আনিস খান হত্যা মামলায় বাইরের রাজ্যের হাত দেখেছেন তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিম। আরও কিছু লোক এর পিছনে “হিন্দুত্ববাদ”, “মুসলিম বলেই আক্রান্ত”, “আইডেন্টিটির অ্যাসার্শান” ইত্যাদি আগডুম বাগডুম বলে তাত্ত্বিক জটিলতায় ঢুকে পড়ে নিজেদের অজ্ঞানতা জাহির করছেন। সঙ্গে আসল খুনি এবং আসল সমস্যাকেও আড়াল করছেন। জেনে হোক বা না জেনে।

দীর্ঘ দিন ব্যক্তিগতভাবে আনিসের সাথে পরিচয়, ওর বাড়িতে থাকা এবং সমস্যাটা জানা থাকার ভিত্তিতে বলতে পারি, আনিস যাদের উপর অভিযোগের আঙুল তুলে গেছে, তারাও মুসলিম। প্রত্যেকেই শাসক দলের সদস্য। অভিযুক্তরা হিন্দু হলেও ব্যাপারটা খুব একটা বদলাত না। কারণ সমস্যাটা গ্রামীণ অর্থনীতি-রাজনীতির পশ্চাৎপদতার, সামন্তবাদী মানসিকতার। জমি বিবাদ, গ্রামীণ ক্ষমতা,পঞ্চায়েতের ফান্ড হাতছাড়া হওয়ার যাবতীয় সম্ভাবনা নির্মূল করা ইত্যাদি রয়েছে এই খুনের পিছনে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আনিসের বাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম, স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব তার বাবাকে চাপ দিয়ে আনিসের ভাগ্নী মুসকান খাতুনের লেখা অভিযোগপত্রটি বাতিল করে নতুন করে অভিযোগপত্রটি লিখিয়েছেন। নতুন অভিযোগপত্রে এর আগের ঘটনা, সন্দেহভাজনদের উল্লেখ ইত্যাদি বাদ দিতে বাধ্য করেছে।

পুলিশের ব্যবহৃত রাইফেল নিয়ে পুলিশের পোশাকে খুনিরা এসেছিলো বলে অভিযোগ। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটনাপ্রবাহে আমতা থানার পুলিশকর্মীরা বা ওসি দেবব্রত চক্রবর্তীও সন্দেহের বাইরে থাকতে পারেন কি? দেখা যাক ঘটনাপ্রবাহ কী বলে?

আনিস খান ২০২১ সালের ২৪ মে প্রথম আমতা থানায় যে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিল, তাতে ২১ মে তার বাড়ির উপর হামলা, নিজের ঘরছাড়া হওয়া এবং প্রাণনাশের আশংকা প্রকাশ করেছিল। সেই পত্রে অভিযুক্ত হিসাবে কিছু নির্দিষ্ট মানুষের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন পঞ্চায়েতের উপপ্রধান এবং তৃণমূলের বুথ সভাপতি মালেক খান, তাঁর ছেলে মাসুদ খান, জাহাঙ্গীর খান, আলি হোসেন খান, মেহবুব খান, রাজা খান, সাইফুল্লাহ খান, আতি খান। যদিও এই অভিযোগপত্র পেয়ে পুলিশ এফ আই আর দূরে থাক, কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এর ফলশ্রুতিতে আনিসের বাড়িতে হামলা, হুমকি অব্যাহত থাকে।

২০২১ সালের ১৭ জুন আনিসের মেজ বৌদি আলেয়া বেগম আবার আমতা থানার আইসির প্রতি অভিযোগপত্র লেখেন এবং আগের দিন, অর্থাৎ ১৬ জুন, তাঁদের পরিবারের জমি দখল, গোয়ালঘর, বাড়ি ভাঙচুর, বাড়ির বৃদ্ধ সদস্যদের মারধোর, মহিলাদের শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেন। প্রাণনাশের আশংকাও প্রকাশ করেন। এই চিঠিতে আলেয়া বেগম আনিসের বাড়ি না ফিরতে পারার কথা এবং আগের বারে আনিসের থানায় জমা দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশের এফ আই আর না করা এবং কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়ার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। আলেয়া বেগম যাদের নাম লিখেছিলেন, তাঁরা হলেন মেহবুব আলম খান, রাজা খান, আসগর খান, বশির খান, সৌরভ খান, আইজুল খান, ইনসান খান, শাজাহান খান, সাইফুল্লাহ খান, সাবির খান, তাইজুল খান, বরজাহান খান, মোর্তেজ খান, মইদুল খান এবং আরও ৩০ জন। আলেয়া বেগম এই সমস্ত অভিযুক্তদের নামের সাথে তাদের বাবার নাম এবং গ্রামের নামও উল্লেখ করেছেন। আলেয়া বেগম এবারও এফ আই আর নিতে অনুরোধ করেছিলেন।

