লেইরে বিয়াতে গার্সিয়া

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নাগরিক ডট নেট যখন আমাকে আমার মাতৃভাষা আর বাংলার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে লিখতে বলল, একসঙ্গে অনেককিছু মাথার মধ্যে ভিড় করে এল।

প্রথমত, মাতৃভাষা কাকে বলব তা নিয়েই চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে একটা ভাষাকে একজন মানুষের মাতৃভাষা বলা যায়? বাবা-মায়ের ভাষাই কি মাতৃভাষা? যদি বাবা আর মায়ের ভাষা আলাদা হয়? তবে কি স্কুলে যে ভাষায় মানুষ পড়াশোনা করে, যে ভাষায় তার বৌদ্ধিক জীবন গড়ে ওঠে, সেটাই তার মাতৃভাষা? নাকি একলা থাকার সময়ে মানুষ যে ভাষায় চিন্তা করে, অন্যের কাছে নিজের ভাব প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা নেই, কেবল নিজেকে নিজে বুঝতে পারলেই চলে — এমন মুহূর্তগুলোতে মানুষ যে ভাষায় চিন্তা করে, সেটা তার মাতৃভাষা? কারোর ক্ষেত্রে যদি এই ভাষাগুলো সবকটাই আলাদা আলাদা হয়, তাহলে সবকটাই কি তার মাতৃভাষা হতে পারে?

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আমাকে মাতৃভাষা নিয়ে লিখতে বলার প্রস্তাবে প্রচ্ছন্ন ছিল একটা প্রশ্ন — “তোমার মাতৃভাষা কী?” চট করে যে উত্তরটা আমার মাথায় আসে, সেটা অবশ্যই স্প্যানিশ। বাড়িতে এই ভাষায় কথা বলেই আমি বড় হয়েছি। কিন্তু যদি বলি গালিসিয়ান, তাহলেও ভুল হবে না। আমার চারপাশের লোকজন রাস্তাঘাটে, দোকান-বাজারে, স্কুল-কলেজে ওই ভাষাতেই কথা বলে। ওটা আমার মায়ের ভাষাও বটে, কারণ আমার মা আর আমি গালিসিয়ারই মানুষ। কিন্তু আমার বাবার ভাষা বাস্ক। ওই ভাষাটা আমি শেখার চেষ্টা করেছি এবং ব্যর্থ হয়েছি। তাই বাড়িতে আমরা শুধুমাত্র স্প্যানিশ ভাষাতেই কথা বলি। পরিবারের অন্যরাও তাই করে। স্প্যানিশ বা গালিসিয়ান, অথবা দুটোই, “তোমার মাতৃভাষা কী?” — এই প্রশ্নের উত্তর হতে পারে। আমি দুটো ভাষাই আলাদা আলাদা জায়গায় শুনতে শুনতে আর বলতে বলতে বড় হয়েছি। দুটোই আমার দেশের ভাষা।

তবে আমি কখনো গালিসিয়ানে চিন্তা করিনি, গালিসিয়ানে স্বপ্ন দেখিনি। এমনকি আমার মায়ের প্রতিও গালিসিয়ানে ভালবাসা প্রকাশ করিনি। আর এখন তো বছরের পর বছরে বিদেশে কাটানোর ফলে গালিসিয়ানে কথাও বলি না। বলতে গেলেও বেশ কষ্ট করেই বলতে হয়। মুখের ভিতরে কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। জিভটা যখন যেখানে যাওয়া উচিত তখন ঠিক সেখানে পৌঁছয় না। মনে হয় যেন কোনো বিদেশি গালিসিয়ান ভাষায় কথা বলছে। তাহলে কি আর গালিসিয়ানকে “মাতৃভাষা” বলা যায়?

