৈতিক তরলীকরণ প্রত্যাশিত ছিল কি? রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতীতি ও প্রয়োগে বাংলা তো ছিল পুরোভাগে! প্রাক্-স্বাধীনতা পর্বে গোটা দেশে কংগ্রেস, বাম ও বিপ্লবী আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বিরাট অংশ তো বাংলারই! বামপন্থী আন্দোলনের সূতিকাগার তো এই রাজ্যই!

৩৪ বছরের বাম সরকার নড়েছিল তৎকালীন বিরোধীদের একটানা পাঁচ বছরের আন্দোলনে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে। শেষ দিকে এর যা বিস্তার, তাকে গণ-আন্দোলন বলাই যায়। ‘বৃহৎ পুঁজিবিরোধী’ তকমাও দেওয়া চলে। সেই সময়েই জোর আলোচনা চলত: অতঃপর উন্নয়নের বিকল্প মডেল কী? হয়ত সরকার পতনের লক্ষ্যে সে দিকে মাথা ঘামানো অনেকের কাছে নিরর্থক মনে হয়েছিল। তারই ফল কি আজ ভুগতে হচ্ছে?

এই যে চারপাশে কুকথার বান, বাংলার আমজনতা কিন্তু তাতেই ভরপুর মজে। ভরসন্ধেয় বাড়িতে বাড়িতে শাঁখ বেজে উঠলেই চ্যানেলে চ্যানেলে বসে যায় ঝগড়ার আসর। রাজনীতির ঢঙটাই যেন বদলে গেছে। আগে রাজনীতির কথাটা রাজনৈতিকভাবে বলতে জানতে হত, যুক্তি কিছু দিতে হতই। সেটা পাড়ার ক্লাব-সংগঠকদের দ্বারা হত না। পলিটিকাল, নন-পলিটিকাল ভেদরেখা ছিল। এখন সে-সবের দরকার নেই! ক্লাবের দাদা, প্রোমোটার, মস্তান, তোলাবাজ সব্বাই খোলাখুলি স্থানীয় রাজনীতির মঞ্চে তো বটেই, নেতৃত্বেও।

এত বক্তৃতায় রাজনীতি কই? কেউ কারও বাপ তুলছেন, তুই তোকারি তো জলভাত। কেউ অন্যের নাম বা পদবির অনুপ্রাসে ব্যঙ্গ করছেন, কেউ বলছেন এমন মার মারব যে ব্যান্ডেজ বাঁধার জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না! বিপক্ষের কারো চেহারা নিয়ে খোঁচা! এ ওকে বলছে চোর, তোলাবাজ! ‘তুই চোর না মুই চোর?’ কী প্রমাণ করতে চায় — আমি ওর চেয়ে কম তোলাবাজ? জনতার কাছে গ্রহণীয় কে? যে একটু কম চোর? দল বদলের দৈনিক হিসাব তো রেকর্ড গড়তে চলেছে! এরই মধ্যে এসে পড়েছে ‘খেলা হবে…’। রাজনীতির বুড়ো, আধবুড়ো সবাই উদ্বাহু নৃত্যে মেতে উঠছেন। বীভৎস দৃশ্য! বলা হচ্ছে, ভয়ঙ্কর এক খেলা নাকি হবে! মানে হাড় হিম করা ভোটপর্ব? সত্তর ছুঁই ছুঁই এক রাজনীতিক আবার কুমড়োর গান গেয়েছেন — সুপারহিট — গানের মাঝে-মাঝে তিনি বলে চলেছেন ‘লাভলি!’ জনতা নাকি উদ্বেল! সে-গানের সঙ্গেও চলছে উদ্দাম নাচ — প্রকাশ্যে — রাজনীতির মঞ্চে। রাজনীতির এই দেউলেপনাই কি বাংলার ললাটলিখন?