পরের দিন, ১৮ জুন ২০২১, আলেয়া বেগম আমতা থানার ওসি দেবব্রত এবং অন্যান্য পুলিশকর্মীরা তাঁর সাথে অভব্য আচরণ করেছে অভিযোগ করে মহিলা কমিশনকে চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে তিনি জনিয়েছেন, ১৭ তারিখ অভিযোগপত্র জমা দিতে গেলে পুলিশ ধমকাতে শুরু করে, প্রাপ্তি স্বীকার করতে অস্বীকার করে এবং অভিযোগ নেওয়া হবে না বলে অভিযোগপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মহিলা কমিশনে তিনি জানান, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

২২ জুন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, রাজ্য মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন, এসডিও, এসডিপিও, বিডিও সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার সংগঠন সহ ১৯টি ঠিকানায় আলেয়া বেগম নিজের এবং পরিবারের অসহায়তার কথা লিখে পাঠান। স্পষ্টভাবে সেখানে পুলিসি নিষ্ক্রিয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী হিংসার তদন্ত করতে আসা কেন্দ্রীয় দল আনিসদের সমস্যার দিকে নজর দেয়নি। “আনিসদের” বলছি, কারণ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে শুধু বিজেপি কর্মী হিন্দুদের উপর নয়, দক্ষিণ ২৪ পরগণা সহ বিভিন্ন জেলায় বিরোধী দল করার কারণে মুসলিমদের উপর ব্যাপক অত্যাচার চলেছে। যদিও কেন্দ্রীয় দলের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচন পরবর্তী হিংসাকে দেশের কাছে হিন্দু মুসলিমের দাঙ্গা বলে চিত্রায়িত করা। তাই সচেতনভাবে তারা আক্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলোকে গুরুত্ব দেয়নি। অন্যদিকে প্রগতিশীল গণআন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে অনেকেই শাসক দলের এই তান্ডবকে বিজেপির রটনা বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন।

সুতরাং অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা, কর্মী, যাদের ধর্মীয় পরিচয় মুসলিম এবং আমতা থানার ওসি, যার ধর্মীয় পরিচয় হিন্দু ব্রাহ্মণ, তাদের যে একটি অশুভ আঁতাত আছে, এমন অনুমান করা কি ভুল হবে? আমতা পুলিশের কি দায় নয়, এই হত্যা যে তারা করেনি, সেটা প্রমাণ করা? ভারতের মত পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে বাজারের শোষণকে সুরক্ষিত করার জন্য যেমন পুলিশ আদালতের মত আইনি ব্যবস্থা থাকে, তেমনি বাজার বহির্ভূত শোষণ চালাবার জন্য বেআইনি দমন যন্ত্র থাকে। এখনো দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাজার এবং আইন বহির্ভূত আঞ্চলিক ক্ষুদে স্বৈরশাসক অ্যাকাডেমিক ভাষায়, ‘লোকাল ডেসপট’ থাকে। অঞ্চলভিত্তিকভাবে এরা আইনি প্রশাসনের উপরেও আধিপত্য বিস্তার করে, প্রভাব খাটাতে পারে। শাসক দল, শাসক শ্রেণি এই আঞ্চলিক স্বৈরশাসকদের উপর ভিত্তি করে টিকে থাকতে বাধ্য হয়। আবার মানুষের আন্দোলন, বাজারের বিস্তার, অর্থনৈতিক উন্নতি এই আঞ্চলিক লিলিপুট স্বৈরশাসকদের আধিপত্য ভেঙে দেয়।