যাঁরা অবগত নন তাঁদের জন্য বলি, গালিসিয়া স্পেনের উত্তর-পূর্ব দিকে, ঠিক পর্তুগালের উপরে। এই লেখাটা যখন বাঙালিরা পড়বেন, তখন একটা ফুটবল দলের নাম বলি। তাহলে চিনতে সুবিধা হবে। সেলতা দে বিগো। বাস্কের সাথে গালিসিয়ানের একটা বড় তফাত হল, এটা ইন্দো-ইউরোপিয় গোষ্ঠীর ভাষা। আইসল্যান্ডিককে বাদ দিলে গালিসিয়ানই এই ভাষাগোষ্ঠীর সবচেয়ে পশ্চিমি ভাষা। ওরকম একটা জায়গায় জন্মে আমার বাংলা শেখার কথাই নয়। ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষাগোষ্ঠীতে গালিসিয়ানের একেবারে বিপরীত মেরুতে থাকা ভাষা হল বাংলা। সত্যি কথা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। জীবনের প্রথম পঁচিশ বছর আমি বাংলা ভাষার অস্তিত্ব আছে বলেই জানতাম না। রবীন্দ্রনাথের কথা ভাসা ভাসা জানা ছিল, কিন্তু তিনি যে ভাষায় লিখেছেন সেই ভাষা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। ভারতে একটা চাকরি পাওয়া, কলকাতায় যাওয়া, বাংলা শেখা — কোনোটাই পরিকল্পিতভাবে হয়নি।

নাগরিক ডট নেটের প্রস্তাবে আরও একটা প্রশ্ন প্রচ্ছন্ন ছিল “তুমি কীভাবে বাংলা শিখলে?” সত্যি কথা বলব ঠিক করেছি যখন, তখন বলেই ফেলি যে আমার মনে হয় না আমি বাংলা কখনো শিখেছি। বাংলা কখন যেন আমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমার কানে আসা, ছাপার অক্ষরে আমার চোখে পড়া বা দেওয়ালে লেখা প্রত্যেকটা বাংলা শব্দ ছিল একেকটা বীজ। সেগুলো যথাসময়ে নিজ নিজ অর্থে আমার মনের বাগানে ফুটে উঠেছে। মাঝে মাঝে আমি অভিধান হাতড়েছি, কোনো বন্ধুর সাহায্য চেয়েছি ঠিকই। কিন্তু কখনো বাংলার পাঠ নিইনি। শুনেছি, আর কী করে যেন বুঝেছি। শেষমেশ ভাষাটা ব্যবহার করতে শুরু করেছি।

যতগুলো ভাষা শিখেছি বা শেখার চেষ্টা করেছি, কোনোটার সাথেই আমার বাংলার অভিজ্ঞতা মেলে না। আমার ইংরেজি শেখা শুরু হয়েছিল মাত্র তিন বছর বয়সে। কঠোর পরিশ্রম করে ইংরেজি শিখেছিলাম। অসংখ্য ব্যাকরণ বই পড়েছি, অভিধান ঘেঁটে শব্দের মানে বার করেছি, একটার পর একটা অনুশীলনী, পরীক্ষার পর পরীক্ষা দিয়েছি, মাস্টারমশাই দিদিমণিরা বছরের পর বছর আমার বলা আর লেখা শুধরে দিয়েছেন। এইসব ততদিন চলেছে যতদিন না আমি নিজেই দিদিমণি হয়ে গেছি আর অন্য একরকমভাবে ইংরেজি শিখতে শুরু করেছি। কীভাবে শেখাতে হয় সে ব্যাপারটা আমি এখনো আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর যতগুলো ভাষা আমি শিখেছি (এবং ভুলে গেছি), সবকটাই এইভাবেই শেখা। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে এসব কিছুই করা হয়নি। হয়ত সেইজন্যেই আমি এখনো বাংলা ভুলিনি। আমি এখনো জাপানি ভাষার চেয়ে বাংলা অনেক ভাল পড়তে এবং বুঝতে পারি। অথচ দশ বছর ধরে জাপানি শিখেছিলাম। তার মধ্যে এক বছর জাপানেই ছিলাম। এমনকি আমার কাছে জাপানি ভাষায় পারদর্শিতার একটা সুন্দর সার্টিফিকেট পর্যন্ত আছে। সেটা আমি এখন আর পড়তেই পারি না। বাংলা জানার কোনো সার্টিফিকেট কিন্তু আমার কাছে নেই। আমি কেবল বলতে পারি কোন কোন বাংলা বই আমি পড়েছি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভারতীয় সাহিত্য ও ভাষায় এম এ পাস করেছিলাম। সেই সময়কার একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। প্রফেসররা ক্লাসে বাংলায় কথা বলতেন, কিন্তু ক্লাসের বাইরে আমার সাথে ইংরেজিতে কথা বলতেন। আমাকে নিয়ে কখনো অধৈর্য হয়ে পড়েননি এবং সবসময় সাহায্য করেছেন। একদিন একজন প্রফেসর পড়াতে পড়াতে খেয়াল করলেন, আমি খসখস করে নোট লিখে যাচ্ছি। তখন পড়ানো বন্ধ করে আমাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন

