গত ১৪ মে (বৃহস্পতিবার) সোশাল মিডিয়ায় আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবসের শুভেচ্ছা পায়নি এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যদি না সে সোশাল মিডিয়ার বাইরে থাকে। গত কয়েক বছর ধরেই এটা হচ্ছে, তবে অবাক হলাম, যখন দেখলাম প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্রও ১৪ মে-কে বিশ্ব মাতৃ দিবস বলে গণ্য করছে। আসলে বিশ্ব মাতৃ দিবস বলে কিচ্ছু নেই। ১৯০৫ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাতৃ দিবস পালিত হয়ে আসছে। ১৯১৪ সালে সেটা সরকারি স্বীকৃতিও পায় এবং প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মাতৃ দিবস হিসাবে গণ্য হয়। মার্কিন সাংস্কৃতিক আধিপত্য আছে এরকম কয়েকটি দেশও আমেরিকাকে নকল করে ওই দিনটাতে মাতৃ দিবস পালন করে। আমরাও কি তাহলে সেই দলে যোগ দিলাম?

নানা বিষয়ে আন্তর্জাতিক বা বিশ্ব দিবস হিসাবে যেগুলি পালিত হয়ে আসছে, যেমন বিশ্ব নারী দিবস, বিশ্ব শ্রমিক দিবস, বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস বা বিশ্ব পরিবেশ দিবস, সেগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এর দুটি দিক আছে। প্রথমত, এই দিনটি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বা অন্য কোনো সর্বজনমান্য আন্তর্জাতিক সংগঠন দ্বারা স্বীকৃত। দ্বিতীয়ত, এই দিনটির কোনো না কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে এবং যে বিষয়ের বিশ্ব দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে, তার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। যেমন ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ রাশিয়ায় মহিলাদের প্রথম ভোটাধিকার দেওয়া হয় এবং সারা বিশ্বে সেই প্রথম মহিলারা ভোটাধিকার পান। তাই ওই দিনটিকেই বিশ্ব নারী দিবস হিসাবে গ্রহণ করা হয়।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

১৮৮৬ সালের ১ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে আট ঘন্টা কাজের দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হয়, যা শেষ হয় শিকাগোর হে মার্কেটে দাঙ্গা ও বেশ কয়েকজনের মৃত্যু দিয়ে। এই আন্দোলনকে স্মরণ করতেই বিশ্ব শ্রমিক দিবস পাল করা হয়।

আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সাক্ষী হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের এবং সেই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর। সেই কারণেই ওই দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হয়।

আরো পড়ুন বাংলা শব্দগুলো যথাসময়ে আমার মনের বাগানে ফুটে উঠেছে

মানবিক পরিবেশ নিয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রথম সম্মেলন শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৫ জুন স্টকহোম শহরে। তাই ৫ জুন পালিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এই দিনগুলোর মধ্যে তিনটির উদ্যোক্তা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ হলেও আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসকে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ স্বীকৃতি দিতে পারেনি, কারণ ১৮৮৬ সালের শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে আমেরিকার অস্বস্তি। সেখানে শ্রমিক দিবস পালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসে। তবে আমেরিকা ও তার কয়েকটি সহযোগী দেশ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই ১ মে শ্রমিক দিবস উদযাপিত হয়। আন্তর্জাতিক স্তরে এর উদ্যোক্তা হল ইন্টারন্যাশনাল সোশালিস্ট কংগ্রেস।

এবার এই মাতৃ দিবসের উৎপত্তি কীভাবে হল একটু দেখা যাক। ১৯০৫ সালের ৯ মে মার্কিন সমাজকর্মী আন্না জার্ভিস তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর গির্জায় যে প্রার্থনা সভা হয় সেখানে দিনটিকে মাতৃ দিবস হিসাবে ঘোষণা করেন। এরপর তিনি এর প্রচার শুরু করেন এবং তার ফলে বেশ কিছু গির্জায় এই দিন পালিত হতে থাকে। পরে সরকারের কাছে দাবি করা হয়, সরকারিভাবে মাতৃ দিবস ঘোষণা করা হোক। সরকার মাতৃ দিবস ঘোষণা করতে রাজি হলেও ৯ মে তারিখটাকেই নির্দিষ্ট করতে চায়নি, কারণ বেশিরভাগ সময়ে দিনটি কাজের দিন হবে, ফলে অনেকের পক্ষে মায়ের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হবে না। তাই শেষ পর্যন্ত মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মাতৃ দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে এই মাতৃ দিবসের বাণিজ্যিকীকরণ দেখে জার্ভিস নিজেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন এবং মাতৃ দিবস পালন বন্ধ করতে পরামর্শ দেন।

তবে মাতৃ দিবস পালন কিন্তু তার আগেও হয়েছে। ব্রিটেন সহ বেশ কয়েকটি দেশে অনেক আগে থেকেই মাতৃ দিবস পালিত হয়ে আসছে খ্রিস্টীয় লেন্ট উৎসবের সময়ে চতুর্থ রবিবারে। কারণ সেইসময় যারা বাইরে কাজ করে তারা বাড়িতে ফেরে। যা-ই হোক, এরকম একটি দিন যার কোনো ঐতিহাসিক তাৎপর্য নেই, সেটিকে সমস্ত দেশ কেন মাতৃ দিবস হিসাবে মেনে নেবে আর কেনই বা তা আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবসের স্বীকৃতি পাবে তা বোঝা শক্ত। তবে এখন সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে সবই সম্ভব।