হ্যাঁ, এই দেশের মুসলমানরা ভালভাবেই জানে যে তারা মুসলমান পরিচয়ের কারণে আক্রান্ত হয়। তাদের কানের কাছে বারবার “তুমি মুসলিম বলেই আক্রান্ত” বলার কোনো মানে হয় না। কেন মুসলিম বলে আক্রান্ত সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নাহলে ধর্মীয় মেরুকরণে অজান্তে হিন্দু ফ্যাসিবাদীদের সহায়তা করা হয়। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গান-নাটক, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী জ্ঞান বিতরণ ছাড়া আর কোনো কর্মসূচি পড়ে থাকে না। ফলত আর্থসামাজিক কাঠামো বদলানোর কষ্টসাধ্য ঘাম, রক্ত ঝরানো লাল রাজনৈতিক কর্তব্য বাতিল হয়ে যায়। শুধুমাত্র মানসিকতা নিয়ে প্রতিবাদীরা ভাবিত হয়। এই মানসিকতা আসলে ফলাফল। কারণটা আড়াল থেকে যায়।

আনিস খানও নিজে জানত যে এই দেশে মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্যই আক্রান্ত। তবুও কলকাতা শহরের বুদ্ধিজীবী মহল থেকে অনেকে দূরের গ্রামের ছেলেটি বুঝেছিল বামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিই এই সমস্যার সমাধান। আমার অভিজ্ঞতায় মুসলিম ছাত্র-যুবরা ভিতর থেকে অনেক বেশী শ্রেণি সচেতন হয়ে বাম দিকে ঝুঁকছে। কারণ তারা উপলব্ধি করছে যে পরিচয়ের রাজনীতি তাকে সামাজিকভাবে আরও কোণঠাসা, সামাজিকভাবে একঘরে করছে। এটা হিন্দু পরিচয়ের রাজনীতিকেই সাহায্য করছে। ফলত মুসলিম ছাত্র যুবরা অনেক বেশি বেকারত্বসহ বিভিন্ন জীবন জীবিকার ইস্যু নিয়ে সোচ্চার হয়ে বামপন্থী হয়ে উঠছে। অন্যদিকে বামেরা মুসলিমদের থেকে বেশি মুসলিম হয়ে উঠছে।

আনিস প্রায় প্রতিদিন ঘন্টাখানেক বাইক চালিয়ে বাগনান-কোলাঘাট যাতায়াত করত, প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফিরত। এলাকাটা এমনই যে সন্ধ্যা থেকে তো বটেই, দিনের বেলাতেও সুনসান থাকে। আনিস এর আগে বেশ কয়েকবার রাস্তায় ঝামেলায় পড়েছে বলে এই লেখককে জানিয়েছিল। খুনিরা ওকে রাস্তাতেই খুন করে নালায় ফেলে দিতে পারত। কিন্তু বাড়িতে ঢুকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করল। এটা কি অঞ্চলে তৈরি হওয়া বিরোধীদের বার্তা দেওয়ার জন্য নয়? রাজ্যে বামপন্থী বিরোধীদের এক অংশের বিজেপির জুজু দেখিয়ে বর্তমান শাসক দলের প্রতি নরম মনোভাব নেওয়ার রাজনীতির ফলে যে বিরোধীশূন্য রাজ্য তৈরি হচ্ছে, সেটা কি এই হত্যাকারীদের সাহসের উৎস নয়? বাড়িতে ঢুকে পুলিশের পোশাকে খুন করে যাওয়া এবং চব্বিশ ঘন্টা কেটে যাওয়ার পরেও কারো গ্রেফতার না হওয়া কি রাজ্য পুলিশের মর্যাদা এবং নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে না?

আনিস খান হত্যার কেউ বিচার চাইবেন, কেউ বদলা চাইবেন। কিন্তু কোনোটাই সমস্যার সমাধান নয়। কারণ মার্কস শিখিয়েছেন, অপরাধ শুধু কিছু ব্যক্তি করে না, অপরাধ আসলে সামাজিক কাঠামো করে। ভারতের সেই আর্থসামাজিক কাঠামোকেই ভাঙার লড়াইকে ভেস্তে দেওয়ার জন্য যেমন আনিসদের খুন হতে হয়, তেমনি তাত্ত্বিকভাবে এই আর্থসামাজিক কাঠামো বদলানোর লড়াইকে ভেস্তে দিতেই কি মানুষকে পরিচয়ের রাজনীতির খোপে ঠেলে দেওয়ার খেলা চলছে?

তবে সবটাই কারোর প্ল্যানমাফিক হয় না। আনিসের খুনিরা ভাবতে পারেনি এত বড় ছাত্র বিক্ষোভ হবে। এই খুন বিরোধীদের ভীত করার বদলে আরও বিরোধী তৈরি করতে পারে।

“থামাতে চাইলে খুন করে যাকে

এখন মিছিলের মুখ সেই আনিস খান”

— নির্বাণ

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.