“গার্সিয়া, তুমি কতগুলো ভাষায় কথা বলতে পারো?”

“আমি স্প্যানিশ, গালিসিয়ান, ইংরেজি আর জাপানি ভাষা জানি। কিন্তু গড়গড় করে কথা বলতে পারি শুধু স্প্যানিশ, ইংরেজি আর গালিসিয়ানে।”

“গালিসিয়ান কী ভাষা?”

“এই আপনাদের এখানে যেমন সব রাজ্যের আলাদা আলাদা ভাষা আছে, স্পেনেও কিছু কিছু অঞ্চল বা রাজ্যের নিজের ভাষা আছে। আমার নিজের অঞ্চলটা হল গালিসিয়া। তার নিজের ভাষা হল গালিসিয়ান। ওটা পর্তুগিজের খুব কাছাকাছি। মধ্যযুগে দুটো একই ভাষা ছিল।”

“তাহলে গালিসিয়ানই তোমার মাতৃভাষা? স্প্যানিশ নয়?”

আবার সেই প্রশ্ন!

“গালিসিয়ান আর স্প্যানিশ — দুটোই আমার মাতৃভাষা। আমি দুটো নিয়েই বড় হয়েছি।”

“দেখছি তুমি আমার লেকচারের নোট নিচ্ছ। এটা কী করে করছ? বাংলা থেকে মনে মনে স্প্যানিশে অনুবাদ করে নিচ্ছ, তারপর গালিসিয়ানে? কীভাবে করো জিনিসটা?”

“আসলে বেশিরভাগ সময়ে আমি ইংরেজিতে চিন্তা করি।”

“ও, আচ্ছা…”

“দ্যাখো, কতগুলো ভাষা নিয়ে কাজ করছে!” আমার ক্লাসমেটদের উনি বাংলায় বললেন। তাদের মধ্যে যারা ইংরেজি তত ভাল বুঝতে পারে না তাদের আমাদের কথোপকথনটা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলেন। “আমাদের গার্সিয়া পাঁচটা ভাষা জানে। আমি যা বলি ও সবটাই বুঝতে পারে। তারপর সেটাকে মনে মনে ইংরেজিতে অনুবাদ করে। ইংরেজি থেকে স্প্যানিশে, স্প্যানিশ থেকে ওর মাতৃভাষা গালিসিয়ানে। এইভাবে ও নোট নেয়! আমি দেখছি তোমরা কেউ কেউ নোট নিচ্ছ না। দেখে শেখো, নইলে পস্তাবে।”