এখন আর বিহার, ইউ পি বা জাঠ বলয়ে ভোটে তেমন অশান্তি বা প্রাণহানির কথা শোনা যায় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভোটপর্বে এসব জলভাত। বাম আমলেও নানা ছকে ভোট লুঠ হয়ে এসেছে। এখনো মনোনয়ন পর্ব থেকে চলে নানা কায়দায় অশান্তি। কোন দলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ যেন বাঙালির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বোধহয় বাড়তেই থাকবে। লক্ষণীয়, ভারতের অন্যান্য আঞ্চলিক রাজনীতির কিছু রেওয়াজ সাম্প্রতিক কালে বঙ্গ-রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে। যেমন, ফিল্ম (তথা সিরিয়াল) স্টারদের রাজনীতি; কাট-আউটের রাজনীতি; জাতের (পড়ুন ‘মতুয়া’) রাজনীতি। যখন অনিল চট্টোপাধ্যায় চৌরঙ্গী বা তাপস পাল আলিপুর থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন, তখন কিন্তু কেউ একে দুর্লক্ষণ বলেনি। কারণ রাজনীতিতে অভিনেতাদের প্রতিনিধিত্ব থাকতেই পারে! কিন্তু এর ব্যাপকতা ও প্রয়োগশৈলীই চিন্তার। যখন সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার রাজনীতিবিদ বাসুদেব আচারিয়া বা প্রবোধ পাণ্ডা-কে ‘বধ’ করতে মুনমুন সেন বা সন্ধ্যা রায়কে নামানো হয়, প্রশ্নটা তখনই ওঠে। (উল্লেখ্য, আসন দুটো কিন্তু ওঁদের হাতে থাকেনি, পাঁচ বছর পর বিজেপির কব্জায় চলে গেছে)। রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন কারো কাছে এঁরা হারলে কিছু বলার থাকত না। যেমন, ২০১৯-এ যাদবপুরে বিকাশরঞ্জন যদি সুগত বসুর কাছে হারতেন! আজকের বঙ্গ রাজনীতিতে এই ‘মোহিনী’বাদ তা হলে অপরিহার্য ও অতীব প্রয়োজনীয়?

রাজনীতির এই লঘুকরণের মূলে কি সরকারের জনমোহিনী রূপ? ‘পপুলিজম্’-এর বাংলা কী? জনস্বার্থবাদ?  জনমোহনবাদ? কেন্দ্রীয় সরকারের দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি বা কর্মসংস্থান প্রকল্পগুলি পঞ্চাশের দশক থেকেই শুরু হয়েছিল। মাঝ-সত্তর থেকে একে-একে আসতে থাকে বিশ দফা কর্মসূচি, ফুড ফর ওয়ার্ক ইত্যাদি। জনতা পার্টির সরকার চলাকালীন গান্ধীবাদী ও সমাজবাদী রাজনীতিকদের প্রেরণায় অন্ত্যোদয় কর্মসূচি চালু হয়েছিল দেশের বেশ কিছু অংশে। মনে পড়ছে, জনতা পার্টির সভাপতি চন্দ্রশেখর (পরবর্তী কালে প্রধানমন্ত্রী) এতে বিশেষ মনোযোগী হয়েছিলেন। এরপর নানা প্রকল্প এসেছে। বিভিন্ন রোজগার যোজনা, একশো দিনের কাজ, খাদ্য সুরক্ষা বিল ইত্যাদি। এগুলি কিন্তু পরিকল্পিত কর্মসূচি। যোজনা কমিশন, অর্থ কমিশন, জাতীয় উন্নয়ন পরিষদ — এই সমস্ত শীর্ষ-আয়োগের অভিভাবকত্ব বা অনুমোদনেই এ জাতীয় প্রকল্প। গল্পে মোচড় এল ১৯৮৩-তে। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হলেন তেলুগু সিনেমার কিংবদন্তি এন টি রামা রাও। বিপুল জয় হাসিল করল তাঁর তৈরি ‘তেলুগু দেশম পার্টি’। মসনদে বসে তিনি চালু করলেন দু’ টাকা কেজি চালের ব্যবস্থা। খুলে গেল ভারতীয় রাজনীতির এক নতুন রাস্তা : পপুলিজম। এনটিআর-এর নির্বাচনী সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে অনেক রাজ্যই এই রাস্তায় এগোল। ক্রমশ এই পপুলিজমই হয়ে উঠেছে নির্বাচনী বৈতরণী টপকানোর প্রধান ভরসা।

সে এক ঘটনা — মনে পড়ে গেল। ‘৮৩ সালের মাঝামাঝি। এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা — হিন্দিভাষী ও সাহিত্যপ্রেমী। গ্র্যাজুয়েশনের পর তখন আমরা চাকরির চেষ্টায়। সে বলল দিল্লিতে একটি সর্বভারতীয় হিন্দি দৈনিকের অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর পদের জন্য লিখিত পরীক্ষায় ইতোমধ্যেই উত্তীর্ণ হয়ে ইন্টারভিউও দিয়ে এসেছে। সেখানে ওকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল — যদি এখন লোকসভার নির্বাচন হয় এবং বিরোধীরা ক্ষমতায় আসে, তোমার মতে কে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন? ও বলেছিল — এন টি রামা রাও। কেন? এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধীদের সকলের কাছে উনিই একমাত্র গ্রহণযোগ্য, উপরন্তু আশা করা যায় অন্ধ্র থেকে উনি অনেক এম পি-কে জিতিয়ে আনতে পারবেন। আমি কিছুটা আশ্চর্যই হয়েছিলাম। কারণ আমাদের মাথায় আসত পোড় খাওয়া, অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের নাম, যাঁরা কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। অনেকে ছিলেন তখন — চন্দ্রশেখর, অটলবিহারী, অনেকেই। হ্যাঁ, ও উত্তীর্ণ হয়ে কাজে যোগ দিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে অনেক দায়িত্ব সামলেছে।

