রাজদীপ বিশ্বাস

আমাদের গ্রামবাংলার এই প্রাচীন প্রবাদটি দিব্যি খেটে যায় “কিউবার মানুষের” জন্য স্যাম খুড়োর বিস্তর চিন্তা প্রসঙ্গে। হ্যাঁ, কিউবার মানুষের জন্য দুর্ভাবনায় সম্প্রতি ভীষণ কাতর হয়ে পড়েছেন শ্বেত বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা। নিন্দুকে অবশ্য বলে দুর্ভাবনার কারণটি আসলে ভিন্ন। সম্প্রতি রাষ্ট্রসঙ্ঘে কিউবার উপর দীর্ঘ ষাট বছর চাপানো মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারের পক্ষে ১৮৪ টি দেশ ভোট দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রটির উপর অন্যায় মার্কিনী অবরোধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমতও গড়ে উঠেছে শেষ কয়েক বছরে। তারপরই কিউবার “মানুষের জন্য” চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছেন শ্বেত বাড়ির কর্তারা।

অবশ্য কিউবার জন্য শ্বেত বাড়ির নিদারুণ ভাবনা নতুন কিছু নয়। ১৮২৩ সালে তৎকালীন মার্কিন স্বরাষ্ট্রসচিব জন অ্যাডমস কিউবা প্রসঙ্গে তাঁর “কনসার্ন” জাহির করেছিলেন “পাকা ফল” উপমা দিয়ে। বলেছিলেন কিউবা গাছের ডালের পাকা ফলটি। নাগালের মধ্যেই আছে। কেবল পেড়ে নেওয়ার অপেক্ষা! তা ফলটিকে পেড়ে তাঁরা নিয়েছিলেন ঠিকই, তবে গোলমালটা বাধাল এক দাড়িয়াল যুবক। ফিদেল কাস্ত্রো। এই যুবকটি এবং তার দলবল স্যাম খুড়োর হাত থেকে পাকা ফলটির বীজ নিয়ে প্রোথিত করলেন উর্বর মাটিতে। পাকা ফলটি পরিণত হল ঋজু কাণ্ড উন্নতশির মহীরুহে। স্যাম খুড়োর পক্ষে একাধারে অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং মানসম্মান হারানো মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাছাড়া যুবকটি ততদিনে নিজেদের মার্কসবাদী ঘোষণা করেছে। কমিউনিস্ট নিধনের মহা কর্তব্যও তো স্যাম খুড়ো এড়াতে পারেন না। অতএব “কিউবার মানুষের জন্য” আবার নতুন করে চিন্তা শুরু হল শ্বেত বাড়িতে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এখন, প্রতিষ্ঠিত বামপন্থী সরকারওয়ালা দেশগুলোর বিষয়ে স্যাম কাকার ভাবনাচিন্তার বেশ সুন্দর একটি সাধারণ নকশা রয়েছে। কীরকম? প্রথমে স্যাম কাকা চেষ্টা করে সরাসরি সেনা পাঠিয়ে দেশটির বিপ্লবী সরকারকে উচ্ছেদ করার, থুড়ি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার। এতে সফল না হলে স্যাম কাকা বিপ্লবী দেশটির উপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেয়। স্যাম কাকার পশ্চিমি বন্ধুরাও ওই মহতী অবরোধ যজ্ঞে শামিল হয়ে যান। অতঃপর বেয়াড়া বিপ্লবী দেশটিকে বাধ্য করা হয় অনাহার, অর্ধাহার অথবা তার বিপ্লবী সরকারকে ফেলে দেওয়া — এই দুটোর মধ্যে কোনও একটা বিকল্প বেছে নিতে। বিপ্লবী দেশটির অভ্যন্তরস্থ স্যাম কাকার গুপ্ত বন্ধু এবং প্রতিবিপ্লবীরা অর্থনৈতিক সংকটে থাকা জনতাকে বুদ্ধি দেন দ্বিতীয় বিকল্পটি গ্রহণ করতে। সুপরিকল্পিত ভাবে তৈরী গণরোষ তারপর ঘুরে যায় বিপ্লবী সরকারের দিকে। হয় সেনাবাহিনী নয় প্রতিক্রিয়াশীল মিলিশিয়া অভ্যুত্থান অথবা ভোটের প্রহসনে ফেলে দেওয়া হয় বিপ্লবী সরকারটিকে। ব্যাস, মিশন কমপ্লিট! সেই দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় সুমহান মার্কিনী গণতন্ত্র!

