কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, আগামী বছর ২৬ জানুয়ারি দিল্লির কুচকাওয়াজে কেবল মহিলা বাহিনীই থাকবে। প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে গত কয়েক বছর ধরেই মহিলা বাহিনীকে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু সামনের বছরে নারীর ক্ষমতায়নের বিশেষ বার্তা দেওয়ার জন্য সরকার শুধুমাত্র মহিলা বাহিনীকেই সুযোগ দিতে চান। এই ঘোষণা যখন করা হল, তখন রাজধানীর যন্তর মন্তরে দেশের জন্য পদক জিতে আনা কুস্তিগীররা যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান বিক্ষোভ চালাচ্ছেন। বিলকিস বানোর জন্য সুবিচার চেয়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ সুপ্রিম কোর্টকে চিঠি দিচ্ছেন।

বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভারতে কর্মরত নারীর সংখ্যা ২৪% থেকে ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এ তো গেল করোনাকালের আগের কথা। গবেষণা জানাচ্ছে, অতিমারী চলাকালীন সারা দেশেই বেকারত্ব বেড়েছে, তবে নারীরা যেহেতু অসংগঠিত ক্ষেত্রেই কাজ করেন বেশি, সেহেতু তাঁরা চাকরি হারিয়েছেন অনেক বেশি। এছাড়া সেইসময় বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে। যেহেতু পারিবারিক আয় কমেছে, মহিলারা কম খাবার খেয়েছেন, তাঁদের পুষ্টি এবং প্রজনন স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হয়েছে। এই বৈষম্য দূর করার সরকারি প্রয়াস তেমনভাবে চোখে পড়ে না। কোভিড পরবর্তী সরকারি বাজেটে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কিন্তু বিশেষ বরাদ্দ দেখা যায়নি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এবার বোঝার চেষ্টা করি, যে সেনাবাহিনীর মহিলাদের কুচকাওয়াজ দেখিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের বার্তা দিতে চাইছে মোদী সরকার, সেই মহিলারা আছেন কেমন। নারীদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তি শুরু হলেও তাদের কমান্ডারের পদ দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল ভারত সরকার। ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্টে চলা মামলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মহিলারা কেন কমান্ডারে পদ দেওয়া উচিত নয় তার যুক্তি হিসাবে ভারত সরকার দুটো কারণ ব্যক্ত করেছিল। প্রথম কারণ, মেয়েদের শারীরিক সক্ষমতা কম। দ্বিতীয় কারণ, সামাজিক কারণে গ্রাম থেকে আসা পুরুষ সেনারা মহিলাদের থেকে নির্দেশ নিতে চাইবে না। কারণ মেয়েদের কথা শুনে চলা ভারতীয় সংস্কৃতি নয়। এইভাবে পিতৃতান্ত্রিক ধারণাকে ভারতীয় সংস্কৃতি হিসাবে আদালতের সামনে পেশ করেছিলেন সরকারি কৌঁসুলি।

ওই মামলা জেতার আগে পর্যন্ত মহিলারা শুধুমাত্র স্বল্পমেয়াদি নিয়োগ হিসাবে আর্মিতে যোগদান করতে পারতেন দশ বা ১৪ বছরের জন্যে। যদিও এই মামলায় জেতার পর অনেক নারীবাদী বলেছিলেন সেনাবাহিনীর মধ্যে যে বিষাক্ত পৌরুষ চালু আছে তা এত সহজে শেষ হবার নয়। সান্দ্রা হুইটওয়ার্থের মত নারীবাদী গবেষক লিখেছেন, যেহেতু সৈনিকদের কঠোর হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যাতে সে প্রয়োজনে মানুষ মারতে দ্বিধা না করে, সেহেতু পৌরুষকে খুব জরুরি বলে মনে করা হয়। মেয়ে, মেয়েলিপনা, সমকামী – এই শব্দগুলোকে সব দেশের সেনাবাহিনীতেই গালাগাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এই পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে প্রশ্ন না করে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীতে নারীদের অন্তর্ভুক্তি লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠার কাজকে খুব এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করা কঠিন।

আরো পড়ুন বিলকিস বানো: ছাত্রীর সঙ্গে অসমাপ্ত আলোচনা

সেনাবাহিনীতে নিয়মশৃঙ্খলা প্রচুর, তা সত্ত্বেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বহুবার যৌন আক্রমণের অভিযোগ উঠেছে। মণিপুরের মেয়েদের উপর সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণ এত ভয়াবহ আকার নিয়েছিল একসময়, যে সেখানে মহিলারা প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। এদিকে সেনাবাহিনীর ভিতরে লিঙ্গবৈষম্য দূর করার জন্য ভারত সরকার কতদূর কী করেছেন তা জানা যায় না। ২০২০ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও বিভিন্ন মহিলারা তাঁদের বিরুদ্ধে লিঙ্গবৈষম্যের অভিযোগ জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।

তাঁদের অভিযোগ নানাবিধ। একে তো পদোন্নতি ঠিকমত দেওয়া হয় না। তার উপর যেখানে পোস্টিং দেওয়া হয় সেখানে মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচাগার থাকে না। পুরুষরা মহিলা সহকর্মীদের সামনে নারীদেহ নিয়ে খোলামেলা হাসি ঠাট্টা করেন ইত্যাদি। অর্থাৎ দেশরক্ষার দায়িত্ব যাঁদের ওপর দেওয়া হয়েছে, তাঁরাই সুরক্ষিত বোধ করেন না। সেনাবাহিনীর মহিলাদেরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে দেশের সাধারণ মহিলাদের দুরবস্থা বোঝা কঠিন নয়।

কিছু কিছু সংবাদপত্র মনে করছে, প্রজাতন্ত্র দিবসের এই কুচকাওয়াজ ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে মহিলাদের ভোট পেতে সাহায্য করবে। কিন্তু এই দেখনদারী কি মহিলাদের মন ভোলাতে পারবে? তাঁরা কি ভুলে যাবেন, যে বিজেপি সরকারের আমলে কিছু অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন? ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে মিছিল বের করা বা ধর্ষকের গলায় মালা পরিয়ে বরণ করার মত ঘটনার কথা কি তাঁরা ভুলতে পারবেন? মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে বিজেপির টালবাহানাও বুঝিয়ে দেয় নারীর ক্ষমতায়নকে তারা কতটা গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কুচকাওয়াজে শুধুমাত্র মহিলা সৈনিকদের রেখে নারীর ক্ষমতায়নের যে ছলনা করা হবে তা ভারতবর্ষের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা মাত্র। প্রজাতন্ত্র দিবসে সরকারের এই ছলনা লিঙ্গসাম্যকে আরও দূরে সরিয়ে দেবে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.