বিড়ম্বনা হল, যারা যথেষ্ট শিক্ষিত এবং সোশাল মিডিয়ায় ভুয়ো খবরের প্রচার সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, এমনকি অনেক সময় এই নিয়ে ‘ফেসবুক স্কুল’ বা ‘হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটি’ ইত্যাদি বলে ব্যাপারটাকে কটাক্ষ করে, তারাও আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে এবং মায়ের সঙ্গে তোলার ছবি সোশাল মিডিয়ায় দিচ্ছে। এর থেকে সোশাল মিডিয়া মানুষের উপর কী প্রভাব ফেলছে এবং সমাজও কীভাবে বদলাচ্ছে তার আভাস পাওয়া যায়। মানুষ সাধারণত যেসব কথাবার্তা বলে তার প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই হচ্ছে আত্মপ্রচার। সামাজিক মাধ্যমে সেটা বেড়ে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হয়ে যায়। আবার কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষ যখন ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভালবাসা বা শ্রদ্ধা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় লেখে, সেটা এই বিশ্বাস থেকে, যে যার সম্পর্কে লেখা হচ্ছে সে এতে অনেক বেশি বিশ্বাস করবে বা খুশি হবে। আমাদের মধ্যে পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব বা কর্তব্য নিয়ে একটা সামাজিক চাপ থাকে। যার ফলে যখন কেউ সোশাল মিডিয়ায় দেখে যে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবস, তখন সে সত্য-মিথ্যা জানার চেষ্টা না করে নিজেই তথাকথিত আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বসে। এর প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে এখন অনেক স্কুলেও ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ব মাতৃ দিবসের কার্ড বা পোস্টার বানানোর কাজ দেওয়া হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে মাতৃ দিবসের বাণিজ্যিকীকরণ সেভাবে হয়নি বটে, তবে এর প্রচারের পিছনে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নেই, এমনটা বলা যায় না। এমনিতেই আমাদের অনেক চিরাচরিত উৎসব বা অনুষ্ঠানের প্রভূত বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। এখন সোনা বা হিরে ব্যবসায়ীরা উপদেশ দিচ্ছে রাখী বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় বোনেদের জন্য ভাইরা কোন উপযুক্ত উপহার দিতে পারে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে অনেকসময় বোনেরা ভাইদের ভালবাসার পরিমাপ করছে উপহারের দাম দিয়ে। এমন দিন যদি আসে, যে মায়েরাও ছেলেমেয়েদের বিচার করবে মাতৃ দিবস উপলক্ষে দেওয়া উপহারের দাম দিয়ে, তা নিশ্চয়ই সমাজের পক্ষে ভাল হবে না।

একথা বলতে দ্বিধা নেই, যে আমাদের সমাজে বা পরিবারে সম্পর্ক অনেকটাই বিনিময়মূলক। সেখানে ভালবাসা নিশ্চয়ই অন্যতম উপাদান এবং অবশ্যই এই বিনিময়ের ব্যাপারটিও বহুমাত্রিক। কিন্তু যদি এই বিনিময়ে অসাম্য বাড়তে থাকে তাহলে ভালবাসা কমতে থাকে এবং সম্পর্কেও চিড় ধরে। পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কও এই নিয়মের বাইরে নয়, বিশেষত আমাদের মত দেশে। এখানেই আমরা পশুপাখিদের থেকে আলাদা। তাদের মা সন্তানের থেকে কিছুই আশা করে না। কিন্তু আমাদের সমাজে পিতামাতা আশা করে সন্তানরা শেষ বয়সে তাদের দেখবে এবং মৃত্যুর পরেও সৎকার ও শ্রাদ্ধশান্তি করবে।

অবশ্যই এর সামাজিক প্রয়োজনও আছে। আমাদের দেশে যে পরিমাণ দারিদ্র্য এবং সামাজিক সুরক্ষার অভাব, তাতে পিতামাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব অগ্রাহ্য করা যায় না। পশুপাখিদের শুধু খাবার হলেই চলে যায়, যা তারা প্রকৃতি থেকেই আহরণ করতে পারে। কিন্তু মানুষের আরও অনেককিছু দরকার এবং সেসব প্রকৃতি থেকে আহরণ করা যায় না, পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। তাই উপার্জন করার ক্ষমতা শেষ হয়ে গেলে সন্তানদের উপরেই নির্ভর করতে হয়। পাশ্চাত্যে তথা অনেক ধনী দেশে শেষ বয়সের জন্য অনেক সঞ্চয় থাকে এবং সামাজিক সুরক্ষা থাকে, তাই এই প্রয়োজন সেভাবে প্রকট নয়। তবে ওইসব দেশে পিতামাতাও সন্তানের জন্য সবকিছু উজাড় করে দেন না। তাই পাশ্চাত্যে মাতৃ দিবস পালিত হলেও সোশাল মিডিয়ায় তা নিয়ে আদিখ্যেতা দেখা যায় না। কারণ এ নিয়ে কারোর উপর কোনো সামাজিক চাপ নেই। আমাদের বাড়াবাড়ির কারণ যদি হয়ে থাকে মাতাপিতার প্রতি দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি সক্ষম না হওয়ার অপরাধবোধ, তাহলে সমাজের পক্ষে লক্ষণটি ভাল নয়।

এর অর্থ এই নয় যে যারা সোশাল মিডিয়ায় মায়ের সঙ্গে তোলা ছবি দিয়েছে তারা সকলেই অপরাধবোধে ভুগছে। তবে এও মনে রাখতে হবে, মানুষ সোশাল মিডিয়ায় যা পোস্ট করে তার মূল প্রেরণা কিন্তু ‘আমি’, অন্য কেউ নয়।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.