গত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গেও উনিশে মে নিয়ে কিছুটা তৎপরতা, কিছুটা উদযাপন দেখতে পাওয়া যায়। একটা সময়ে এর উদযাপন সীমাবদ্ধ ছিল বরাক উপত্যকার অভ্যন্তরেই। পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র ঋষিণ মিত্রের উদ্যোগে ১৯৭৫ সাল থেকে ছোট আকারে হলেও উনিশে মে উদযাপন হয়েছে। মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে, আবার শুরু হয়েছে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে যখন পুলিশের গুলিচালনায় এগারোজন তরুণ-তরুণী প্রাণ দেন, তখন মনীশ ঘটক ‘শিলচরে কমলা ভট্টাচার্যের মায়ের কান্না’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কমলা এগারোজন শহিদের প্রথম শহিদ। সেইসময় কলকাতার পত্রপত্রিকায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে খবরটা প্রকাশিত হয়। দুর্গাপুরে কংগ্রেস অধিবেশনে এ নিয়ে আলোচনাও হয়। সেই আলোচনাকে ব্যঙ্গ করে যুগান্তর পত্রিকায় কার্টুনও আঁকা হয়েছে। পরবর্তীকালে নাগরিক উদ্যোগে যে বেসরকারি কমিশন শিলচরের গুলি চালনার তদন্ত করে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তার অধ্যক্ষ ছিলেন এন সি চ্যাটার্জী, অন্যতম সদস্য স্নেহাংশুকান্ত আচার্য।

তারপর সবকিছুই মিইয়ে যায়। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, আন্দোলনের ভূমি বরাক উপত্যকাতেও। উনিশের উদযাপন নমো নমো করেই সারা হত। এর রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে বৃহত্তর রাজনীতিতে বা বৌদ্ধিক পরিসরে কোনো চর্চা ছিল না। কিন্তু এর রাজনীতি বহমান ছিল শাসকের মধ্যে। সেই বহমানতা থেকেই আসামে সাত, আট বা নয়ের দশকে ভাষার অধিকারের উপর আক্রমণ হয়েছে। ফলে ভাষা সংগ্রামের নতুন তরঙ্গ এসেছে। প্রতিবারই রক্তে ভিজেছে বরাকের মাটি। একাদশ শহিদের পর সেই সারিতে যুক্ত হয়েছে আরও চারজন শহিদের নাম। পঞ্চদশ শহিদের বরাক উপত্যকায় এখন শুধু ভাষার অধিকার নয়, নাগরিকত্বের অধিকারের উপরেও আক্রমণ নেমে এসেছে। ভাষার মানচিত্র যেভাবে সংকুচিত হচ্ছে, সেভাবেই রাষ্ট্রহীন মানুষের ভিড়ও বাড়ছে। পরিবর্তিত স্বদেশের পরিবর্তিত রাজনীতির পরিমণ্ডলে সংখ্যাগুরুবাদের মোহাঞ্জন চোখে পরিয়ে সমস্ত আক্রমণেরই নাগরিক সমাজ থেকে এক অচেতন সম্মতি আদায় হয়ে যাচ্ছে। উনিশ এখন বরাকে উৎসব হয়ে ফিরে আসে প্রতি বছর তার সংগ্রামের অতীতকে পিছনে ফেলে। এখন উনিশ নিয়ে আবেগের চোখের জল আছে হয়ত, কিন্তু সংগ্রামের শপথ নেই।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এই নেইয়ের কারণ বহুমাত্রিক। উনিশের যে রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে, তাকে কোনোদিনই সঠিকভাবে উপলব্ধি করা হয়নি। সংগ্রাম যখন শীর্ষে উঠেছে তখনো এর রাজনীতির সামগ্রিক উপলব্ধি ছিল না নেতৃত্বের স্তরে বা তার সমর্থক সুশীল সমাজে। কেউ একে ভেবেছেন তৎকালীন কাছাড়ের সমস্যা, কেউ ভেবেছেন বাঙালির লড়াই বলে। আসামের রাজ্য রাজনীতির সন্দর্ভে উনিশের মূল্যায়ন কিংবা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দুটি দশক ধরে রাজ্য পুনর্গঠন ও ভাষা নিয়ে দেশের নানা প্রান্তে ভাষার প্রশ্ন ঘিরে যে রাজনৈতিক অসন্তোষ, আন্দোলন সংগ্রাম ও রক্তপাতের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে, তার সাথে উনিশকে যুক্ত করে রাজনৈতিক বা বৌদ্ধিক চর্চা আজও হয়নি। এক বড় অংশের বাঙালি একে শুধুমাত্র বাঙালির ভাষা সংগ্রাম ভাবেন। তাঁদের বক্তব্য, বাঙালিরাই জাতি হিসাবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এ দেশে। সেজন্য সারা পৃথিবীতে ভাষার লড়াইটা একমাত্র বাঙালিরাই করেছে, প্রাণও দিয়েছে একমাত্র বাঙালিরাই। বলা বাহুল্য, এই বয়ানগুলি শুধু একদেশদর্শীই নয়, ভয়ঙ্কর ক্ষতিকরও। ১৯৩৭ সালেই ভাষার জন্যে লড়াইয়ে নেমে প্রথম প্রাণ দিয়েছিলেন তামিলভাষী নটরাজন ও থালামুথু। এরপর আবার ১৯৬৫ সালে আরও দুই তামিল – শন্মুগম ও চিন্নাস্বামী – প্রাণ দেন। অন্যদিকে ১৯৭৫ সালে ত্রিপুরায় ককবরক ভাষার স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন ধনঞ্জয় ত্রিপুরা। সবশেষে ১৯৯৬ সালে আসামের বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে সংগঠিত আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী তরুণী সুদেষ্ণা সিনহা। এই প্রাণদানের ঘটনাগুলির বাইরেও ভাষার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামে ভারতের নানা প্রান্তে শামিল হয়েছে নানা ভাষাভাষী মানুষ।