আগস্ট ১৯৮৪। বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ তেলুগু দেশম পার্টির সরকারকে রাজ্যপাল বরখাস্ত করলেন। মুখ্যমন্ত্রী এন টি রামা রাও তখন চিকিৎসার জন্যে বিদেশে। নতুন মুখ্যমন্ত্রী হলেন এন ভাস্কর রাও, দলের অন্যতম স্থপতি ও এন টি আর সরকারের অর্থমন্ত্রী। সে এক কেলেঙ্কারি! মাস খানেক বাদে দেশে ফিরেই এন টি আর গদি পুনর্দখল করলেন। স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত দোষ গিয়ে পড়ল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ওপর, কারণ ওঁর এই প্রবণতা তো ছিলই! কিন্তু আজ মনে প্রশ্ন জাগে, যদি ইন্দিরা গান্ধী এই ঘটনার মূল কারিগর হয়ে থাকেন, তা হলে তা কেন? বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের পতন ঘটানো তো মূর্খামি! কিন্তু কেন? তা হলে মতাদর্শহীন এই পপুলিজমে কি ইন্দিরা বিপদের পূর্বাভাস পেয়েছিলেন? ভবিষ্যতের ভারত নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন? কে জানে!

ডোল (Dole) ব্যাপারটা আদতে ছিল সাময়িক বা সময়োচিত ব্যবস্থা। কোনও বিপর্যয় বা দাঙ্গায় এই বিশেষ খয়রাতি ব্যবস্থা চলত। দেশভাগের পর উদ্বাস্তুদের দীর্ঘদিন ডোল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই ডোলব্যবস্থা যে বঙ্গ-রাজনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্র হয়ে উঠবে, তা কি আমাদের ধারণায় ছিল?

বাংলায় পপুলিজমের প্রতিশব্দ এখন জনস্বার্থবাদ, জনমোহনবাদের সীমানা অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে ‘জনতোষণবাদ’। যখন যেমন, তখন তেমন— এই ভঙ্গিতে একের পর এক খয়রাতি ব্যবস্থা চালু হয়ে চলেছে। জনতোষণবাদের সঙ্গেই হাত ধরাধরি করে চলে আসে ‘ইনস্ট্যান্টিজম’, যাকে বোধহয় ‘তৎকালবাদ’ বলা চলে। ওরা চার মারলে আমাদের ছয় মারতে হবে। অবশ্য খয়রাতিতে সাফল্য অর্জনে মতাদর্শে সমৃদ্ধ না হলেও চলে বই কি! রাজনৈতিক দর্শনেরও প্রয়োজন পড়ে না। থাকতে হবে প্রখর বাস্তববোধ, শাণিত উপস্থিত বুদ্ধি আর অব্যর্থ সময়জ্ঞান। সব দিক সামাল দিয়ে তুখোড় পপুলিস্ট হতে পারলে জয়যাত্রা ঠেকায় কে?

এত সোজা হয়ে গেছে আজকে! এই অভ্যাস কি গোটা সমাজের তরলীকরণ করছে? রাজনীতি হয়ে উঠেছে মতাদর্শহীন? শেষমেশ আবগারির আয়ের ওপর ভীষণ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটাই বোধহয় সত্যিকারের তরলীকরণ!

এই জনতোষণের রাস্তায় হাঁটা যেন বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়া! নামা যাবে না। নামলেই বাঘে খাবে। ডোলের রাজনীতি কঠিন অনেক কিছুকে সহজ করে দিয়েছে। এই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই মস্ত কিছু করে ফেলা যায়। তার জন্যে পণ্ডিত হতে হয় না।

অবশ্য মতাদর্শ কপচানো পাণ্ডিত্য-প্রসূত ধাপ্পা যে আমরা আগে দেখিনি তা নয়। আর যা-ই হোক, এই পপুলিজমের রাস্তাটা কিন্তু বেশ সোজাসাপটা। এই ব্যবস্থায় ‘না পেলে’ জনতা ‘বুঝে নেবে’।

এই ঝুঁকিটা থাকছেই।

চিত্র ঋণ: Wikimedia
ভিডিও সৌজন্য : India Today (পুরো ভিডিওটি দেখতে এইখানে click করুন )

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.