আমার মস্তিষ্ক এত শক্তিশালী যে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চারটে আলাদা আলাদা ভাষায় অনুবাদ করে ফেলতে পারি! স্রেফ স্যারের কথা বুঝতে পারি বলেই উনি এতটা বিশ্বাস করেছেন দেখে আমি আপ্লুত হয়েছিলাম। কিন্তু নোট নেওয়ার সময়ে মোটেই আমার মস্তিষ্ক ওভাবে কাজ করত না। ওঁর বাংলা কথার অর্থ আমি বুঝতে পারতাম আর সেই অর্থ কোনো একটা ভাষায় রোমান হরফে লিখে রাখতাম। নাহলে নোট নেওয়ার মত তাড়াতাড়ি লেখা সম্ভব হত না। যে কোনো ধারণা যে ভাষায় আমার মাথায় ঢুকত, তাতেই লিখে ফেলতাম। আর হাতের লেখাটা হত একেবারে অপাঠ্য। এই কারণে আমার ক্লাসমেটরা আমার উপর চটে যেত। আসলে ক্লাসের পর ওরা অনেকে আমার নোটগুলো চাইত, হয়ত জেরক্স করে নেবে আশা করে। কিন্তু আবিষ্কার করত আমার লেখার বিন্দুবিসর্গ বোঝা যাচ্ছে না। কোনো কোনো লেখা তো আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারতাম না।

এবার তাহলে শেষ প্রশ্নে আসা যাক। ইংরেজির সাথে আমার সম্পর্ক কেমন? আপনি এই লেখাটা বাংলায় পড়ছেন, কিন্তু আমি লিখেছিলাম ইংরেজিতে। কারণ আমি কোনোদিনই বাংলায় দড় হয়ে উঠতে পারিনি। আগেই বলেছি আমি ইংরেজি শিখতে শুরু করেছিলাম তিন বছর বয়সে, আর এখন আমি বড়দের ইংরেজি পড়াই। বেশিরভাগ সময়ে আমি ইংরেজিতে ভাবি, স্বপ্নও দেখি ইংরেজিতে। এই লেখাটা আমাকে যখন লিখতে বলা হয়েছিল, তখন থেকে নাগরিকের কাছে এটা জমা দেওয়া পর্যন্ত কোনো স্তরে স্প্যানিশের সাথে লেখাটার কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ভেবে দেখুন, মাতৃভাষা আর বাংলা নিয়ে লেখা একটা নিবন্ধ কি বাংলা অথবা রচয়িতার মাতৃভাষাতেই লেখা উচিত নয়? তবে কি এটা লেখাই উচিত হয়নি? আচ্ছা, ইংরেজিকে কি আমার বিমাতৃভাষা বলা যেতে পারে?

আমার বাবা-মা কিন্তু ইংরেজি বলেন না। আমার পরিবারের আর কেউই ইংরেজি বলে না। সুতরাং আমি ইংরেজিকে পতিভাষা জাতীয় কিছু একটা ভাবতে পছন্দ করি। মানে ইংরেজি এক আগন্তুক, যে আমার পরিবারে প্রবেশ করেছে আমার সাথে তার সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে। আমাদের আলাপ হয়েছিল কিছুটা পরিস্থিতি আর কিছুটা প্রয়োজনের চাপে, আলগা সম্পর্কের প্রেমিক-প্রেমিকার মত। বহু বছর মেলামেশার ফলে আমরা এখন সত্যিকারের জুটি হয়ে উঠেছি। হয়ত আমাদের মনে মনে বিয়েই হয়ে গেছে, যদিও আমাদের ঘনিষ্ঠতার প্রমাণস্বরূপ বিয়ের সার্টিফিকেট নেই।

নিবন্ধকার প্রাপ্তবয়স্কদের ভাষাশিক্ষা দেওয়ার বিশেষ পারদর্শিতাসম্পন্ন একজন শিক্ষিকা। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভারতীয় সাহিত্য ও ভাষাসমূহ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ স্পেন, ভারত ও আমেরিকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অবসরে তিনি তুলনামূলক গোয়েন্দা গল্প নিয়ে গবেষণা করেন।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।