এটা অবশ্যই ঠিক যে, আসামের ভাষা রাজনীতির একটি স্থানিক মাত্রা আছে। আসামের বাঙালি জনগোষ্ঠী ও তাদের ভাষাকে যে বিরুদ্ধতার মুখোমুখি হতে হয়, তার জন্ম এই মাটিতেই। স্বাধীনোত্তর সর্বভারতীয় ভাষা রাজনীতি একে আরও পুষ্ট করলেও এর শেকড় রয়েছে আসামের মাটিতেই।

উপর্যুপরি বর্মী আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে এবং পরিশেষে বর্মীদের হাতে রাজ্য খুইয়ে আসামের অহোম রাজা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে সহায়তা প্রার্থনা করেছিলেন রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্যে। ইঙ্গ-বর্মা একাধিক যুদ্ধের পর আসাম বর্মীদের দখলমুক্ত হয় এবং ১৮২৬ সালে আসামে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আসামের মানুষ বর্মী শাসনমুক্ত আসাম চেয়েছিলেন, ব্রিটিশ শাসনাধীন আসাম চাননি। প্রাথমিক এই বিরূপতা অসন্তুষ্টিতে পরিণত হয় যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসামকে যুক্ত করে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে এবং পরবর্তী ঘটনাক্রমে বঙ্গদেশ থেকে সরকারি কর্মচারি, উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, ব্যবসায়ী সহ দলে দলে ভাগ্যান্বেষী মানুষকে বাংলা থেকে আসামে নিয়ে যায়। ফলে ঔপনিবেশিক শাসন স্থানীয় মানুষের কাছে পৌঁছয় প্রধানত বঙ্গভাষী মানুষের মাধ্যমেই। এছাড়া বাঙালি কর্মচারিদের আচার আচরণে যে ঔপনিবেশিক মনোভাব প্রকাশিত হত না, তাও নয়।