সাতের দশকের চিলি বা আটের দশকের নিকারাগুয়ার বিপ্লবী সরকারের পতন ঠিক এই মার্কিন নীতিরই নমুনা। আপাতত একই নীতি আমেরিকা নিয়েছে কিউবা প্রসঙ্গে। দীর্ঘ ষাট বছর ধরে চলতে থাকা মার্কিন পশ্চিমি শিবিরের অর্থনৈতিক অবরোধ মোকাবিলা করেও ঋজু, উন্নতশির কিউবায় অতিমারীর আবহে সম্প্রতি দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টিতে যাদের ভূমিকা প্রধান, সেই আমেরিকাই এখন কিউবার অর্থনৈতিক সংকট মুক্তির জন্য প্রতিবিপ্লবীদের মাধ্যমে কিউবানদের পরামর্শ দিচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির সরকারকে ফেলে দিতে। ফলত বিগত কয়েক দিন ধরেই কিউবায় শুরু হয়েছিল প্রতিবিপ্লবী বিশৃঙ্খলা। মার্কিন এবং পশ্চিমি মিডিয়া অবশ্য এই প্রতিবিপ্লবী বিশৃঙ্খলার নাম দিয়েছে “গণতন্ত্রের লড়াই”!

কিন্তু কিউবানরা মহা সেয়ানা। বে অফ পিগসের অভিজ্ঞতা তাদের আগেই ছিল। ফলে বিশেষ না ঘাবড়ে কিউবার সরকার নাগরিকদের ডাক দিল বিপ্লবকে রক্ষা করতে রাস্তায় নামার। মার্কিন মদতপুষ্ট প্রতিবিপ্লবী প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে তাঁরা আওয়াজ তুললেন ‘ভিভা ফিদেল’! কর্পোরেট মিডিয়ার দাবি ছিল খাবারের ঘাটতি এবং কোভিড মোকাবিলায় ব্যর্থতার কারণেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের এই বিক্ষোভ। কিউবার রাষ্ট্রপতি দিয়াজ ক্যানেল বললেন “ওরা (পশ্চিম) যদি কিউবার জন্য কিছু করতে চায়, ওরা যদি সত্যিই আমাদের জনগণের জন্য উদ্বিগ্ন হয়, ওরা যদি কিউবার সমস্যার সমাধান করতে চায়, তাহলে আগে ওরা অবরোধ প্রত্যাহার করুক, তারপর আমরা দেখব।“ সেইসঙ্গে দিয়াজ ক্যানেলের আহ্বান “আমাদের দেশের সমস্ত বিপ্লবী, সমস্ত কমিউনিস্টদের আমরা রাস্তায় নামতে বলছি। বিশেষ করে যেখানে যেখানে প্ররোচনা ছড়ানো হয়েছে, সেখানে সবাইকে রাস্তায় থাকতে বলছি।”

ফলাফল মিলেছে হাতে গরম। মাত্র ৯৬ ঘন্টার ভিতরেই বিপ্লব সমর্থক কিউবানদের জমায়েতে রাজপথ ছেড়ে পুনরায় কন্দরে লুকিয়েছেন আমেরিকাকে কিউবায় “গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা” করতে আসার আহ্বান জানানো “আন্দোলনকারীরা”। নিন্দুকে বলে এই আন্দোলনকারীরা নাকি মোটামুটি তিন বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন স্যাম কাকার কাছ থেকে, ঘুরপথে। ব্যাপারখানা সত্যি হলে বলতেই হয় স্যাম কাকার তিন বিলিয়ন ডলার নিতান্ত জলেই গেল!

তথাকথিত ওই আন্দোলন আপাতত মিটে গিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু একটি ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রের ওপর একটি দামড়া সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের অনৈতিক অবরোধ আরও কতকাল চলবে সে প্রশ্ন কিন্তু এত সহজে মিটবে না। খুবই সম্ভব স্যাম কাকার উপর অবরোধ তোলার চাপ আরও বাড়বে। দীর্ঘ ষাট বছরের অবরোধ সয়েও যে দ্বীপরাষ্ট্রটি আজ ক্ষুধামুক্তির নিরিখে বিশ্বে প্রথম সারিতে, বিনামূল্যে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার নিরিখে আমেরিকার চেয়েও এগিয়ে (প্রতি ১০০০ জনে কিউবায় ডাক্তারের সংখ্যা ৮.৪২২, প্রতি ১০০০ জনে আমেরিকায় ডাক্তারের সংখ্যা ২.৬১২; প্রতি ১০০০ জনে কিউবায় হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৫.৩৩, প্রতি ১০০০ জনে আমেরিকায় হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ২.৮৭), সেই দেশটির উপর স্রেফ ভিন্ন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাজনিত অসূয়া থেকে চাপানো নীতি বিগর্হিত অবরোধ পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বেশিদিন আর মেনে নেবেন বলে মনে হয় না।

লেখক বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী

কিউবা – বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব: ছবি ইন্টারনেট ওর উইকিপেডিয়া থেকে।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.