কিছুদিন পরেই ব্রিটিশ প্রশাসন আসামে শিক্ষার মাধ্যম এবং সরকারি কাজকর্মের ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা চালু করে। আসামের মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। এই ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে বাঙালিবিরোধিতা আরও জোরালো হয়। প্রবল প্রতিবাদ ও বিরোধিতা সত্ত্বেও ৩৬ বছর চালু থাকার পর আসামে শিক্ষার মাধ্যম ও সরকারি কাজের ভাষা হিসাবে অসমিয়া ভাষার প্রবর্তন হয়, যদিও বাংলা ভাষা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়নি। ১৮৭৪ সালে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র আসাম প্রদেশ গঠন করা হয়। আসাম যেহেতু রাজস্বের দিক থেকে ঘাটতিতে চলা রাজ্য ছিল, তাই এই ঘাটতি পূরণ করার জন্যে অবিভক্ত বাংলার গোয়ালপাড়া, সিলেট ও কাছাড় অঞ্চলকে নবগঠিত আসাম প্রদেশের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। আসাম ছিল জনবিরল অঞ্চল। এর সঙ্গে বাংলার ঘনবসতিপূর্ণ তিনটি অঞ্চলকে যুক্ত করে দেওয়ার ফলে আসামে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। এই সিদ্ধান্ত অসমিয়াদের মধ্যে যতটা বিক্ষোভের জন্ম দেয়, ততটাই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় সিলেট ও কাছাড়ের বঙ্গভাষী সমাজের মধ্যে। আসামে অসমিয়া ও বাঙালি সমাজের মধ্যে অবিশ্বাস ও বিরূপতার মাত্রা এতে আরও বৃদ্ধি পেয়ে রাজনৈতিক রূপ ধারণ করতে শুরু করে প্রাথমিক স্তরে।

ব্রিটিশ প্রশাসন এরপর যে সিদ্ধান্ত নেয়, তার প্রত্যক্ষ অভিঘাত আজকের আসামকেও রক্তাক্ত করছে প্রতিনিয়ত। আসামের স্থানীয় জনগোষ্ঠী জলাজমিতে চাষাবাদ করত না, ফলে আসামে অনাবাদী জমি ছিল প্রচুর। এছাড়া আসামে রাজস্ব সংগ্রহ তো কম ছিলই। এই দুই পাখি এক ঢিলে মারতে ব্রিটিশ প্রশাসনের উদ্যোগে অবিভক্ত বাংলার মূলত ময়মনসিংহ জেলা থেকে পরিশ্রমী বাঙালি মুসলিম কৃষকদের হাজারে হাজারে এনে আসামে চাষের জমি দেওয়া হয়। এতে এক ধাক্কায় আসামের খাদ্য উৎপাদন বেড়ে যায়, রাজস্ব আদায়েও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। প্রথম অবস্থায় অসমিয়া মধ্যবিত্ত সমাজ বাঙালি কৃষকদের এই আগমনকে স্বাগতও জানিয়েছিল। কিছুদিন পরেই তাদের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব হারানোর আতঙ্কের জন্ম হল। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উদ্যোগে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় ভারতীয় জনগণের আংশিক অংশগ্রহণ শুরু হল। ক্ষমতার রাজনীতির ময়দানে মুখ্য দ্বন্দ্বের চেহারা নিল সিলেট, কাছাড়ের সঙ্গে অবশিষ্ট আসামের স্বার্থের দ্বন্দ্ব। বাঙালি-অসমিয়া প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতিতে অতিরিক্ত মাত্রা যুক্ত হল মুসলিম লিগের আবির্ভাবে। বাঙালি-অসমিয়া রাজনীতি ও হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন গোটা রাজ্যের রাজনীতিকে জটিলতর করে তুলল।

জটিলতার এই আবহেই দেশভাগের মধ্য দিয়ে ভারত স্বাধীন হয়। আসামের সিলেট জেলা গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। আসামের অসমিয়া মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব চেয়েছিল বাংলা থেকে জুড়ে দেওয়া সমস্ত অঞ্চলকেই আসাম থেকে আলাদা করে দেওয়া হোক, যাতে অসমিয়া স্বার্থরক্ষায় আর কোনো বাধা না থাকে। সে উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়ায় আসামের রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর পূর্ণাঙ্গ দখল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারা চাইল আসামে শিক্ষার মাধ্যম ও সরকারি কাজের ভাষা হিসেবে একমাত্র অসমিয়া ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে, চাইল আসামকে একভাষী রাজ্যে পরিণত করতে। নতুন রাজ্যভাষা আইন প্রণয়নের দাবিতে আসামের অসমিয়াভাষী অঞ্চলে বিক্ষোভ ও আন্দোলনের সূত্রপাত হল। অচিরেই এই আন্দোলন পরিণত হল বাঙালিবিরোধী দাঙ্গায়। এই আবহেই রাজ্য সরকার অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র রাজ্যভাষা হিসেবে স্থির করে রাজ্য ভাষা আইন পাস করে বিধানসভায়। অথচ ভারত সরকারের আইন অনুযায়ী, আসাম একভাষী রাজ্য হিসাবে পরিগণিত হওয়ার কথা ছিল না। এমনকি সরকারি শর্ত অনুযায়ী আসামে বাংলা ভাষার সহযোগী ভাষার স্বীকৃতি প্রাপ্য ছিল। কিন্তু সরকার উগ্র জাতীয়তাবাদের পথে হাঁটতেই বদ্ধপরিকর ছিল।

এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গোটা আসামের অন্যান্য ভাষাভাষীদের মধ্যে তীব্র বিক্ষোভের জন্ম হয়। অসমিয়ার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে রাজ্যভাষা করার দাবিতে অবিভক্ত কাছাড় জেলায় জোরালো আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনে সমর্থনের হাত বাড়ান অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষও। এই আন্দোলনের তরঙ্গশীর্ষেই ১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচর স্টেশনে শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহরত আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ বিনা প্ররোচনায় গুলি চালায়, ১১ জন তরুণ-তরুণীর প্রাণ যায়। প্রথম প্রাণ দেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম নারী শহিদ কমলা। এই আত্মদানের ফলে ভাষা আন্দোলনের আংশিক দাবি মেটে। ভাষা আইনে সংশোধন করে আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসমিয়া, পার্বত্য জেলাগুলিতে ইংরেজি এবং তৎকালীন কাছাড়, অর্থাৎ আজকের বরাক উপত্যকায়, বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা প্রদান করা হয়। পরবর্তী সময়ে বোড়ো ভাষাগোষ্ঠীর আন্দোলনের ফলে বোড়োল্যান্ড এলাকায় সরকারি ভাষার স্বীকৃতি পায় বোড়ো। আসামের বিজেপি সরকার বোড়োকে এখন রাজ্যের সহযোগী ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মাত্র ৮% জনগণের ভাষা বোড়ো এই মর্যাদা পেলেও, আসামের ৩০% জনগণের ভাষা বাংলা এই মর্যাদা থেকে এখনো বঞ্চিত।

আসলে একুশই হোক আর উনিশ, অথবা অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ভাষা আন্দোলন, মূল প্রশ্নটি হচ্ছে ভাষার অধিকারের উপর সংখ্যাগুরুবাদের আক্রমণ। এর মানে আবার সবসময় এই নয় যে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর রাজনীতি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভাষার অধিকারের উপর আক্রমণ করছে। অবিভক্ত পাকিস্তানে জনসংখ্যার ৫৭% ছিল বাংলাভাষী, উর্দুভাষীরা ছিল মাত্র ৮%। কিন্তু সরকার একটি সংখ্যালঘু ভাষাকে সারা দেশে, বিশেষ করে সর্ববৃহৎ ভাষাগোষ্ঠীর উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইছিল। আসলে পাকিস্তানে রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভাষাটি ছিল উর্দু। একইভাবে ভারতেও হিন্দি বলয়ের সন্নিহিত অঞ্চলের অসংখ্য ভাষাকে হিন্দি ভাষায় অন্তর্ভুক্ত করেও হিন্দি ভারতের সিংহভাগ মানুষের ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। মাত্র ৪৪% মানুষ হিন্দি তাঁদের মাতৃভাষা বলে জানিয়েছিলেন সর্বশেষ জনগণনায়। কিন্তু ভারতে রাষ্ট্র পরিচালনা করার ভাষা করা হয়েছে হিন্দিকে। আসামেও যদি জনগণনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না হত, তাহলে নিরপেক্ষ বিবেচনায় বাংলাভাষীরা সম্ভবত সংখ্যালঘুই হত না। কিন্তু আসামে সরকারি ক্ষমতার ভাষা হয়ে উঠেছে অসমিয়া ভাষা।

আরো পড়ুন ১৯ মে: কলকাতায় বিস্মৃত একটি ভাষা আন্দোলন

আসামে বিজেপির আত্মপ্রকাশ ও শক্তি সঞ্চয় হয়েছে ভাষা রাজনীতির সঙ্গে হিন্দুত্বের এক চতুর মিশেলের মাধ্যমে। আসামের উগ্র জাতীয়তাবাদ একদা ভাষিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য ময়মনসিংহ মূলের বাঙালি মুসলমান কৃষকদের কাছে টেনেছিল তাদের ভাষিক পরিচয় পরিবর্তন করে। তখন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ। এখন হিন্দুত্বের মোহাঞ্জনে মুগ্ধ বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজকে সঙ্গী করে নিয়ে বাঙালিবিদ্বেষকে বাংলাদেশীবিরোধিতা নাম দিয়ে মুসলিম বিদ্বেষের রাজনীতিকে ভাষার রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু ভাষা নয় – নাগরিকত্ব। উনিশ লক্ষ মানুষকে ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, তারা এখনও রাষ্ট্রহীন হয়নি, কিন্তু কার্যত তাদের সব নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তাদের জন্যে তৈরি হচ্ছে একাধিক ডিটেনশন সেন্টার। বলা হচ্ছে, এগুলো শুধু ‘দেশদ্রোহী’ মুসলমানদের জন্যে, অথচ ১৯ লক্ষের সিংহভাগই হিন্দু। মুসলিম বিদ্বেষের বিষবাষ্পে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে বাংলা ভাষার অধিকার হরণের নানা পদক্ষেপও। এখানেও জাতীয় রাজনীতির ছায়া। ঠিক যেভাবে নতুন নাগরিকত্ব আইনের নাম করে মুসলমানবিদ্বেষ গোপন করা হচ্ছে, জাতীয় শিক্ষানীতির নাম করে হিন্দি আগ্রাসনের চক্রান্ত চলছে।

এমন সময়ে আজকের দিনটিকে শুধু বাঙালিত্বের গণ্ডিতে আটকে রাখলে ভুল হবে। ১৯৬১ সালে উনিশ এসেছিল বহুভাষিক আসামের বহুত্ব রক্ষার লড়াই হিসাবে। এই মুহূর্তেও পশ্চিমবঙ্গ, আসাম কিংবা সারা দেশেই উনিশ উদযাপিত হতে হবে সংখ্যাগুরুবাদের বিরুদ্ধে বহুত্বের লড়াই হিসাবেই। ভাষা কিংবা ধর্ম, কেন্দ্র কিংবা রাজ্য – সংখ্যাগুরুবাদের সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপোস করলেও তাকে আর উনিশের উদযাপন বলা যাবে না। উনিশ মানে ভাষা গণতন্ত্র, উনিশ মানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, উনিশ মানে বহুত্ব।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.